ইমাম হুসাইন (আ.)- উত্তম আদর্শের প্রতীক

ইসলামের ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনাসমূহের মধ্যে কারবালার ঘটনা সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হযরত ইমাম হুসাইনকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা সংঘটিত হয়, যাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : ‘হুসাইন আমা থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে।’ মহানবী (সা.)-এর এ বাণী আমাদের এ শিক্ষা দেয় যে, যেমনভাবে তাঁর প্রতিটি কথা, কর্ম ও আচরণ উম্মতের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ তেমনিভাবে ইমাম হুসাইনের প্রতিটি কথা, কর্ম ও আচরণও তাঁর উম্মতের জন্য আদর্শ। কেননা, তিনি যেমন উদ্দেশ্যহীন কোন কাজ করতে পারেন না, যে ব্যক্তি তাঁর থেকে, তিনিও উদ্দেশ্যহীন কোন কাজ করতে পারেন না। সুতরাং কারবালার ঘটনার পেছনেও অবশ্যই মহৎ উদ্দেশ্য ও দর্শন নিহিত রয়েছে।

ইসলামের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নের উদ্রেক হয়, কী এমন ঘটেছিল যে, মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত না হতেই তাঁরই উম্মত যারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করত তাঁরই দৌহিত্র ও বংশধরদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে এবং তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুদের বন্দী করে ইসলামী ভূখন্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। অন্যদিকে আমরা লক্ষ্য করি, এ ঘটনার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বনি উমাইয়্যা যারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল এবং মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের প্রভাব-প্রতিপত্তির সামনে পরাস্ত হয়ে বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এ গোষ্ঠীই মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হিসাবে ক্ষমতায় আরোহণ করেছিল এবং ইসলামের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। এ গোষ্ঠীর ব্যাপারেই রাসূল (সা.) বার বার হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। অথচ মুসলিম উম্মাহ্র অজ্ঞতা, উদাসীনতা ও দুনিয়াপ্রেমের মতো নৈতিক বিচ্যুতির সুযোগে তারাই মুসলমানদের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়। তারা ইসলামী মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও মানবিক মর্যাদার বিষয়সমূহকে বিকৃত করে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা চালায়। একদিকে তারা ইসলামের তাওহীদী বিশ্বাসে ইয়াহুদিবাদী চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল, অপরদিকে মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিত্বকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ ও তাঁর শত্রুদের ভিতকে মজবুত করার জন্য অসংখ্য জাল হাদিস তৈরি করেছিল এবং এভাবে ইসলামের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছিল। জাহেলিয়াতের নতুনভাবে প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছিল। কারণ, বদর, উহুদ, খন্দক ও অন্যান্য যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধশক্তি ইসলামের লেবাসে শুধু আবির্ভূতই হয়নি; বরং ইসলামের মূল পৃষ্ঠপোষক, ব্যাখ্যাকার ও মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এমনকি তাদের কথা, কর্ম ও আচরণই ইসলাম বলে গণ্য হতে শুরু করেছিল। এ চিন্তাধারা ইসলামে বিকাশ লাভ করেছিল যে, খলিফা যা বলেন ও নির্দেশ দেন তা-ই ইসলাম। কারণ, তিনি পৃথিবীতে আল্লাহ্র ছায়া। যদি তাঁর কথা ও নির্দেশ কুরআন ও সুন্নাহ্র পরিপন্থীও হয়, তবু তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা আল্লাহ্র বিরোধিতার শামিল এবং তাঁর কর্মের প্রতিবাদ করা অন্যায় ও নিষিদ্ধ। এ ধরনের চিন্তার ফলে খলিফার আনুগত্যের কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না। এমনকি মহান ব্যক্তিদের হত্যা করা, পবিত্র কাবাগৃহে অগ্নিসংযোগ ও তা ধ্বংস করা সবই এ আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুসলমানদের মৃতদেহ থেকে শির বিচ্ছিন্ন করে ইসলামী ভূখন্ডের সর্বত্র ঘুরিয়ে বেড়ানোর মতো ঘৃণ্য আচরণও খলিফার আনুগত্যের জন্য বৈধ বলে গণ্য হত। অথচ ইসলাম কোন কাফের ও মুশরিকের মৃতদেহের সাথেও এরূপ আচরণকে অনুমোদন করে না।

এ সকল আচরণ বনি উমাইয়্যার অভ্যন্তরীণ কলুষ বা কালিমার ক্ষুদ্র এক চিত্র মাত্র। অপরদিকে সাধারণ জনগণের মধ্যেও ইসলামি চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। ফলে তারা শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল।  অবস্থা এতটা সঙ্গীন হয়ে পড়েছিল যে, বনি উমাইয়্যা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসাবে চরিত্রহীন ও লম্পট ব্যক্তিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিল। ইমাম হুসাইন (আ.) তৎকালীন শাসকের অবস্থা এ বাণীতে তুলে ধরেছেন : ‘নিশ্চয় ইয়াযীদ পাপাচারী ও মদ্যপায়ী, যাদেরকে হত্যা করা নিষেধ তাদের হত্যাকারী। আমার মতো কেউ কখনই তার মতো লোকের আনুগত্য করতে পারে না।… যদি মুসলিম উম্মাহ্ ইয়াযীদের মতো একজন শাসকের আনুগত্য করে তবে ইসলামকে চিরবিদায় জানাতে হবে।’

মুসলমানদের এ অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে ইমাম হুসাইনের বক্তব্য ছিল : ‘তোমরা কি দেখছ না সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে না? যখন সত্য প্রত্যাখ্যাত এবং মিথ্যা ও বাতিল সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়েছে তখন যে কোনো মুমিনের উচিত শাহাদাতের আকাঙক্ষা করা ও আল্লাহ্র সাক্ষাতকে স্বাগত জানানো।’

ইমাম হুসাইনের এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলাম সম্পূর্ণরূপে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল এবং শাসকগোষ্ঠী ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ রাখত না। ইমাম হুসাইন (আ.) দেখলেন মুসলিম উম্মাহ্কে এরূপ তিমিরাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার এবং ইসলামকে রক্ষা করতে হলে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী যে অবৈধ এবং তাদের আনুগত্য যে ইসলামে অসমর্থিত তা স্পষ্টভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা আবশ্যক। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের শাসকের সঙ্গে বেঁচে থাকাও যে কোনো মুমিনের জন্য কাঙিক্ষত নয়, তিনি সকলের মধ্যে সে চেতনা জাগ্রত করার প্রয়াস চালান। তিনি তাঁর আন্দোলন শুরু করেন।

অবশেষে জালেম ইয়াযীদের নির্দেশে ত্রিশ হাজার সৈন্য কারবালায় ইমাম হুসাইনকে অবরোধ করে এবং বাহাত্তর জন সঙ্গীসহ তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরপর তাঁদের সকলের শির বিচ্ছিন্ন করে ইয়াযীদের নিকট প্রেরণ করা হয়। তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুদের বন্দী করে ইরাক ও সিরিয়ায় ঘোরানো হয়। এভাবে উমাইয়্যাদের ইসলামের বাহ্যিক লেবাস খুলে পড়ে এবং তাদের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়। মুসলিম উম্মাহ্ ইমাম হুসাইনকে সহযোগিতা না করলেও এ ঘটনার পর তাদের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের উদাসীনতা ও অবহেলার নিদ্রা ভঙ্গ হয়। বনি উমাইয়্যারও শাসনের পতনের সূচনা হয়। ইমাম হুসাইনের এ আন্দোলনের মধ্যে একদিকে সত্য, ন্যায় ও ইসলামের পক্ষের শক্তির মধ্যে এ অনুপ্রেরণাদায়ক আদর্শ রয়েছে যে, যদি কোন সমাজে সত্য ও ন্যায় উপেক্ষিত এবং অন্যায়-অবিচার ও শোষণের নীতি প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তার প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যদিকে এর বিরোধী শক্তির জন্যও এ সতর্কবাণী রয়েছে যে, শক্তি প্রয়োগ করে হয়ত সত্যপন্থীদের হত্যা করা যায়, কিন্তু সত্যকে কখনই নিশ্চিহ্ন করা যায় না। তাই ইমাম হুসাইনকে স্মরণ করার অর্থ সত্য ও ন্যায়কেই স্মরণ করা। এজন্য তাঁর শিক্ষাকে চির জাগরুক রাখার জন্য আমাদের প্রয়াস চালাতে হবে।

 

সৌজন্যে : প্রত্যাশা, একটি মানব উন্নয়ন বিষয়ক ত্রৈমাসিক, বর্ষ ১, সংখ্যা ৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.