ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন ও এর শিক্ষা সংকলন

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জীবন সম্পর্কে যাঁরা পরিচিত তাঁরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করেন যে, ইসলামের প্রতি খেদমত তাঁর জীবনের প্রাথমিক কালেই শুরু হয়ে যায়। বাল্যকালেই তিনি ইসলামি কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর পিতা আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর খেলাফতকালে তিনটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইমাম হাসান (আ.)-এর নেতৃত্বকালে তিনি সর্বাবস্থায় তাঁকে মান্য করেন ও তাঁর অনুসরণ করেন। ইমাম হাসানের শাহাদাতের পর ইমাম হোসাইনের ভূমিকা একটি নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়। যেহেতু আহলে বাইতের ইমামগণের ভূমিকা তাঁদের সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করত সেভাবে ইমাম হোসাইনও তাঁর সময়ের পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামি আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন করেন।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ পরিমাণ সামরিক শক্তি ছিল না যার মাধ্যমে তিনি যুদ্ধ করে জয় লাভ করতে পারতেন, এমনকি তিনি তাদের ওপরও আস্থাশীল ছিলেন না যারা কুফা থেকে চিঠি লিখে তাঁকে সেখানে গিয়ে তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। উপরন্তু তিনি তাদের চিঠি প্রাপ্তি ও তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদল তাঁর নিকট আসার পূর্বেই তাঁর আন্দোলনের ঘোষণা দেন। তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে রক্তপাত ঘটানোকে পরিহার করার জন্য মক্কা ত্যাগ করেন। তিনি জানতেন যে, তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, তারপরও তিনি সেদিকেই অগ্রসর হন।
এখানে যে প্রশ্নটি এসে যায় তা হলো, এত প্রতিকূলতার মাঝেও কেন তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন এবং তাঁর আন্দোলনের ঘোষণা দেন? এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য নিচের বাস্তবতাগুলোর ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন হতে হবেÑ
প্রথমত, ইয়াযীদ মুসলিম উম্মাহর জন্য একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি ছিল। ইতিহাসবিদদের অভিমত অনুযায়ী বলা যায়, সে ইসলামের কোন শিক্ষাই তার মধ্যে ছিল না। সে মদপান করত, জুয়া খেলত এবং সকল ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হত। ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে সংকলিত ইসলাম, ওহী, মহানবী (সা.) সম্পর্কে ইয়াযীদের বিভিন্ন মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তার কাছে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ছিল ক্ষমতা দখলের অজুহাত; প্রকৃতপক্ষে মহানবী (সা.)-এর কাছে কোন ওহী আসে নি। মুসলিম উম্মাহর পরিচালনার বিষয়ে এমন ধরনের লোকের ওপর কিভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা সম্ভব? অন্যদিকে সত্যপন্থীদের জন্য এমন ধরনের ভ্রষ্ট নেতার বিপক্ষে ইমাম হোসাইনকে নেতা হিসেবে গ্রহণ ও তাঁর আনুগত্য করা ছিল একটি যৌক্তিক বিষয়।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও দেখা যায় তৎকালীন মুসলিম সমাজের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বগণও ইমাম হোসাইনকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা বিরত থাকল। উপরন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানালে তারা উল্টো তাঁকে ইয়াযীদের বিপক্ষে না দাঁড়ানোর জন্য পরামর্শ দিল, যদিও তাদের কাছে বনু উমাইয়্যার দুর্নীতি ও ইসলামবিরোধী কর্মকা- প্রমাণিত ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে উমর এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরও ইমাম হোসাইনকে তাঁর জাগরণী কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। এসব কর্মকা- মুসলিম উম্মাহর মধ্যে জিহাদী চেতনার অনুপস্থিতিকে তুলে ধরে।
এভাবে একটি নেতিবাচক চেতনা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইবনে যিয়াদের ভীতি প্রদর্শনের মুখে কুফার জনগণ তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, শুধু তা-ই নয় ইবনে যিয়াদের প্রদত্ত পদ ও ধন-সম্পদের প্রতিশ্রুতির প্রতি তারা আস্থা স্থাপন করে সত্যপথে লড়াই করা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়। ইমাম হোসাইন (আ.) জনসাধারণের মৃত চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে কিয়াম করেন।
দ্বিতীয়ত, তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান বিচ্যুতিকে দূর করার ব্যাপারে সার্বিকভাবে উম্মাহর অবস্থান ছিল খুবই নি¤œ পর্যায়ে। সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করার পরিবর্তে পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রবণতা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এই বিষয়টি সুযোগসন্ধানীদেরকে শাসনক্ষমতা দখল এবং মানুষকে তাদের ইচ্ছামতো পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সক্ষম করে তোলে। ইমাম হোসাইনের সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল সকল যুগের মানুষের চেতনাকে ক্ষণস্থায়ী বস্তুবাদী আকাক্সক্ষার বিপরীতে জাগ্রত করা। এটাই ইমাম হোসাইন বলেছেন : ‘আমি সৎকর্মের আদেশ করতে ও অসৎকর্মে নিষেধ করতে চাই।’
তৃতীয়ত, সময়ের বাস্তবতায় এটি জরুরি হয়ে পড়েছিল যে, মুসলিম উম্মাহ ইমাম, ইমামত, ইমামের সত্যিকার ভূমিকা ও অন্যান্য দিক সম্পর্কিত প্রকৃত ধারণার বিষয়ে অবহিত হবে। কারণ, ইসলামি আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও হুকুম-আহকামের অবমূল্যায়নের মতো বিপজ্জনক বিষয়গুলো কখনই তৃণমূল স্তর থেকে উত্থিত হয় নি; বরং তা উমাইয়্যা শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হয়েছিল যারা সকল কিছুকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। সুতরাং ইসলামের নির্দেশনা এবং একজন মুসলমান শাসকের যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন, ইমাম হোসাইনকে মুসলিম উম্মাহর সামনে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ইমাম হোসাইন (আ.) যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই তিনি জনসাধারণের সামনে প্রদত্ত প্রতিটি বক্তৃতায় তা ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন, তিনি বলেছেন : ‘হে জনগণ! তোমরা ধর্মপরায়ণ মুমিন হও; তোমাদেরকে সত্য ও সঠিক বিষয়সমূহ জানতে হবে। এটিই তোমাদের জন্য অধিকতর উত্তম। আর আমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরিবারবর্গ সেসব অত্যাচারী ও নির্যাতনকারীর চেয়ে শাসক হওয়ার জন্য অধিকতর দাবিদার, যারা যা তাদের নয় সে বিষয়টি দাবি করে।’
এমন অকাট্য বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (আ.) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, ইসলামের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত উমাইয়্যা গোষ্ঠী মুসলিম উম্মাহর শাসক হওয়ার যোগ্য নয়। আর তিনি একই সাথে এটাও ব্যক্ত করেন যে, ইসলামে শাসক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যাবলি তিনিই ধারণ করেন এবং তিনিই এ পদের অধিকারী। আর তাই নেতৃত্ব বা ইমামতের বিষয়ে ইসলামের ধারণা কী এবং বনু উমাইয়্যার শাসক হওয়ার দাবি যে মিথ্যা এটি প্রকাশ করে দেয়াও ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল বলা যায়।
চতুর্থত, ইসলামি সমাজে একজন মানুষ কোন বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা নয়, বরং সে তার সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং ইসলামের বিধি অনুসারে তাকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু ইসলামি শরীয়তের অন্যতম বিধান ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ’ এর দায়িত্ব পালনের অর্থ হলো তাকে বিপ্লবের পথ অনুসরণ করতে হবে, কারণ, এটিই একমাত্র পথ ছিল যার মাধ্যমে ইমাম হোসাইন তাঁর নানার উম্মতের সংস্কার সাধন করতে পারতেন।
পঞ্চমত, অত্যাচার ও নির্যাতনের মোকাবেলায় এবং সত্য, ন্যায় এবং চিন্তা, কথা ও কর্মের স্বাধীনতার মানবিক মূল্যবোধকে উচ্চে তুলে ধরতে ইমাম হোসাইন (আ.), তাঁর পরিবার এবং বন্ধুরা তাঁদের জীবন, ধন-সম্পদ ও সম্মান অর্থাৎ যা কিছু তাঁদের ছিল সকল কিছুকে উৎসর্গ করেছিলেন।
এই কারণগুলোকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে যে আন্দোলন ইসলামকে অমর করেছে এবং অনাগত প্রজন্মকে ইসলামের প্রতিরক্ষায় জিহাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করেছে।
ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের শিক্ষা
ইমাম হোসাইন (আ.) ছয় মাসেরও অধিককাল ধরে একটি আন্দোলন পরিচালনা করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। কিন্তু এই মহান আন্দোলনে ইমাম হোসাইনের প্রতিটি পদক্ষেপ, জনসাধারণের উদ্দেশে দেয়া তাঁর প্রতিটি বাণী এবং তাঁর শাহাদাত ও শাহাদাত-পরবর্তী প্রতিটি ঘটনা থেকে মানুষ কিয়ামত অবধি পাঠ লাভ করতে থাকবে। আমরা এখানে তন্মধ্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি মাত্রÑ
প্রথমত, ইসলাম আপোসকামী ধর্ম নয়। ইসলাম অনুসারে অত্যাচারী শাসকের অধীনে কেবল নিজে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা অন্যায়। যদি ইমাম হোসাইন (আ.) অত্যাচারী শাসকের আনুগত্য স্বীকার করে নিতেন তাহলে হয়তো তিনি নিজেকে নিহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারতেন এবং খলিফা কর্তৃক কোন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন যে খলিফা তাকে নামায পড়া, রোযা রাখা এবং অন্যান্য বিধান পালন করার সুযোগ দিত। কিন্তু তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাতি যে রাসূল ঘোষণা করেছেন : ‘অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং সত্য কথা বলা বড় জিহাদগুলোর অন্যতম।’ আর ইমাম হোসাইনও কারবালার পথে তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে, অত্যাচারী শাসকের সাথে জীবন যাপন করা অসম্মানের।
ইমাম হোসাইন (আ.) পবিত্র কোরআনকে বুকে ধারণ করতেন এবং জানতেন যে, মহান আল্লাহর পথে জিহাদের পরম পুরস্কার রয়েছে। যেমন কোরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে : যারা ঈমান এনেছে, দেশ ত্যাগ করেছে এবং আল্লাহর রাহে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে, তাদের বড় মর্যাদা রয়েছে আল্লাহর কাছে। আর তারাই সফলকাম।Ñ সূরা তাওবা : ২০,
অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘যারা আমার পথে জিহাদ (সাধনায় আত্মনিয়োগ) করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।’Ñ সূরা আনকাবুত ৬৯
দ্বিতীয় শিক্ষা হলো জীবনের মালিকানা এবং মালিকের কারণে জীবন বিলিয়ে দেয়ার ধারণা। আমাদের দেহ ও জীবনের মালিক হলেন আল্লাহ তাআলা। আর এজন্যই এ জীবন তাঁর কারণেই ও তাঁর পথেই সঠিকভাবে ব্যয়িত হওয়া উচিত। যদি আমরা তা করি, তাহলে এটি হবে আমাদের জীবনকে এর প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার মহা পুরস্কার রয়েছে। একজন শহীদ বেহেশতে নবী-রাসূলগণের পাশে অবস্থান করবেন।
পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে : ‘যদি তোমরা আল্লাহর পথে নিহত হও অথবা (স্বাভাবিক) মৃত্যুবরণ কর তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা যা তোমরা সঞ্চয় কর (ধনদৌলত) তা থেকে উত্তম। এবং যদি তোমরা (স্বাভাবিক) মৃত্যুবরণ কর বা নিহত হও, (পরিশেষে) অবশ্যই আল্লাহরই দিকে সমবেত হবে।’- সূরা আলে ইমরান : ১৫৭-১৫৮
তৃতীয় শিক্ষা হলো যখন আমরা পরীক্ষার সম্মুখীন হব তখন সেই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। এটি বেহেশতে প্রবেশের অন্যতম শর্ত। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে : ‘তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম কর নি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের ওপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনি ভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য! তোমরা শুনে নাও, আল্লাহর সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী।’Ñ সূরা বাকারা : ২১৪
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে : ‘আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে, অতঃপর মারে ও মরে। তওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের ওপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হল মহান সাফল্য।’Ñসূরা তওবা : ১১১
চতুর্থ যে শিক্ষা আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন থেকে পাই তা হলো আত্মত্যাগের শিক্ষা। আল্লাহর কারণে জীবন দেয়া হলো চূড়ান্ত আত্মত্যাগ। কিন্তু নিজেকে প্রাধান্য না দিয়ে অপরকে প্রাধান্য দেয়া ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও আত্মত্যাগের বিষয় রয়েছে। আমরা কি আমাদের সম্পদ-সম্পত্তি যেগুলোকে আমরা খুব ভালোবাসি তা দরিদ্রদের জন্য বিলিয়ে দিতে পারি? আমরা কি আমাদের মূল্যবান সময়গুলোকে আমাদের সন্তানদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দানের ক্ষেত্রে ব্যয় করতে প্রস্তুত? আমরা কি আমাদের বংশ, রক্ত, ভাষা, জাতীয়তা ও বর্ণের মিথ্যা অহমিকা পরিত্যাগ করতে পারি এবং অন্যান্য মুসলমানকে আমাদের ভাই বা বোন হিসেবে মেনে নিতে পারি? জীবন দানের মতো চূড়ান্ত ত্যাগের শিক্ষা আমাদেরকে এই সকল ত্যাগের শিক্ষার দিকে পরিচালিত করে।
শোক পালন
আমাদের কাছে এটি স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন যে, কেন আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান ও ক্রন্দন করি। যদি আমরা ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের জন্য ক্রন্দন করি তাহলে কোরআন মজীদ আমাদের বলছে যে, শহীদরা মৃত ননÑ ‘আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বোঝ না।’Ñসূরা বাকারা : ১৫৪
আমরা কি তাঁর পরাজয়ের জন্য ক্রন্দন করি? নিশ্চয়ই নয়; বরং যদি ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতেন এবং তার আনুগত্য মেনে নিতেন তাহলে তিনি পরাজিত হতেন, কিন্তু তা করেন নি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর আত্মত্যাগ ইসলামি সমাজের জন্য রাজতন্ত্র ও রাজা-বাদশাহর শাসনব্যবস্থাকে একটি কাঠামো হিসেবে গড়ে ওঠাকে প্রতিরোধ করে। এটি ইয়াযীদের মতাদর্শের মৃত্যু। যেমনটি কবি বলেছেন, নিশ্চয়ই হোসাইনের হত্যাকা-ে ইয়াযীদের মৃত্যু নিহিত। প্রতিটি কারবালাই ইসলামকে জীবিত করে।
প্রকৃতপক্ষে শোক পালনের মাধ্যম আমরা আহলে বাইত ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি। একই সাথে যারা আহলে বাইতের শত্রু তাদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ ও তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করি। এই অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আমরা তাঁদের আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজকে সুন্দর করতে এবং এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মের মধ্যে প্রকৃত ইসলাম, কোরআন, মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের আদর্শ স্থানান্তর করতে চাই।
উপসংহার
ইসলামি নববর্ষ যেভাবে উদ্যাপন করা হয় সম্ভবত অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠী তাদের নববর্ষকে সেভাবে উদ্যাপন করে না। অধিকাংশ সভ্যতাই এ দিনটিকে আনন্দ ও খুশির দিন হিসেবে গ্রহণ করে এবং উদ্যাপন করে। কিন্তু ইসলামে, বিশেষ করে আহলে বাইতের অনুসারীদের জন্য নতুন বর্ষটি শুরু হয় দুঃখ-বেদনা এবং দুর্নীতি, শয়তান ও পাপের মূলোৎপাটনের আহ্বানের মাধ্যমে। এই সময়টিতে আমরা কেবল বাহ্যিক অত্যাচারীকে মূলোৎপাটনের আহ্বান জানাই না; বরং আমরা আমাদের অভ্যন্তরস্থ অবাধ্য সত্তাকেও মূলোৎপাটনের আহ্বান জানাই। এই বিশ্বাসের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা আমরা দেখতে পাই মহানবী (সা.)-এর একটি দোয়ার মধ্যে যা তিনি মুহররমের নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার সময় করতেন : ‘হে আল্লাহ! আপনি অনাদি প্রভু এবং এটি একটি নতুন বছর, অতঃপর এতে (এ বছরে) আমি আপনার কাছে শয়তানের কাছ থেকে আশ্রয় চাই এবং মন্দের দিকে ধাবিত করে এমন নিচু নাফ্সের বিরুদ্ধে শক্তি কামনা করি এবং আপনি আমাকে সেই কাজে ব্যস্ত রাখুন যা আপনার নৈকট্য আনয়ন করে, হে মহান… হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে পথপ্রদর্শন ও গ্রহণ করার পর আপনি আমাদের অন্তরকে বিভ্রান্ত করেন না, আপনার পক্ষ হতেই ক্ষমা। নিশ্চয়ই আপনি গ্রহণকারী।’
আমাদের এটি মনে রাখতে হবে যে, মুহররম কেবল দশদিনের জন্য আর এরপর সবকিছু আগের মতো হয়ে যাওয়া নয়। যখন অধিক ইবাদত-বন্দেগিতে সময় ব্যয় করার জন্য আমাদের সামনে রমযান ও মুহররম মাসের মতো মাস আসে তখন আমাদের উচিত এই মাসগুলো থেকে কতটুকু লাভবান হলাম তা মূল্যায়ন করা। শুধু ত-ই নয়, আমাদেরকে এটাও মূল্যায়ন করতে হবে যে, এই মাসগুলোর পরে আমরা কি সেই মাসগুলোর প্রাপ্তিকে ধরে রাখতে সক্ষম হই কিনা। আর কীভাবেই বা আমরা পরবর্তী মাসগুলোতে সর্বোচ্চ লাভবান হতে পারি। অনেক মানুষই এই সময়ে তার ইবাদত-বন্দেগি ও অন্যান্য কর্মকা- নিয়ে সন্তুষ্ট হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে কী হবে সে সম্পর্কে তেমন চিন্তা-ভাবনা করে না। শয়তান চেষ্টা করে প্রথম সুযোগেই মুমিনরা এই মাসগুলোতে যা অর্জন করে তা ছিনিয়ে নেয়ার। এই বিষয়ে সচেতন হয়ে কর্মে নিয়োজিত হলেই কেবল আমাদের পক্ষে পার্থিব ও পরকালীন কল্যাণ লাভ করা সম্ভব।

– মো. আশিফুর রহমান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.