‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা বাকি আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা না ছাড় তবে আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা গ্রহণ কর। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর তাহলে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। অত্যাচার কর না । অত্যাচারিত হবেও না ‘ (সূরা বাকারা : ২৭৮ ও ২৭৯)
ইসলামী ব্যাংকিং এর মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে সুদবিহীন ব্যাংকিং সম্পর্কে দু’ধরনের বক্তব্যের পার্থক্য সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আইনবেত্তা শহীদ আয়াতুল্লাহ উজমা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ বাকির সাদর তাঁর ‘আল ব্যাংক আল লা রাবওয়ায়ী ফিল ইসলাম’ (সুদহীন ইসলামী ব্যাংকিং) গ্রন্থে বলেন, প্রথম ধরনের বক্তব্য হচ্ছে মাইক্রো ধরনের। প্রচলিত অনৈসলামী ব্যাংকগুলোকে পুরো ইসলামী কায়দায় ঢেলে সাজানোর দরকার নেই বলে এ মতের অনুসারীরা মনে করেন। সমাজ ও সমাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরো ইসলামীকরণের প্রশ্নটি তাঁরা বিবেচনা করছেন না। এর ফলে আর্থ সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত অন্যায় ও অনৈতিক কাজকর্ম চালু থাকার পক্ষে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না । অধিকন্তু ইসলামী ব্যাংকিং এর মাইক্রো ধারণা বাস্তবায়নের ফলে দেখা যায়, মুসলমান ও অমুসলমান দেশসমূহের তথাকথিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থা নিরাপদে অবস্থান করছে।
দ্বিতীয় মতামত হচ্ছে, মেক্রো ধরনের। এ মতের দৃষ্টিতে সুদবিহীন ব্যাংকিং ইসলামী সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামী পরিকল্পনার আওতায় সকল সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক এসে যায়, এসে যায় প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন। ইসলামী নিয়ম নীতি অনুযায়ী পরিচালিত একটি সমাজের সকল প্রয়োজনীয়তার সাথেও তা সামঞ্জস্যশীল।
সুদবিহীন ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কিত এ দুটি ধারণার একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাইক্রো পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো প্রস্তাবিত ইসলামী ও প্রতিষ্ঠিত অনৈসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঠামোতে যে সকল সমস্যা ও বিরোধ বিদ্যমান সেগুলোকে ইসলামী শরিয়তের আইন অনুযায়ী সমাধান করা।
সুদের ভিত্তিতে ধারকর্জ পরিচালনা হচ্ছে সম্পূর্ণ একটি নিষিদ্ধ কাজ। অমুসলমান শাসনে মুসলমানদের জীবনযাত্রার মান ও অবস্থার উন্নতি সাধন করতে হলে যে অর্থের প্রয়োজন সে অর্থ ব্যাংককেই দিতে হবে। এই দ্বিতীয় প্রয়োজনের সাথে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতার একটি প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠান সুদের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পূর্ব র্পযন্ত পুঁজিবাদী ব্যাংকগুলোই একমাত্র বিকল্প ব্যবস্থা এবং মুসলমানদের জন্য নীতিগতভাবে এ সকল ব্যাংক-এর কাছে যাওয়া এক ধরনের আপোসকামিতা।
স্বৈর শাসনের অধীনে মাইক্রো পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ইসলামের শিক্ষা ও দাবির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা, এর ফলে ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং ইসলামী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হলেই সুদের দ্বারস্থ না হয়ে ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা করা সম্ভব। তাই একটি অনৈসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু করা বাস্তবেই সম্ভব নয়। (কতিপয় ব্যাংক কর্মকর্তা অবশ্যই এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন)।
একটি অনৈসলামী সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনৈসলামী অর্থ ব্যবস্থার সাথে ইসলামী রীতি নীতির আপোসকামিতার মাধ্যমেই বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ইসলামী ব্যাংকগুলো চলছে। ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের ধারণাই একটি অবাস্তব চিন্তা এবং কুরআন ও শরিয়তের খেলাফ। অনৈসলামী সমাজে যারা সুদবিহীন ব্যাংকের আকাঙ্খা পোষণ করে তারা এভাবে জুলুমূলক অর্থব্যবস্থার খপ্পর থেকে মুসলমানদেরকে মুক্তি দিতে পারবেন না।
মেক্রো পদ্ধতির দাবি হচ্ছে সত্যিকার ইসলামী সমাজের ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা করা। সুদের সাথে জড়িত দোষক্রটি ও দুর্নীতি থেকে মুসলমান সমাজকে মুক্তিদানের অতিরিক্ত কিছু উদ্দেশ্যও এর রয়েছে। একটি ইসলামী সমাজের সামাজিক কাঠামোর অঙ্গ হিসেবে পুঁজিবাদী ব্যাংক ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করতে হলে অনৈসলামী নীতি পদ্ধতিকে ইসলামী নীতির আলোকে পুনর্গঠিত করতে হবে।
আর্থ সামাজিক অন্যায় অনাচার সমাজ থেকে উচ্ছেদের জন্য সামগ্রিক জীবনে ইসলামী রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। ইসলামী বিধানগুলো একটির সাথে অন্যটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত । এজন্য একটি বিধান বাস্তবায়ন করলে ইসলামের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে প্রাথমিক কর্ম সম্পন্ন হয়।
মুসলমানদের অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামী ব্যাংক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নিম্নে বর্ণিত নীতিমালার আলোকে ব্যাংক সার্ভিসকে ইসলামীকরণ করা যেতে পারে :
১. ব্যাংকিং সার্ভিসকে নিছক ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করলে চলবে না। তাদের সার্ভিস চার্জ সাভির্সের মূল্যের অনুপাত অনুযায়ী হতে হবে। কমিশন আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক সাভির্স যাতে পুঁজিবাদী শোষণের হাতিয়ার না হয় সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
২. ব্যাংকের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সেবা করা। সে জন্য তাদের কাজ কোনো অবস্থাতেই সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারবে না।
৩. ব্যাংকের নিয়ম-নীতির সাথে ইসলামী আইন ও শরিয়তের বিরোধ থাকলে চলবে না। ইসলামী আইনের মূলনীতি অনুযায়ীই তা পরিচালিত হবে।
পুঁজিবাদের ক্রটি-বিচ্যুতি থেকে উত্তরণের জন্য পুঁজির নতুন ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে চিন্তাভাবনার জন্য গবেষণা চালাতে হবে। মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে একজন মানুষ কর্তৃক অপর একজন মানুষকে শোষণের যে প্রক্রিয়া রয়েছে তা উচ্ছেদ করা ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব।
ইসলামী রীতিনীতির আলোকে ইসলামী ব্যাংক তার সবকিছু পরিচালনা করবে। পুঁজিবাদী ব্যাংকিং পদ্ধতি ব্যবহার না করেই তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পন্থা ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। ইসলামী নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকের তৎপরতা নিম্নলিখিত সুফলগুলো বহন করে নিয়ে আসবে :
১. ইসলামী সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানতের গ্যারান্টি দিবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যেখানে কোনো পার্থক্য থাকবে না এবং কেউ শোষিত হবে না। পুঁজিবাদী ধারায় সম্পদ পুঁঞ্জিতূত করা বা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে পুঁজিকে ব্যবহার করার যে পদ্ধতি রয়েছে সে পদ্ধতি আর চলবে না। পুঁজি গঠনের কাজটি সমগ্র সমাজের হাতে চলে আসবে এবং বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে একাজটি ইসলামী সরকার পরিচালনা করবে। এ পথে যে সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জিত হবে তা কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের একচেটিয়া হবে না এবং এভাবে ব্যাংকের উপায়-উপাদান কিছুসংখ্যক লোকের হাতে কুক্ষিগত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে।
২. ইসলামী ব্যাংকগুলো কোনো প্রকার সুদ গ্রহণ করবে না। আমানতের উপর যে সুদ নির্ধারণ করা হয়, তা আসলে উপরি বা বিনাশ্রমে অর্জিত পারিশ্রমিক এবং সে টাকা আমানতকারীদেরকে তাদের টাকা ব্যবহারের বিনিময়ে দেয়া হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এ টাকাকে পারিশ্রমিক বা মুনাফা হিসেবে গণ্য করে।
ইসলামী নীতি অনুযায়ী পারিশ্রমিক তখনই বৈধ হয় যখন এর সাথে চুক্তি অনুযায়ী অপরের কল্যাণে কর্মসম্পাদনের প্রসঙ্গ জড়িত থাকে। অধিকন্তু একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ করার ফলে যে অর্থ আসে তা জমানোর অধিকার ‘পুঁজি’কে দেয়া যায় না। ঋণ ফেরত দেয়াকে তেমনি ‘পুঁজির’ বৃদ্ধি বা সমাজিক আয়-উপাদানের বৃদ্ধি বলে ভাবা যায় না। এ সকল দৃষ্টান্ত ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণসমূহকে ব্যাখ্যা করছে।
ধর্মনিরপেক্ষ কর প্রথার বিপরীতে ইসলামী জাতীয় অর্থ ব্যবস্থা নৈতিকতা, পরোপকার ও আত্মিক উন্নতির উপর জোর দেয়। ট্যাক্স প্রদানকারী মুসলমান ও অন্যরা যাতে সবধরনের স্বার্থপরতা ও হৃদয়হীনতা থেকে মুক্ত হতে পারে সে চেষ্টা করাও ইসলামী ব্যবস্থার কাজ। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মুসলমানদের চূড়ান্ত রুহানী প্রতিদান বা পুরুস্কারের নিশ্চয়তা এভাবে দিচ্ছে :
‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে প্রকাশ্য ও গোপনে দান করে তারাই এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যে ব্যবসায় কোনো ক্ষতি নেই।’ (সূরা ফাতের : ২৯)
কুরআন খাজনার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই উপকারী ব্যবসাকে অনুমোদন করে এবং সাথে সাথে গরীব ও অভাবগ্রস্তকে শুধু দান হিসেবে নয়; বরং ভ্রাতৃত্ব ও খোদার নৈকট্য লাভের অনুভূতি নিয়ে সাহায্য করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। ব্যবসায়ী লেনদেনেও ইসলাম নৈতিক সততা ও শুভ আকাঙ্খার মানসিকতা জাগ্রত করতে চায়।
ইসলাম আর্থসামাজিক উন্নয়ন করতে চায় এবং এর প্রমাণ হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সান্দুক্বী কারযুল হাসানা (সুদবিহীন ঋণের জন্য জনগণের ট্রাস্ট ফান্ড) এবং ব্যক্তিগত কারযে হাসানা ব্যবস্থা । এ ধরনের ট্রাস্ট ফান্ড এক সময় প্রচলিত ছিল এবং এখনো তা বহু মুসলমান ও অমুসলমান দেশ নির্বিশেষে মুসলমানদের মধ্যে চালু আছে। জনগণ নিয়মিত সে খানে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী জমা রাখে। তারা শুধু পরোপকারে ব্রতী হয়েই এ কাজ করে, কেননা, তারা সুদ পাওয়ার আশা নিয়ে ট্রাস্ট ফান্ডে টাকা দিচ্ছে না। এ ইসলামী ঐতিহ্যের ব্যাপকভিত্তিক পুনর্বিন্যাস সাধিত হলে অমুসলমানদের মধ্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়তে বাধ্য। সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে গিয়ে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রথমেই ঘোষণা দেয়, সে যেকোনো পরিমাণ অর্থ বা মূল্যবান সম্পদ আমানত হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তত। নিরাপদে আমানত রাখার শর্তেই শুধু সে অর্থ গ্রহণ করবে। ইসলামী ব্যাংক জামানতের অর্থকে ঋণ হিসেবেও গ্রহণ করতে পারে। তবে দু’পদ্ধতির কোনো পদ্ধতিতেই সুদ প্রদানের প্রশ্ন থাকবে না এবং জমারাখা অর্থ চাহিবা মাত্রই ফেরত দেয়া হবে।
আর্থসামাজিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংকে যে টাকা বিনিয়োগ করা হবে সে টাকা সম্পদ ট্যাক্স থেকে মুক্ত থাকবে। অবশ্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে জামানতকারীকে তার সেবামূলক কাজের বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে না।
(নিউজলেটার, এপ্রিল ১৯৮৯)