যদিও প্রথম দিন থেকেই মউলা আলি(আঃ) বুঝতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধ অবশ্যই হবে তবু ওজর নিঃশেষ করার প্রয়োজনে জামালের যুদ্ধ শেষে কুফায় ফিরে এসে ৩৬ হিজরি ১২ রজব সোমবার তিনি জারির ইবনে আব্দিল্লাহ আল-বাজালিকে একটা পত্রসহ মুয়াবিয়ার কাছে সিরিয়া প্রেরণ করেছিলেন। পত্রে তিনি লিখেছিলেন যে, মুজাহির ও আনসার তাঁর বায়াত গ্রহণ করেছে এবং মুয়াবিয়া যেন বায়াত গ্রহণ করে উসমান হত্যার মামলা পেশ করে, যাতে তিনি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী রায় প্রদান করতে পারেন। কিন্তু মুয়াবিয়া নানা তালবাহানা করে জারিরকে দেরী করাতে লাগলো। অপর দিকে আমর ইবনে আল-আসের বুদ্ধিতে উসমান হত্যার কারণ দেখিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণার ব্যবস্থা করলো। সে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বাক্তিদের মাধ্যমে অজ্ঞ জনগণকে বুঝিয়েছিল যে, উসমান হত্যার জন্য আলী দায়ী। তার আচরণ দ্বারা অবরোধকারীদের উৎসাহ ও প্রশ্রয় দিয়েছেন। ইতিমধ্যে মুয়াবিয়া উসমানের রক্তমাখা জামা ও তার স্ত্রীর নায়লাহ বিনতে ফারাফিসার কাটা আঙ্গুল দামস্কের কেন্দ্রীয় মসজিদে ঝুলিয়ে রেখেছিল এবং তার চারদিকে সত্তর হাজার সিরিয়ান কান্নারত ছিল এবং তারা উসমানের রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার শপত গ্রহণ করেছিলো। এভাবে মুয়াবিয়া সিরিয়দের অনুভূতি এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেল যে, তারা উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতেও দৃঢ় সংকল্প হলো। তখন মুয়াবিয়া “উসমান হত্যার প্রতিশোধ” ইস্যুর অপর তাদের বায়াত গ্রহণ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো। মুয়াবিয়া জারিরকে সিরিয়দের অনুভূতি ও মনোভাব দেখিয়ে দিয়ে অপমান করে ফেরত পাঠিয়ে দিল।
জারির কাছে বিস্তারিত জানতে পেরে মওলা আলী (আঃ) খুব দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মালিক ইবনে হাবিব আল- ইয়ারবুইকে নুখায়লাহ উপত্যকায় সৈন্য সমাবেশ করার আদেশ দিলেন। ফলে কুফার উপকণ্ঠে প্রায় আশি হাজার লোক জড়ো হয়েছিলো। প্রথমে মওলা আলী (আঃ) জিয়াদ ইবনে নদর আল-হারিছির নেতৃত্বে আট হাজারের একটা শক্তিশালী রক্ষীবাহিনী এবং সুরায়হ ইবনে আল- হারিছির নেতৃত্বে অন্য একটা চার হাজারের শক্তিশালী বাহিনী সিরিয়া আভিমুখে প্রেরণ করলেন। অবশিষ্ট সৈনবাহিনির নেতৃত্ব নিজে গ্রহণ করে ৫ শাওয়াল বুধবার মওলা আলি(আঃ) সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। কুফার সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি যোহর সালাত আদায় করলেন এবং তারপর দায়র আবু মুসা, নাহর, নারস, কুব্বাত কুব্বিন, বাবিল, দায়র কাব, কারবালা, সাবাত, বাহুরা সিনি, আল-আনবার ও আর জাযিরাহ স্থানে বিশ্রাম গ্রহণ করে আর-রিক্কায় উপনীত হলেন। এখানকার জনগণ উসমানের পক্ষে ছিল এবং এখনেই ইবনে মাখতামাহ আল আসাদি তার আটশত লোকসহ তাঁবু খাটিয়েছিল। এসব লোক মওলা আলী (আঃ) পক্ষ ত্যাগ করে মুয়াবিয়ার সাথে যোগ দেয়ার জন্য কুফা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যখন তারা মওলা আলী (আঃ) এর বাহিনী দেখতে পেল তখন তারা ফরাত নদীর ওপরের সেতু খুলে ফেললো যাতে তিনি নদী পার হতে না পারেন। কিন্তু মালিক ইবনে হারিছ আল- আশতারের ধমকে তারা ভীত হয়ে গেল এবং উভয়ের মধ্যে আলাপ আলোচনার পর সেতু জোড়া লাগিয়ে দিল এবং মউলা আলী (আঃ) তাঁর সৈনবাহিনি নিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। নদীর অপর পারে যেয়ে দেখতে পেলেন জিয়াদ ও সুরায়হ সেখানে অপেক্ষা করছে। তারা মওলা আলী (আঃ) কে তারা জানালো ফরাত অভিমুখে মুয়াবিয়ার এক বিশাল বাহিনী আসছে, আমাদের দ্বারা তাদের গতিরোধ করা সম্ভব হবে না এই কারনে আমরা মউলা আলী (আঃ) এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তাদের থেমে থাকার ওজর মউলা আলী (আঃ) গ্রহণ করলেন এবং অগ্রবর্তী হওয়ার আদেশ দিলেন। যখন তারা সুর-আর-রুম নামক স্থানে গিয়ে দেখতে পেল, আবু আল-আওয়ার আস-সুলামি সেখানে সৈন্য সহ অবস্থান করছে।মওলা আলী (আঃ) মালিক ইবনে হারিছ আল-আশতার কে সেনাপতি করে সেখানে পাঠালেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, যত দূর সম্ভব যুদ্ধ এড়িয়ে তাদেরকে যেন প্রকৃত আবস্থা বুঝিয়ে বলা হয় এবং উপদেশের মাধ্যমে মনোভাব পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। মালিক ইবনে হারিছ আল-আশতার তাদের কাছ থেকে অল্প দূরে ক্যাম্প করলেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধের কোন ভাব দেখালেন না। অপর দিকের অবস্থা থমথমে ছিল, যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু করার তারা উন্মুক্ত অসি হাতে অপেক্ষা করছিলো। আবু আল-আওয়াল হঠাৎ করে রাতের বেলা আক্রমণ করে বসলো এবং সামান্য যুদ্ধের পর পালিয়ে গেল। পরদিন মওলা আলী (আঃ) সসৈন্যে সেখাপৌছে সিফফিন অভিমুখে যাত্রা করলেন। মুয়াবিয়া পূর্বেই সিফফিন পৌছে ছাউনি পেতেছিল এবং ফরাত কূল অবরোধ করে সৈন্য মোতায়েন করেছিলো। মওলা আলী (আঃ) সেখানে পৌঁছে মুয়াবিয়াকে অনুরোধ করে পাঠালেন যেন সে ফরাত কূল থেকে সৈন্য সরিয়ে পানি নেয়ার ব্যবস্থা অবরোধমুক্ত করে। মুয়াবিয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে মওলা আলী (আঃ) এর সৈন্যগন সাহসিকতার সাথে আক্রমণ করে ফরাত কূল দখল করে। তারপর মওলা আলী (আঃ) মুয়াবিয়ার কাছে বশীর ইবনে আমর আল-আনসারি, সাইদ ইবনে কায়েস আল-হামদানি ও শাবাছ ইবনে আত-তামিমীকে প্রেরণ করলেন এ জন্য যে, তারা যেন যুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে বুঝিয়ে বলে এবং সে যেন বায়াত গ্রহণ করে একটা মীমাংসায় আসতে রাজি হয়। এ প্রস্তাবে মুয়াবিয়া সরাসরি বলে দিল যে, উসমানের রক্তের প্রতি সে উদাসীন থাকতে পরে না; কাজেই তরবারিই একমাত্র মীমাংসা- এর কোন বিকল্প নেই। ফলে ৩৬ হিজরি সালের জিলহজ মাসে উভয় পক্ষের যোদ্ধারা একে অপরের মোকাবেলা করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়লো। মওলা আলী (আঃ) এর পক্ষে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন তারা হলো হুজব আদি আল-কিন্দি, সাবাছ ইবনে রিবি আত-তামিমি, খালিদ ইবনে মুয়াম্মার, জিয়াদ ইবনে নদর আল-হারিছি, জিয়াদ ইবনে খাসাফাহ আত-তায়মি, সাইদ ইবনে কায়েস আল-হামদানি, কয়েস ইবনে সাদ আল আনসারী ও মালিক ইবনে হারিছ আল-আসতার। আর মুয়াবিয়ার পক্ষে আবদার রহমান ইবনে খালিদ বিন ওয়ালিদ, আবু আল-আওয়ার আস-সুলামি, হাবিব ইবনে মাসলামাহ আল-ফিহরি, আবদুল্লাহ ইবনে জিলকালা, উবায়দুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে আল-খাত্তাব,সুরাহবিল ইবনে সিমত আল-কিন্দি ও হামজাহ ইবনে মালিক আল-হামদানি। জিলহজ মাসের শেষে যুদ্ধ বন্ধ করা হল মুহরামের জন্য যুদ্ধ ১ মাস বন্ধ থাকার পর ১ সফর আবার যুদ্ধ শুরু হল। মওলা আলী (আঃ) পক্ষ থেকে কুফি অশ্বারোহীগণের সেনাপতি হলেন মালিক আশতার ও কুফি পদাতিক বাহিনির সেনাপতি হলেন আম্মার ইবনে ইয়াসির এবং মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে অশ্বারোহীগণের সেনাপতি হলেন সহল হুনায়েক ও পদাতিকের সেনাপতি হলেন কায়েস ইবনে সাদ। মওলা আলী (আঃ) ঝাণ্ডা বহনকারী ছিল হাসিম ইবনে উতবাহ। মুয়াবিয়ার সেনাদলের দক্ষিণ বাহুর সেনাপতি ছিল ইবনে জিলকালা ও বাম বাহুর সেনাপতি ছিল হাবিব ইবনে মাসালামাহ।
প্রথম দিন মালিক ইবনে আশতার যুদ্ধের ময়দানে তার লোকজন নিয়ে এবং হাবিব ইবনে মাসলামাহ তার লোকজন নিয়ে মালিকের মোকাবেলা করলো। সারাদিন তরবারি ও বর্শার যুদ্ধ চলেছিল।
পরদিন হাসিম ইবনে উতবাহ মওলা আলী (আঃ) এর সৈন্য নিয়ে ময়দানে নামলো এবং আবু আল-আওয়াল তার মোকাবেলা করলো। অশ্বারোহী অশ্বারোহীর উপর পদাতিক পদাতিকের উপর ঝাপিয়ে পড়লো এবং ভয়ানক যুদ্ধে দৃপ্তপদে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলো।
তৃতীয় দিন আম্মার ইবনে ইয়াসির অশ্বারোহী ও জিয়াদ ইবনে নদর পদাতিক বাহিনী নিয়ে ময়দানে নামলো। আমর ইবনে আস বিশাল বাহিনী নিয়ে তাদের মোকাবেলা করলো। মালিক ও জিয়াদের প্রবল আক্রমণে শত্রুপক্ষ পরাজয়ের মুখামুখি ও আক্রমণ রোধে ব্যর্থ হয়ে সেনা নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যায়।
চতুর্থ দিনে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। উবায়দুল্লাহ ইবনে উমার তার মোকাবেলায় এসেছিল মুহাম্মাদ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে মুয়াবিয়া সেনেদলের প্রভূত ক্ষতি করে।
পঞ্চম দিনে আবাদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ময়দানে গেল এবং তার মোকাবেলা করার জন্য ওয়ালিদ ইবনে উকবা এসেছিল। কিন্তু আবাদুল্লাহ বীরবিক্রমে এমন প্রচণ্ড আক্রমণ করলো যে, ওয়ালিদের সেনা পিছু হটে গেল।
ছষ্ঠ দিনে কায়েস ইবনে সা’দ আল-আনসারী ময়দানে নামলো তার বিপরীতে ইবনে জিলকালা এসেছিল। উভয় পক্ষে এমন লড়াই হয়েছিল যে, প্রতি পদক্ষেপে মৃতদেহ দেখা গিয়েছিল এবং রক্তের স্রোতধারা বয়ে গিয়েছিল। অবশেষে রাত নামলে উভয় বাহিনী আলাদা হয়ে যায়।
সপ্তম দিনে মালিক আশতার ময়দানে নামলে হাবিব ইবনে মাসলামাহ তার মোকাবেলায় এসে যোহরের নামাজের পূর্বেই ময়দান ছেড়ে পিছিয়ে গেল।
অষ্টম দিনে মওলা আলি(আঃ) নিজেই ময়দানে গেলেন এবং এমন প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করলেন যে যুদ্ধক্ষেত্র কম্পিত হয়ে উঠেছিল। বর্শা ও তীরবৃষ্টি উপেক্ষা করে ব্যূহের পর ব্যূহ ভেদ করে শত্রুর উভয় লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং মুয়াবিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন, “অযথা লোক ক্ষয় করে লাভ কি? তুমি আমার মোকাবেলা কর। তাতে একজন নিহত হলে অপরজন শাসক হবে”। এ সময় ইবনে আস মুয়াবিয়াকে বললো, আলী ঠিক বলেছে। একটু সাহস করে তার মোকাবেলা কর। মুয়াবিয়া বললো, “ তোমাদের প্ররোচনায় আমি আমার প্রান হারাতে প্রস্তুত নই”। এ বলে সে পিছনের দিকে চলে গেল। মুয়াবিয়াকে পিছনে হটতে দেখে মওলা আলী (আঃ) মুচকি হেসে ফিরে এলেন। যে সাহসিকতার সাথে মওলা আলী (আঃ) সিফফিনে আক্রমণ রচনা করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে অলৌকিক। যখনই যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতেন তখন শত্রু ব্যূহ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং দুঃসাহসী যোদ্ধারাও তাঁর মুখামুখি হতো না। এ কারনে তিনি কয়েক বার পোশাক বদল করে যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন। একবার আরার ইবনে আদ’হামের মোকাবেলায় আব্বস ইবনে রাবি ইবনে হারিস ইবনে আবদাল মুত্তালিব গিয়েছিল। আব্বাস অনেকক্ষণ লড়াই করেও আরারকে পরাজিত করতে পারছিল না। হঠাৎ সে দেখতে পেল আরারের বর্মের একটা আংটা খুলে আছে। আব্বস কাল বিলম্ব না করে তরবারি দিয়ে আরও ক’টি আংটা কেটে দিয়ে চোখের নিমিষে আরারের বুকে তরবারি ঢুকিয়ে দিল। আরারের পতন দেখে মুয়াবিয়া বিচলিত হয়ে গেল এবং আব্বাসকে হত্যা করতে পারে এমন কেউ আছে কিনা বলে চিৎকার করতে লাগলো। এতে গোত্রের লাখম গোত্রের কয়েকজন এগিয়ে এসে আব্বাসকে চ্যালেঞ্জ করলে সে বললো যে, সে তার প্রধানের অনুমতি নিয়ে আসবে। আব্বাস মওলা আলী (আঃ) কাছে গেলে তিনি তাকে রেখে তার পোশাক পরে ও তার ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন, আব্বাস মনে করে লাখম গোত্রের লোকেরা বললো, “তাহলে তুমি তোমার প্রধানের অনুমতি নিয়েছ”। তার উত্তরে মওলা আলী (আঃ) বলেনঃ
“যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্ নিশ্চয় তাদের সাহায্য করতে সক্ষম”। (কুরআন- ২২:৩৯)
তখন লাখাম গোত্রের একজন লোক হাতির মত গর্জন করতে করতে মওলা আলী (আঃ) এর উপর আঘাত করলো। তিনি সে আঘাত প্রতিহত করে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, লোকটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে ঘোড়ার দুদিকে দুখণ্ড পরে গেল। তারপর সে গোত্রের অন্য একজন এসেছিল। সেও চোখের নিমিষে শেষ হয়ে গেল। আসি চালনা ও আঘাতের ধরণ দেখে লোকেরা বুঝতে পারল যে আব্বাসের ছদ্মবেশে আল্লাহ্র সিংহ ময়দানে যুদ্ধ করছেন। তখন আর সাহস করে তাঁর সামনে আসে নি।
আম্মার ইবনে ইয়াসির ইবনে আমির, ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় যে কজন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি প্রথম মুসলিম যিনি নিজের ঘরে মসজিদ নির্মাণ করে আল্লাহ্র ইবাদত করতেন।
তাঁর পিতা ইয়াসির ও মাতা সুমাইয়ার সাথে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ও মাতা উভয়ে ইসলামের প্রথম শহীদ।
আম্মার রাসুল (সাঃ) সময় থেকে বদর থেকে শুরু করে মহানবী (সাঃ) এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ইসলামের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রান। তাঁর ধার্মিকতা, বিশিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও সৎকর্মের জন্য রাসুল (সাঃ) অনেক হাদিস আছে। আয়েশা (রাঃ) ও বেশ কয়েক জন সাহাবীর বর্ণনায় আছে,
*রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “আম্মারের আপাদমস্তক ইমানে ভরপুর”।
*রাসুল (সাঃ) আরও বলেন, “আম্মার সত্যের সাথে সত্য আম্মারের সাথে। সত্য যেদিকে আম্মার সেদিকে। চোখ নাকের যতটা কাছে আম্মার আমার ততটা কাছের, কিন্তু হায়, হায়! একটা বিদ্রোহী দল তাকে হত্যা করবে”।
*রাসুল (সাঃ) আরও বলেন, “হায়, হায়! সত্য ত্যাগী একদল বিদ্রোহী আম্মারকে হত্যা করবে, আম্মার তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকবে এবং ওরা আম্মারকে জাহান্নামের দিকে ডাকবে। তাঁর হত্যাকারী এবং যারা তাঁর অস্ত্র ও পরিচ্ছদ খুলে ফেলবে তারা জাহান্নামের অধিবাসী”।
*রাসুল (সাঃ) তিরোধনের পর, রাসুল (সাঃ) ঘোষিত ১ম ইমাম মওলা আলী (আঃ) কে অস্বীকার করে অগনতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় বসে আবু বক্কর (রাঃ)। এসময় আম্মার মওলা আলী (আঃ) এর বিশেষ সমর্থক ও অনুচর ছিলেন। উসমান (রাঃ) খেলাফত (আমিরুল মোমেনিন) কালে বায়তুল মাল বণ্টনে দূর্ণীতিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যখন জনগণ সেচ্চার হয়ে উঠল তখন এক জনসমাবেশে আমিরুল মোমেনিন বলেন “বায়তুল মাল পবিত্র এবং তা আল্লাহ্র সম্পদ। রাসুলের উত্তরসূরি হিসাবে আমার ইচ্ছা মত তা বণ্টন করার অধিকার আছে। যারা আমার কথা ও কাজের সমালোচনা করে তারা অভিশপ্ত এবং তাদেরকে কঠোর ও কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে”। তখন আম্মার জোর গলায় বলেছিলেন “আমিরুল মোমেনিন জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করে রাসুল (সাঃ) কর্তৃক নিষিদ্ধ গোত্র-স্বার্থ উপেক্ষা করে স্বজন প্রীতির প্রবর্তন করেছে”। এতে উসমান (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে আম্মার কে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করে দেয়ার জন্য তার লোকজন কে আদেশ দিলেন। ফলে কয়েক জন বনি-উমাইয়া আম্মারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাকে বেদম প্রহার করেছিল। এমন কি আমিরুল মোমেনিন নিজেই জুতা পরিহিত পায়ে তার মুখে পদাঘাত করেছিলেন। এতে আম্মার অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং উম্মে সালমার পরিচর্যায় তিন দিন পর জ্ঞান ফিরে পান।
মওলা আলী (আঃ) ক্ষমতায় আশার পর আম্মার তাঁর একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি এসময় সকল প্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা মূলক কাজে অংশ গ্রহণ করেছিলন। বিশেষ করে জামালের ও সিফফিনের যুদ্ধে।
আম্মার শত্রু সনৈব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করে একের পর এক আক্রমন রচনা করে তাদের নাস্তানবুদ করে দিচ্ছিলো। এ সময় নিচ প্রকৃতির মুয়াবিয়ার কিছু সৈন তাঁকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং আবু আল- যুহরী নামক এক পিশাচ তাঁকে এমন আঘত করেছিল যে যা সহ্য করতে না পেরে সাউনি তে ফিরে গেলেন। সাউনিতে ফিরে তিনি পানি চাইলেন। লোকেরা তাঁকে এক বাটি দুধ দিয়েছিল। দুধ দেখে আম্মার বলেছিলেন, “আল্লাহ্র রাসুল ঠিক কথাই বলেছেন”। লোকেরা এই কথার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বললেন, “আল্লাহ্র রাসুল আমাকে একদিন বলেছিলেন এ পৃথিবীতে আমার শেষ খাদ্য হবে দুধ”। এই দুধ পান করার পর নিজে কে আল্লাহ্র কাছে নিজেকে সপে দিলেন। মওলা আলী (আঃ) তাঁর মাথা কোলে তুলে নিয়ে বললেন, নিশ্চয়, “যদি কোন মুসলিম আম্মারের মৃত্যুতে মানসিক ভাবে আহত না হয়ে থাকে তবে তাকে যর্থাথ ঈমানদার বলা যাবে না।
মওলা আলী (আঃ) অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, রাসুল (সাঃ) বলেছিলেন “আম্মার সত্যের সাথে সত্য আম্মারের সাথে”।
আম্মার ইবনে ইয়াসির ইবনে আমির ৩৭ হিজরি সনের ৯ সফর সিফফিন যুদ্ধে মারা যান।
এদিকে আম্মারের মৃত্যুতে মুয়াবিয়ার সৈনদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাদের মনে ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, তারা ন্যায়ের জন্য মওলা আলী (আঃ) এর বিরুধে লড়ছে। আম্মারের সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) এর ঐ বানী অনেকেই জানত, আম্মারের মৃত্যুতে তাদের ভুল ভেঙ্গে গেল। তারা বুঝতে পারল যে তারা অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত এবং মওলা আলী (আঃ) ন্যায়ের পথে রয়েছেন। এ চিন্তা অফিসার হতে শুরু করে সাধারন সৈনিক সবার মনে আলোড়ন তৈরি করেছিলো। অবস্থা বেগতিক দেখে মুয়াবিয়া তার চিরাচরিত মিথ্যা, ছলনা ও কুট চালের আশ্রয় গ্রহণ করলো, “আম্মারের মৃত্যুর জন্য আমরা দায়ী নই। আলিই তো তাকে যুদ্ধে নিয়ে এসেছে। কাজেই তার মৃত্যুর জন্য আলী দায়ী। মুয়াবিয়ার এমন ছলনা পূর্ণ উক্তি যখন মওলা আলী (আঃ) কে জানানো হলে মওলা আলী (আঃ) বললেন, “মুয়াবিয়া বুঝাতে চায় হামজার মৃত্যুর জন্য রাসুল (সাঃ) দায়ী, কারণ তিনি তাকে ওহুদের যুদ্ধে এনেছিলেন”।
এছাড়াও রাসুলের(সাঃ) অনেক সাহাবী ও আনসারী এ যুদ্ধে শহীদ হন। যেমন, খুজায়মাহ ইবনে ছাবিত আল- আনসারী। রাসুল (সাঃ) তাঁর সাক্ষ্যকে দুজন লোকের সাক্ষ্যের সমতুল্য সত্য বলে মনে করতেন, একারণে তাঁর উপাধি ছিল যূশ-শাহাদাতাইন। সিফফিনের যুদ্ধে ময়দানে তাঁর কাছাকাছি কোন মওলা আলী (আঃ) এর সৈন্য এলে তিনি চিৎকার করে বলতেন, আমি যূশ-শাহাদাতাইন খুজায়মাহ ইবনে ছাবিত আল-আনসারী আমি রাসুল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি “যুদ্ধ কর, যুদ্ধ কর, আলীর পক্ষে যুদ্ধ কর”।
নবম দিনে দক্ষিণ বাহুর দায়িত্ব দেয়া হল আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়ল কে ও বাম বাহুর দায়িত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস মওলা আলী (আঃ) মধ্যভাগে ছিলেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যদের নেতৃতে ছিল হাবিব ইবনে মাস্লামাহ। উভয় লাইন মুখামুখি হলে একে অপরের উপর সিংহের মত ঝাপিয়ে পড়েছিল এবং চারদিক থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মওলা আলী (আঃ) এর পতাকা বনি হামাদানের হাতে ঘুরছিল। একজন শহীদ হলে আরেকজন তুলে ধরে।প্রথমে শুরায়রের হাতে ছিল তার পতনে শুরাহবিল ইবনে শুরায়রের হাতে গেল, তারপর ইয়ারিম ইবনে শুরায়রের, এরপর হুবায়রাহ ইবনে শুরায়র এরপর মারসাদ ইবনে শুরায়র- এই ছয় ভ্রাতা শহীদ হবার পর পতাকা গ্রহণ করল সুফিয়ান, এরপর আবাদ, এরপর কুরায়ব- জায়েদের তিন পুত্র । তারা শহীদ হবার পর পতাকা ধারন করলো বসিরের দুপুত্র- উমায়র ও হারিস। তারা শহীদ হবার পর পতাকা ধারন করল ওহাব ইবনে কুরায়ব। এদিনের যুদ্ধে শত্রুর বেশী লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ বাম বাহুর দিকে। সেদিকে এত তীব্র বেগে আক্রমণ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়লের সাথে মাত্র তিনশত সৈন্য ছাড়া সকলেই যুদ্ধক্ষেত্র পিছিয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থা দেখে মওলা আলী (আঃ) আশতারকে বললেন, “ওদের ফিরিয়ে আন। ওদের জীবন যদি ফুরিয়ে আসে থাকে তাহলে পালিয়ে গিয়ে মৃত্যু কে এড়ানো যাবে না। দক্ষিণ বাহুর পরাজয় বাম বাহু কে প্রভাবিত করবে ভেবে মওলা আলী (আঃ) বাম বাহুর দিকে এগিয়ে গেলেন। এসময় উমাইয়াদের এক ক্রীতদাস (আহমার) বলল, “তোমাকে কতল করতে না পারলে আল্লাহ্ আমার মৃত্যু দেন” এ কথা শুনে মওলা আলী (আঃ) এর এক ক্রীতদাস ফায়সান তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে শহীদ হলে মওলা আলী (আঃ) আহমারকে এমন আছাড় দিলেন যে তার শরীরের সব জোড়া খুলে গিয়েছিল। তখন ইমাম হাসান ও মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া তাকে জাহান্নামে পাঠায়ে দিল। এদিকে মালিক আসতারের আহব্বানে দক্ষিণ বাহুর পালাতক লোকজন ফিরে আসে তীব্র আক্রমণ করে শত্রুকে পূর্বস্থানে ঠেলে নিয়ে গেল- এখানে আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়েল শত্রু কর্তৃক ঘেরাও হয়ে ছিলেন। নিজের লোকজন দেখে সাহস ফিরে এলো। সে মুয়াবিয়ার তাঁবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মুয়াবিয়া আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়েল কে দেখে ভয় পেয়ে তার দেহরক্ষীদের পাথর মারতে বলল। এতে তিনি শহীদ হন। মালিক বনি হামদান ও বনি মুযহিদ- এর যোদ্ধা নিয়ে মুয়াবিয়ার উপর আক্রমণ চালাবার জন্য এগিয়ে গেল এবং দেহরক্ষীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাগলো। দেহরক্ষীদের পাঁচটি চক্রের মধ্যে একটি বাকী থাকলে মুয়াবিয়া পালাতে চাইলে, এমন সময় কে একজন সাহস দেয়ায় সে ফিরে দাঁড়াল। অপর দিকে আম্মারের তরবারি প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আম্মার যেদিকে যেত রাসুল (সাঃ) এর সকল সাহাবী তাঁকে অনুসরণ করত। এইদিনে আম্মার শহীদ হন।
এসব অকুতোভয় যোদ্ধাগনের মৃত্যুতে মওলা আলী (আঃ) দুঃখিত হৃদয়ে হামদান ও রাবিয়াহ গোত্রদ্বয়ের লোকদের বললেন, “আমার কাছে তোমরা বর্ম ও বর্শা সমতুল্য। উঠে দাঁড়াও- এসব বিদ্রোহীকে উচিত শিক্ষা দাও”। ফলে হামদান ও রাবিয়াহ গোত্রদ্বয়ের বার হাজার সৈন্য তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে গেল।তাদের পতাকা ছিল হুদায়ন ইবনে মুনযিরের হাতে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলো এবং ব্যূহ একের পর এক ভেদ করে রক্তের স্রোত বইয়ে দিল এবং লাশ স্তূপীকৃত হয়ে রইল। রাতের গাঢ় অন্ধকার না নামা পর্যন্ত তরবারি থামলো না। এটাই সেই ভয়ঙ্কর রাত যা ইতিহাসে “আল- হারিরের রাত্রি” বলে খ্যাত। এ রাতে অস্ত্রের ঝনঝনানি, ঘোড়ার খুরের শব্দ ও মুয়াবিয়ার সৈন্যদের আর্তনাদে আকাশ প্রকম্পিত হয়েছিল। আর মওলা আলী (আঃ) এর দিক থাকে “অন্যায় ও বিভ্রান্তি নিপাত যাক”- শ্লোগানে তাঁর সৈন্যগণের সাহস বৃদ্ধি করছিল এবং মুয়াবিয়ার হ্রদয় শুকিয়ে দিয়েছিল। সকাল বেলায় দেখা গেল ত্রিশ হাজার উর্ধে লোক নিহত হয়েছে।
দশম দিনে মওলা আলি (আঃ) এর সৈন্যগন একই মনোবল নিয়ে যুদ্ধে গেল। দক্ষিণ বাম বাহুর দলনেতা ছিলেন মালিক আল-আসতার এবং বাম বাহুর নেতা আব্বাস। তারা এমন তীব্র বেগে আক্রমণ রচনা করেছিলেন যে, মুয়াবিয়ার সৈন্যরা পালাতে শুরু করল। পরাজয় নিশ্চিত দেখে মুয়াবিয়া আবার ছল করল, পাঁচশত কুরআন বর্শার মাথায় বেঁধে তুলে ধরল, তারা বলছিল যুদ্ধ নয়, কুরআনের আলোয় সিদ্ধান্ত হবে, এতে মওলা আলী (আঃ) এর ক্লান্ত সৈন্যরা তলোয়ার চালনা বন্ধ করল- ছলনা কৃতকার্য হলো। অন্যায়ের পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।
এই যুদ্ধ নিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম লিখলেনঃ
“এই ধূত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,
‘আলীর’ সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান!
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসান হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।
এরই আত্ম প্রতিষ্ঠা- লোভে মসজিদে মসজিদে
বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে”।