‘মিথ্যা ঈমান নষ্ট করে দেয়’ ইমাম বাকের (আ.)
অনেক পরিবারে শিশুদের মিথ্যা বলার কারণে পিতামাতার জন্য নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই ধরনের পরিবারে আত্মবিশ্বাস ও শ্রদ্ধার চেতনা নষ্ট হয়ে নৈরাজ্য ও আস্থাহীনতা মাথাচাড়া দেয়।
শারীরিক রোগব্যাধির মতোই মিথ্যা বলাও খুব ছোট আকারে শুরু হয়। শুরুতেই এর প্রতিকার না হলে ক্রমান্বয়ে এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
মিথ্যা বলা শিশুরা শিখে তাদের মাতাপিতার কাছ থেকেই। কারণ, শিশুরা প্রকৃতিগতভাবেই নিরীহ এবং নিষ্কলুষ। তারা যে পরিবেশে থেকে বড় হয় সেই পরিবেশের শিক্ষাই তাদেরকে মিথ্যাবাদী বা সত্যবাদিতে পরিণত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের প্রকৃতিতে অসৎ বা খারাপ মনোবৃত্তি নেই। পরিবার, স্কুল বা সমাজের কারণেই তার মাঝে অসৎ মনোবৃত্তি দানা বেঁধে ওঠে। ইসলামের শিক্ষায় বলা হয়েছে, শিশুর অন্তঃকরণ সকল প্রকার কলুষ থেকে মুক্ত। পৃথিবীর পরিবেশই তাকে খারাপ করে গড়ে তোলে। যেমন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে।’
মিথ্যা বলার পিছনে কারণসমূহ : ডাক্তার রোগ নিরাময়ের আগে রোগের কারণ অনুসন্ধানে সচেষ্ট হন। তারপর ডাক্তার রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করেন। ঠিক তেমনি অসৎ কাজের প্রতিবিধানেও এই পন্থা প্রযোজ্য। হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘মিথ্যাবাদী খুবই হীন এবং নীচ প্রকৃতির হয়।’ হযরত আলী (আ.) আরো বলেন : ‘শিশুর অন্তঃকরণ হলো অনাবাদী জমির মতো। এতে যা কিছু করা হয় তাই বেড়ে ওঠে।’
শিশুর প্রথম শিক্ষক হলো তার পিতামাতা। একজন ছাত্রের মতোই শিশু যা শোনে এবং দেখে তাই হৃদয়ঙ্গম করে নেয়। সে এর ভালো-মন্দ বিচার করে না। সহজ-সরলভাবে যা পায় তাই সে গ্রহণ করে। পরিবারে কথাবার্তা, ঝগড়া-বিবাদ বা বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে শিশু অনেক কিছু শেখে। পরিবারের সদস্যদের ওয়াদা খেলাফ বা অসৎ আচরণ থেকে শিশু নিজে মিথ্যাবাদী ও অসৎ হওয়া শেখে। যেমন মাতাপিতা অনেক সময় কোন দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে। এই মিথ্যা অজুহাত শিশু বুঝতে পারে এবং মনে করে এই ধরনের মিথ্যাও গ্রহণযোগ্য।
শাস্তি পাওয়ার ভয়েও শিশু অনেক সময় মিথ্যা কথা বলে। যদি শিশু বুঝত যে, তাদের অপরাধ স্বীকার করলে কোন শাস্তি দেয়া হবে না, তাহলে তারা কখনো মিথ্যা কথা বলত না। অকপটে তাদের দোষ স্বীকার করত। কিন্তু কোন দোষ করার পরে পিতামাতার বা পরিবারের অন্য সদস্যদের মারধোর বা বকাঝকা খাওয়ার ভয়ে শিশু মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে মাতাপিতা এবং শিক্ষকরা যদি একটু সতর্ক হয়ে শিশুদের দোষারোপ না করে তাদের কৃতকর্মের অপকারিতার কথা হাসিমুখে আদর করে তাদের বুঝিয়ে বলেন তাহলে শিশুরা মিথ্যা কথা বলার কোন প্রয়োজনই বোধ করবে না।
হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘তোমাদের শিশুদের প্রতি রাগান্বিত হয়ো না।’ একবার ইমাম মূসা কাযিম (আ.)-এর এক সহচর ইমামের কাছে এসে তার ছেলের বিরুদ্ধে নালিশ জানালে ইমাম বলেন : ‘তাকে প্রহার করো না। তবে কিছুকাল তার থেকে দূরে পৃথক হয়ে থাক।’
নিজেকে গুরুত্বহীন ভেবেও অনেক শিশু মিথ্যা বলার আশ্রয় নেয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের চেয়ে কোন শিশু যদি কম আদর বা কম গুরুত্ব পায় তাহলে সে নিজেকে অসহায় মনে করে মিথ্যাকে অবলম্বন করে। এই ধরনের মর্যাদাহীনতায় ভুগলে শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবন অত্যন্ত মারাত্মক পরিণতিতে মোড় নেয়। ভালো শিক্ষা এবং আদর ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে অভিভাবক ও শিক্ষকবৃন্দ শিশুদেরকে এই পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারেন।
অনেক শিশু আবার নিজেদের পিতার জন্মস্থান বা পেশার পরিচয় জানাতে লজ্জাবোধ করে এবং এই কারণে পরিচয় গোপন রাখার জন্য মিথ্যা বলার প্রয়াস পায়। তাই উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদেরকে এই প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখা উচিত।
মিথ্যা বলার প্রতিকার : দুইভাবে মিথ্যাকে প্রতিহত করা যায়। একটি হলো অস্বাভাবিক পন্থায়; অন্যটি হলো বাস্তব পন্থায়। অস্বাভাবিক পন্থায় শারীরিক শাস্তি বিধান করা হয়। এই পন্থায় শিশু আঘাত পায় এবং ভীত হয়ে ওঠে। এই শারীরিক শাস্তি বিধানের মাধ্যমে সাময়িকভাবে মিথ্যা বলা বন্ধ হলেও পরে এর কোন প্রভাব আর থাকে না। মার খেয়ে শিশুর মাঝে বরং একটি বিদ্রোহী ও অসহযোগী মনোভাব গড়ে ওঠে। পরে সে জিদের বশেই আবার মিথ্যার আশ্রয় নেয়। দ্বিতীয় যে পন্থার কথা বলা হয়েছে সেটাই হলো আসল পন্থা। এই পন্থায় শিশুকে মারধোর বা গালমন্দ না করে শিশুর মিথ্যা বলার পিছনে কারণ খুঁজে বের করে সেই কারণগুলোর চিকিৎসা করা হয়। এটা স্বাভাবিক যে, শিশুর চাহিদা এবং প্রয়োজন যদি ঠিকমত পূরণ করা হয় তাহলে তাদের মিথ্যা বলার কোন প্রয়োজনই হয় না। কারণ, তারা মিথ্যা কী জিনিস তা জানবেই না। তবে যে সকল শিশু স্বভাবতঃই মিথ্যা কথা বলে, তাহলে বুঝতে হবে তাদের মাঝে উপযুক্ত শিক্ষার বিকাশ ঘটেনি এবং তাদের নৈতিক শক্তি পূর্ণরূপে গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে নতুন কিছুর প্রতি আকৃষ্ট করে তাদের স্বভাবের মোড় পরিবর্তন করে এবং ক্রমাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে মিথ্যার পথ থেকে সরিয়ে আনা যায়।
মিথ্যা বলা একটি মারাত্মক মানসিক ব্যাধি। এই ব্যাধির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই এর প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। শিশুদেরকে খুবই সতর্কভাবে সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা প্রত্যেক পিতামাতার দায়িত্ব। সুশিক্ষা এবং সদ্ব্যবহারের মাধ্যমেই পরিবারে এবং বিদ্যালয়ে সুস্থ ও নির্মল পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। শিশুর মাঝে মিথ্যা বলা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে অবিলম্বে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে সে শিশু অচিরেই অন্যান্য নীতিহীন খারাপ অভ্যাসে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। ইমাম হাসান আসকারী (আ.) বলেন : ‘অসৎ কাজে পরিপূর্ণ ঘরের চাবি হলো মিথ্যা কথা।’