হাশেমী রাফসানজানী
আমি এমন একটি বিষয়ে কথা বলতে চাই যা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপারে অনেক প্রশ্নেরও অবতারণা হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নারী সমাজের অধিকার বা দায়িত্ব কি রয়েছে? আমি এই ব্যাপারে প্রত্যেকের, বিশেষ করে মহিলাদের মনোযোগ আকর্ষণ করব। এই ব্যাপারে তাঁদের মতামত ও ধারণা ব্যক্ত করার জন্য আহ্বান করছি। টেলিফোনে অথবা পত্রযোগে তাঁরা আমাকে তাঁদের মতামত অবহিত করতে পারেন।
এছাড়া এই বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাঁদেরকেও আমি এই মর্মে উৎসাহিত করব যে, তাঁরা যেন তাঁদের নতুন মনোভাব ও ধারণা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। তা হলেই আমাদের পারিবারিক জীবনের বন্ধন সংহত ও মজবুত হবে। অনেক সামাজিক ও নৈতিক সংকটেরও সমাধান মিলবে। আমি বিষয়টিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে চাই : (১) নারীর অধিকার (২) পুরুষের অধিকার এবং (৩) সমাজের অধিকার। এরপর আমি দেখাতে চেষ্টা করব যে, সামাজিক ন্যায়বিচার কি করে নারী, পুরুষ এবং সামাজ কাঠামোর উপর নির্ভর করছে। ইতিহাসের গভীর অধ্যয়ন থেকে আমরা জানতে পারব যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে সে ক্ষেত্রে ইতিহাসের সকল স্তরে বিশেষ করে নারীরাই নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার আনুমানিক অর্ধেকই হচ্ছে নারী যারা এমনকি আজও বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য দ্বারা আক্রান্ত ও সর্বস্বান্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নারী সমাজ তাদের সমান অধিকারের দাবি তুললেও অদ্যাবধি তারা প্রতারিত হয়ে আসছে। তারা নিজেরাও বুঝতে পেরেছে যে, তারা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অতত্রব, যারা বিষয়টিকে নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেন তাঁরা অবশ্যই বুঝতে পারবেন যে, নারী সমাজের অধিকার সংরক্ষণের একমাত্র উপায় হচ্ছে ইসলামী মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও তার অনুসরণ। ইসলামী শিক্ষাই নারী-পুরুষের বৈধ অধিকারসমূহ রক্ষা করতে পারে। নারী সমাজের প্রতি যে জুলুম-নিষ্পেষণ ও অত্যাচার হয়ে আসছে তাকে তিনটি ঐতিহাসিক স্তরে ভাগ করা যেতে পারে : (ক) প্রাক-ইসলামী কাল, যখন নারী সমাজকে শুধু দাসত্বের স্থানই দেওয়া হয়েছিল, (খ) এমন একটি ঐতিহাসিক পর্ব যখন নারীকে গৃহপালিত পশুর স্থান দেওয়া হয়েছিল এবং (গ) এমন একটি কাল যখন নারীরা পুরুষের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং তাদেরই অভিভাবকত্বের অধীনে জীবনযাপন করতো।
ঐতিহাসিক নিরিখে বিচার করলে তিন ধরনের সভ্যতার সন্ধান পাওয়া যায় : (ক) অসভ্য-বর্বর জাতি এবং গোত্রগুলোর সভ্যতা, (খ) ইরান, ভারত, চীন, মিশর প্রভৃতি দেশের সভ্যতা। উল্লেখ্য, এসব দেশের সমাজগুলো আইন দ্বারা শাসিত ছিল না এবং (গ) গ্রীস, রোম এবং আসিরীয় সভ্যতা- যেখানকার সমাজসমূহে আইনের শাসন বিদ্যমান ছিল।
ইসলামের লালনভূমি আরব উপদ্বীপে উপরোক্ত সভ্যতাগুলোই বিরাজমান ছিল। সেখানে একটি প্রথা তো এই ছিল যে, যদি পরিবার মনে করতো যে, নতুন কোন জীবনের ভার সে বহন করতে পারবে না, তা হলে পরিবারের পক্ষ থেকে নবজাতক কন্যাসন্তানটিকেই মাটির নিচে পুঁতে রাখা হতো। আর এ ধরনের রীতি শুধু যে আরব উপদ্বীপেই ছিল এমন নয়, বরং প্রাচীনকালে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকায়ও এরূপ করা হতো। অনেক সময় খাদ্যাভাবে লোকেরা তাদের কন্যাসন্তানকে হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করতো। ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই নারী হত্যার একটি প্রথা চলে আসছে যা ‘সতীদাহ প্রথা’ নামে খ্যাত। এইভাবে নারী সমাজ নির্যাতিত হয়ে আসছে।
আজ যেসব দেশ এই মর্মে গর্ব করছে যে, তারা নারীকে সমঅধিকার দিয়েছে, তারাও মূলত প্রতারণাই করছে। তারা তাদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নারীদেরকে ভোগের পণ্য হিসেবেই ব্যবহার করছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, যদি কোন মহিলা ব্যবসায়িক স্বার্থে দেহ বিক্রি করে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিত্রগ্রাহক ও ফ্যাশন শো এর ব্যবসায়ের শিকারে পরিণত হয়, তা হলে স্বাভাবিকভাবেই তার মর্যাদা পণ্যের সারিতে এসে যায়। আর তাদেরকে ব্যবসায়িক স্বার্থে খাটিয়ে কেবল ঐ শ্রেণির লোকেরাই অধিকতর লাভবান হচ্ছে। আজ যেসব পাশ্চাত্য নারী সিগারেট, শ্যাম্পু এবং অন্যবিধ উৎপাদন সামগ্রীর বিজ্ঞাপনের বাহন হিসেবে নিজেদেরকে সোপর্দ করে তারা মূলত তাদের মানবীয় প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। আমি মহিলাদেরকে এ ধরনের পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি। আমি এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছি যে, এ ধরনের সমান অধিকার কখনো তাদের রক্ষাকবচ হতে পারে না। বরং বলতে গেলে নারীর মর্যাদা আজ প্রাচীনকাল অপেক্ষাও শোচনীয়।
আমরা এজন্য গর্ব করতে পারি যে, ইসলাম এমন এক ধর্ম যা নর-নারীর সত্যিকার অধিকার সম্পর্কে পথনির্দেশ ও পরামর্শ দিয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থা থেকেই আরব উপদ্বীপে নারী-পুরুষের জন্য একটি নির্দিষ্ট রীতি-নীতি ও বিধান চালু করা হয়েছে যা উভয়ের অধিকারকে সংরক্ষণ করছে। ইসলামের এই নৈতিক বিধান- যা আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে বেঁধে দেওয়া হয়েছে তা বর্তমানের বিজ্ঞানের বিচিত্র উৎকর্ষের যুগেও সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। কিছুসংখ্যক লোক আছেন যাঁরা নারীদেরকে পরনির্ভরশীল এবং অক্ষম বলে অপবাদ দিয়ে থাকেন, কিন্তু ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ একে একটি ভুল তথ্য বলে অভিহিত করেন। আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে ইসলাম নারী জাতিকে এভাবে বিচার না করে তাকে মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছে। বর্তমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সমভাবেই নারী জাতিকে প্রতারণার জালে আবদ্ধ করছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের দুর্নীতি ও অসৎ উদ্দেশ্যাবলিকে চরিতার্থকরণ।
ইসলাম-পূর্ব যুগে কোন দার্শনিক বা পণ্ডিত একথা বলার সাহস করেননি যে, সামাজিকভাবে নারীর সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে ইসলাম এ ঘোষণা দিয়েছে। তা হলে এটা কি অলৌকিক নয়? ইসলাম বলে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নারী ও পুরুষের মর্যাদার মধ্যে কোন প্রকার ইতর বিশেষ নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের উভয়কেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে সৃষ্টি করেছেন এবং তারা উভয়ই স্ব স্ব প্রচেষ্টা বলে আধ্যাত্মিকতার শীর্ষদেশে পৌঁছতে সক্ষম। যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে নারী-পুরুষ একে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তা হলো সদ গুণাবলি, বিশ্বাস (ঈমান) এবং উত্তম কর্ম। কারণ, পরকালে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের কর্মের ভিত্তিতেই সফল অথবা বিফল হয়ে থাকবে। এমন অনেক মহিলা আছেন যাঁরা ব্যক্তিগত গুণাবলি ও মনীষার কারণে মানবতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আবার অনেক পুরুষ অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুমিনগণ নবী করিম (সা.)-এর নিকট এই মর্মে স্বীকার করেছিলেন যে, তারা অজ্ঞতাবশতঃই কন্যাসন্তানদের পুঁতে রাখতো। নারী জাতিকে বেহেশতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে কিনা এই ব্যাপারেও তাদের প্রশ্ন ছিল। আর আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে পরিষ্কার রূপে বলে দিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ করা হবে না।
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে, অনুরূপভাবে শারীরিক দিক থেকেও নারীর ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। যুগ যুগ ধরে নারীর কাঁধে নির্যাতন-নিপীড়নের বোঝা চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাচীনকালের প্রভাব বিস্তারকারী চিন্তা বিশ্বাসগুলোকে চিরতরে মূলোৎপাটনের জন্য পবিত্র কুরআন নারী-পুরুষের সৌহার্দ ও অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।
ইসলাম নারী-পুরুষকে একে অন্যের পরিপূরক বলে মনে করে। ইসলাম-পূর্ব যুগে দয়া বলতে কোন ধারণা সাধারণত ছিল না। তদানীন্তন সময়ে নারী-পুরুষ সকলের কাছেই দয়া, মায়া এবং পুণ্যকর্ম ছিল অর্থহীন। লোকেরা অর্থের লোভে তাদের স্ত্রীদেরকে পণ্যের মতো বিনিময় করতো। লাম্পট্য, চারিত্রিক দুর্বলতা এবং অশ্লীলতা সমাজ জীবনকে সংক্রমিত করেছিল। কিন্তু ইসলামের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই এইগুলো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ইসলাম সৌহার্দ এবং মমত্ববোধকে মানবীয় মূল্যবোধ বলে ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্যে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? সেখানে কি পরিস্থিতি বিরাজমান? সেখানে নারী জাতি পুরুষের ভোগ-লালসার শিকারে পরিণত হয়েছে। নারীর আত্মসম্মানকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৯১)