হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) এর ইবাদত দর্শন

ভূমিকা
নবীকন্যা ও বেহেশ্তে নারীদের স¤্রাজ্ঞী হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা। মাত্র আঠারো বছরের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালে তিনি জীবনের প্রত্যেকটি অঙ্গনে এমনভাবে কদম রেখেছেন যে, পরম উপাস্যের একত্বের সৌন্দর্য সত্তার শুভ্র তাজাল্লি তাঁর প্রাণের দর্পণে প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে আয়াত-ই তাতহীর [সূরা আহযাব : ৩৩] অবতীর্ণের মাধ্যমে তিনি নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপত্বের মহামূল্যবান মর্যাদার খেতাবটি অর্জন করে নিতে সক্ষম হন। আল্লাহর ইবাদত করাকে তিনি নিজ জীবনের সাথে এমন নিগুঢ়ভাবে মিশিয়ে নেন যে তার সুবাদে তিনি বিরল এক মাকামের অধিকারী হন। সে মাকামটি হলো ‘তাঁর সন্তুষ্টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির কারণ এবং তাঁর অসন্তুষ্টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অসন্তুষ্টির কারণ’ হওয়া। ইবাদতের প্রভাবে তাঁর সত্তা এমন ভাবে মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার তাজাল্লির প্রকাশস্থলে পরিণত হয় যে, তাঁকে কষ্ট দেওয়া স্বয়ং আল্লাহকে কষ্ট দেওয়ার শামিল হয়ে দাঁড়ালো। এ কারণে অত্র প্রবন্ধে আমরা হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা’র ইবাদত দর্শনের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা উপস্থাপন করার চেষ্টা করব। যাতে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির দর্শনের সাথে ইবাদতের সম্পর্কটা জানা যায়। তবে মূল পর্যালোচনায় প্রবেশ করার আগে সংক্ষেপে ইবাদত ও তার প্রভাব সম্পর্কে কিছু ধারণা বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, যা হযরত ফাতিমা যাহরা সালামুল্লাহি আলাইহা’র ইবাদত দর্শনকে সহজে বুঝতে সাহায্য করবে।
ইবাদত-এর অর্থ
ভাষাতত্ত্ববিদগণের অনেকের অভিমত হলো ‘ইবাদত’ কথাটির অর্থ হচ্ছে কথায় ও কর্মে উভয় দিক হতে ‘বিনয়শীল থাকা’ অথবা ‘পরম বিনয়’ প্রকাশ করা, তবে তা অবশ্যই আল্লাহকে উপাস্য হিসাবে বিশ্বাস রেখে এবং তাঁর নৈকট্য লাভের সংকল্প সহকারে হতে হবে। এ কথা থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, ইবাদত যতই বিনয় ও অবনত হওয়ার প্রকাশ হোক না কেন, তাই বলে যে কোন বিনয় ও অবনত হওয়াকে ‘ইবাদত’ বলে আখ্যায়িত করা যায় না। উপাস্য হিসাবে বিশ্বাস পোষণ এবং তাঁর নৈকট্য অর্জনের সংকল্পÑ এ দুটি বিষয় ইবাদতের অনিবার্য শর্ত।
আর আভিধানিক ভাবে ‘আব্দ’ তথা ইবাদতকারী সেই ব্যক্তিকেই বলা হয় যে আপাদমস্তক স্বীয় মনিব তথা মাওলার সাথে সম্পৃক্ত। তার ইচ্ছা মনিবের ইচ্ছাধীন। তার চাওয়াও মনিবের চাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সে মনিবের বিপরীতে নিজেকে কোন কিছুর মালিক বলে মনে করে না। আর মনিবের আনুগত্য করতে কোন শৈথিল্যও সে প্রদর্শন করে না। মোটকথা, ইবাদত তথা বন্দেগি হচ্ছে সেই পরম সত্তার প্রতি নিরঙ্কুশ বিনয় জ্ঞাপন, যিনি সকল কিছুর উৎসমূল। একারণে একমাত্র সেই সত্তাই ‘উপাস্য’ হতে পারেন, যিনি সকল অনুগ্রহ ও অনুকম্পার নিরঙ্কুশ দাতা। এক আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ সেই যোগ্যতার অধিকারী নয়। বান্দার দিক থেকে তাই বন্দেগি হলো একজন মানুষের আত্মিক পূর্ণতার চূড়ান্ত মাত্রা এবং মাবুদের সাথে তার নৈকট্যের প্রকাশ।
ইবাদতের স্বরূপ ও তাৎপর্য
ইবাদতের সারকথা হলো মানুষ আল্লাহর পবিত্র সত্তা ব্যতীত অন্য কাউকে উপাসনার উপযুক্ত বলে জানবে না, একমাত্র তাঁরই আদেশ মেনে চলবে এবং সর্বদা তাঁকেই স্মরণ করবে। আর সুখে-দুঃখে সকল বিষয়ে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টিকেই বিবেচনায় রেখে চলবে। এ অর্থে বান্দার ইবাদত কখনো কখনো নামায, রোযা, হজ ও যাকাতের ন্যায় বিশেষ আমলসমূহ পালনের মাধ্যমে; আবার কখনো কখনো মিথ্যাচার, গীবত, ব্যভিচার, হত্যা ইত্যাদি বিশেষ কিছু পাপাচারমূলক কাজ হতে বিরত থাকার মাধ্যমে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
এই ইবাদতের জন্যই আল্লাহ জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন [وَ ما خَلَقْتُ الْجِنَّ وَ الإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ] । নবী রাসূলগণের প্রেরণের উদ্দেশ্যও ছিল মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানানো [وَ لَقَدْ بَعَثْنا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ]। মানুষ যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন, বাস্তবতা হলো মানুষের জন্য ইবাদত তথা বন্দেগির মাকামই হচ্ছে সবচেয়ে উঁচু মাকাম। ইবাদতের মাধ্যমেই মানুষ আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর মাকামে পৌঁছতে সক্ষম হয়। নবী-রাসূলগণ ও ওলি-আউলিয়াগণ সকলেই এই ইবাদত ও আনুগত্যের পথ ধরেই আধ্যাত্মিকতার শিখরে উপনীত হতে পেরেছেন। আর এ কারণেই নামাযের তাশাহুদে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর রাসূল হওয়ার আগে তাঁর বান্দা হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করা ফরয করা হয়েছে [اشهد أن محمدا عبده و رسوله]।
ইবাদত মানুষকে আত্ম-সংশোধন ও আত্মিক পবিত্রতা দান করে, চিত্তে প্রশান্তি আনে, আল্লাহর নৈকট্যের মাকামে পৌঁছে দেয় এবং বান্দাকে সৃষ্টি জগতের ওপর কর্তৃত্ব শক্তির অধিকারী করে তোলে। তখন সে আল্লাহর অনুমতিক্রমে অলৌকিক কর্মকা- সম্পন্ন করতে পারে। এমর্মে একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে বর্ণিত হয়েছে : [وَ مَا تَقَرَّبَ إِلَي عَبْدٌ بِشَيْ‏ءٍ أَحَبَّ إِلَي مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَ إِنَّهُ لَيَتَقَرَّبُ إِلَي بِالنَّافِلَةِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَ بَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَ لِسَانَهُ الَّذِي يَنْطِقُ بِهِ وَ يَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا إِنْ دَعَانِي أَجَبْتُهُ وَ إِنْ سَأَلَنِي أَعْطَيْتُهُ وَ مَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْ‏ءٍ أَنَا فَاعِلُهُ كَتَرَدُّدِي عَنْ مَوْتِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَ أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ] ‘আমার নৈকট্যের সবচেয়ে উত্তম উসিলা হলো ফরযসমূহকে পালন করা। আর মুস্তাহাবসমূহ পালনের মাধ্যমে সে আমার মুহব্বত অভিমুখে অগ্রসর হতে পারে, যতক্ষণ না আমিও তাকে ভালোবাসি। অবশেষে আমি যখন তাকে ভালোবাসি, তখন আমিই হই তার কান যা দ্বারা সে শোনে, আমিই হই তার চোখ যা দ্বারা সে দেখে, আমিই হই তার জিহ্বা যা দ্বারা সে কথা বলে এবং আমিই হই তার হাত যা দ্বারা সে প্রহার করে। সে যখন আমার কাছে দোয়া প্রার্থনা করে, আমি তা মঞ্জুর করি এবং সে যখন আমার কাছে কিছু চায়, আমি তা প্রদান করি।’
ফাতিমা (সা. আ.) শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারিণী
হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা সম্পর্কে মানুষ যত বেশি চিন্তা করবে এবং তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে যত বেশি অনুধ্যান করবে, ততই সে বিস্ময়ের সম্মুখীন হবে। কীভাবে একজন নারী দুনিয়ায় মাত্র আঠারো বছর আয়ুষ্কালের মধ্যে এমন আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছতে সক্ষম হন যে, তাঁকে সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে পরিচয় দেওয়া হবে। হযরত ফাতিমা রাসূলের কন্যা হিসাবে নয়, বরং আল্লাহর জযবায় বিগলিত এবং তাঁর আনুগত্যে আত্ম-নিবেদিত হিসাবেই আধ্যাত্মিকতার পরম শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) বলেন, হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার চেয়ে অধিক ইবাদতকারী আর কেউ ছিল না। তিনি এত বেশি ইবাদতে দ-ায়মান হতেন যে তাঁর পদযুগলে কড়া পড়ে যেত। [বিহারুল আনওয়ার, খ. ৩, পৃ. ৬১] হাসান বসরী, যিনি একজন অধিক ইবাদতকারী এবং অতিশয় পরহেযগার মানুষ হিসাবে পরিচিত, তিনি হযরত ফাতিমা সম্পর্কে বলেন : নবীদুহিতা এত বেশি ইবাদতে মশগুল হতেন এবং নামাযের মেহরাবে দ-ায়মান হতেন যে, তাঁর পদযুগলে কড়া পড়ে গিয়েছিল।
হযরত ফাতিমার ভীত-বিহ্বল ও বিনয়ী চিত্ত
তাঁর নামায ও ইবাদতের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল আন্তরিক ভীতি ও বিনয়শীলতা। আবু মুহাম্মাদ দেইলামি ‘ইরশাদ-উল কুলুব’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেন : كانت فاطمة تنهج فى صلواتها من خوف الله ‘নামাযের হালে আল্লাহর ভয়ে ফাতিমার নিঃশ্বাস যেন গুণে গুণে নির্গত হতো।’ [ইরশাদ-উল কুলুব, খ. ১, পৃ. ১০৫] রেওয়ায়াতে এসেছে যে, আল্লাহ ফেরেশতাদের ডেকে বলেন : তাকিয়ে দেখ আমার কানিজ ফাতিমার দিকে, কীভাবে সে আমার সম্মুখে দ-ায়মান হয়েছে, আমার ভয়ে তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে এবং নিজের অন্তরাত্মা দিয়ে আমার ইবাদতে মশগুল হয়েছে! [ফাতিমা মিনাল মাহদ-ই ইলাল লাহদ, পৃ. ১৭৩]
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হযরত ফাতিমা ছিলেন চৌদ্দ মাসুমের মধ্যে একজন এবং পাঁচ পঞ্জতনের অন্যতম বাতি। ইবাদতের হালে তাঁর এ ভীতির কারণ অন্য কিছু ছিল না, কেবল মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর পূর্ণ মারিফাত তথা বাতেনী জ্ঞান ও পরিচিতি ব্যতীত। আল্লাহর ওলি-আউলিয়াগণের ভীতি তখনই সৃষ্টি হয় যখন তাঁরা মাবুদের পরম সত্তার মহিমা, শান ও মহান অভিব্যক্তির সাক্ষাৎ পেয়ে যান। তখন তাঁরা এ ব্যাপারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন, না জানি কোন পর্দা এসে তাঁর ও তাঁর প্রেমাস্পদের মাঝে অন্তরাল হয়ে দাঁড়ায়!
আর এ অবস্থা ঐ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ছাড়া সৃষ্টি হয় না যাঁরা মহামহিমের বিশালতা ও তাঁর নৈকট্যের অপার্থিব স্বাদ আস্বাদন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। একারণে মহান আল্লাহ বলেন :انما یخشی الله من عباده العلماء – আল্লাহর বান্দাদের মধ্য হতে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁর ভয় করে। সুতরাং এখানে ‘ভয়’ কথাটি একটি বিশেষ অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। আর হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা ও অন্য মাসুম ইমামগণ (আ.) এর ভয় হলো সেই শ্রেণিভুক্ত।
নামাযের হালে হযরত ফাতিমার ভীতি ও বিনয়
মহান আল্লাহর সনে দ-ায়মান হওয়া ও নামায আদায় করার জন্য হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার একটি নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। বিশেষ পরিচ্ছদে, বিশেষ জায়নামাযের ওপর বিশেষ আদবের সাথে এমনভাবে তিনি ইবাদতে মশগুল হতেন যে, তাঁর ঘরই তাঁর জন্য মসজিদে পরিণত হয়। ইবাদতের হালে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য আকাশের ফেরেশতারা সেখানে ভীড় জমাতো। এ সময়ে তিনি এমনই বিনয়াবনত ও ভীত অবস্থায় থাকতেন যেন ঈমানের নির্যাস তাঁর অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে।
স্বয়ং আল্লাহও আপন বান্দাদের কাছে এরূপ বিনয় ও ভয় চান। হযরত মূসা (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন : ‘হে ইমরানের পুত্র! তোমার হৃদয় হতে আমাকে ভয় দাও। আর তোমার দেহ হতে আমাকে বিনয় দাও। আর তোমার চক্ষু হতে রাতের আঁধারে আমাকে অশ্রু দান করো। আর আমাকে ডাকো। নিশ্চয় তুমি আমাকে নিকটেই পাবে সাড়াদানকারী হিসাবে।’ [আমালি আস-সাদুক : ২১৫]
আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ.) বলেন : এ ভয় পরাভূত ব্যক্তিদের মধ্যে উৎপত্তি লাভ করা এক বিশেষ চিহ্ন, যখন সে এক অপরাজেয় দুর্দান্ত প্রতাপশালী সুলতানের বিপরীতে এমনভাবে উপস্থিত হয় যে, তার সমস্ত মনোযোগ ও ধ্যান-জ্ঞান তাঁর দিকেই নিবিষ্ট হয়। আর অন্য সবকিছু হতে তার মনোসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা ছিলেন তেমনই একজন। তিনি নামাযে দ-ায়মান হয়ে শুধু আল্লাহর ইবাদতের কথাই ভাবতেন। মাবুদ আল্লাহর প্রতি প্রেমভক্তি ও উপাসনা ব্যতীত অন্য কোন স্মৃতি বা চিন্তা তাঁর মনে উঁিক দিত না। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভাষায়, তার অন্তর কেবল ইবাদতের জন্যই শূন্য ছিল। কেবল সে ছিল আর তাঁর মাবুদ। জীবন কিরূপ, কীভাবে নির্বাহ করতে হবে এসব চিন্তা থেকে সে ছিল পুরোপুরি মুক্ত। [দার মাকতাবে ফাতেমা, পৃ. ১৭০]
ইবাদতের আকুল আকাক্সক্ষা
হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা আল্লাহর বন্দেগিতে ডুবে থাকতেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন : ‘কন্যা আমার! তুমি আল্লাহর নিকট হতে এমন কিছু চাও যা জিবরাইল আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ হযরত ফাতিমা আরজ করলেন : ‘একমাত্র আল্লাহর বন্দেগি করার তৌফিক ছাড়া আমার আর কোন মনোস্কামনা নেই। আমার আকাক্সক্ষা শুধু এটুকু যেন আল্লাহর ‘ওয়াজ্হ’ তথা চেহারায় তাকাতে পারি এবং তাঁর সৌন্দর্য দর্শনে মুগ্ধ হতে পারি।’ [আল-কাফি, হাদিস নং ৫৩৬]
কেনই বা তিনি এরূপ ইবাদতপরায়ণ হবেন না, যখন তিনি লালিত পাালিত হয়েছেন এমন ব্যক্তির ক্রোড়ে যিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী। যে নবী এত দীর্ঘক্ষণ ধরে নামাযে দ-ায়মান থাকতেন যে, স্বীয় প্রতিপালক তাঁকে বললেন হলেন : ‘ত্বা-হা, আমি আপনাকে কষ্টে নিপতিত করার জন্য এ কোরআন আপনার ওপর অবতীর্ণ করি নি।’ [ত্বা-হা : ১-২] হযরত ফাতিমাও ইবাদতের মর্যাদা ও মূল্যমানকে মহাপ্রতিপালকের প্রতি তাঁর সুগভীর মা’রিফাতপ্রসূত বলেই জানতেন। কাজেই এখানে আশ্চর্য ও বিস্ময়ের কোন অবকাশ নেই যে, কেন এ মহিয়ষী নারী ইবাদত হতে এত বেশি মাত্রায় মজা উপভোগ করতেন। আর কেনই বা তিনি মহান আল্লাহর খাতিরে দীর্ঘ ক্ষণ ধরে দ-ায়মান হয়ে নিজেকে কষ্টে নিক্ষেপ করতেন এবং বিনয় ও হীনতা প্রকাশ করতেন। একটিবারের জন্যও তিনি এ কিয়াম, রুকু ও সিজদার কঠিন সাধনা চালিয়ে যেতে অসন্তুষ্ট হননি।
উপসংহার
তাঁর ইবাদতের গুণ বন্দনার কথা রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে। ‘ইলালুশ শারা’য়ি’ গ্রন্থে এসেছে : ‘তিনি যখন ইবাদতে দাঁড়াতেন, একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আসমানের বাসিন্দাদের জন্য আলো ছড়াতেন।’ [খ. ১, পৃ. ২১৫] নামাযের প্রতি এ তাঁর এ প্রবল আকর্ষণের কারণে এক পর্যায়ে হযরত জিরবাইল তাঁকে বিশেষ এক নামাযের তা’লিম দেন। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : ‘আমার মা ফাতিমা সর্বদা জিবরাইল তাঁকে যে দু’রাকাত নামায শিখিয়ে দিয়েছিলেন, তা আদায় করতেন। প্রথম রাকাতে সূরা হাম্দের পরে একশ’ বার সূরা কাদ্র এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা হাম্দের পরে একশ বার সূরা তাওহীদ পাঠ করতেন। অতঃপর সালাম ফিরিয়ে তাসবীহাতে যাহরা পাঠ করতেন।’
হযরত ফাতিমা ইবাদত-বন্দেগির পথে অনেক সৃজনশীলতারও স্বাক্ষর রেখে গেছেন। যেমন প্রথম দিকে তিনি একটি সুতায় ৩৪টি গিরা দিয়ে তা তাসবীহ হিসাবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু হযরত হামযা সাইয়্যেদুশ শুহাদার শাহাদাত বরণের পর তাঁর কবর হতে সংগ্রহ করা মাটি হতে পুঁথি বানিয়ে সুতায় গেঁেথ সেটাকেই তাসবীহ হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করেন। এরপর থেকে মানুষের মধ্যে তাসবীহ ব্যবহারের প্রচলন লাভ করে। [ওয়াসায়িলুশ শিয়া, খ. ১৪, পৃ. ১০৩৩]

–আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.