আদম এবং হাওয়াকে সৃষ্টির পর দ্বিতীয় পর্যায়ে যে বিষয়টির প্রতি নজর দেয়া হয়েছিল তা হলো প্রথম মানব যুগলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দৃঢ় মনোবলের পরীক্ষা। এ ক্ষেত্রে তাঁদেরকে কিছু পরামর্শও দেয়া হয়েছিল। সেখানে ছিল কিছু আদেশ এবং কিছু নিষেধ। আদম এবং হাওয়া দু’জনে দৃঢ়সংকল্পের কথাই এক সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথকভাবে বলা হয়নি।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘যেখানে ইচ্ছা আহার কর…’ (সূরা আরাফ : ১৯)
এখানে আল্লাহ তাআলা এ রকম বলেননি : ‘হে আদম! এই সকল সুস্বাদু খাবার থেকে তোমরা খাও এবং তোমার স্ত্রীও আহার করুক।’
যখন মহান আল্লাহ বলেন, ‘এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না’ (সূরা আরাফ : ১৯) অর্থাৎ তোমাদের ‘দুই জনের’ কেউ ‘এই গাছের’ নিকটে যাবে না এবং এই বৃক্ষের ফল যদি তোমরা খাও, তাহলে তোমরা নিজেদের প্রতিই নিজেরা যুলুম করবে- এর অর্থ হলো তোমরা দু’জনই তোমাদের কৃতকর্মের জন্য দায়ী।
যদি মূর্খতা এবং দুর্বলতা নারীদের প্রকৃতি হয়ে থাকে, তাহলে তো তার কাজের জন্য দায়ী করা যায় না। নারীকে যদি তার কাজের জন্য দায়িত্বশীল হতে হয়, তাহলে তার বোধ-উপলব্ধিরও পূর্ণাঙ্গতা থাকতে হবে।…‘শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল…’ (সূরা আরাফ : ২০) অর্থাৎ শয়তান উভয়ের মর্যাদায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস পেল। কারণ, আল্লাহ তাআলার খলিফা হওয়া এবং হযরত আদমকে জ্ঞান দান করায় ইবলিস শয়তান হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিল।
আগে আমরা বলেছি, সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে কুরআনের আয়াতে আদম সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা কোন একক ব্যক্তি বিশেষকে উপলক্ষ করে বলা হয়নি। উল্লিখিত আদমকে আসলে বর্গীয় বিশেষ্য (এবহবৎরপ ঘড়ঁহ) হিসাবে ধরতে হবে। অর্থাৎ আদমকে যেমন জ্ঞান দেয়া হয়েছে, নাম শেখানো হয়েছে, তেমনি হাওয়াকেও জ্ঞান দেয়া হয়েছে এবং নাম শেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হাওয়ার যদি বাদ পড়তেন, তাঁকে যদি জ্ঞান, মর্যাদা দেযা না হতো তাহলে শয়তান তাঁর বিরুদ্ধে হিংসা পোষণ করত না বা তাঁকেও ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লাগত না। অথচ শয়তান কুমন্ত্রণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁদের দু’জনের কাছেই শপথ করেছে এবং বলেছে : ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন শুভাকাক্সক্ষী…’ (সূরা আরাফ : ২১)
তাই আল্লাহ বলেছেন : ‘…আমি কি বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?’ (সূরা আরাফ : ২২)
যদি আদমকেই শুধু নাম শেখানো হতো তাহলে আল্লাহ তাআলা দু’জনকেই সম্বোধন করলেন কেন? কেউ কেউ বলে থাকেন, হাওয়া কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন, তাঁকে নিছক প্রয়োজনের খাতির আদমের বাম পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি করা হয়েছে। আদমের ব্যবহারের জন্যই শুধু তাঁকে সৃষ্টি করা হযেছে। তাই যদি হয় তাহলে তিনি আল্লাহ তাআলার আলোচনার পাত্র হতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা উভয়কেই উদ্দেশ্য করে আদেশ-নিষেধ জারি করেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা ব্যাপারই যুগ্মভাবে হয়েছে। শয়তান শুধু আদমের সাথে নয়, একটি দম্পতির সাথেই মোকাবিলায় লিপ্ত হয়েছে। যেমন সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন : ‘কিন্তু শয়তান তা হতে তাদের পদস্খলন ঘটাল এবং তারা যেখানে ছিল সেখানে থেকে তাদেরকে বের করল…’ (বাকারা : ৩৬)
‘তারা যেখানে ছিল’ এই কথায় যেখানে জায়গাটা নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে আলোচনা হতে পারে। অর্থাৎ যেখানে আদম এবং হাওয়া উভয়েই বাস করতেন। তাঁরা যদি সেই জায়গায় বসবাসের উপযুক্ত না হতেন তাহলে আদম, তাঁর মর্যাদা ইত্যাদির কোন বাস্তবতাই থাকত না। আদমের সঙ্গিনী যদি আদমের চেয়ে হীন স্তরের হতেন তাহলে তিনি সেই জায়গায় আদমের সাথে থাকতেন না। তাই এই আয়াতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মর্যাদার দিক দিয়ে আদম এবং হাওয়া উভয়ই সমান।
গুণে গরিমায় অভিন্নতা : পৃথিবীতে আগমনের আগে বেহেশতে থাকাকালীন আদম ও হাওয়ার মর্যাদা ছিল এক এবং অভিন্ন। পৃথিবীতে আসার পর তাঁদের দু’জনের পৃথক মর্যাদা হয়। পাক কুরআনের সূরা ত্বাহায় আল্লাহ পাক শুধু আদমকে উদ্দেশ্য করে বলেন : ‘অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল; সে বলল : হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা এবং অক্ষয় রাজ্যের কথা? অতঃপর তারা তা হতে আহার করল; তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা বেহেশতের বৃক্ষপত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। আদম তার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করল, ফলে সে ভ্রমে পতিত হলো। এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হলেন ও তাকে পথনির্দেশ করলেন।’ (সূরা ত্বাহা : ১২০-১২২)
কিন্তু সূরা বাকারায় এই সকল বিষয় দু’জনকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। যেমন ‘এবং আমি বললাম : হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বাস কর ও যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু শয়তান তা হতে তাদের পদস্খলন ঘটাল এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করল। আমি বললাম, তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নেমে যাও, পৃথিবীতে কিছু কালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।’ (বাকারা : ৩৫-৩৬)
কাজের আল্লাহ তাআলা যখন আদমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তখন বুঝতে হবে হাওয়া তাঁর সাথে রয়েছেন। আবার যখন আল্লাহ পাক বলেন : ‘তোমার জন্য তাই রইল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না ও নগ্ন হবে না’ (সূরা ত্বাহা : ১১৮) এ ক্ষেত্রেও আদমকে একা সম্বোধন করা হয়নি। আদম-হাওয়া দু’জনকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এখানে একটি বিয়ষ প্রণিধাযোগ্য যে, আদম-হাওয়া এমন এক জায়গায় ছিলেন যা পার্থিব নয়। সেই জায়গায় ক্ষুধা, পিপাসা নেই, কোন গরম, ঠাণ্ডা নেই। পৃথিবীর মত নগ্নতার কোন স্থান ওখানে নেই। এতেই বুঝা যায়, পার্থিব কোন দেহ বুঝাতে আদম-হাওয়ার অস্তিত্বকে বুঝানো হয়নি। তাঁরা মানুষ হিসাবেই সেখানে ছিলেন। তবে আমাদের মতো পার্থিব রিপুতাড়িত মানুষের মতো নয়। তাই সে ক্ষেত্রে আদমকে এককভাবে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন পিপাসার প্রশ্ন আসে, কামনা-বাসনার ব্যাপার আসে তখন আদম-হাওয়া দু’জনই উপলক্ষ হয়ে ওঠেন। সেহেতু আদম দু’টি দৃষ্টিকোণে আলোচিত হয়েছে। একটি দৃষ্টিকোণে আদম একটি একক সত্তা, অন্য দৃষ্টিকোণে আদমকে ধরা হয়েছে উৎপাদন এবং বংশবৃদ্ধির মাধ্যম হিসাবে। তখন শয়তান এসে হাজির হয় প্ররোচনার জন্য। যেমন আল-কুরআনে বর্ণনা এসেছে : ‘তখন আদম এবং হাওয়া সেই বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করল, তাই তাদের বেহেশতী পোশাক তাদের শরীর থেকে খসে পড়ল।’
এভাবে আদম কখনো একবচনে আবার কখনো দ্বিবচনে উপস্থাপিত হয়েছেন। একবচন হিসাবে যখন আদমকে উদ্দেশ্য করা হয় তখন তিনি গোটা মানবজাতির প্রতিভু হিসাবে উপস্থাপিত। আবার দি¦বচনে এসে পার্থিব চরিত্রে আদম-হাওয়া দু’টি পৃথক সত্তায় উপস্থাপিত। আদম ও হাওয়ার সাধারণ প্রকৃতি পৃথিবীতে এসে প্রকৃতির কারণেই আদম হাওয়া দু’টি আলাদা সত্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু বেহেশতে প্রথম অবস্থায় মর্যাদাহানির আগে আদম ছিলেন একক।
আল্লাহ যখন বলেন, ‘তারপর মহান প্রভু তাকে (আদমকে) নির্বাচন করলেন এবং তার অনুশোচনা গ্রহণ করলেন এবং ক্ষমা করলেন…’, এখানে আদম একবচন হিসাবে উল্লিখিত। আদম যখন এক অপরাধের জন্য অনুশোচনা করলেন তখন আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করলেন। এখানে কিন্তু আদম একাই অনুশোচনা করলেন না। সাথে হাওয়াও ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা যখন ক্ষমা করলেন তখন দু’জনকেই ক্ষমা করলেন, যেমন পাক কুরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘এভাবে সে (শয়তান) তাদেরকে (আদম ও হাওয়া) প্রবঞ্চনার দ্বারা অধঃপতিত করল। তারপর যখন তারা সেই বৃক্ষফলের স্বাদ গ্রহণ করল তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা উদ্যানপত্র দ্বারা নিজেদের আবৃত করতে লাগল। তখন প্রতিপালক তাদের সম্বোধন করে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু?’ (আরাফ : ২২)
ঠিক তেমনি পাক কুরআনে বলা হয়েছে : ‘তিনি বললেন, তোমরা উভয়ে একই সাথে জান্নাত হতে নেমে যাও …’ (সূরা ত্বাহা : ১২৩), এ ক্ষেত্রেও দু’জনকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। এ থেকে স্পষ্টত বুঝা যাচ্ছে যে, দু’জনের মর্যাদাই সমান এবং ‘নেমে যাও’ বলতে আদম এবং হাওয়াকে নামতে বলা হয়েছে; শয়তানকে উদ্দেশ্য করা হয়নি। শয়তান তো আগে থেকেই বহিষ্কৃত। এই নেমে যাওয়ার আদেশ আদমের বেলায় প্রযোজ্য, যেন তিনি পৃথিবীতে গিয়ে জীবনযাপন করেন এবং আল্লাহ তাআলার খলিফা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
আল্লাহ যখন বলেন, ‘তোমরা সকলে নেমে যাও’- এর অর্থ মানবজাতির সকলে। যেমন সূরা আরাফে বলা হয়েছে : “স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক আদমসন্তানের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরকে বের করেন এবং তাদের নিজদিগের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই ?’ তারা বলে, ‘নিশ্চয়ই আমরা সাক্ষী রইলাম।’ এই স্বীকৃতি গ্রহণ এ জন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বল, ‘আমরা তো এ বিষয়ে গাফিল ছিলাম।’’ (সূরা আরাফ : ১৭২)
ঠিক তেমনি যখন আদমকে নাম শেখানো হয়েছিল, ফেরেশতারা সকলে সিজদা করে যখন তাঁকে সম্মান করেছিলেন তখন আসলে সেই জ্ঞান সকল মানবজাতিকেই দেয়া হয়েছিল; ফেরেশতারা যে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন তা সকল মানুষের জন্যই ছিল। তাই সৃষ্টিগতভাবে সকল মানুষই সমান মর্যাদাশীল। মানুষের মাঝে কোন প্রভেদ নেই। সেই ক্ষেত্রে হাওয়াও একজন মানুষ হিসাবে সমান মর্যাদার।