ইমাম জাফর আস-সাদিক (আ.) ছিলেন ইমামতি ধারার বারোজন ইমামের মধ্যে ষষ্ঠ উত্তরাধিকারী। তাঁর ডাক নাম ছিল আবু আবদুল্লাহ। তবে তিনি ‘আস-সাদিক’, ‘আল-ফাযিল’ ও ‘আত-তাহির’ উপাধিতে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন পঞ্চম ইমাম মুহাম্মাদ আল বাকির (আ.)-এর পুত্র। তাঁর মাতা উম্মে ফারওয়া ছিলেন কাশেম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকরের কন্যা।
ইমাম জাফর আস-সাদিক (আ.) জীবনের প্রথম বারো বছর অতিবাহিত করেন পিতামহ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর তত্ত্বাবধানে এবং পরবর্তী ১৯ বছর কাটান পিতা ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকির (আ.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায়।
১১৪ হিজরিতে পিতা ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকির (আ.) ইন্তেকাল করলে হযরত জাফর আস-সাদিক (আ.) ৬ষ্ঠ ইমাম হিসাবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। এভাবেই পূর্ববর্তী ইমামের উত্তরাধিকারী হিসাবে ইসলাম প্রচার ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার পবিত্র দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়।
হযরত জাফর আস-সাদিকের ইমামতের যুগ ছিল ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল। ঐ সময় উমাইয়্যা শাসনব্যবস্থার পতন ঘটে এবং আব্বাসী খেলাফতের উত্থান হয়। অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে সরকারের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। আবদুল মালিকের মাধ্যমে যে রাজবংশের সূচনা হয়েছিল, মারওয়ান আল-হিমারের মাধ্যমে তার অবসান হয়। উমাইয়্যা ও আব্বাসীদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বজনিত এই রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যে ইমাম একাকী মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা মোতাবেক নিবিষ্ট চিত্তে তাঁর কর্তব্য পালন করে চলেন। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজ করতে থাকেন।
উমাইয়্যা শাসনের শেষ দিনগুলোতে শাসকগোষ্ঠী ছিল একেবারে টলটলায়মান। আব্বাসীরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এবং এই রাজনৈতিক স্থিতিহীনতার সুযোগে নিজেদেরকে বনু হাশিম গোত্রের ওপর বঞ্চনার প্রতিশোধ গ্রহণকারী হিসাবে চিত্রিত করে। তারা এই মিথ্যা জাহির করতে লাগল যে, নিরপরাধ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্তপাতের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই তারা আন্দোলন করছে।
উমাইয়্যা শাসনামলে তাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং সংগোপনে মহানবী (সা.)-এর বংশধরদের ক্ষমতায় আসার খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। আব্বাসীদের একটি দল বনু হাশিমের কাছে ক্ষমতা অর্পণের কথা বলে গোপনে উমাইয়্যাদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার জন্য আত্মনিয়োগ করে। কিন্তু আব্বাসীরা ক্ষমতা গ্রহণ করেই আহলে বাইতের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। ঐ সময়টা ছিল অত্যন্ত গোলযোগ, বিশৃঙ্খলা ও ক্ষমতার পালাবদলের কাল। তখন ইসলামের নৈতিকতাবোধ এবং মহানবী (সা.)-এর শিক্ষাকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করা হচ্ছিল আর সারাদেশে বিরাজ করছিল এক অরাজক অবস্থা। এই গভীর কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে ইমাম জাফর আস-সাদিকের মতো এক পবিত্র আত্মা আলোকবর্তিকা হিসাবে অবির্ভূত হন এবং তদানীন্তন পাপপূর্ণ সমাজ পরিবেশকে আলোকিত করতে থাকেন। আবু সালামাহ আল-খাল্লাল তাঁকে খলিফা হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম তা অস্বীকার করেন এবং নিঃস্বার্থভাবে ইসলামের সেবা করার কাজে ব্যস্ত থাকেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় ইমাম জাফর আস-সাদিকের বহুমুখী বিচরণ সমগ্র ইসলামী বিশ্বের প্রশংসা লাভ করে। জ্ঞানের সন্ধানে দূর-দূরান্ত থেকে বহু ছাত্র আসে তাঁর কাছে। খোদায়ী আইন বিধানের আলেম ও বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ ইমাম জাফর সাদিকের বহু হাদিসের উদ্ধৃতি গ্রহণ করেছেন। এমনকি তাঁর ভক্ত শিষ্যরা বিজ্ঞান ও চিত্রকলার বিভিন্ন দিকের ওপর শত শত বই সংকলন করেছেন। ফিকাহ, হাদীস ও তাফসীর ছাড়াও তিনি ছাত্রদের অংক ও রসায়নশাস্ত্র শিক্ষা দান করেছেন। তাঁর জ্ঞান ও হেদায়াতের সুফলপ্রাপ্ত শিষ্যদের একজন হলেন খ্যাতনামা অংকশাস্ত্রবিদ জাবের ইবনে হাইয়ান আত-তূসী। ইমাম জাফর সাদিক তাঁর ইমামতের শেষ দিন পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিস্তারের কাজ করে গেছেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানী ও প্রতিভাবানদেরকে উচ্চতর জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। যাঁরা তাঁর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হচ্ছেন : যুরারা ইবনে আয়ান, মুহম্মাদ ইবনে মুসলিম, মুমীন তা’ক, হিশাম ইবন আল-হাকাম, আবান ইবনে তাগলিব, হিশাম ইবনে সালিম, নুরাইজ, হিশাম আল-কালরিয়ান নাসাবাহ ও জাবের ইবনে হাইয়ান (আল-কেমী)।
আল্লামা শিবলী নোমানী তাঁর ‘সিরাতুন্নোমান’ গ্রন্থে লিখেছেন, ইমাম আবু হানিফা ইমাম জাফর আস-সাদিকের কাছ থেকে ফিকাহ ও হাদীসের বিশেষ জ্ঞান অর্জন ও গবেষণার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সময় তাঁর সাহচর্যে অতিবাহিত করেন। সকল মাযহাবের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, ইমাম আবু হানিফার জ্ঞানের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন ইমাম জাফর আস-সাদিক ও তাঁর সাহচর্য।
এই মহান ইমাম মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা মোতাবেক ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য সারাটি জীবন নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেছেন। তাঁর ব্যাপক জ্ঞান ও সুন্দর শিক্ষা লাভের জন্য লোকেরা তাঁকে ঘিরে ধরত এবং তাঁর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা পোষণ করত। আব্বাসী শাসক আল-মনসুর এতে ক্ষিপ্ত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে এবং ইমামের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৪৮ হিজরির ২৫ শাওয়াল আব্বাসী খলিফা আল-মানসুরের ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বিষ প্রয়োগে তিনি শহীদ হন। ইমাম জাফর আস-সাদিককে দাফন করা হয় মদীনার জান্নাতুল বাকীতে।