হুসাইন (আ.)’র কর্তিত মাথার কুরআন পাঠ ও ঘাতকদের খোদায়ি শাস্তি

বিশ্বনবী (সা.)’র নাতি ও নিষ্পাপ ইমাম হযরত ইমাম হুসাইনের (আ.)’র ঘাতকদের সবাইকে কঠিন শাস্তি বা পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল। তাদের ওপর একের পর এক দুনিয়াবি ও আসমানি শাস্তি আসতে থাকে।

যেমন, তাদের বেশিরভাগই প্রাণ হারায়, কারো মুখ কৃষ্ণ বর্ণ হয়ে যায়, কারো চেহারা বিকৃত হয়ে যায়, কেউ রাজ্য হারায় ইত্যাদি।

ইমামের সঙ্গে বেয়াদবির পরিণাম:

যুদ্ধের প্রথম দিকে তামিম গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনু হাউজা নামের এক পাষণ্ড ব্যক্তি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ইমাম হুসাইন (আ.)-কে খুঁজতে আসে। লোকটি ও হুসাইন! ও হুসাইন বলে চিতকার দিচ্ছিল। ইমাম (আ.) বললেন, কি চাও? লোকটি বলে: দোযখের সুসংবাদ নাও। ইমাম হুসাইন (আ.) বললেন: আমি তো দয়ালু প্রতিপালক ও বাধ্য শাফাআতকারীর কাছে যাচ্ছি।

পরে ইমাম বলেন, লোকটি কে? সঙ্গীরা বললেন: ইবনু হাউজা। ইমাম অভিশাপ দিয়ে বললেন: হে আমার প্রতিপালক তাকে দোযখে স্থানান্তরিত করুন।

বর্ণনাকারী বলেন: লোকটির ঘোড়া তাকে নিয়ে খালের মধ্যে পড়ে তার আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। সে নিচে পড়ে যায়। আর তার বাম পা রেকাবিতে আটকে থাকে। ঘোড়া দৌড়াতে থাকে। আর লোকটির মাথা পাথরের মধ্যে বার বার ধাক্কা খেতে থাকে। ফলে লোকটির মাথার মগজ বেরিয়ে যায়। এভাবে যুদ্ধের শুরুতেই লোকটি জাহান্নামে চলে যায়। (তাবারি, পঞ্চম খণ্ড, ২৫৫ পৃ.)

কারবালায় যে অসম যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাতে ইমাম হুসাইন (আ.)সহ তাঁর প্রায়৭২ জন সঙ্গী প্রথম দিকে জয়ী হচ্ছিলেন। কারণ, প্রথম দিকে হচ্ছিল দ্বৈত বা মল্ল যুদ্ধ। কিন্তু এইসব যুদ্ধে প্রতিপক্ষ খুব সহজেই ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মুমিন ও বীরদের দৃঢ় আঘাতে কুপোকাত হয়ে জাহান্নামবাসী হচ্ছে দেখে ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বাধীন প্রায় ত্রিশ হাজার সেনার ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম শিবিরের প্রত্যেক বীরের ওপর সম্মিলিত হামলার নির্দেশ দেয়। ফলে ইমাম শিবিরের প্রত্যেক যোদ্ধা বীর-বিক্রমে জিহাদ করে বহু সংখ্যক মুনাফিক সেনাকে জাহান্নামে পাঠালেও শেষ পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক তির, বর্শা ও তরবারির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত ও বিপর্যস্ত হয়ে শহীদ হন। ইমাম নিজে প্রায় দুই হাজার ইয়াজিদ সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন এবং আরো বেশি সংখ্যককে আহত করেছিলেন।

অশ্ব-খুরে ইমামের দেহ দলিত-মথিত করার শাস্তি

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শহীদ করেই ইয়াজিদের লোকজন ক্ষান্ত হয়নি। ইবনে জিয়াদের নির্দেশে ইমামের লাশের ওপর ঘোড়া দাবড়ানো হয়। এই কাজে নেতৃত্ব দেয় ইবনু হায়াত হাজরামি ও আহবাশ ইবনু মারসাদ নামের দুই পাষণ্ড।

এ প্রসঙ্গে ইবনে জারির তাবারি লিখেছেন, ঘোটক বাহিনী আসল। তারা ইমাম হুসাইন (আ.)’র লাশের ওপর ঘোড়গুলো দাবড়িয়ে তার পিঠের হাড় ও বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দেয়। এ কাজে নেতৃত্ব দানকারী আহবাশ ইবনু মারসাদ কিছু দিন পর এক অজানা তিরের আঘাতে নিহত হয়। তিরটি তার বুক ভেদ করে চলে গিয়েছিল। (তাবারি, পঞ্চম খণ্ড, ২৬০ পৃ.)

ইমামের শির মুবারকের কুরআন তিলাওয়াত

ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শহীদ করার পর কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদ যখন মিম্বরে উঠে বলেছিল যে,’আল্লাহর প্রশংসা করছি যিনি মিথ্যাবাদী ও তার সন্তানকে তথা আলী (আ.) ও তাঁর সন্তান হুসাইন (আ.)-কে হত্যা করেছেন’ তখন আযদ গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে আফিফ আজদি (যিনি সিফফিন ও জামাল যুদ্ধে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন ) ইবনে জিয়াদের সামনেই ঘোষণা করেন যে, নবী-পরিবারকে স্বয়ং আল্লাহ সব অপবিত্রতা থেকে দূরে রেখেছেন আর ইয়াজিদ ও তার বাবা (মুয়াবিয়া) আল্লাহর রাসূল (সা.)’র মাধ্যমে অভিশপ্ত হয়েছে এবং জিয়াদ আল্লাহর শত্রু ও হুসাইন (আ.)-কে হত্যার পরও সে (জিয়াদ) নিজেকে আর মুসলমান বলে দাবি করতে পারে না। তিনি জিয়াদকে মিথ্যাবাদী ও মিথ্যাবাদীর সন্তান এবং যে(ইয়াজিদ) তাকে নিয়োগ দিয়েছে সে ও তার পিতাও (মুয়াবিয়া) মিথ্যাবাদীর সন্তান বলে উল্লেখ করেন। এসব কথা শুনে ইবনে জিয়াদ ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেয়। কিন্তু আযদির গোত্রের লোকেরা তাকে রক্ষা করেন এবং এমনকি এ জন্য ছোটোখাটো যুদ্ধও সংঘটিত হয়। কিন্তু পরে জিয়াদের সেনারা গভীর রাতে আযদিকে ঘর থেকে ধরে এনে হত্যা করে এবং তাঁর মাথা ঝুলিয়ে রাখে একটি লবনের জলাশয়ের পাশে। এর পরের দিন ভোরে জিয়াদ ইমাম হুসাইন (আ.)’র পবিত্র শির মুবারকটি আনতে বলে ও এই পবিত্র মাথাকে কুফার রাস্তাগুলোয় সবগুলো গোত্রের জনগণের মধ্যে প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। যাইদ বিন আরক্বাম বলেন, আমি আমার বারান্দায় ছিলাম যখন বর্শায় বিদ্ধ ইমামের মাথাটি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ও আমার খুব কাছে এসে গিয়েছিল তখন আমি ওই পবিত্র মাথাকে তিলাওয়াত করতে শুনলাম:

أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَابَ الْکَهْفِ وَالرَّقِیمِ کَانُوا مِنْ آیَاتِنَا عَجَبًا [١٨:٩]

আপনি কি ধারণা করেন যে, আসহাবে কাহাফ তথা গুহার (৩০৯ বছর পর জীবিত হওয়া) অধিবাসীরা এবং লেখাগুলো আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল ? (সুরা কাহাফ-৯)

যাইদ বিন আরক্বাম বলেন, “আমার চামড়ার লোম দাঁড়িয়ে গেল এবং আমি বললাম, হে রাসূলুল্লাহর সন্তান, আপনার রহস্য ও আপনার কাজও সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং হ্যাঁ, সবচেয়ে বিস্ময়কর।”

(সূত্র, শেইখ আব্বাস কুমির লেখা নাফাসুল মাহমুম বা ‘শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস’, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ-৩৮)

এক ঘাতক অন্ধ হয়ে যায়

সিবত ইবনে জাওজি বর্ণনা করেছেন: এক বৃদ্ধ ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.) হত্যায় শরিক ছিল। লোকটি একদিন হঠাত অন্ধ হয়ে যায়। লোকেরা এর কারণ জানতে চাইলে বৃদ্ধ বলল: আমি রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে দেখি যে তিনি হাতের কাপড় ঘুটিয়ে আছেন। তাঁর হাতে তলোয়ার। সামনে একটি বিছানায় হুসাইন (আ.)’র দশ ঘাতকের মাথা কাটা লাশ পড়ে আছে। এরপর রাসূল (সা.) আমাকে ধমক দিলেন। আর হুসাইন (আ.)’র রক্ত-মাখা একটি শলাকা আমার চোখে লাগিয়ে দিলেন। সকালে উঠে দেখি আমার চোখ অন্ধ।

এক ঘাতকের মুখ আলকাতরার মত কালো হয়ে যায়

সিবত ইবনে জাওজি আরো বর্ণনা করেছেন: যে পাষণ্ড লোকটি ইমাম হুসাইন (আ.)’র খণ্ডিত মস্তক ঘোড়ার গলায় লটকিয়ে রেখেছিল তার মুখ কালো আলকাতরার মত রং ধারণ করে। লোকেরা তাকে বলল: তুমি সমস্ত আরবে সুন্দর চেহারার মানুষ ছিলে, তোমার এ অবস্থা কেন হল? সে বলল: যেদিন আমি ইমাম হুসাইন (আ.)’র মাথা ঘোড়ার গলায় ঝুলিয়েছিলাম সেদিন থেকে একটু ঘুমালেই দুই ব্যক্তি এসে আমার দুই বাহু ধরে আমাকে জ্বলন্ত আগুনে নিয়ে যায়। তারা আমাকে আগুনে ফেলে দেয়। আগুনে পুড়ে পুড়ে আমার এ দশা হয়েছে। কিছু দিন পর লোকটি মারা যায়।

আরেক ঘাতক আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যায়

সিবত ইবনে জাওজি আরো বর্ণনা করেছেন: প্রসিদ্ধ তাফসিরকার সুদ্দি বলেছেন, তিনি একদিন লোকজনকে দাওয়াত করেন। মজলিসে আলোচিত হল যে, যারা ইমাম হুসাইন (আ.)’র হত্যাকাণ্ডে শরিক ছিল দুনিয়াতে তাদের শাস্তি হয়ে গেছে। এক ব্যক্তি বলে: এটা একেবারে মিথ্যা কথা। সে নিজে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, কিন্তু তার কিছুই হয়নি। লোকটি মজলিস থেকে উঠে বাড়ীতে পৌঁছায় এবং তার প্রদীপ জ্বালানোর চেষ্টা করে। প্রদীপ বা চেরাগের শলতা ঠিক করতে গিয়ে তার কাপড়ে আগুন লেগে যায়। আর সেই আগুনে জ্বলেই লোকটি কয়লা হয়ে যায়। সুদ্দি নিজে সকাল বেলা খবর পেয়ে তাকে কালো কয়লা অবস্থায় দেখতে পান।

ইমামের প্রতি তির নিক্ষেপকারীর পানির পিপাসা

ফুরাত নদীর কুলে চরম পিপাসার্ত অবস্থায় ইমাম হুসাইন (আ.) পানি পানের চেষ্টা করলে ইয়াজিদ বাহিনীর এক পাষণ্ড তাঁর গলায় তির ছোঁড়ায় তিনি আর পানি পান করতে পারেননি। পাষণ্ড ওই লোকটি সব সময় পানি বা শরবত পান করলেও তার পিপাসা মিটতো না। অবশেষে তার পেট ফুলে যায় ও তীব্র পানির পিপাসায় কাতরাতে কাতরাতে সে জাহান্নামবাসী হয়।

আরেক ঘাতকের শাস্তি

ইমাম হুসাইন (আ.)’র মাথার ওপর তরবারির আঘাত হেনেছিল জালিম বুরনস এবং ইমামের আহত অবস্থায় তাঁর টুপিও উঠিয়ে নিয়ে যায় সে। লোকটি ওই টুপি দেখিয়ে ইয়াজিদের কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়ার আশা করছিল। ইমাম তা বুঝতে পেরে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এ আঘাতের বিনিময়ে তুমি যেন পানাহারের ব্যবস্থা করতে না পার। আর আল্লাহ যেন তোমাকে জালিমদের সঙ্গে হাশর করেন।’

লোকটি আজীবন আর্থিক অনটনে ভুগেছে এবং দারিদ্রের মধ্য দিয়েই তার মৃত্যু ঘটেছিল।

ইমাম হুসাইন (আ.)’র শাহাদতের ৫ বছর পর মুখতার সাকাফি ঘাতকদের শাস্তি দেয়ার জন্য জনপ্রিয় গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেন এবং কুফা ও ইরাকে তাঁর শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি হুসাইন (আ.) হত্যায় জড়িত প্রত্যেক ঘাতককে খুঁজে বের করে একের পর এক হত্যা করেন। বেশ কয়েক দিন ধরে এই কিসাস অব্যাহত ছিল। হুসাইন (আ.) হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্য থেকে গড়ে প্রতিদিন ২৪৮ জনকে হত্যা করেন মুখতার।

যেমন, আমর ইবনে হাজ্জাজ পিপাসার্ত অবস্থায় মরুভূমির উত্তপ্ত হাওয়ার মধ্যে পালাতে গিয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় জনগণ তাকে হত্যা করে।

শিমারকে ধরে এনে তাকে হত্যা করা হয় এবং তার শরীরের গোশত কুকুরকে খাওয়ানো হয়।

আবদুল্লাহ ইবনে উসাইদ, মালিক ইবনে বশির ও হামল ইবনে মালিকসহ কয়েকজন ঘাতককে ঘেরাও করা হলে তারা ক্ষমা চায়। মুখতার বলে: তোরা ইমাম হুসাইন (আ.)’র প্রতি দয়া দেখাতে পারলি না, তোদের আবার ক্ষমা কিসের? তাদেরকে ধরে এনে হত্যা করা হয়।

ইমামের টুপি হরণকারী মালিক ইবনে বশিরের হাত ও পাগুলো কেটে ফেলেন বিপ্লবীরা। ফলে সে তড়পাতে তড়পাতে মারা যায়।

ওসমান ইবনে খালিদ ও বিশর ইবনে শুমহিত কুফায় ইমাম হুসাইন (আ.)’র দূত বা প্রতিনিধি তথা তাঁরই চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (আ.) হত্যায় জড়িত ছিল। এ দুই ঘাতককে হত্যার পর তাদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়।

ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ ও তার ছেলেকেও ধরে এনে হত্যা করেন বিপ্লবীরা।

ইমাম হুসাইন (আ.)’র প্রতি তির নিক্ষেপকারী হাকিম ইবনে তোফায়েলকে তির মেরে হত্যা করেন বিপ্লবীরা।

ইমাম হুসাইন (আ.)’র ভাতিজা আবদুল্লাহ ইবনে হাসান (আ.)’র হত্যাকারী জায়েদ ইবনে রিফাদকে তির ও পাথর ছুড়ে আহত করেন বিপ্লবীরা এবং এরপর তারা তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। পাষণ্ড রিফাদ ইমাম হাসানের পুত্রের কপালের ওপর তির নিক্ষেপ করেছিল। এ অবস্থায় কপাল রক্ষার চেষ্টা করায় রিফাদ আরেকটি তির ছুঁড়ে আবদুল্লাহ (আ.)’র হাতকে কপালের সঙ্গে গেঁথে ফেলে।

ঘাতক সিনান ইবনে আনাস কুফা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মুখতার তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেন।

মুখতার বলেছিলেন, চার ভাগের তিন ভাগ কুরাইশকে হত্যা করলেও তা ইমাম হুসাইন (আ.)’র একটি আঙ্গুলের বদলার সমান হবে না।

ইমাম হুসাইন (আ.)’র আরেক প্রধান ঘাতক ইবনে জিয়াদের কর্তিত মাথায় সাপ!

জালিম ও মহাপাপিষ্ঠ শাসক ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি মহা-বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন যাতে নানাজান বিশ্বনবী (সা.)’র ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা পায় এবং প্রকৃত ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পথ খুলে যায়। মদীনা থেকে মক্কায় গিয়ে তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এরপর নিরাপত্তার কারণে এবং পবিত্র ও শান্তির নগরী মক্কায় রক্তপাত এড়ানোর জন্য তিনি হজ শেষ না করেই ইরাকের কুফার দিকে রওনা দেন।

[বিশ্বনবীর নাতি ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছেন শুনে কুফার দোদুল-মনা লোকেরা তাঁকে ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়ার ও ইসলামী হুকুমাত কায়েমের মাধ্যমে মদ্যপ, জুয়াড়ি ও ব্যভিচারী ইয়াজিদের প্রজা হওয়ার কলঙ্ক থেকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। কুফাবাসী’র পক্ষ থেকে ১৮ হাজার চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছে এবং প্রতিটি চিঠির মধ্যে ১০০ জনের স্বাক্ষর ছিল। কিন্তু প্রয়োজনের সময় কারবালায় খুব কম লোকই তাঁকে সহায়তা দিয়েছে। ফলে ইয়াজিদের ত্রিশ হাজার সদস্যের সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় ১০০ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি বীরের মত লড়াই করে শহীদ হন। এই অসম লড়াইয়ে তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যসহ ৭২ জন সঙ্গী শহীদ হন। (তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে কেবল পুত্র আলী ইবনুল হুসাইন বা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) অসুস্থতার কারণে বা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।)]

ইমাম হুসাইন (আ.) কুফার দিকে যাচ্ছেন- গুপ্তচরদের কাছ থেকে পাওয়া এমন খবর সম্ভাব্য গণ-বিপ্লব বা গণ-জাগরণ সৃষ্টির ভয়ে ইয়াজিদ ও তার দলবলকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। ইমামের সফরের সম্ভাব্য পথ ও ততপরতা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় ছিল এইসব গুপ্তচর।

ইয়াজিদের নিয়োগ-করা কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে হোর ইবনে ইয়াজিদ রিয়াহি (রা.) নামের একজন সেনা কর্মকর্তা চিঠি লিখে এই খবর দেন যে, রাসূল (সা.)’র নাতি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীরা কারবালায় এসেছেন। ( হোর ইমামকে বাধা দানকারী প্রথম ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও দশই মহররমের প্রাক্কালে তিনি তওবা করে ইমামের –আ. শিবিরে যোগ দিয়ে বীরের মত যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন। সে প্রথম দিকে কল্পনাও করতে পারেনি যে রাসূল-সা.’র নাতির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার স্পর্ধা দেখাতে পারে মুসলমান নামধারী উমাইয়া শাসক-চক্র।)

ইবনে জিয়াদ একদিকে ওমর সাদ নামের সেনা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয় ইমামের (আ.) সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে এবং অন্যদিকে দূতের মাধ্যমে ইমামের (আ.) কাছে চিঠি পাঠায় ইয়াজিদের আনুগত্য অথবা যুদ্ধ-এ দুইয়ের যে কোনো একটিকে বেছে নিতে। (ওমর সাদ কুফাবাসীদের নিয়ে গঠিত চার হাজার সেনা নিয়ে ইরানের রেই শহরের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু কারবালায় ইমামের (আ.) আগমনের ফলে তাঁকে ওই অভিযান বাতিল করতে ও ইমাম হুসাইন (আ.)’র সঙ্গে যুদ্ধ করতে বলে ইবনে জিয়াদ।)

ইমাম (আ.)’র কাছে জিয়াদের লেখা চিঠির ভাষা ছিল এমন: “হে হুসাইন! কারবালায় তোমার আগমনের বিষয়ে অবহিত হয়েছি। আমিরুল মুমিনিন ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন এক মুহূর্তের জন্যও যেন চোখ বন্ধ না করি এবং খাবার খেয়ে পেট না ভরি যাতে তোমাকে জ্ঞানী ও দয়াময় আল্লাহর সঙ্গে মিলিত (হত্যা) করতে পারি, কিংবা তোমাকে তাঁর (আল্লাহর) হুকুম ও ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার নির্দেশ মানতে বাধ্য করতে পারি।”

ইমাম (আ.) এই চিঠি পাঠ করে তা এক পাশে নিক্ষেপ করে বলেন: “যে জাতি নিজের সন্তুষ্টিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর প্রাধান্য দেয় সেই জাতি সফল হবে না বা মুক্তি পাবে না।” ইবনে জিয়াদের দূত বলল: হে আবা আবদুল্লাহ! (ইমামের উপাধি) চিঠির জবাব দেবেন না? ইমাম (আ.) বললেন: “এর উত্তর হল যন্ত্রণাদায়ক খোদায়ী আজাব বা ঐশী শাস্তি যা শিগগিরই তাকে গ্রাস করবে।” দূত এই উত্তরের কথা ইবনে জিয়াদের কাছে গিয়ে বললে সে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।

ইমাম হুসাইন (আ.)’র এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। কারবালা পরবর্তী ঘটনা-প্রবাহের এক পর্যায়ে মুসআব ইবনে যোবায়েরের সঙ্গে এক যুদ্ধে প্রাণ হারায় ইবনে জিয়াদ। ইবনে জিয়াদের সেনাদলকে কতল করেন মুসআব। আর তাদের মাথাগুলা জড়ো করা হয় কুফা মসজিদের আঙ্গিনায়। লোকেরা এ দৃশ্য দেখার জন্য জড় হয়। দর্শকদের মধ্যে আমারাহ ইবনে ওমায়ের বলেন: যখন ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ও তার সেনাদের কাটা মস্তক আনা হল ও মসজিদের আঙ্গিনায় সেগুলো স্তূপীকৃত করা হল আমি তখন সেখানে গেলাম। লোকেরা বলছিল, এসে গেছে, এসে গেছে। দেখতে পেলাম একটি সাপ এসেছে। সাপটি স্তূপীকৃত খণ্ডিত মাথাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে প্রবেশ করছিল। সবশেষে সাপটি ইবনে জিয়াদের নাকের দুই ছিদ্রের ভেতর ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ মাথার ভেতরে থেকে আবার বেরিয়ে এসে চলে যায়। কিন্তু সাপটি কোথায় গেল তা দেখা যায়নি। কিছুক্ষণ পর আবার দেখা যায় সাপটিকে। লোকেরা আবার বলল, এসে গেছে। সাপটি দুই তিনবার এই কাণ্ড ঘটায়। (হাদিস গ্রন্থ,’তিরমিজি: ২য় খণ্ড, ২১৮ পৃষ্ঠা)

হুসাইন (আ.)’র ঘাতকদের ভয়াবহ পরিণতি দেখে মনে করা যায় পবিত্র কুরআনের এই আয়াত: ‘শাস্তি এমনই হয়ে থাকে। তবে আখিরাতের শাস্তি আরো কঠিন, যদি তারা জানতো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.