নাফ্স্ সমূহ কি পূর্বসৃষ্ট ?

” নাফ্স্ সমূহ কি পূর্বসৃষ্ট ? ”

মুসলিম সমাজের বেশীর ভাগ মানুষই চৈন্তিক দিক থেকে অদৃষ্টবাদী, যদিও তারা তাদের কাজের মাধ্যমে এখতিয়ারী হবার প্রমাণ দেয়। (এ সম্পর্কে আমি আমার “অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম” গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি – যা ধারাবাহিক নোট আকারে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে।) অদৃষ্টবাদী ‘আক্বীদাহ্ কয়েক ধরনের – যার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা অনাদি কালে সৃষ্টিকর্মের সূচনার সময়ই তাঁর ভবিষ্যত বান্দাহদের সকলের জন্মগ্রহণের বিষয়টি ও তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে রাখেন। সুতরাং পৃথিবীতে যতো মানুষের আগমন ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে তার সবই পূর্বনির্ধারিত। শুধু তা-ই নয়, তাদের আত্মা (নাফ্স্) সমূহ পূর্বসৃষ্ট। ক্বিয়ামত পর্যন্ত যতো মানুষের জন্ম হবে তাদের আত্মা (নাফ্স্) সমূহ যে পূর্বসৃষ্ট Ñ এ ধারণার যথার্থতা প্রমাণের জন্য নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ের উল্লেখ করা হয় :
وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ.
“আর (হে রাসূল!) যখন আপনার রব্ বানী আদম থেকে তথা তাদের পৃষ্ঠদেশ থেকে আগত তাদের সন্তানদেরকে পাকড়াও করলেন এবং (তাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন – যাতে) তাদের নিজেদের ওপরে তাদেরকে সাক্ষী করলেন – (তিনি তাদেরকে বললেন 🙂 “আমি কি তোমাদের রব নই?” তখন তারা বললো : “অবশ্যই; আমরা সাক্ষ্য দিলাম।” (আল্লাহ্ তাদেরকে বলেন : আমি এ কারণে তোমাদের থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে,) পাছে ক্বিয়ামতের দিনে তোমরা বলো : “নিঃসন্দেহে আমরা এ সম্পর্কে অসাবধান (গ্বাফেল) ছিলাম” অথবা বলো : “নিঃসন্দেহে আমাদের পূর্বপুরুষরা পূর্ব থেকেই শিরক্ করেছিলো এবং আমরা হলাম তাদের পরবর্তী বংশধর (তাই তাদের অনুসরণে র্শিক্ করেছি); বাত্বিলের অনুসারীরা যা করেছে সে জন্য কি তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করবে?” (সূরাহ্ আল্-আ‘রাাফ্ : ১৭২-১৭৩)
বলা হয় যে, এ অঙ্গীকার গ্রহণের ঘটনা ঘটেছিলো হযরত আদম (‘আঃ)কে পৃথিবীর বুকে পাঠানোর আগে যখন তিনি ও হযরত হাওয়া (‘আঃ) বেহেশতে ছিলেন। বলা হয়, তাঁদের বংশে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যতো মানুষ জন্ম নেবে তাদের সকলের রূহ্ (প্রকৃত পক্ষে “নাফ্স্”) আল্লাহ্ তা‘আলা আগেই সৃষ্টি করে রেখেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকেই এ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু উল্লিখিত আয়াত দু’টিতে তা বলা হয় নি। বরং হযরত আদম ও হযরত হাওয়াকে (‘আঃ) পৃথিবীতে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্য পাঠাবার পরে তাঁদের দু‘জনের সন্তানদের বংশধরদের কাছ থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ (বানী আদম থেকে তথা তাদের পৃষ্ঠদেশ থেকে আগত তাদের সন্তানদের থেকে) বলায় এটা সুস্পষ্ট। তাছাড়া ذُرِّيَة বলতে দেহ বিহীন নাফস্-কে বুঝানো হয় না, বরং শরীর ও নাফ্স্ বিশিষ্ট মানবসন্তানকে বুঝানো হয়। যেভাবে ধরে নেয়া হয়েছে যে, জন্মপূর্ববর্তী দেহ বিহীন নাফস্-এর কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিলো (যদিও মানবসন্তানের জন্মগ্রহণের আগে তার নাফস্-কে সৃষ্টি করা হয়েছে Ñ এ ধারণার সপক্ষে কোনোই প্রমাণ নেই) তাকে যদি আমরা যুক্তির খাতিরে সঠিক বলে ধরে নেই তাহলেও এটা সুস্পষ্ট যে, এ ধরনের অঙ্গীকারের কোনো মূল্য নেই। কারণ, মানুষ তার সহজাত জ্ঞানের দ্বারা এ ধরনের কোনো অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করতে পারে না। ফলে এ অঙ্গীকার থেকে উদ্ভূত দায়িত্ব পালন না করার কারণে তাকে পাকড়াও করা যেতে পারে না। বরং পৃথিবীর বুকে নাফ্স্ ও রক্তমাংসের শরীরের অধিকারী মানুষ যে অঙ্গীকার করে তার জন্যই সে দায়িত্বশীল, তেমনি তারা তা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সমূহকে জানালে পরবর্তী প্রজন্ম সমূহও এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল। অন্যদিকে এ অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা যে কারণ উল্লেখ করেছেন তা থেকেও প্রমাণিত হয় যে, এ অঙ্গীকার পৃথিবীর বুকে নাফ্স্ ও রক্তমাংসের শরীরের অধিকারী মানুষের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছিলো। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে এ অঙ্গীকার গ্রহণের কারণ সম্পর্কে বলেন : أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ – পাছে ক্বিয়ামতের দিনে তোমরা বলো : “নিঃসন্দেহে আমরা এ সম্পর্কে অসাবধান (গ্বাফেল) ছিলাম” অথবা বলো : “নিঃসন্দেহে আমাদের পূর্বপুরুষরা পূর্ব থেকেই শিরক্ করেছিলো এবং আমরা হলাম তাদের পরবর্তী বংশধর (তাই তাদের অনুসরণে শিরক্ করেছি)।” এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ অঙ্গীকার যখন গ্রহণ করা হয় ততোদিনে হযরত আদম (‘আঃ)-এর বংশধরদের মধ্যে কিছু লোক শিরকে নিমজ্জিত হয়েছিলো। তাই স্বয়ং হযরত আদম (‘আঃ)-এর মাধ্যমে অথবা তাঁর বংশে আগত অন্য কোনো নবীর মাধ্যমে হযরত আদম (‘আঃ)-এর নাতি-নাত্নী ও তাদের বংশধরদের কাছ থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিলো।
বি.দ্র : অত্র আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক না হলেও উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি যে, আমাদের মতে, নবী-রাসূলগণ (‘আঃ) সহ আল্লাহ্ তা‘আলার কতক খাছ্ব বান্দাহর সৃষ্টির বিষয়টি আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিপরিকল্পনায় পূর্বনির্ধারিত ছিলো এবং অন্য মানুষদের সৃষ্টির বিষয়টি কারণ ও ফলশ্রুতি (Cause and Effect – علت و معلول) বিধির আওতায় শর্তাধীন ও অনিশ্চিত ছিলো।

নুর হোসেন মজিদী ।
(২০শে জুলাই ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.