সুরা তওবা,আয়াত# ১,
“(হে মুসলমানগন!) যে অংশীবাদীদের সঙ্গে তোমরা (সন্দ্বির) চুক্তি করেছিলে,এখন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষনা করা হল” (১)।
সঠিক ব্যাখ্যাঃ
রাসুল(সাঃ) এই সুরার ১ম ১০টি আয়াত হযরত আবুবকরের হাতে দিয়ে কিছু সংখ্যক লোকসহ প্রেরন করেন এবং মক্কায় হাজীদের সমাবেশে তা পাঠ করার নির্দেশ দেন।তিনি রওনা হয়ে গেলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরীল(আঃ) রাসুলের (সাঃ) কাছে অবতীর্ন হলেন এবং বললেন, ‘এটা হয় আপনি স্বয়ং গিয়ে পাঠ করে শুনান অথবা এমন লোককে প্রেরন করুন যিনি আপনার থেকে’।তিনি হযরত আলীকে(আঃ) এই বলে নিজ উটে সওয়ার করে পাঠালেন যে, ‘ তুমি আবুবকরের হাত থেকে আয়াতগুলো নিয়ে স্বয়ং পাঠ করে শোনাবে’। আবুবকর ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন যে, তাঁর ব্যাপারে কোন নেতিবাচক আদেশ এসেছে কি?রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘না, তবে আদেশ এসেছে যে,এটা হয় আপনি স্বয়ং পাঠ করে শুনান অথবা এমন লোককে প্রেরন করুন যিনি আপনার থেকে।তাই আলীকে প্রেরন করছি’।অতপর হযরত আলী(আঃ) জামারায়ে উকবার সন্নিকটে দাড়িয়ে বললেন, ‘ হে লোক সকল! আমি রাসুলের প্রেরিত,’ এবং নির্ভয়ে আয়াতগুলো পাঠ করে শুনালেন(তাফসীরে দুররে মানসুর,৩য় খন্ড,পাতা-২০৯)। এ ব্যাপারে শিয়া-সুন্নি সকলেই একমত পোষন করেন। আল্লামা ইবনে আবিল হাদীদ শারহে নাহজুল বালাগা গ্রন্থে হযরত আলীর মর্যাদা বর্ননা প্রসঙ্গে এ বিষয়টির উল্লেখ করেছেন।তাফসীরে মায়ালিমুত তানযিল,দুররে মানসুর,মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল,সহিহ তিরমিজি,সহি নাসায়ী,দারে কুতনী,বায়হাকী ইত্যাদি গ্রন্থে রেওয়ায়েতটি উল্লেখিত হয়েছে।
জামায়াত নেতা মাওলানা মউদুদির ভুল তাফসীরঃ
সূরা আনফালের ৫৮ আয়াতে একথা আলোচনা করা হয়েছে যে, কোন জাতির পক্ষ থেকে যখন তোমাদের খেয়ানত করার তথা অঙ্গীকার ভংগ ও বিশ্বাসঘাতকতা করার আশংকা দেখা দেয় তখন প্রকাশ্যে তার চুক্তি মুখের ওপর ছুঁড়ে দাও এবং তাকে এ মর্মে সতর্ক করে দাও যে, এখন তোমাদের সাথে আমাদের আর কোন চুক্তি নেই। এরূপ ঘোষণা ও বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে কোন চুক্তিবদ্ধ জাতির বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম শুরু করে দেয়া মূলত বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। এ নৈতিক বিধি অনুযায়ী চুক্তি বাতিল করার এ সাধারণ ঘোষণা এমনসব গোত্রের বিরুদ্ধে করা হয়েছে যারা অংগীকার করা ও চুক্তিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সমসময় ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাতে এবং সুযোগ পেলেই সকল অংগীকার ও চুক্তি শিকেয় তুলে রেখে শত্রুতায় লিপ্ত হতো। সে সময় যেসব গোত্র শিরকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদের মধ্য থেকে কিনানাহ ও বনী দ্বামরাহ এবং হয়তো আরো এক আধাটি গোত্র ছাড়া বাদবাকি সকল গোত্রের অবস্থা এ রকমই ছিল।
এ দায়িত্ব মুক্তি ও স্পর্কচ্ছেদ সংক্রান্ত ঘোষণার ফলে আরবে শিরক ও মুশরিকদের অস্তিত্বই যেন কার্যত আইন বিরোধী (Out of Law)হয়ে গেলো। এখন আর তাদের জন্য সারাদেশে কোন আশ্রয়স্থল রইল না। কারণ দেশের বেশীরভাগ এলাকা ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের আওতাধীন হয়ে গিয়েছিল। এরা নিজেদের জায়গায় বসে অপেক্ষা করছিল, রোম ও পারস্যের পক্ষ থেকেই ইসলামী সালতানাত কখন বিপদের সম্মুখীন হবে অথবা নবী (সা)কখন ইন্তেকাল করবেন। তখনই এরা অকস্মাত চুক্তি ভংগ করে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করে দেবে। কিন্তু আল্লাহ তার ও তার রসূল (সা) তাদের প্রতীক্ষিত সময় আসার আগেই তাদের পরিকল্পনার ছক উল্টে দিলেন এবং তাদের থেকে দায়িত্ব মুক্তির কথা ঘোষণা করে তাদেরকে তিনটি পথের একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করলেন। এক, তাদের যুদ্ধ করার জন্য তৈরী হতে হবে এবং ইসলামী শক্তির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। দুই, তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। তিন, তাদের ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের বৃহত্তর অংশ আগেই যে শাসন ব্যবস্থার আওতাধীন চলে এসেছে তারই আয়ত্বে নিজেদেরকে ও নিজেদের এলাকাকে সোপর্দ করে দিতে হবে।
এ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রকৃত ও যথার্থ যৌক্তিকতা অনুধাবন করার জন্য আমাদেরকে পরবর্তীকালে উদ্ভুত ইসলাম বর্জন আন্দোলনের দিকে ফেরাতে হবে।আলোচ্য ঘটনার দেড় বছর পরে নবী(সা) ইন্তেকালের পরই দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ অশুভ তৎপরতা ও গোলযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠার ফলে ইসলামের নব নির্মিত প্রাসাদটি আকস্মিকভাবে নড়ে ওঠে। ৯ হিজরীর এ সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণার মাধ্যমে যদি শিরকের সংগঠিত শক্তিতে খতম করে না দেয়া হতো এবং সারাদেশে ইতিমধ্যে ইসলামের নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতা প্রধান্য বিস্তার না করতো, তাহলে হযরত আবু বকর(রা) খিলাফত আমলের শুরুতেই মুরতাদ হওয়ার যে হিড়িক লেগে গিয়েছিল তার চেয়ে অনন্ত দশগুণ বেশী শক্তি নিয়ে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু হয়ে যেতো। এ অবস্থায় ইসলামের ইতিহাসের চেহারাই হয়েতো সম্পূর্ণ পাল্টে যেতো।
সুপ্রিয় পাঠক,লক্ষ্য করুন,রাসুল(সাঃ) আবুবকরের হাত থেকে কুরানের বানীগুলো নিয়ে হযরত আলীকে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আল্লাহর নির্দেশেই-এই মহাসত্য ব্যাপারটি মাওলানা মউদুদী বেমালুম চেপে গেছেন।
তাফসীরে ইবনে কাসীরে সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রনে উপরে উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর করা হয়েছে।