আশুরার দিনে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রথম ভাষণ
আশুরার দিন সকালে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর ঘোড়া আনতে বললেন এবং তা আনা হলে তিনি তার ওপর আরোহণ করলেন। এরপর তিনি ইয়াযীদের অনুগত সেনাপতি ওমর বিন্ সা‘দের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর দিকে মুখ করে উচ্চৈঃস্বরে এমনভাবে আহবান করে তাঁর ভাষণ শুরু করলেন যে, তাদের মধ্যকার অধিকাংশ লোকই তা শুনতে পেল। ইমাম বলতে লাগলেন : ‘হে লোকসকল! আমার কথা শোন এবং (আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য) তাড়াহুড়া কর না যতক্ষণ না আমি তোমাদের সেই বিষয়ে উপদেশ প্রদান করি যে ব্যাপারে আমার ওপর তোমাদের অধিকার আছে এবং যতক্ষণ না আমার পক্ষ থেকে প্রকৃত বিষয় তোমাদের কাছে পেশ করি। অতঃপর তোমরা যদি আমার ওযর কবুল কর, আর আমার কথার সত্যতা স্বীকার কর এবং আমার প্রতি তোমাদের পক্ষ থেকে ইনসাফ কর তাহলে এ কারণে তোমরা অধিকতর সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। সে ক্ষেত্রে আমার ব্যাপারে তোমাদের আর কোন দায়িত্ব থাকবে না। আর তোমরা যদি আমার ওযর কবুল না কর এবং তোমাদের পক্ষ থেকে ইনসাফের পরিচয় না দাও তাহলে (আমি হযরত নূহের ভাষায় বলব) :
فَأَجْمِعُوا أَمْرَكُمْ وَشُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُنْ أَمْرُكُمْ عَلَيْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُوا إِلَيَّ وَلَا تُنظِرُونِ ﴿٧١﴾
অতঃপর তোমরা তোমাদের ও তোমাদের শরীকদের কাজকর্ম গোছগাছ করে নাও যাতে তোমাদের কাজ তোমাদের কাছে অস্পষ্ট না থাকে, অতঃপর আমার ব্যাপারে তোমাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর কর এবং আর অপেক্ষা কর না।’’৯
إِنَّ وَلِيِّيَ اللَّـهُ الَّذِي نَزَّلَ الْكِتَابَ ۖ وَهُوَ يَتَوَلَّى الصَّالِحِينَ
‘‘নিঃসন্দেহে আমার অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ্, যিনি কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছেন এবং তিনি পুণ্যবানদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করবেন।’’১০
এরপর হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) প্রতিপক্ষের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ধরে উচ্চৈঃস্বরে সম্বোধন করে বললেন : ‘হে শাবাছ্ বিন্ রাব্‘ঈ! হে হাজ্জার্ বিন্ আব্জার্! হে কায়স্ বিন্ আশ্‘আছ! হে ইয়াযীদ বিন্ হারেছ্! তোমরা কি আমাকে এ বলে পত্র লিখনি যে, ‘ফল পেকে গেছে এবং যমিন সবুজে ঢেকে গেছে; আপনি যদি আসেন, তাহলে আপনার খেদমতে একটি সুসজ্জিত বাহিনী দেখতে পাবেন?’
তখন কায়স্ বিন্ আশ্‘আছ জবাব দিল : ‘আমরা বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন। তবে আপনি যদি আপনার চাচার গোত্রের১১ ফরমানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তাহলে কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু দেখবেন না।’
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর খিমার (তাঁবুর) নারী ও কন্যারা যখন তাঁর ভাষণ শুনতে পেলেন তখন তাঁরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। হযরত ইমাম (আ.) তাঁদেরকে থামতে বলার জন্য তাঁর ভাই আববাস ও স্বীয় পুত্র আলী আকবারকে নারীদের তাঁবুতে পাঠালেন। তিনি বলে পাঠালেন : ‘আমার প্রাণের শপথ, এরপরে তোমরা আমার জন্য অনেক বেশি ক্রন্দন করবে।’
মহিলারা ও বালিকারা নীরব হলে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় আল্লাহ্ তা‘আলাকে স্মরণ করলেন এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.), পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ ও ফেরেশতাগণের প্রতি দরূদ পাঠালেন। এরপর তিনি তাঁর ভাষণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলেন :
‘তোমরা আমার নসবের (বংশ পরম্পরার) বিষয়টি স্মরণ কর, ভেবে দেখ, আমি কে। তোমাদের হুঁশ হোক; তোমরা নিজেদের ধিক্কার দাও এবং ভেবে দেখ যে, আমাকে হত্যা করা এবং আমার মর্যাদা বিনষ্ট করা কি তোমাদের জন্য জায়েয?’
‘আমি কি তোমাদের রাসূলের কন্যার পুত্র নই? আমি কি তাঁর (রাসূলের) স্থলাভিষিক্ত ও চাচাত ভাইয়ের পুত্র নই- যিনি সকলের আগে ঈমান এনেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যা এনেছিলেন তার সত্যতা স্বীকার করেছিলেন?’ ‘সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা হামযাহ্ কি আমার চাচা১২ নন?’ ‘জা‘ফর তাইয়ার- আল্লাহ্ তা‘আলা যাঁকে কারামতস্বরূপ দু’টি পাখা দিয়েছেন যাতে তিনি তা দিয়ে বেহেশ্তের ভিতরে উড়তে পারেন, তিনি কি আমার চাচা নন?’ ‘তোমরা কি জান না যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এরশাদ করেছেন : ‘এ দু’জন হচ্ছে বেহেশ্তে যুবকদের নেতা।’?’
‘তোমরা যদি আমার কথায় বিশ্বাস করতে না পার এবং আমার কথার সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করে থাক, তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলার শপথ করে বলছি, যখন থেকে জেনেছি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মিথ্যাবাদীকে তাঁর দুশমন হিসাবে গণ্য করেন তখন থেকে কখনই মিথ্যা কথা বলিনি। তোমাদের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা তাদের সত্যবাদিতার জন্য সুপরিচিত, তারা আমার কথার সত্যতা স্বীকার করবে। তোমরা জাবের বিন্ আবদুল্লাহ্ আনসারী, আবু সা‘ঈদ খুদরী, সাহল্ বিন্ সা‘দ্, যায়দ্ বিন্ আর্ক্বাম্ ও আনাস্ বিন্ মালেকের কাছে জিজ্ঞাসা কর যাতে তারা আমার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছ থেকে যা শুনেছেন তা তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন। তাহলে তোমাদের কাছে আমার কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। এসব সাক্ষ্য কি আমার রক্তপাত ঘটানো থেকে তোমাদের বিরত থাকার জন্য যথেষ্ট নয়?’
( হায়াতুল ইমামিল্ হুসাইন, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৮৪)