চির-ভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব

চির-ভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব – (এক)

চির-ভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব - (এক)

মহররমের চাঁদ এলো ওই কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়

ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায়….
কারবালার মহাবিপ্লব ইসলামী পুনর্জাগরণ ও মৃতপ্রায় ইসলামের প্রাণ-সঞ্জীবনের এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে চির-ভাস্বর হয়ে আছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র প্রচারিত মহান ইসলাম ধর্ম এবং উদীয়মান ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য শয়তানের দোসর আর শত্রুদের প্রচেষ্টার কখনও কোনো কমতি ছিল না। শত্রুরা যখন প্রকাশ্যে ইসলামকে মোকাবেলা করার সর্বাত্মক চেষ্টায় ব্যর্থ হল তখন তারা বাহ্যিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ও মুসলমান সেজেই ভেতর থেকে এই মহান ধর্মের ওপর আঘাত হানতে সচেষ্ট হল যাতে এই ধর্মের মূল শিক্ষা, চেতনা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বিকৃত এবং বিলুপ্ত হয়। বৃহত্তর মুসলিম সমাজের নানা উদাসীনতা ও কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের চক্রান্তের পরিণতিতে ইসলামের এক সময়কার চরম শত্রু উমাইয়ারা মুসলমানদের নেতৃত্বের পদ দখল করে। তারা পবিত্র ইসলামী সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয় রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র।
উমাইয়ারা ইসলামী নেতৃত্বের প্রকৃত হকদার এবং মুসলিম সমাজের সবচেয়ে যোগ্য, জ্ঞানী ও খোদাভীরু ব্যক্তিদের তথা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যুদ্ধ ও সংঘাতের পাশাপাশি রাজকীয় কোষাগারের সীমাহীন অপব্যবহারেও অভ্যস্ত ছিল। অর্থ-সম্পদ, ভোগ-বিলাস ও রাজকীয় পদমর্যাদার লালসায় নিমজ্জিত দরবারি আলেমরা বিশ্বনবীর পবিত্র আহলে বাইতকে বিদ্রোহী এবং পথভ্রষ্ট বলে ফতোয়া দিয়েছিল। এর পাশাপাশি তারা উমাইয়া নেতাদের ফজিলত ও মাহাত্ম্য তুলে ধরার জন্য রচনা করেছিল শত-সহস্র বা লক্ষাধিক জাল হাদিস।
সে সময়কার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার নানা চিত্র তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিকরা নানা বর্ণনায়। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন:
ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ্।..
তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে !
এসেছে সীমার, এসেছে কুফা’র বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা !
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ,
…কাঁদে আসমান জমিন, কাঁদিছে মহররমের চাঁদ।
একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা,
আর দিকে যত তখত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা।..
এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,
আলী’র সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান !
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসানে হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।.. …

উল্লেখ্য, উমাইয়া শাসকরা সিরিয়ার জনগণকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষী প্রচারণায় এতোটা প্রভাবিত ও মাতিয়ে রেখেছিল যে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ) যখন পবিত্র রমজান মাসে কুফার মসজিদে এক ধর্মান্ধ খারিজির সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ হন তখন সিরিয়ার অনেকেই বিস্মিত হয়ে বলেছিল: আলী কি মসজিদে যেতো ও নামাজ পড়তো!!? বলা হয় সিরিয়ার জনগণকে শৈশবেই আলী-বিদ্বেষী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শাসক-গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে শিশুদের জন্য ছাগল-ছানা উপহার হিসেবে পাঠানো হত। আর শিশুরা যখন ওই মেষ শাবক নিয়ে খেলাধুলায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কারণে এর গভীর অনুরাগী হয়ে উঠত তখন রাজ-দরবারের কর্মীরা এক রাতে ওই ছাগল-ছানা নিয়ে যেত। আর কে ওই ছাগল-ছানা নিয়ে গেছে শিশুরা তা জানতে চাইলে বলা হত আলী ওই ছাগল ছানা নিয়ে গেছে!! ফলে শৈশবেই সিরিয় শিশুদের কচি-মনে জন্ম নিত আলী (আ.) ও আহলেবাইতের প্রতি বিদ্বেষ।

 

৬০ হিজরিতে উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়। সে মদীনার গভর্নরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ নির্দেশ দেয় যে, হুসাইনের কাছ থেকে যে কোনো ভাবেই হোক আনুগত্য আদায়ের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করবে এবং আনুগত্য এড়ানোর কোনো সুযোগ বা সময় তাকে দেয়া যাবে না। এ নির্দেশ পেয়ে মদীনার গভর্নর ওলিদ বিন উৎবা কুখ্যাত উমাইয়া নেতা মারোয়ান বিন হাকামের পরামর্শ অনুযায়ী সে রাতেই একটি সভার আয়োজন করে ইমাম হুসাইন (আ)-কে সেই সভায় আসতে বলে যাতে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার আগেই ইমামকে ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে বাধ্য করা যায়। ইমাম হুসাইন (আ) নিরাপত্তার খাতিরে তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত ত্রিশ জনের সশস্ত্র এক গ্রুপকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে ওই সভায় যোগ দেন। ওলিদ মুয়াবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে ইমামকে আহ্বান জানান। ইমাম তাকে জানান যে:
‘হে ওলিদ! আমাদের বংশ হল নবুওত ও রেসালতের খনি এবং ফেরেশতাদের আসা-যাওয়ার স্থান ও খোদায়ী রহমতের স্থান। মহান আল্লাহ নবী-পরিবারের মাধ্যমে ইসলামকে উদ্বোধন করেছেন এবং এই বংশকে সঙ্গে নিয়েই ইসলামকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নেবেন। আর ইয়াজিদ যার আনুগত্য করতে তুমি আমায় বলছ সে হচ্ছে এমন এক মদখোর ও খুনি যার হাত নিরপরাধ মানুষের রক্তে রঞ্জিত। সে হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে আল্লাহর বিধি-বিধানের সীমানা লণ্ডভণ্ড করেছে এবং জনগণের সামনেই নানা অশ্লীল কাজ ও পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় অমন উজ্জ্বল রেকর্ড ও উন্নত পারিবারিক ঐতিহ্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আমার মত একজন ব্যক্তি কী এই পাপিষ্ঠের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে বা তার নেতৃত্ব মেনে নেবে? তোমার ও আমার উচিত এ বিষয়ে ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়া এবং তাহলে দেখতে পাবে যে খেলাফত বা মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আমাদের মধ্যে কে বেশি উপযুক্ত?’
এভাবে ইসলামের সেই চরম দুর্দিনে নানার ধর্ম ও সম্মান রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন তাঁরই সুযোগ্য নাতি হযরত ইমাম হুসাইন (অ)। মহানবী (সা) তাঁকে উম্মতের নাজাতের তরী ও হেদায়াতের প্রদীপ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এর অর্থ ইমাম হুসাইনের (আ) দেখানো পথ ও আদর্শ অনুসরণ ছাড়া মুসলমানরা তাদের ঈমান ও পবিত্র ধর্মকে রক্ষা করতে পারবে না। বিশ্বনবী (সা) গোটা আহলে বাইতকে (আ) নুহের নৌকার সঙ্গে তুলনা করলেও ইমাম হুসাইনের (অ) ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ওই বিশেষণ যুক্ত করেছেন যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একজন ডুবন্ত বা আহত ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য দ্রুত গতিশীল বাহন বা গাড়ি দরকার। অন্যদিকে সাধারণ রোগীকে ধীরে-সুস্থে বা কিছুটা পরেও সাধারণ কোনো গাড়িতে চড়িয়ে হাসপাতালে নেয়া যায়। কারবালার মহাবিপ্লবের আদর্শ ও ইমাম হুসাইনের (আ) ভূমিকা মৃতপ্রায় ইসলামকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত গতিশীল নৌকা বা বাহনের ভূমিকাই পালন করেছিল। #

 

চিরভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব- (দুই)

 

চিরভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব- (দুই)

কুল মাখলুক কাঁদিয়ে ওই এলো মহররম

হায় হোসেন! হায় হোসেন! উঠলো রে মাতম

হায় হোসেন! হায় হোসেন! উঠলো রে মাতম

সারা জাহান কেঁদে বিভোর আসমান-জমিন

দজলা কাঁদে ফোরাত কাঁদে কাঁদে মুসলিমিন….

কাতরা পানি পায়নি  হায়রে পিয়াসে কাতর

তির খেয়ে যে মরলো কচি শিশু সে আসগর

(কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গান)

 

হযরত ইমাম হুসাইন (আ)’র কালজয়ী মহাবিপ্লব নানা কারণে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে এবং এইসব কারণে এই মহাপুরুষ ও তাঁর সঙ্গীরা মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে ভালবাসা আর শ্রদ্ধার অক্ষয় আসন করে নিয়েছেন।  এই কারণগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আন্তরিক চিত্তে যথাসময়ে জরুরিতম দায়িত্বটি পালন করা ও এ জন্য নিজের সন্তান ও জীবনসহ সব কিছু বিলিয়ে দেয়ার মত সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার। তাই মহান আল্লাহ তাঁর একনিষ্ঠ এই খোদাপ্রেমিক ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য বিশ্বের সব যুগের মু’মিন মানুষের হৃদয়ে দান করেছেন অনন্য মমত্ববোধ আর শ্রদ্ধা। ইমামের অতুলনীয় বীরত্ব, সাহসিকতা ও আপোসহীনতাও এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

 

ইয়াজিদের মত বর্বর ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির শাসকের আনুগত্য অস্বীকার করার পরিণতি কি হতে পারে তা ভেবে যখন অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব আতঙ্কিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন এবং তারা যখন আপোষ বা নীরবতার পথ বেছে নিয়েছিলেন তখন ইমাম হুসাইন (আ) প্রকাশ্যেই এই চরম জালিম ও তাগুতি শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। একইসঙ্গে তিনি জনগণকে এই উমাইয়া শাসকের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হন। এ সময় ইমামের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক সাহাবি ও এমনকি তাঁর এক সৎ ভাইও বিপ্লবী তৎপরতা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন মুসলিম উম্মাহর এই অমর ত্রাণকর্তাকে। হযরত আলী (আ)’র অন্যতম পুত্র মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া কোনো নির্দিষ্ট শহরে বেশি দিন না থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে ইমামকে পরামর্শ দেন যাতে সংঘাত ও রক্তপাত এড়ানো যায় এবং জাতির সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তির প্রাণহানি না ঘটে।

 

জবাবে ইমাম হুসাইন (আ) বলেছিলেন, ‘ভাই আমার! তুমি ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ এড়ানোর জন্য আমাকে এক শহর থেকে আরেক শহরে সফরের পরামর্শ দিচ্ছ। কিন্তু তুমি এটা জেনে রাখ যে, সারা বিশ্বেও যদি কোনো আশ্রয়-স্থল না থাকে তাহলেও আমি মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত করব না।’

 

ভাইয়ের এ কথা শুনে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। আর ইমাম বলতে থাকলেন: ‘হে আমার ভাই! আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন। কারণ, তুমি ভাই হিসেবে ভাইয়ের মঙ্গল কামনার দায়িত্ব পালন করেছ। কিন্তু আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে তোমার চেয়ে বেশি অবহিত এবং আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।’

 

ইমাম হুসাইন (আ) সম্পর্কে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, হুসাইন আমার থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে। তিনি আরও বলেছেন, হুসাইন আমার সন্তান, আমার বংশ ও মানবজাতির মধ্যে তাঁর ভাই হাসানের পর শ্রেষ্ঠ। সে মুসলমানদের ইমাম, মুমিনদের অভিভাবক, জগতগুলোর রবের প্রতিনিধি বা খলিফা, … সে আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণ পুরো সৃষ্টির ওপর, সে বেহেশতের যুবকদের সর্দার, উম্মতের মুক্তির দরজা। তার আদেশ হল আমার আদেশ। তার আনুগত্য করা হল আমারই আনুগত্য করা। যে-ই তাকে অনুসরণ করে সে আমার সাথে যুক্ত হয় এবং যে তার তার অবাধ্য হয় সে আমার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। …. নিশ্চয়ই হুসাইন বিন আলীর মূল্য আকাশগুলো ও জমিনগুলোর চেয়ে বেশি এবং নিশ্চয়ই তাঁর বিষয়ে মহান আল্লাহর আরশের ডান দিকে লেখা আছে : হেতদায়াতের আলো, নাজাতের নৌকা, একজন ইমাম, দুর্বল নন, মর্যাদা ও গৌরবের উৎস, এক সুউচ্চ বাতিঘর এবং মহামূল্যবান সম্পদ। (মিজান আল হিকমাহ নামক হাদিস গ্রন্থ)

 

ইমাম হুসাইন (আ)’র জন্মের পর এই নবজাতক শিশু সম্পর্কে বিশ্বনবী বলেছিলেন, ‘হে ফাতিমা! তাকে নাও। নিশ্চয়ই সে একজন ইমাম ও ইমামের সন্তান। সে নয়জন ইমামের পিতা। তারই বংশে জন্ম নেবে নৈতিক গুণ-সম্পন্ন ইমামবৃন্দ। তাঁদের  নবম জন হবেন আল-কায়েম তথা মাহদি।’

 

উল্লেখ, অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে ইমাম হুসাইন (আ) সম্পর্কে মহানবীর (সা) এ কথার অর্থ কী  যে, সে আমার থেকে ও আমি তার থেকে? কারণ, ইমাম হুসাইন রাসুলের বংশধর হিসেবে তাঁর থেকে হলেও রাসূল আবার হুসাইন থেকে হবেন কেন?

এর উত্তরে বলা হয়, ইমাম হুসাইনের মহাবিপ্লবের কারণে ইসলাম বিকৃতি ও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। সেই অর্থেই মহানবী (সা) নিজেকে তাঁর নাতির থেকে বলে মন্তব্য করেছেন বলে মনে করা হয়।

 

ইমাম হুসাইনের জন্য শোক প্রকাশ প্রসঙ্গে বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, নিশ্চয়ই প্রত্যেক মু’মিনের হৃদয়ে হুসাইনের শাহাদতের ব্যাপারে এমন ভালবাসা আছে যে তার উত্তাপ কখনো প্রশমিত হবে না। তিনি আরও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সমস্ত চোখ কিয়ামতের দিন কাঁদতে থাকবে, কেবল সেই চোখ ছাড়া যা হুসাইনের বিয়োগান্ত ঘটনায় কাঁদবে, ঐ চোখ সেদিন হাসতে থাকবে এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ ও বিপুল নেয়ামত দান করা হবে।’

 

ইসলামের শত্রুরা মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতকে ও তাঁদের পবিত্র নামকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল চিরতরে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো।  কারণ, মহান আল্লাহ নিজেই তাঁর ধর্মের নুরকে রক্ষার অঙ্গীকার  করেছেন এবং এই আলোকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কাফির-মুশরিকদের কাছে তা যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।

 

ইমাম জাফর আস সাদিক (আ) বলেছেন, ‘আমাদের ওপর তথা মহানবীর আহলে বাইতের ওপর যে জুলুম করা হয়েছে তার কারণে যে শোকার্ত তার দীর্ঘশ্বাস হল তাসবিহ এবং আমাদের বিষয়ে তার দুশ্চিন্তা হল ইবাদত।… হাদিসটি বর্ণনা শেষে তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই এ হাদিসটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত।’ #

চিরভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব- (তিন)

কয়েক যুগ আগের কারবালা (ফাইল ছবি)
কয়েক যুগ আগের কারবালা (ফাইল ছবি)

বহিছে সাহারায় শোকর ‘লু’ হাওয়া

দোলে অসীম আকাশ আকুল রোদনে।

নুহের প্লাবন আসিল ফিরে যেন

ঘোর অশ্রু শ্রাবণ-ধারা ঝরে সঘনে।।

“হায় হোসেনা, হায় হাসেনা” বলি

কাঁদে গিরিদরী মরু বনস্থলী,

কাঁদে পশু ও পাখী তরুলতার সনে।।

ফকির বাদশাহ্ আমীর ওমরাহে কাঁদে

তেমনি আজো, তা’রি মর্সিয়া গাহে,

বিশ্ব যাবে মুছে; মুছিবে না আঁসু,

চিরকাল ঝরিবে কালের নয়নে।।

ফল্গুধারা-সম সেই কাঁদন-নদী/ সেই সে কারবালা সেই ফোরাত নদী

কুল-মুসলিম-চিতে বহে গো নিরবধি,

আসমান ও জমিন্ রহিবে যতদিন

সবে কাঁদিবে এমনি আকুল কাঁদনে।। (কাজী নজরুল ইসলাম, গুল্-বাগিচা)

 

ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়াকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর হযরত ইমাম হুসাইন (আ) পবিত্র মদীনা থেকে মক্কার দিকে রওনা হন। নবী-পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি এ সম্পর্কেও ব্যাখ্যা দেন যে কেনো ইয়াজিদের মত চরম পাপিষ্ঠ ও অনাচারী ব্যক্তিকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব নয়।  ইমাম যে ক্ষমতার লোভী ও নৈরাজ্যকামী নন তা তুলে ধরার জন্য একটি ওসিয়তনামাও লিখে যান। সেই ওসিয়ত-নামায় একত্ববাদ বা তাওহিদ, নবুওয়ত, পরকাল ও এই সফর সম্পর্কে নিজের চিন্তাধারা এবং বিশ্বাস তুলে ধরে ইমাম হুসাইন (আ) লিখেছিলেন: ‘আমি আত্মকেন্দ্রীকতা কিংবা আরাম-আয়েশের জন্য অথবা দুর্নীতি ও জুলুম করার জন্য মদীনা থেকে বের হয়ে যাচ্ছি না, বরং আমার এই সফরের উদ্দেশ্য হল সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজে নিষেধ করা; মুসলমানদের মধ্য থেকে দুর্নীতি বা অনাচার দূর করা এবং আমার নানার তথা মহানবীর সুন্নাত আর বিধি-বিধান ও আমার বাবা আলী ইবনে আবি তালিবের রসম-রেওয়াজকে পুনরুজ্জীবিত করা।’

 

সেই ঐতিহাসিক ওসিয়তনামায় কারবালা বিপ্লবের মহানায়ক ইমাম হুসাইন (আ) আরও লিখেছিলেন: ‘যারা আমার কাছ থেকে এই বাস্তবতাকে মেনে নেবেন তারা আল্লাহর পথের অনুসারী হবেন। আর কেউ প্রত্যাখ্যান করলেও আমি ধৈর্য ও প্রতিরোধের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাব যাতে মহান আল্লাহ আমাদের মধ্যে কে উত্তম তা নির্দেশ করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোচ্চ হাকিম বা বিচারক।’

 

এ ছাড়াও ইমাম হুসাইন (আ) ওই ওসিয়তনামায় ইয়াজিদ সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, অমানবিক ও ইসলাম-বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে তার ওই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করেছিলেন।

 

ইমাম হুসাইন (আ) একই প্রসঙ্গে আরও লিখেছিলেন:

‘যদি তারা আমার কাছে ইয়াজিদের জন্য আনুগত্যের শপথ আদায় করতে নাও আসে তবুও আমি শান্ত ও নীরব হব না। কারণ, সরকারের সঙ্গে আমার বিরোধ কেবল ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে সীমিত নয় যে এ বিষয়ে তারা নীরব হলেই আমিও নীরব হয়ে যাব। বরং ইয়াজিদের ও তার বংশের তথা উমাইয়াদের অস্তিত্বই নানা ধরনের জুলুম আর দুর্নীতি এবং ইসলামের মধ্যে বিকৃতি ঘটানোর মাধ্যম।  তাই এইসব অনাচার ও দুর্নীতি দূর করা, সৎ কাজের আদেশ  ও অসৎ কাজে বাধা দেয়া,  আমার নানা রাসুলে খোদার (সা) বিধি-বিধানসহ আমার বাবা আলী ইবনে আবি তালিবের রসম-রেওয়াজ পুনরুজ্জীবন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সব সংকট ও অসঙ্গতির মূল শেকড় বনি-উমাইয়াদের নির্মূল করার  জন্য সক্রিয় হওয়া আমার দায়িত্ব।’

 

ইমাম হুসাইন (আ)’র বক্তব্যগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি তার বিপ্লবী মিশনের সম্ভাব্য সফলতা বা ব্যর্থতার আলোকে বিপ্লবের  দায়িত্ব পালন করার প্রক্রিয়াকে শিথিল বা তীব্র করতে চাননি। বরং ইসলামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার মহান খোদায়ী দায়িত্ব পালনের জন্য নিজে অগ্রসর হওয়ার ও একই লক্ষ্যে জনগণকে জাগিয়ে তোলার পদক্ষেপ নেন।

 

অনেকেই এ প্রশ্ন করতে পারেন যে ইমাম হুসাইন (আ) যে বিপ্লব করতে চেয়েছেন তা তাঁর বড় ভাই বা পিতা কেন করেননি? আসলে ইমাম হুসাইন (আ)’র সময় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তার সঙ্গে অতীতের ও পরের পরিস্থিতিগুলোর কোনো মিল নেই। একই পরিস্থিতিতে বিশ্বনবী (সা)’র অন্য সদস্যরা বা আহলে বাইতের অন্য ইমামরাও একই কাজ করতেন।

 

যা-ই হোক  মদীনা ত্যাগের পর ইমাম হুসাইন (আ) মক্কায় আসেন এবং সেখানে চার মাস অবস্থান করেন। আরবের সর্বত্র এ খবর ছড়িয়ে পড়ে যে  মহানবীর (আ) নাতি ইমাম হুসাইন (আ) মক্কায় এসেছেন। হজ মওসুমের প্রাক্কালে মক্কায় মুসলমানদের সমাগম ক্রমেই বাড়ছিল।

 

জনগণ মুয়াবিয়ার শোষণ ও শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। মুয়াবিয়া তার ছেলে ইয়াজিদকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যবস্থা করে যায়। ইয়াজিদের মত লম্পট ও প্রকাশ্য অনাচারী মুসলিম জাহানের খলিফার পদে বসায় জনগণ আরও বেশি অসন্তুষ্ট হয়। এ অবস্থায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ)’র সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় করেন এবং তারা ইমামের প্রতি তাদের সমর্থন ও সহানুভূতির কথা ঘোষণা করেন।

 

ইরাক থেকে চিঠি-পত্রের ঢল নামে ইমাম হুসাইনের (আ) কাছে।

 

কুফার বহু নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং তাদের অনুসারী হাজার হাজার চিঠি পাঠান ইমাম হুসাইনের কাছে। ইমাম যেন তাদেরকে ইয়াজিদের জুলুম ও দুঃশাসন থেকে মুক্ত করে প্রকৃত ইসলামী শাসন কায়েম করেন সে জন্য আকুল আবেদন ছিল এইসব চিঠিতে। হজ মওসুমের প্রাক্কালে এ পরিস্থিতি ছিল ইয়াজিদের জন্য খুবই আতঙ্কজনক। ইমাম কুফার পরিস্থিতি যাচাইয়ের জন্য নিজের চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে পাঠালেন কুফায়। মুসলিম যাত্রা শুরু করেছিলেন পবিত্র রমজান মাসে। তিনি শাওয়ালের পঞ্চম দিনে পৌঁছে যান কুফায়। ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনা অনুযায়ী  তিনি অবস্থান করেছিলেন মুখতার ইবনে আবু উবায়দার বাড়িতে। আহলে বাইতের অনুসারীরা তাঁকে দেখতে আসেন। তিনি জনগণের এক সমাবেশে ইমাম হুসাইন (আ)’র চিঠি পড়ে শোনান। উপস্থিত জনগণ ইমামের বক্তব্য শুনে কাঁদতে থাকেন। আবিস ইবনে শাবিব শাকিরি এবং হাবিব ইবনে মাজাহের তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে ইমামের জন্য লড়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন।

 

কুফার ১৮ হাজার ব্যক্তি ইমাম হুসাইনের প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকিলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। মুসলিম এই পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে ইমামের কাছে চিঠি লেখেন। কিন্তু এই চিঠি লেখার ২৭ দিন পর মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় নির্মমভাবে শহীদ হতে হয়েছিল ইয়াজিদের অনুচরদের হাতে। কুফার জনগণ তাঁকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। ইরাক ও বিশেষ করে কুফা শহরে ছিল বিশ্বনবীর (সা) আহলে বাইতের সমর্থকদের প্রাধান্য। কিন্তু এইসব সমর্থকের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই ইসলামের জন্য বড় ধরনের ত্যাগ বা কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল। হযরত আলী (আ) ও ইমাম হাসান (আ) অনেকটা এই একই কারণে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিলেন। #

 

চিরভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব- (চার)

১৯২০ সালে কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ)'র পবিত্র মাজারের দৃশ্য
১৯২০ সালে কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ)’র পবিত্র মাজারের দৃশ্য

 

এল শোকের সেই মহররম কারবালার স্মৃতি লয়ে।

আজি বেতাব বিশ্ব-মুসলিম সেই শোকে রোয়ে রোয়ে।।

মনে পড়ে আসগরে আজ পিয়াসা দুধের বাচ্চায়

পানি চাহিয়া পেল শাহাদত হোসেনের বক্ষে রয়ে।।

এক হাতে বিবাহের কাঙন এক হাতে কাসেমের লাশ

বেহোশ খিমাতে সকিনা অসহ বেদনা সয়ে।।

ঝরিছে আঁখিতে খুন হায়  জয়নাল বেহুঁশ কেঁদে,

মানুষ বলে সহে এত পাথরও যেত ক্ষয়ে ।।

শূন্য পিঠে কাঁদে দুলদুল হযরত হোসেন শহীদ,

আসমানে শোকের বারেষ, ঝরে আজি খুন হয়ে ।।

(কাজী নজরুল ইসলাম)

 

গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি ইমাম হুসাইন (আ) ইয়াজিদকে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর জনগণ ও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এই মহান ইমামের প্রতি। ইমাম মদীনা ছেড়ে চলে আসেন মক্কায়। মক্কায় হজের মওসুমে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন ইমাম হুসাইন (আ)।  ইরাকের ও বিশেষ করে কুফার হাজার হাজার বিপ্লবী মুসলমান  বিপ্লব ও মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ইমামের কাছে চিঠি লেখেন।

 

কুফার জনগণ ইয়াজিদের প্রতি ইমাম হুসাইন (আ.)’র আনুগত্য প্রকাশ না করার কথা শুনে তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এই শহরের জনগণ প্রকৃত ইসলামী খেলাফতের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ও তাঁদেরকে মুক্ত করার জন্য ইমামের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে অন্তত ১৮ হাজার চিঠি পাঠিয়েছিল। প্রতিটি চিঠিতে অন্তত ১০০ জনের স্বাক্ষর ছিল।

 

কিন্তু কুফাবাসীরা প্রয়োজনের সময় ইমামের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

 

এমনকি কুফার প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য ইমাম হুসাইন (আ) যখন চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (রা)-কে কুফায় পাঠান তখন কুফাবাসী ইমামের এই দূতকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়। ইয়াজিদের মনোনীত গভর্নর ইবনে জিয়াদের ত্রাস-সঞ্চারী নানা পদক্ষেপের ফলে আকিল জন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং  তিনি একাকী  বীরের মত লড়াই করে নৃশংসভাবে শহীদ হন।  ।

 

কিন্তু আকিল (রা.)’র শাহাদতের পরও ইমাম হুসাইন (আ.) যদি দোদুল-মনা কুফাবাসীদের আহ্বানে সাড়া না দিতেন, তাহলে ইতিহাসে এই ইমামকে কাপুরুষ বলে উল্লেখ করা হত এবং বলা হত লাখো মানুষের মুক্তির আহ্বানকে উপেক্ষা করে ইমাম হুসাইন (আ.) নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন।

 

কুফার পথে যাওয়ার সময় আকিল (রা.)’র শাহাদতের খবর শুনে কেঁদে ফেলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। কিন্তু তবুও তিনি বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। এ সময় ইমাম আবৃত্তি করেছিলেন পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত যেখানে বলা হয়েছে: “মুমিনদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ (শাহাদতের জন্য) প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।”(সুরা আহজাব, ২৩)

 

 

ইমাম হুসাইন (আ) মক্কায় থাকতে চাইলে সেখানেও তিনি শান্তিতে থাকতে পারতেন না।  ইয়াজিদের গুপ্ত-ঘাতকরা হজযাত্রীর ছদ্মবেশে মক্কায় এসে ইমামকে হত্যার চেষ্টা করছিল। এখানে তিনি ইয়াজিদের গুপ্ত-ঘাতকের হাতে শহীদ হলে তাতে ইয়াজিদি শাসক-গোষ্ঠীর অপরাধ জনগণের কাছে অস্পষ্ট থাকত এবং গণ-জাগরণ গড়ে তোলা সম্ভব হত না। এ ছাড়াও ইমাম পবিত্র কাবাঘরের আশপাশসহ  ইসলামের ঘোষিত শান্তির শহর হিসেবে মক্কাকে সংঘাত ও রক্তপাত-মুক্ত রাখার জন্য এই শহর ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানতেন এবারের হজ তিনি করবেন পবিত্র কারবালায়। সেখানে তিনি কোনো পশু নয় বরং কুরবানি করবেন নিজেকে নিজের পরিবার ও নিবেদিত-প্রাণ একদল সঙ্গীকে।

 

ইমাম হুসাইন (আ) ইরাকের দিকে তাঁর সফরের কথা তুলে ধরেন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা শহীদ হবেন বলেও জানিয়ে দেন। ফলে তাঁর কাছে নানা দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে জড়- হওয়া হাজার হাজার সঙ্গীর বেশির ভাগই ইমামকে ত্যাগ করে। আল্লাহর পথে জীবন দিতে এগিয়ে আসার জন্য ইমামের আহ্বানে খুব কম মুসলমানই সাড়া দেয়। এমনকি গণ্যমান্য অনেক ব্যক্তি ইমামকে সফর বাতিল করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ইমাম জানান যে তিনি যেখানেই যান না কেন তাঁকে হত্যা করা হবেই।  ইমাম মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়ায় মনে মনে খুশি হন মক্কার  উচ্চাভিলাষী বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের। কারণ, তিনি মহানবীর আহলে বাইতকে হিংসা করতেন এবং জানতেন যে ইমাম হুসাইন যতদিন মক্কায় থাকবেন ততদিন জনগণ অন্য কোনো নেতাকে গুরুত্ব দেবে না।

 

কারবালা বিপ্লবের যুগে উমাইয়ারা ইসলামের শেষ প্রাণ-প্রদীপটুকুও নিভিয়ে ফেলার আয়োজন পাকাপোক্ত করেছিল। এর আগে নানা বিচ্যুতি ও অধঃপতন সত্ত্বেও ইসলামের বাহ্যিক কিছু বিধি-বিধান অন্তত প্রকাশ্যে মেনে চলত উমাইয়ারা। কিন্তু ইয়াজিদের মত প্রকাশ্য পাপাচারীকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলে প্রকৃত ইসলাম তখনই চিরতরে বিলুপ্ত বা কবরস্থ হত। আর উমাইয়ারা বলতো দেখুন মহানবীর নাতি তথা বেহেশতি যুবকদের সর্দার ইমাম হুসাইনই (আ) তো আমাদের সমাজ-ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন বা এই ব্যবস্থাকেও ইসলামী সমাজ বলে মেনে নিয়েছেন!

 

অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগে যে ৬১ হিজরির মধ্যেই মুসলমানদের এত দুর্দশা কেন ঘটেছিল? মুসলমানদের মধ্যে কি মুনাফিকদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ইমাম হুসাইন ছাড়া অন্য কেউ ইসলামকে চরম দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসার দরকার মনে করেননি?

 

আসলে দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে মহানবীর (সা) বংশধরদের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন গোত্র ও ব্যক্তিত্বের অভাব ছিল না। তাদের সহযোগিতা নিয়েই অধঃপতিত উমাইয়ারা মুসলমানদের ওপর ক্ষমতাসীন হয়ে বসে।

 

অন্যদিকে যুগে যুগে  নবী-রাসূলদের তিরোধানের পর খুব দ্রুত তাদের উম্মতের বিভ্রান্ত হওয়ার নজির দেখা যায়। মুসা (আ)’র জাতি ইহুদিরা এই মহান নবীর জীবদ্দশায় উনার মাত্র চল্লিশ দিনের অনুপস্থিতিতে তথা তুর পাহাড়ে মহান আল্লাহর সঙ্গে তাঁর বিশেষ যোগাযোগের দায়িত্ব পালনের অবকাশেই বাছুর পূজারী হয়ে পড়ে। হযরত ঈসা নবীর উম্মতেরও প্রায় বেশিরভাগই কয়েকজন ধূর্ত ও প্রতারক ইহুদির কারসাজিতে এই মহান নবীকে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করতে থাকে। অন্য কথায় খ্রিস্টানরাও খুব দ্রুতই বিভ্রান্ত হয়েছিল।

 

অন্যদিকে নবী-রাসূলদের মত  তাঁদের প্রকৃত প্রতিনিধিরাও অশেষ সাহসের অধিকারী ছিলেন জুলুম ও অন্যায়ের মুকাবিলায়। ইব্রাহিম (আ) গোটা জাতি ও পরাক্রান্ত সম্রাট নমরুদের মূর্তি-পূজার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। হযরত ইয়াহিয়া নবীকেও (আ) তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে জীবন দিতে হয়েছিল। ইমাম হুসাইন (আ) নিজেও কারবালার দিকে সফরের পথে নানা স্থানে যাত্রা-বিরতির সময় বলতেন:  ‘আল্লাহর কাছে দুনিয়ার মূল্যহীনতার জন্য এটাই যথেষ্ট যে ইয়াহিয়া ইবনে জাকারিয়ার (আ) মাথা উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছিল এক চরিত্রহীন ব্যক্তিত্বের কাছে। আর এ কাজটি করেছিল বনি ইসরাইলের একদল নৈতিক চরিত্রহীন ব্যক্তি।’ #

 

 

চিরভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব- (পাঁচ)

কারবালা ময়দানের এখানেই ছিল হযরত ইমাম হুসাইন (আ)'র তাবু (বর্তমানে এই স্থাপনা ইমামের মাজার কমপ্লেক্সের একটি অংশ)
কারবালা ময়দানের এখানেই ছিল হযরত ইমাম হুসাইন (আ)’র তাবু (বর্তমানে এই স্থাপনা ইমামের মাজার কমপ্লেক্সের একটি অংশ)

মহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়।

ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায়।।

কাঁদিয়া জয়নাল আবেদীন বেহোঁশ হ’ল কারবালায়।
বেহেশতে লুটিয়া কাঁদে আলি ও মা ফাতেমায়।।
..
কাঁদে বিশ্বের মুসলিম আজি, গাহে তারি মর্সিয়া।
ঝরে হাজার বছর ধরে অশ্রু তারি শোকে হায়।।

(কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গান)

 

গত কয়েকটি আলোচনায় আমরা ইসলামের সঙ্গে ও নবী-বংশ তথা বনি হাশিম বংশের সঙ্গে বনি-উমাইয়ার জাত-শত্রুতা বা অতি পুরনো শত্রুতার নানা দিক তুলে ধরেছি। এ প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা যায় যে, কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার মহান সঙ্গীরা যখন শাহাদত বরণ করেন তখন ইয়াজিদ খুশি হয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিল যেখানে সে স্পষ্টভাবে এটা উল্লেখ করে যে ” হুসাইনকে হত্যার মাধ্যমে আমরা উমাইয়ারা মুহাম্মাদকেই হত্যা করেছি এবং বদর, উহুদ ও খন্দকের প্রতিশোধ নিয়েছি।” আসলে বনি উমাইয়াদের অনেকেই কেবল মুখে মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। বিভিন্ন জিহাদে, বিশেষ করে বদর, উহুদ ও খন্দকে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র হাতে তৎকালীন কাফিরদের বড় বড় ব্যক্তিত্বরা নিহত হওয়ায় এবং তাদের অনেকেই বনি উমাইয়া গোত্রের লোক ছিল বলে সেই বংশীয় বা গোত্রীয়-ক্ষোভ তাদের মধ্যে সুপ্ত ছিল। উমাইয়াদের অনেকেই বা বেশিরভাগই মক্কা বিজয়ের পর শক্তিহীন হয়ে পড়ায় প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে টিকে থাকার আশায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপায়হীন হয়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

 

আবু সুফিয়ানসহ অনেক উমাইয়া নেতা ইসলামের সঙ্গে শত্রুতায় সবচেয়ে অগ্রণী ছিল। তাই তারা ভেতর থেকেই ইসলামের ওপর আঘাত হানার দীর্ঘ মেয়াদী ষড়যন্ত্র করে যাতে এক সময় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব তাদের হাতেই চলে আসে।

 

ইসলামী বর্ণনায় এসেছে,  কোনো এক সময় মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখেন যে, বনী উমাইয়্যা তাঁর মিম্বরে বানরের মত নাচানাচি করছে। এ স্বপ্ন দেখে তিনি এমনই শোকাহত হলেন যে, এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি আর হাসেননি। তাঁর এই স্বপ্ন দেখার পর পবিত্র কুরআনের সুরা বনি ইসরাইলের ৬০ নম্বর আয়াত নাজেল হয়েছিল। ওই আয়াতে বলা হয়েছে:

 

“এবং (স্মরণ কর) যখন আমরা তোমাকে বলেছিলাম যে, নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছেন এবং আমরা তোমাকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম  তা কেবল মানুষের জন্য পরীক্ষার মাধ্যম ছিল এবং কুরআনে বর্ণিত অভিশপ্ত বৃক্ষটিও। আমরা মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করতে থাকি, কিন্তু তা তাদের চরম ঔদ্ধত্যকেই কেবল বৃদ্ধি করে।”

 

তাফসিরে তাবারিসহ কয়েকটি সুন্নি সূত্রমতে, কুরআনে উল্লিখিত ওই “অভিশপ্ত বৃক্ষ” বলতে আবু সুফিয়ানের বংশধর তথা উমাইয়াদের বোঝানো হয়েছে এবং রাসূল (সা.) স্বপ্নে তাঁর মিম্বরে বানরদের নাচানাচির যে ঘটনাটি দেখেছিলেন তার অর্থ উমাইয়াদের মাধ্যমে খেলাফত দখল করা হবে।

 

ইমাম হুসাইন (আ) মদিনা থেকে মক্কায় আসার পর বসরার জনগণের উদ্দেশ্যেও এক চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি তার নানা বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা)’র সুন্নাত পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে তার পরিবর্তে বেদাআত বা কুপ্রথা চালু হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এ অবস্থায় তিনি সংগ্রাম বা বিপ্লবে অংশ নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান যাতে ইসলামকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। তিনি জানতেন এই সংগ্রামের পথে পবিত্র ব্যক্তিদের রক্ত ও জীবন দান ইসলামের জন্য মহাকল্যাণ বয়ে আনবে, অন্যদিকে ইসলামের শত্রুদের ঘটবে নৈতিক পরাজয়।

 

কুফা ও বসরার জনগণ যদি ইয়াজিদি শাসকগোষ্ঠীর প্রচারণা ও হুমকিতে বিভ্রান্ত   না হয়ে ইমাম হুসাইন (আ) এবং তাঁর আন্দোলনের প্রতি তাদের আনুগত্য ও ভালবাসায় অবিচল থাকতো তাহলে ঘটে যেতো একটি সফল ইসলামী বিপ্লব। কিন্তু কুফা ও বসরার জনগণ ইমামের প্রতি যথাসময়ে আনুগত্য দেখাতে সক্ষম হয়নি। অথচ মূলত কুফার জনগণই হাজার হাজার চিঠি পাঠিয়ে ইমামকে  জালিম উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।

 

ইমাম হুসাইন যখন ইরাকের দিকে যাচ্ছিলেন তখন এক স্থানে কবি ফারাজদাক ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইমাম তার কাছে কুফাবাসীদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চান। ফারাজদাক বলেন, তাদের হৃদয় আপনার সঙ্গে থাকলেও তরবারিগুলো রয়েছে উমাইয়াদের পক্ষে।  ইমাম বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলছ, সবই মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করছে। আমরা তারই সাহায্য চাই।’ এরপর ‘জারুদ’ অঞ্চলে আসার পর তিনি কুফায় তার পাঠানো প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকিল ও আহলে বাইতপন্থী নেতা হানি ইবনে উরওয়ার শহীদ হওয়ার খবর পান। ইমাম ও তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা শোকাহত হন। ইমাম এ দুই মহান শহীদের জন্য দোয়া করেন।

 

‘জুবালাহ’ নামক স্থানে এসে ইমাম হুসাইন (আ) খবর পান যে কুফায় পাঠানো তার দ্বিতীয় প্রতিনিধি আবদুল্লাহ ইয়াকতারকেও ইয়াজিদের গভর্নর ইবনে জিয়াদ শহীদ করেছে। ইমাম এখানেই ঘোষণা করেন যে যারা তাঁর এই মিশন তথা ইসলামকে রক্ষার বিপ্লবের জন্য জীবন দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এই কাফিলায় যোগ দিয়েছে তারা যেন এখনই সরে পড়ে। এরপর ‘শারিফ’ অঞ্চল হয়ে ইমামের কাফেলা পৌঁছে ‘দুহসম’ এলাকায়। এখানেই ইবনের জিয়াদের সেনা কর্মকর্তা  ‘হোর আর রিয়াহি’ (রা) এক হাজার সেনা নিয়ে ইমাম হুসাইনকে (আ) বাধা দেন। ইমাম হোরের সেনাবাহিনীকে পানি সরবরাহের নির্দেশ দিলে তা পালন করা হয়। হোর ইমামকে ইয়াজিদের গভর্নর ইবনে জিয়াদের একটি ফরমান দেখান যাতে বলা হয়েছে ইমামকে যেন মদীনায় ফিরে যেতে বাধা দেয়া হয় অথবা তাঁকে গ্রেফতার করে যেন কুফায় আনা হয়। ইমাম তাকে জানান যে কুফার জনগণই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদেরকে নেতৃত্ব দিতে ও মুক্তি দিতে। তোমরা কুফার লোকেরা যদি আমাকে পছন্দ না কর তাহলে আমি ফিরে যাব। এরপর হোরের সেনাদল নীরব থাকে এবং ইমাম জোহরের নামাজ পড়তে চান। ইমাম হোরকে বলেন তুমি তোমার সেনাদের নিয়ে নামাজ পড়। কিন্তু  হোর বলেন আমরা আপনার পেছনেই জামাআতে নামাজ আদায় করব। এভাবে সম্মিলিতভাবেই আদায় করা হয় জোহরের নামাজ।

 

নামাজ শেষে ইমাম নবীর আহলে বাইতের মর্যাদা ও যোগ্যতার কথা তুলে ধরেন এবং কুফাবাসী তাদের সিদ্ধান্ত বদল করে থাকলে তিনি ফিরে যাবেন বলে আবারও জানান। ইমাম হুসাইন (আ) হোরকে কুফাবাসীদের পাঠানো চিঠির স্তূপ দেখান। হোর জানান যে ইমামকে কুফায় ইবনে জিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়াই তার দায়িত্ব। ইমাম বললেন, এর আগে মৃত্যুই উত্তম! এরপর ইমাম ফিরে দাঁড়ালেন ও সহযোগীদের যাত্রা শুরু করতে বললেন।  কিন্তু হোর তাদের বাধা দিলেন। ইমাম রাগ করে বললেন, তোমার মা তোমার জন্য শোক প্রকাশ করুক, কি চাও তুমি আমাদের কাছ থেকে? হোর বললেন, আপনি ছাড়া অন্য কেউ এভাবে আমার সঙ্গে কথা বললে আমি একইভাবে জবাব দিতাম। কিন্তু আপনি নবীর নাতি ও হযরত ফাতিমা আপনার মা বলে আমি তা করতে পারি না। আপনি এমন এক পথ ধরুন যা কুফাগামীও নয় ও মদিনাগামীও নয়। আর ততক্ষণে আমি ইবনে জিয়াদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছি দেখি তিনি কি নির্দেশ দেন। আল্লাহ আমাকে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করুক।

 

ইমাম হুসাইন (আ)’র কাফেলা এগিয়ে যেতে থাকে। হুরের বাহিনীও চলছে এই কাফেলার পেছনে। ‘বায়জাহ’ নামক স্থানে ইমাম হোরের সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ করে বলেন: ‘হে জনগণ!।  মহান আল্লাহর রাসুল (সা) বলেছেন, যে কেউ একজন জালিম শাসককে এ অবস্থায় দেখতে পায় যে সে হারামকে হালাল করছে, ওয়াদা লঙ্ঘন করছে,নবী-রাসুলদের সুন্নাত-বিরোধী কাজ করছে, জুলুম ও অবিচার করছে। অথচ এ অবস্থায় তার বিরুদ্ধে কথা বা কাজের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সে। এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ সেখানেই প্রবেশ করাবেন যেখানে প্রবেশ করে জালিম। আসলে এই লোকেরা শয়তানের অনুসরণ করছে এবং আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে দিয়েছে। তারা অশান্তি বা নৈরাজ্য ছড়িয়ে দিয়েছে এবং ত্যাগ করেছে সব বিধান। তারা সম্পদের অপব্যবহার করছে এবং হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করছে। অন্য যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে আমিই নেতৃত্বের জন্য বেশি উপযুক্ত। তোমাদের চিঠি আমার কাছে এসেছে। তোমাদের নানা প্রতিনিধি আমার কাছে এসে আনুগত্য করার প্রস্তাব দিয়েছে এবং তোমরা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না বলে তারা বলেছিল। আর আমি তোমাদের নেতৃত্ব দিলে তোমরা সফল হবে বলে তারা বলেছিল। আমি হুসাইন আলী ও আল্লাহর রাসূলের কন্যা ফাতিমার সন্তান। আমার প্রাণ তোমাদের সঙ্গে রয়েছে, আমার পরিবার তোমাদের পরিবারের সঙ্গে রয়েছে এবং আমি তোমাদেরই একজন। তোমরা যা বলেছ তা যদি না কর ও তোমাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ও আমার প্রতি আনুগত্য ত্যাগ কর তাহলে তা আমার জন্য বিস্ময়ের কিছু হবে না। তোমরা একই কাজ করেছ আমার বাবা, আমার ভাই ও আমার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। তোমরা যদি একই আচরণ কর তাহলে তোমরা তোমাদের সুযোগ হারালে ও ছেড়ে দিলে তোমাদের অংশ। যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে সে নিজের বিরুদ্ধেই তা করে। তোমাদের প্রতি সালাম। ’

 

এরপর ইমাম এলেন নেইনাভায়। এখানে  ইবনে জিয়াদের একটি ফরমান পেলেন হোর। ইমাম যেন মরুময় ও পানিশূন্য স্থান ছাড়া লোকালয়ের কোথাও শিবির প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন সে নির্দেশ ছিল এ ফরমানে।   এ অবস্থায় ইমাম বললেন, আমরা তাহলে নেইনাভা বা ক্বাজারিয়ায় যাই। ইমামের সঙ্গী জুহাইর বলেন, সেখানে ফোরাতের পাশে একটি গ্রাম আছে ও আছে একটি দুর্গ। আমরা সেখানে যেতে পারি। স্থানটির নাম ‘আক্ র’। ইমাম বললেন, আমি এই জায়গা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই। এরপর ইমাম হোরকে বললেন আমাদেরকে আরেকটু এগিয়ে যেতে দাও। হোর রাজি হলেন। এরপর ইমামের কাফেলা পৌঁছল কারবালায়। পিছে পিছে এল হোরের বাহিনী। এখানে ইমামের কাফেলার ঘোড়াগুলো থেমে গেল। ইমাম হুসাইন (আ) জুহাইরকে প্রশ্ন করলেন: এই জায়গাটার নাম কি? জুহাইর বললেন, এই স্থানকে কারবালাও বলা হয়। শুনে ইমামের চোখ পানিতে ভরে গেলো। তিনি বললেন: ‘হে আল্লাহ আমি কার্ব বা দুঃখ এবং বালা বা দুর্যোগ থেকে তোমার আশ্রয় চাইছি। এখানেই আমাদের শিবির বা তাঁবু বসাব। এখানেই আমাদের রক্ত ঝরানো হবে। এখানেই হবে আমাদের কবর যা আমার নানা আমাকে বলেছিলেন’।  #

 

রেডিও তেহরান/এএইচ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.