প্রিন্সিপ্যাল এ. এ. রেজাউল করিম চৌধুরী
রুমীর মসনবী আমাদের দেশে একটি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। আমাদের মাদ্রাসাসমূহে এই মহাকাব্যের পঠন-পাঠন হয়ে থাকে। আমাদের আলেমসমাজ, পীর-মশায়েখ মসনবী থেকে উদ্ধৃতি পেশ করে ওয়াজ-নসীহত করেন। মসনবীর অনেক ছত্র আমাদের ভাষায় প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। মসনবী আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে সঞ্জীবিত করে রেখেছে।
ছয়শ’ বছরেরও অধিক কাল ফারসি আমাদের রাষ্ট্রভাষা ছিল। আরবি ও ফারসিমিশ্রিত বাংলাভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। মসনবী ফারসি ভাষায় লিখিত অনন্য মহাকাব্য। এই মহাকাব্যকে অনুবাদ এবং এর দর্শনকে অবলম্বন করে আমাদের আত্মার জাগৃতিকে আমরা অব্যাহত রাখতে পারব।
আল্লাহর প্রেমের ওপর এত বড় মহাকাব্য পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় ও সাহিত্যে নেই। কাব্যকলার যত রূপ-আঙ্গিক আছে সবগুলোর সমাহার রুমীর মসনবী, Epic, lyric, ode, elegy, তথা কাব্যের যত রূপ এবং ঋড়ৎস আছে সবই সন্নিবেশিত হয়েছে মসনবীতে। মওলানার ভাষা, ছন্দ, শব্দ চয়ন, উপমা, রূপকল্প, প্রতীক তথা অলংকারশাস্ত্র প্রয়োগ ও ছন্দ প্রকরণে যে নৈপুণ্য দেখা যায় তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। তাই সারা বিশ্ব মসনবীর শ্রেষ্ঠত্বে এবং মাহাত্ম্যে এত মুগ্ধ, অভিভূত।
মানবাত্মার ইতিকথা বর্ণনার মধ্য দিয়ে রুমী আমাদের অনন্ত জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর কাব্যের ছত্রে ছত্রে আমাদের আত্মা জেগে ওঠে, অনন্তের অন্বেষায় আমাদের সত্তা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। রুমীর কাব্যপ্রেরণা তাওহীদ এবং রেসালাতভিত্তিক। তাই তাঁর কাব্যে সত্যিকার কাশ্ফ, এলকার আভাস পাওয়া যায়। এর সাথে খান্নাস ও শয়তানের প্রেরণালব্ধ কবিতার তুলনা হয় না। তিনি ঈমানদার, নেক আমলের কবি। হেদায়াতের পথকে তিনি সুপ্রশস্ত করেছেন।
আমরা আনন্দিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, প্রতিষ্ঠানে রুমীচর্চা ব্যাপকতা লাভ করেছে। রুমীর মসনবীসঞ্জাত খোদাপ্রেম, বিশ্বপ্রেম এবং মানবপ্রেম যতই জাগ্রত হবে ততই এই হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর হবে। রুমী আমাদের মত পার্থক্য পরিহার করে তাওহীদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হবার প্রেরণা দিয়েছেন।
কাব্যকলায় যে Art অবলম্বন করেছেন তা গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহর প্রতি আমাদের প্রেমকে প্রকাশ করার জন্য তিনি যে পন্থা অবলম্বন করেছেন তা হলো : প্রেমাস্পদের গোপন কথা লুকানো থাকা ভালো, বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে তা বলা যাবে, এসব গোপন রহস্য অন্যের কথাবার্তায় বলা যাবে। তুচ্ছ ঘাসের ওপর পাহাড় রাখা যাবে না, সূর্যকে কাছে আনলে অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। তাই রুমী আল্লাহপ্রেমের এই মহাকাব্যে অসংখ্য বাস্তব, কাল্পনিক কাহিনী, উপকথা, নীতিগল্প, রূপক কাহিনীর সাথে সংযোজিত করেছেন গভীর চিন্তা-চেতনার ¯্রােত যাতে আল্লাহপ্রেমের ঝংকার মানুষ অনুভব করতে পারে।
মসনবীর শুরুতে বাঁশীর রূপকে খোদা থেকে মানবাত্মার বিচ্ছেদ বিরহ যন্ত্রণার সুরকে উচ্চকিত করে মওলানা খোদাপ্রেমের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। এই প্রেমের পথে অন্তরায় নাফ্্সকে চিহ্নিত করে সেই নাফ্্সকে দমনের উপায় শিখেয়েছেন বাদশা বাঁদীর গল্পে।
তোতা এবং সবজি বিক্রেতার গল্পে তিনি আমাদের আল্লাহর ওলীদের নিজের অবস্থায় কেয়াস না করার জন্য সাবধান করে দিচ্ছেন। ইয়াহুদী রাজার খ্রিস্টান নিধন গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে আল্লাহ যালেমদের অবশ্যই ধ্বংস করে দেবেন যদি ঈমানদারগণ ঈমানের ওপর মজবুত থাকে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই গল্প থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। সিংহ ও খরগোশের গল্পে আমরা তাকদীর-তদবীর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আখেরাত ভুলে গিয়ে দম্ভের সাথে দুনিয়ায় বাহাদুরি করতে থাকলে সিংহের মতো কুয়ায় পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাব। অতি ক্ষুদ্র প্রাণীও বড় প্রাণীকে ধ্বংস করতে পারে যদি তা দাম্ভিক হয়।
ক্ষুদ্র ও দুর্বলকে আল্লাহ পাক এমন হেকমত, কৌশল দান করেন যা সবল এবং বিশাল আকৃতির মধ্যে দেখা যায় না। মৌমাছিকে, রেশম পোকাকে যে হেকমত দেয়া হয়েছে তাতো হাতিকে দেয়া হয়নি। মাটির তৈরি আদমকে ফেরেশতাদের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বাহ্যিক বস্তুর বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু আবিষ্কার করেন, কিন্তু আসল জ্ঞান তাঁদের নেই। মানুষের ছোট অন্তরে যে খোদার প্রেম আছে তা সাগরে-আকাশে নেই। বিজ্ঞানের বস্তুগত সাফল্য অনেক, কিন্তু বিজ্ঞান প্রেম কাকে বলে, জানে না। বিজ্ঞানের কোন প্রক্রিয়ায় প্রেমের বিশ্লেষণ নেই, অথচ খোদার প্রেম ছাড়া জীবনটাই নিষ্ফল।
রুমীর কাহিনীর মাধ্যমে খোদাপ্রেমের বর্ণনায় কেউ অসঙ্গতি দেখলেও তা ভিত্তিহীন। এ সম্পর্কে নিকলসন এবং Gustar বলেন : “To say that ‘The stories follow each other in no order’, is entirely wrong. They are bound together by subtle links and transitions arising from the poets’ development of his theme and each book forms an artistic whole.”
কবি মানবাত্মার খোদাপ্রেমের জাগতিক পরিবেশে বিকাশের ক্ষেত্রে যেসব অন্তরায় এবং সহায় আছে সেগুলোকে গল্পকারে মূর্ত করে এক সূক্ষ্ম চিন্তার সূত্রে অচ্ছেদ্যভাব গ্রথিত করে যে অপূর্ব কাব্যিক সুষমা সৃষ্টি করেছেন, বিশ্বের কাব্যসাহিত্যে তার তুলনা নেই।
মওলানা রুমীর মূল্যায়ন করে Nicholson যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন : “Today, the words I applied to the author of the Mathnabi thirty five years ago- ‘the greatest mystical poet of any age’ seem to me no more than just.
Where else shall we find such a panorama of Universal existence unrolling itself through time into eternity? And apart from the supreme mystical quality of the poem, what a wealth of satire, humour and pathos what masterly pictures drawn by a hand that touches nothing without revealing essential character.”
আমাদের বিশ্বজনীন অস্তিত্ব, কাল থেকে মহাকালে উত্তরণের যে অপূর্ব চিত্র সমাহার মসনবীতে বিদ্যমান তা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।
রুমীর সেই প্রসিদ্ধ উক্তি : ‘আমি প্রস্তররূপ ছিলাম, সেখান থেকে উদ্ভিদ রূপে জন্ম নিলাম, উদ্ভিদরূপ থেকে প্রাণী রূপে জন্ম নিলাম, প্রাণীরূপ থেকে মানুষ হিসাবে জন্ম নিলাম, মানুষ হিসাবে মৃত্যুর পর ফেরেশতা হব, তারপর আমি অনন্তে বিলীন হয়ে যাব।’ Universal Existence -এর কথা মওলানা বলেছেন : ‘আমি সূর্য কিরণের কণা, আমি সূর্যের গোলক, আমি প্রভাতের আলোক, আমি সন্ধ্যার বায়ু।’