‘জাত আস সালাসিল’ যুদ্ধ জয়ী আলী (আ.)’র সম্মানে সুরা নাজেল
৫ এপ্রিল (রেডিও তেহরান) : আজ হতে ১৪২৯ চন্দ্র-বছর আগে অষ্টম হিজরির এই দিনে (২৬ শে জমাদিউস সানি) আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.)’র নেতৃত্বে মুসলমানরা ‘জাত আস সালাসিল’ নামক যুদ্ধে গৌরবময় বিজয় অর্জন করে।
মু’তাহ যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মূর্তি পূজারী কয়েকটি আরব গোত্রের সঙ্গে মদীনা থেকে উত্তরে সিরিয়াগামী সড়কের পাশে।
মু’তাহ যুদ্ধক্ষেত্রে (যা বর্তমানে জর্দানে অবস্থিত) আরব খ্রিস্টান ও রোমানদের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল অমীমাংসিতভাবে। এই যুদ্ধ আরব মূর্তি পূজারী গোত্রগুলোর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে তারা ইসলামকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য মদীনায় হামলার পরিকল্পনা করে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাদের এ পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে নওমুসলিম আমর ইবনে আসের নেতৃত্বে ওয়াদি আল ক্বুরা অঞ্চলে একদল সেনা পাঠান। সেখানে শত্রু সেনারা সমবেত হচ্ছিল। এই শত্রু সেনাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া অথবা তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলে তাদের দমন করা ছিল মুসলমানদের এই সেনা অভিযানের দায়িত্ব। শত্রুসেনাদের বিপুল সংখ্যা দেখে আমর ইবনে আস খুব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তিনি বাড়তি সেনা পাঠাতে রাসূল (সা.)’র কাছে আবেদন জানান। বিশ্বনবী (সা.) আসের বাহিনীকে সাহায্যের জন্য (পরবর্তী যুগের) প্রথম খলিফা আবু বকরের নেতৃত্বে একদল সেনা পাঠান। কিন্তু একটি সংঘর্ষে বহু সেনা হারানোর পর তিনি আসের বাহিনী ছেড়ে মদীনায় ফিরে আসেন। এরপর (পরবর্তী যুগের) দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাবের নেতৃত্বে আরো একটি বাড়তি বাহিনী পাঠান বিশ্বনবী (সা.)। কিন্তু এই বাহিনীও বিপর্যয়ের শিকার হয়। এরপর মহানবী (সা.) মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব অর্পণ করেন নিজের চাচাত ভাই ও জামাতা হযরত আলী (আ.)’র কাছে। তিনি রণাঙ্গনে মূর্তি পূজারী আরবদেরকে যথাযথভাবে ইসলামের দিকে আহ্বান জানান। কিন্তু তারা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।
শেরে খোদা বা ‘আল্লাহর সিংহ’ ওই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বেশ দক্ষতার সঙ্গে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলেন। এরপর সংঘটিত হয় কয়েকটি মল্ল যুদ্ধ যাতে আলী (আ.) নিজেও অংশ নেন। মল্ল যুদ্ধে মূর্তি পূজারী আরবদের ভয়ানক যোদ্ধা ও কমান্ডার হারিস বিন মাকিদাসহ একদল উদ্ধত যোদ্ধা আলী (আ.)’র হাতে প্রাণ হারায়। এরপর শেরে খোদার নেতৃত্বে মুসলিম মুজাহিদরা অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে হামলা চালিয়ে মূর্তি পূজারিদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। মুসলিম বাহিনীর মাত্র দুই জন সেনা শহীদ হন। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক মূর্তি পূজারী সেনা নিহত হয় এবং তারা তাদের নারী, শিশু সন্তান ও সম্পদসহ মুসলিম বাহিনীর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে।
এই গৌরবময় বিজয়ের পর হযরত আলী (আ.)’র সম্মানে নাজেল হয় পবিত্র কুরআনের সুরা আদিয়াত। বিশ্বনবী (সা.)-ই মদীনাবাসীকে এ কথা জানান যে আলী (আ.)’র সম্মানেই নাজেল হয়েছে এই পবিত্র সুরা।
আলী (আ.) মদীনায় ফিরে আসলে শহরের উপকণ্ঠে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান মহানবী (সা.)। তিনি আলী (আ.)’র চেহারা থেকে ধুলো মুছে দেন এবং তাঁর কপালে চুমো দেন। আনন্দের অশ্রু বিসর্জন করে বিশ্বনবী (সা.) বলেন:
“হে আলী, আমি আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যিনি আমাকে শক্তিশালী করেছেন তোমার মাধ্যমে। হে আলী, মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা করেছিলেন যে নিজ ভাই হারুনের মাধ্যমে যেন তাঁর বাহু শক্তিশালী করা হয় এবং নিজ নবুওতে যেন তাঁকেও সহযোগী করা হয়। মুসা নবীর মত আমিও আল্লাহর কাছে তোমার জন্য একই প্রার্থনা করেছি এবং আল্লাহ তা কবুল করেছেন। (পার্থক্য হল এই যে আলী-আ. নবী নন।)”
রাসূল (সা.) এরপর তাঁর সাহাবীদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে এরশাদ করেন: ” আল্লাহর নির্দেশেই আমি আলীকে ভালবাসি। হে আলী, যে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবে বা ভালবাসবে সে আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে বা আমাকে ভালবাসবে, যে আমাকে ভালবাসবে সে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভালবাসবে, আর যে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভালবাসবে আল্লাহও তাঁকে ভালবাসবে এবং বেহেশত হবে তাঁর আবাসস্থল। হে আলী, যে তোমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে, সে আমারও শত্রু, আর যে আমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে সে আল্লাহরও শত্রু। আর আল্লাহ আলী(আ.)’র শত্রুদের কোনো আমলই গ্রহণ করবেন না।”
বিশ্বনবী (সা.)’র জীবদ্দশায় কেবল একটি যুদ্ধ ছাড়া সব যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন হযরত আলী (আ.)। এইসব যুদ্ধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিজয়ের মূল নায়ক ছিলেন তিনি। তাই বলা হত ” আলীর তরবারি জুলফিকার ছাড়া কোনো বিজয় নেই”।#
রেডিও তেহরান/