আত্মসংযমের উপকারিতা : মানুষ অত্যাশ্চর্য সব রহস্যে ঘেরা এক জীবন্ত সত্তা। সে দুটি বৃহৎ শক্তিতে বলীয়ান। সেগুলো হলো যুক্তি এবং ইচ্ছাশক্তি। যুক্তি হলো এমন একটি আলো বা জ্ঞান যা এই জীবনে মানবাত্মার ভাগ্য বা পরিণতি নির্ধারণ করে। এটা মানুষের বাস্তব ব্যক্তিত্বের প্রতিনিধি এবং উজ্জ্বল আালোকচ্ছটা যা জীবনের স্তরগুলোকে আলোকিত করে রাখে। সুতরাং এই যুক্তির নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধান ছাড়া আমরা জীবনের এ ক্রমবর্ধমান জটিল পথে অগ্রসর হতে পারি না।
মানুষকে তার মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন প্রকার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা হলেই এগুলো অতিমাত্রায় বা স্বল্প মাত্রায় আত্মপ্রকাশের অবকাশ পাবে না। যুক্তি হলো এমন শক্তি যা আমাদেরকে সুস্থ অনুভূতিসমূহ প্রকাশের যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি শিক্ষা দেয় এবং আমাদেরকে কামনা ও অভিলাষের বশবর্তী হওয়া থেকে রক্ষা করে।
বস্তুতপক্ষে যুক্তির আলোকে যদি আমাদের অনুভূতিগুলো আলোকিত হয় তাহলে এটা নিশ্চিত যে, সুখের আলোকরশ্মি আমাদের জীবনে কিরণ ছড়াবে। ঠিক এরই বিপরীতে আমরা যদি আমাদের কামনা-বাসনার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ি তাহলে আমরা দুর্বল হয়ে যাব এবং পরিণামে আমাদের জীবনক্ষেত্রে নেমে আসবে চরম পরাজয়।
মানুষের ইচ্ছাশক্তি হলো অন্যতম প্রধান প্রভাবশালী নৈতিক উপাদান এবং মহৎ লক্ষ্য হাসিলের জন্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির মৌল ভিত্তির সাথে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই ইচ্ছাশক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বকে যে কোন প্রকার নোংরামি ও অবমাননাকর অবস্থা থেকে রক্ষা করে।
একটি প্রবল ইচ্ছাশক্তি একটি সুখী জীবনে নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করে। একজন মানুষের জীবনে যেসব ঘটনা জটিল পরিণতি ডেকে আনতে পারে এ ইচ্ছাশক্তি সেগুলোকে প্রতিহত করতে সাহায্য করে। আমরা যতই এই ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালাব ততই নৈতিক উৎকর্ষ সাধনে আমরা সফল হব। দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে পারব। আমাদের হৃদয় আমাদের অন্তঃকরণ তখন বিশৃঙ্খলামুক্ত হয়ে পরম প্রশান্ত হয়ে উঠবে।
একজন পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ এই বিষয়ের ওপর নিম্নলিখিতভাবে মন্তব্য করেন : ‘যুক্তির একটি সুন্দর সংজ্ঞা রয়েছে যাতে সুন্দর সামঞ্জস্য ফুটে উঠেছে। সংজ্ঞাটি হলো এই যে, যুক্তি হলো সাংগঠনিক শক্তি। এটা অনেকটা গাড়ির স্টিয়ারিং এর মতো কাজ করে পুরুষ এবং নারী উভয়কেই পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। এটা এমন এক ব্যবস্থা যা অকস্মাৎ সংঘর্ষ বা সড়ক দুর্ঘটনার কারণে সৃষ্ট আঘাতকে হজম করে নেয়। এটা যাত্রীদেরকে আরামদায়ক ভ্রমণ দান করে এবং এমনকি কঠিন দুর্গম পথেও নিরাপদ ভ্রমণের নিশ্চয়তা দেয়।’
অপরাধ হলো সামঞ্জস্যহীন ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। যখন কোন ব্যক্তি তার নিজের যুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তখন স্বাভাবিকভাবেই সে তার ইচ্ছাশক্তির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। যুক্তি দ্বারা যে শাসিত হয় না, সে শুধু জীবনে সৃজনশীল উপাদান হিসেবে নিজের ভূমিকাটুকু হারায় না, উপরন্তু সে সমাজে এক বিপজ্জনক সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ক্রোধ মানুষকে এমন করে গড়ে তোলে যেন সে দুই বিশাল পর্বতমালার মাঝখানে ধাবমান এক ছোট্ট স্রোতস্বিনী। মহৎ ব্যক্তিগণ যাঁরা নৈতিক উৎকর্ষের অধিকারী তাঁরা হলেন সেই সব নদীর মতো যেগুলো কোন প্রকার ক্ষিপ্ততা ও প্রচ-তা ছাড়াই সাগরে প্রবাহিত হয়।
শক্তিশালী প্রকৃতির জন্য চাই দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি যাতে তা আত্মাকে অতিক্রম করে সীমা ছাড়িয়ে যেতে না পারে। ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তির অভাব থাকলে কোন বিপদ-আপদে বা চাপের মুখে তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সে অযথা বিপদের সম্মুখীন হয়।
ক্রোধের বিচিত্র পরিণতি : একটি মানসিক অবস্থা যা কারো স্বাভাবিক মনোভাবের দিক পরিবর্তন করে তা হলো ক্রোধ বা রাগ। এই ক্রোধ মানুষের ওপর যখন প্রভাব বিস্তার করে তখন তা ঔদ্ধত্যের রূপ পরিগ্রহ করে, মানুষকে প্রতিপক্ষের প্রতি অহেতুক অন্যায় আচরণে প্ররোচিত করে। ক্রোধের পর্দা মনকে অন্ধ করে দেয় এবং মানুষকে নিরেট এক জানোয়ারে রূপান্তরিত করে। এর প্রভাবে মানুষ অপরাধ করে যা তার জীবনে চিরস্থায়ী কালিমা লেপন করে দেয়। তারপর যখন সে তার ভুল বুঝতে পারে এবং কাল্পনাতীত পরিণতির সম্মুখীন হয় তখন হতাশার অন্ধ গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এই অশুভ লক্ষণটি শুধু দুঃখের দিকেই ঠেলে দেয়। এই ‘নিন্দনীয় আত্মা’র বহিপ্রকাশ ঘটলে ব্যক্তির হীন কার্যাবলি লজ্জাকর পরিস্থিতির অবতারণা করে এবং নিজের যুক্তি প্রদর্শন ও সচেতনতায় আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। যুক্তি প্রদর্শনে দুর্বলতার পরিণতি যখন উপলব্ধি করা হয় তখন দুঃখ-দুর্দশার উত্তাল তরঙ্গ কঠিন বেদনার সাথে জোড় বেঁধে আবির্ভূত হয় হৃদয়ের ভেতরে আর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বাইরে। এই ধরনের বৈরী প্রভাবের মোকাবিলায় এমনকি শারীরিক এই দেহ কাঠামোও অসহায়। কারণ, এটাই তো আত্মার বাসস্থান।
এটা জানা দরকার যে, সঠিক অনুপাতে ক্রোধের শক্তিও দরকারী। সুনির্দিষ্ট পন্থায় ক্রোধ শৌর্য বীর্যের পরিচায়ক হতে পারে। যে ক্রোধ মানুষকে অত্যাচারের প্রতিবাদে এবং নিজের অধিকার রক্ষায় সাহায্য করে সেই ধরনের ক্রোধে কোন দোষ নেই। তা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মাত্র।
প্রতিশোধস্পৃহা যা অনেক সময় ক্রোধের সাথে সম্পর্কিত তা মানব জীবনকে হতাশায় নিক্ষেপ করে। সকল পরিস্থিতিতে যদি আমরা দুষ্টকে দুষ্টামির দ্বারা মোকাবিলা করি এবং অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করি তাহলে আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তর্ক-বিতর্ক ও মতবিরোধে অপচয় হয়ে যাবে। সর্বোপরি এর ফলে আমরা স্বাধীন ভূমিকা নেয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলব এবং অবমাননাকর অবস্থা বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের।
মানুষ প্রায়ই ভুল-ভ্রান্তির শিকার। কাজেই যদি আমাদের কার্যাবলি কাউকে রাগান্বিত করে তাহলে তার রাগ প্রশমিত করার সর্বোত্তম পন্থা হলো নিজেদের ভুল তার সামনে অকপটে স্বীকার করা।
ড. ডেল কার্নেগী বলেন : ‘যদি আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, আমরা নিজেরা শাস্তি বা তিরস্কারের যোগ্য তাহলে নিজেদের দোষ স্বীকার করাই কি আমাদের জন্য উত্তম নয়? অন্যরা আমাদের তিরস্কার করার চেয়ে নিজেরা নিজেদের তিরস্কার করা কি অধিক সহনীয় নয়? তাহলে চলুন আমরা নিজেদের দোষ স্বীকারের কাজ শুরু করি যাতে আমাদের শত্রুরা তাদের নিজেদের হাতিয়ার ব্যবহার থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে। এইভাবে আমরা শতকরা ৯০ ভাগ গ্যারান্টি দিতে পারি যে, নিজেদের দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যেতে ক্ষমাশীলতা এবং ইচ্ছাশক্তি অর্জন করতে পারব। সকলেই তার দুর্বলতা লুকিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু একজন মহৎ ব্যক্তিই শুধু নিজের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করার গৌরব বোধ করেন। যখন আমরা বুঝতে পারি আমরা সত্য সঠিক রয়েছি তাহলে আমাদের ওপর অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এমন সুযোগ এবং পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে অন্যরা আমাদের পাশে জয়লাভ করার সুযোগ পায়। অপরপক্ষে আমরা যদি ভুল-ভ্রান্তিতে থাকি তাহলে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হলো সেই ভুল-ত্রুটি অবিলম্বে স্বীকার করা। ভুল স্বীকার করলে আমরা শুধু চমৎকার ফলই পাবো না বরং অপূব একটি আত্মতুষ্টিও লাভ করবো-যা নিজের দোষ গোপন করে রাখলে পাওয়া যেতো না।
ক্ষমতার মাধ্যমেই হৃদয়ে প্রকৃত সুখ ও মহৎ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ক্ষমার মাধ্যমে এমনকি আমরা শত্রুদের উপর জয়লাভ করতে পারি এবং তাদেরকে নতি স্বীকারও করাতে পারি। এটা আমাদের ও অন্যদের মাঝে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলে এবং এ থেকে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির ভাব প্রকাশ পায়। ক্ষমা মহা শত্রুকেও সম্প্রীতির বন্ধনে টেনে নেয় এবং পরস্পরের মতানৈক্য ও বিরোধিতাকে জয় করতে পারে। জ্ঞান উগ্রতাকে প্রশমিত করে এবং ভদ্র আচরণের বিকাশ ঘটায়। যতই মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায় ততই এই চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত হয় এবং কামনা-বাসনার ফাঁদকে জয় করার জন্য যে শক্তি লাভ করে, ফলে সে সহসশীল ও অধিক ক্ষমাশল হয়ে উঠে।
ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের পথ নির্দেশ
ক্রোধ নামের এই রোগটার সবচেয়ে কার্যকরী নিরাময় নবীদের ও ইমামদের শিক্ষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের সাধনা এবং সিদ্ধান্তসমূহ যে পুরোপুরিই অকেজো তা বলা যাবে না। তবে তাঁরা এই রোগ নিরাময়ের বিস্তারিত পন্থা সম্পর্কে অবহিত নন। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের জ্ঞানগর্ভ বাণীর মাধ্যমে ক্রোধ বা রাগের বিপজ্জনক পরিণতির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং তা পরিহারে কী উপকারিতা রয়েছে সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন : ‘ক্রোধ পরিহার করো। কেননা, তা নিন্দা বয়ে আনে।’
ডা. মারদিন এই বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন : ‘একজন রাগান্বিত ব্যক্তি (যে কোন কারণেই সে রাগ হোক না কেন) তার রাগ কমে আসার পরে সে বুঝতে পারে তার রাগের যুক্তিহীনতা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে বুঝতে পারে যে, যাদেরকে সে অবমাননা করেছে তাদের কাছে তার ক্ষমা চাওয়া উচিত। যখন রাগ আসে তুমি যদি তখন তার অপকারিতা নিজে বুঝতে পারো তাহলে এর অবাঞ্ছিত পরিণতির মাত্রা কমিয়ে আনতে পারবে।’ (পিরোজী ফিকর)
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন : ‘জ্ঞানীর হৃদয়ের ধ্বংসকারী হলো ক্রোধ। যে তার ক্রোধকে সংবরণ করতে পারে না সে তার মনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’- উসুলুল কাফী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৫
ক্রোধ এবং সেই কারণে উদ্ভূত হতাশা ব্যক্তির স্বাস্থ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে ক্রোধ সীমাহীন মাত্রার পৌঁছলে তা কারো মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘যে নিজের রাগ সামলাতে পারে না সে তার মৃত্যুকে তরান্বিত করে।’- গুরারুল হিকাম, পৃ. ৬২৫
ডা. মারদিন বলেন : ‘দুর্বল হৃদয়ের অধিকারীরা কি বুঝতে পারে যে, হতাশা তাদের জীবনকে শেষ করে দিতে পারে? তারা হয়তো এটা জানে না, কিন্তু তাদের বোঝা উচিত যে, অনেক স্বাস্থ্যবান লোকও ক্রোধের শিকার হয় এবং পরিণামে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যুও হতে পারে।’
রাগ বা ক্রোধ ব্যক্তির মধ্যে ক্ষুধামন্দা, বদহজম প্রভৃতি সৃষ্টি করতে পারে এবং পেশীতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন ধরে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ক্রোধ শারীরিক ও আধ্যাত্মিক সকল কর্মকাণ্ডে নিদারুণ প্রভাব ফেলে। এমনকি স্তন্যদানকারী মায়ের ক্রোধ অনেক সময় তাদের দুধে বিষক্রিয়াও ঘটাতে পারে।’- পিরোজী ফিকর।
ডা. মান বলেন : ‘বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে উদ্বেগের কারণে শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাঝে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। হৃৎপি-, শিরা-উপশিরা, পাকস্থলি, মস্তিষ্ক এবং অভ্যন্তরীণ গ্রন্থি প্রভৃতি সকলই রাগান্বিত অবস্থায় নিজেদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বদলে ফেলে। এক্ষেত্রে অ্যাড্রেনালিন মানবদেহের ভেতরে জ্বলন্ত জ্বালানির মতো কাজ করে।’- উসূলে রাওয়ান সেনাশী
ইমাম আলী (আ.) নিম্নলিখিত মন্তব্যটি করেছেন : ‘ক্রোধকে পরিহার করে চলো, কেননা, এর শুরুটা হাস্যকর এবং শেষটা হলো দুঃখ। ক্রোধ হলো প্রজ্বলিত আগুনের মতো; যে ক্রোধকে দমন করলো সে যেন আগুনটাকে নিভিয়ে দিল আর যে একে প্রশ্রয় দিলো সে এই প্রজ্বলিত হুতাশনেরই প্রথম শিকারে পরিণত হলো।’
‘ক্রোধের কঠোরতা থেকে সতর্ক থাক এবং ধৈর্যের সাথে এর মোকাবিলা কর।’- গুরারুল হিকাম, পৃ. ৭১, ১৩১
‘রাগের মুহূর্তে আত্মসংযম তোমাকে সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করবে।’- গুরারুল হিকাম, পৃ. ৪৬২
এমনকি রাগের মাথায় অনেকের পক্ষে খুন করে ফেলাও সম্ভব।
ইমাম বাকির (আ.) বলেন : ‘ক্রোধের চেয়ে অশুভ আর কি আছে? নিঃসন্দেহে মানুষকে রাগিয়ে তোলা যায় এবং তারপর সে একটি আত্মাকে খুন করে। অথচ এই কাজ আল্লাহ তাআলা নিষিদ্ধ করেছেন।’- আল ওয়াফী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪৮
জন মারকয়িস্ট (John Markaiest) এর মতে, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত কোন কোন লোকের মনে সিনেমার মতোই অপরাধ চিত্রসমূহ দ্রুত ভেসে ওঠে। এই ধরনের রোগীর একটি বৈশিষ্ট্য হলো মুহূর্তের মধ্যেই তার কোন অপরাধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এবং বিন্দুমাত্র দেরি না করে তারা ওই অপরাধটি করে ফেলে। অন্য কথায় বলতে গেলে, তারা হলো তাৎক্ষণিক খুনী।- চি মিদানাম
আল্লাহর রাসূল (সা.) ক্রোধের সময়ের জন্য নিম্নলিখিত আদেশ প্রদান করেছেন : ‘যদি তোমাদের মধ্যে কারো এই জিনিসটি (ক্রোধ) দেখতে পাওয়া যায় তাহলে সে যেন দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়ে আর বসা অবস্থায় থাকলে শুয়ে পড়ে। তারপর যদি সে ক্রোধান্বিত থাকে তাহলে তার উচিত ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওজু করা কিংবা গোসল করা। কেননা, আগুন তো পানি দিয়েই নিভানো যায়।- এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫১
ড. ভিকটর পাশি বলেন : ‘কঠোর ভর্ৎসনার ফলে যদি তোমার শিশু রাগে দিশেহারা হয়ে পড়ে তাহলে তুমি তাকে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করিয়ে কিংবা ভিজা বা স্যাঁসসেঁতে কাপড়ে তাকে জড়িয়ে রেখে তার রাগ প্রশমিত করতে পার।’- রাহি খুশবাখতি
ড. সি রবিনও বলেন : ‘আচার-আচরণের ওপর শারীরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিরাট প্রভাব রয়েছে। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করলে শরীর যেমন পরিষ্কার হয় তেমনি একঘেঁয়েমি মুক্ত হয়ে মন-মেজাজ প্রফুল্ল থাকে। এছাড়া এর মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে সৃষ্ট যে কোন ক্রোধকে দমন করা যায়। কাজেই আমরা শরীর ও মনের উপকারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে পারি।’- চি মিদানাম
পূর্বে যেমন বলা হয়েছে, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ আমাদের জন্য অনেক উদাহরণ রেখে গেছেন, তারই একটি দিক প্রতিফলিত হয়েছে নিম্নলিখিত কাহিনীতে। ইবনে শাহরে আশুব তাঁর গ্রন্থে এটি বর্ণনা করেছেন, মুবারাদ এবং ইবনে আইশা সিরিয়ার এক লোকের গল্প বলেছেন। ঐ লোকটি একদিন ঘোড়ায় চড়ে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। সাক্ষাতের শুরুতেই সে ইমামকে তিরস্কার করতে থাকে। ইমাম হাসান তখনই তার কথার জবাব দিলেন না। যখন সিরীয় লোকটি তার কথা বন্ধ করল তখন ইমাম তার দিকে অগ্রসর হলেন এবং তাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন : ‘হে বৃদ্ধ! মনে হচ্ছে আপনি একজন বিদেশী। সম্ভবত আপনি আমাকে অন্য কেউ বলে ভুল করছেন। যদি আপনি ক্ষমা চান তাহলে ক্ষমা করা হবে, যদি আপনার কোন বাহনের দরকার হয় তাহলে আমরা আপনার জন্য তা সরবরাহ করব, যদি আপনি ক্ষুধার্ত হয়ে থাকেন তাহলে আমরা আপনাকে খাওয়াব, যদি আপনার কাপড়ের অভাব থাকে তাহলে আমরা আপনাকে পরিধেয় বস্ত্র দান করব, যদি আপনি বঞ্চিত ও অবহেলিত হন তাহলে আমরা আপনাকে সাহায্য করব, আপনি যদি আশ্রয়প্রার্থী হন তাহলে আমরা আপনাকে আশ্রয় দেব, যদি আপনার কোন প্রয়োজন থাকে তাহলে আমরা তা পূর্ণ করব এবং যদি আপনি আপনার কাফেলার সাথেই এগিয়ে যেতে চান তাহলে অন্ততঃপক্ষে রওয়ানা হওয়া পর্যন্ত আমাদের মেহমান হিসেবে থাকবেন। এটা আপনার জন্য খুবই উপকারী হবে; কারণ, আমরা উত্তম অবস্থানে আছি। আমরা মহান মর্যাদা এবং অনেক প্রাচুর্যের অধিকারী।’
ইমাম হাসান (আ.)-এর এই কথা শোনার পর লোকটি চিৎকার করে বলে উঠল : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি এই জমিনের বুকে আল্লাহর খলিফা বা উত্তরাধিকারী। আল্লাহ ভালো করেই জানেন কার কাছে তিনি তাঁর বাণী অর্পণ করছেন। আল্লাহর সৃষ্ট জীবকুলে আপনি এবং আপনার পিতাই ছিলেন আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য, বিরক্তিকর; কিন্তু এখন আমার কাছে আপনারা হলেন আল্লাহর সৃষ্ট জীবের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়।’
এরপর লোকটি তার কাফেলার দিক পরিবর্তন করে তাঁদের অতিথি হিসেবে অবস্থান করল এবং তাঁদের ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জন করল।- আল-মানাকিব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৯