ইরানের সবচেয়ে পবিত্র নগরী হিসেবে খ্যাত হচ্ছে কোম। ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.)-এর বোন হযরত ফাতেমা মাসুমার মাযারের অবস্থান এ শহরে হওয়ার কারণেই এ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অমুসলিমরা এ মাযারে প্রবেশ করতে পারে। তবে সেজন্য কোন মুসলিম সঙ্গী বা গাইডের সাহায্য নিতে হয়। ৮ম শতকে কোম শিয়া মুসলমানদের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ৮১৬ খ্রিস্টাব্দে ইমাম রেযার বোন ফাতেমা মাসুমা কোমে ইন্তেকাল করলে তাঁকে এখানেই সমাহিত করা হয়। সেই থেকে কোম মুসলমানদের কাছে অন্যতম পবিত্র নগরী হিসেবে বিবেচিত। কোম সেই শহর যেখানে ইরানের শাহের অনুগত সেনাবাহিনী ইসলামী বিপ্লব সফল করার লক্ষ্যে গঠিত স্বাধীনতাকামী মিলিশিয়াদের কাছে ১৯৭৯ সালে আত্মসমর্পণ করে এবং ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সফলতা লাভ করে। এরপর থেকে ইমাম খোমেইনী আমৃত্যু কোমে বসবাস করতেন। ধর্মীয় শিক্ষা নগরী হিসেবে কোমের খ্যাতি সুদীর্ঘকালের। ‘হাউজায়ে এলমিয়ে কোম’ ইরানের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে অনেক শীর্ষস্থানীয় ধর্মবেত্তা কোমে বসবাস করেন। ধর্ম শিক্ষার স্কলারশীপের জন্য এ শহর পৃথিবীখ্যাত। ইরান এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানের ধর্মপ্রাণ শিয়া মুসলমানদের কাছে কোম আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রবিন্দু। এ শহর অনেক ধর্মবেত্তাকে জন্ম দিয়েছে। এখানে ধর্মীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৫০ এবং ধর্ম গবেষণা ও লাইব্রেরির সংখ্যা ২৫০টির মতো। কোমের অদূরে আরেকটি উপশহর ধর্মপ্রিয় মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এর নাম হচ্ছে ‘জামকারান’।
ইরানের ৮ম বৃহত্তম নগরী কোম তেহরান থেকে সড়ক পথে ১২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী কোমের জনসংখ্যা ১,০৭৪,০৩৬ জনÑ যার মধ্যে ৫৪৫৭০৪ জন পুরুষ এবং ৫২৮৩৩২ জন নারী। কোম নদীর তীরে এ শহরের অবস্থান। কোমের দক্ষিণ-পূর্বে প্রাচীন নগরী কাশান। কোমের সরাসরি দক্ষিণে দেলিজান, মাহালাত নারাক, পারদিসান, কাহাক ও জাসব। পূর্বে রয়েছে তাফরেশ, সাভে, অশতিয়ান ও জাফরিয়াহ।
আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থান : কোমের আবহাওয়া সাধারণত শুষ্ক তবে বছরে কোন কোন সময় বৃষ্টিপাত হয় এবং কখনো কখনো বরফ পড়ে থাকে। বাৎসরিক গড় তাপমাত্রা ২৫.৮০ ফারেনহাইট এবং সর্বনি¤œ গড় তাপমাত্রা ৯.৯০ ফারেনহাইট। অতীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্র ছিল ৪০.১০ সেলসিয়াস এবং সর্বনি¤œ ছিল -২.৩০ সেলসিয়াস। ইরানের রাজধানী তেহরানের দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত নিচু ও সমতল ভূমিতে মরুভূমি বেষ্টিত শহর হচ্ছে কোম।
ব্যবসা-বাণিজ্য : বর্তমানকালে কোম শিল্প-বাণিজ্য ও ইউরেনিয়াম উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্যের আঞ্চলিক বিতরণকেন্দ্র কোমে অবস্থিত। প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপ লাইন বন্দর আঞ্জালী এবং তেহরান থেকে কোমে এসেছে। অপরিশোধিত তেল লাইন তেহরান থেকে কোম হয়ে পারস্য উপসাগরের রিসাই নগরীতে গিয়ে মিলেছে। তেহরান ও কোমের মধ্যবর্তী স্থান শারাজে ১৯৫৬ সালে বিশাল তেলক্ষেত্র আবি®কৃত হয়। ‘সোয়ান’ নামক এক প্রকার টফি ও কার্পেটের জন্য কোমের খ্যাতি রয়েছে। কোমে প্রায় ২৫০০টি টফি বিক্রির দোকান রয়েছে। ধর্মীয় গ্রন্থাদি বিক্রির জন্য প্রচুর দোকান রয়েছে যা একসাথে ইরানের অন্য কোন জায়গায় দেখা যায় না। কোমে পেট্রোকেমিক্যাল ছাড়াও রয়েছে সিমেন্ট ও ইট প্রস্ততকারী ইন্ডাষ্ট্রি। খাবারের জন্য এখানে রয়েছে অনেক প্রাচীন ও বৃহৎ রেস্টুরেন্ট। এখানকার কাবাব খুবই বিখ্যাত। বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের মধ্যে রয়েছে- সালারিয়ে, আলবোর্জ, মোরভারিদ, জাম, মারকাজি, ডিজি বাজার, বামা, শাহরে মা’, ফাদাক, ডলফিন প্রভৃতি। এখানে অনেক ক্যাফে, আইসক্রীম ও জুস শপ রয়েছে।
যাতায়াত : তেহরানের কাছাকাছি হওয়ায় কোমের যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ উন্নত। সড়ক ও রেল পথে ইরানের বিভিন্ন শহরের সাথে যাতায়াত সুদীর্ঘকাল থেকেই। ১৯৭০ সালে কোম নদীর পার্শে¦ চলাচলের উপযোগী করে ড্যাম্ব স্থাপন করা হয়। কোমের সাথে তেহরান, আরাক, কাশান, সাভে এবং ইয়ায্দের সড়ক ও রেল যাতায়াত রয়েছে। এখানে সড়কপথে চলাচলের জন্য বাস, ট্যাক্সি ও মোটর বাইক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে জনপ্রিয়।
প্রশাসন ব্যবস্থা : কোম শহরের প্রশাসন ব্যবস্থা মেয়র শাসিত। যিনি মিউিনিসিপ্যাল বোর্ড কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে থাকেন। কোমের বর্তমান এলাকাসমূহ হচ্ছে- শাহরে কায়েম, পাঞ্জদাহে খোরদাদ, জাহান বীনী, তাবলিগানী টাউন, রাজাক টাউন, ফারহাঙ্গীয়ান টাউন, তাভানীর টাউন, ফাতিমা টাউন, ইমাম হাসান টাউন, ইমাম হোসাইন আবাসিক এলাকা, মাদীয়া টাউন, ইমাম খোমেইনী টাউন, পারদিসিয়ান সিটি, কুদ্স টাউন প্রভৃতি।
দর্শনীয় স্থান : ইরানের ইতিাহাস ও ঐতিহ্য সংস্থা কোমের ১৯৫টি স্থানকে দর্শনীয় স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার অধিকাংশই ধর্মীয় স্থাপনা। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জামকারান মসজিদ, ফাতেমা মাসুমার মাযার, আযম মসজিদ, ইমাম হাসান আল আসকারী মসজিদ, আল গাদির মসজিদ, আতীক মসজিদ, কোম বাজার, ফাইজিয়াহ ধর্মীয় স্কুল, মারাসি নাজাফী লাইব্রেরি, জাহাঙ্গীর খান স্কুল, ফতেহ আলী শাহ কাচার মাযার, মোহাম্মাদ শাহ কাচার মাযার, ২য় শাহ আব্বাস এর মাযার, ৩য় শাহ সোলায়মান এবং শাহ সাফী মাযার, গোম্বাদ সাব্জ ঐতিহাসিক গার্ডেন, আলী ইবনে জাফর এর মাযার, শাহ হামযার মাযার, সাইয়্যেদ হাসান বোরুজেরদীর ঐতিহাসিক ভবন, ইয়ায্দান পানাহ ঐতিহাসিক ভবন, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী (র.)-এর বাসভবন, বাইতুন নূর ভবন, হাজী আসগর খান ঐতিহাসিক গোসলখানা,, গোলী দরবেশ পাহাড়, জামকারান প্রাসাদ, জামকারান এর ৫০০ বছরের পুরোনো বৃক্ষ, ন্যাশনাল কাভীর পার্ক, মারাসী নাজাফী লাইব্রেরি, হাউজিয়ে লেক, কোনে বাজার কমার্শিয়াল সেন্টার, কোনে মসজিদ, কোম কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রভৃতি। জাদুঘরসমূহের মধ্যে রয়েছে- কোম নৃতাত্ত্বিক জাদুঘর, ট্রাডিশনাল আর্ট মিউজিয়াম, ন্যাচারাল হিস্ট্রি ও বন্যপ্রাণী মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব অ্যাস্ট্রোনমি, কোম হ্যান্ডিক্রাফ্ট মিউজিয়াম। বিখ্যাত হোটেলসমূহের মধ্যে রয়েছে- পার্সিয়া হোটেল, হোটেল সাফ, ইরাম হোটেল, অলিম্পিক হোটেল, খোরশীদ হোটেল, আবসার হোটেল, আরিয়া হোটেল, বিবি হোটেল, যায়তুন হোটেল, সালাম হোটেল, ফাখরে আযম হোটেল, নায়নাভা হোটেল প্রভৃতি।
শিক্ষা ব্যবস্থা : কোম ধর্ম শিক্ষার কেন্দ্রস্থল হিসেবে বহুকাল থেকে খ্যাত হয়ে আছে। এখানে প্রচুর ধর্মশিক্ষা কেন্দ্র ও ইন্সটিটিউট রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্কলারশীপ দেয়া হয় এ শহরে। এখানে ৫০০০০ (পঞ্চাশ হাজার) এর বেশি ধর্ম শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা পৃথিবীর ৮০টির বেশি দেশ থেকে আগত। শুধু পাকিস্তান থেকেই এসেছে ৬০০০ এর বেশি। কোমে নারী ও অমুসলিমদের জন্য ধর্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কোমে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্যও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন সাইয়্যেদ হাসান সিরাজী ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র, ইমাম হোসাইন ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র, ইমাম বাগির ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র, রাসূল আযম, রাজাভিয়া, সাতিয়া, আবা-সালি, আল-মাহদী, আল-হাদী, জানবাজান রেসালাত, দাররে আস্তানা, সাইয়্যেদ আবদুল আজিজ ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র প্রভৃতি। কোমের হাউজায়ে এলমিয়ায় (ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে) ২০০ এর বেশি শিক্ষা ও গবেষণা সেন্টার রয়েছে। যেখানে ৪০০০০ (চল্লিশ হাজার) গবেষক ও ছাত্র-ছাত্রী নিয়মিত অধ্যয়ন করছে। কোমের আধুনিক হাউজায়ে এলমিয়ার প্রতিষ্ঠায় ওস্তাদ আবদুল করিম হায়েরীর ব্যাপক অবদান রয়েছে। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- ইউনিভার্সিটি অব কোম, মোফিদ ইউনিভার্সিটি, কোম ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্স, আল-যাহরা ইন্সটিটিউট, দানেশ ইউনিভার্সিটি, পারদিসে দানেশগাহে তেহরান ইউনিভার্সিটি, আইআরআইবি ইউনিভার্সিটি অব কোম, কোম ইন্ডাট্রিয়াল কলেজ, আযাদ ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব পারদিসান, মাসুমিয়া ইউনিভার্সিটি, হিকমাত কলেজ, আল-মুস্তাফা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কোরআন-হাদীস ইউনিভার্সিটি, ফাখরে ইসলামী ইউনিভার্সিটি, মায়াকে ইসলামী ইউনিভার্সিটি, কম্পিউটার রিসার্চ সেন্টার অব ইসলামিক সাইন্স প্রভৃতি।
কোম নিউক্লিয়ার সেন্টার : কোমে রয়েছে ইরানের অন্যতম নিউক্লিয়ার সেন্টার। কোম শহরের ২০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ইউরেনিয়াম উন্নতকরণ সেন্টার অবস্থিত। ১ জানুয়ারি ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সী (ওঅঊঅ) প্রকাশ করে যে, ইরান মেডিকেল ক্ষেত্রে ২০% ইউরেনিয়াম উৎপাদন করছে। সেই থেকে ইসরাইলসহ অন্যান্য শক্তিধর দেশ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছে। তাদের মনে ধারণা জন্মেছে যে, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে শক্তিধর দেশে পরিণত হলে তাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে। তাই প্রতিনিয়ত বিশ্বের অনেকগুলো শক্তিধর দেশ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ঘোর বিরোধিতা করে আসছে। যদিও ইরান এ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থেকে পিছু হটেনি। এছাড়া কোমে রয়েছে মহাকাশ কেন্দ্র বা স্পেস সেন্টার। যেখান থেকে ইতোমধ্যেই মহাকাশযান শাহাব-৩ এর সফল উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়েছে।
সুদীর্ঘকাল থেকে কোম একদিকে যেমন ধর্মীয় পবিত্র স্থান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে তেমনি সাম্প্রতিককালে তার খ্যাতি রয়েছে পরমাণু কর্মসূচির জন্য। ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছাকাছি শহর হওয়াতে এখানকার জীবনমান বেশ উন্নত। ইরানের পর্যটকরা তো বটেই, বিদেশি পর্যটকরাও ইরানের অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি কোম শহরকে ভিন্নরকম গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইমাম খোমেইনীর শহর কোম বিপ্লব ও ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে স্ব-মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে বিশ্ব মুসলিমের কাছে।
-কামাল মাহমুদ