https://ipdsbd.net/category/প্রশ্নউত্তর
আপনার জিজ্ঞাসা 01 (আল্লাহ্, বেহেশত ও শয়তান)
এবারে প্রশ্ন পাঠিয়েছেন জনাব মোহাম্মাদ করিম, কক্সবাজার থেকে। তিনি দু’টি প্রশ্ন করেছেন।
প্রশ্ন নং 01 (ক) : আল্লাহ্ কেন শয়তানকে সৃষ্টি করেছেন?
প্রশ্ন নং 02 (খ) : যে সব মানুষ সৎকর্ম করার পুরস্কার হিসাবে বেহেশতে যাবে, তারা কি সেখানে শুধুই আহার করবে ও নিদ্রা যাবে? এটি কি তাদের জন্য ক্লান্তি ও অবসাদ বয়ে আনবে না?
উত্তর 01 (ক) : আল্লাহ্ কেন শয়তান সৃষ্টি করেছেন- এটি অনেকেরই প্রশ্ন বটে। আল্লাহ্ তো জানতেন যে, শয়তানই সকল কুমন্ত্রণা, প্রলোভন, পথভ্রষ্টতা ও ধোঁকাবাজির উৎস। আর মানুষের সমস্ত দুর্ভাগ্য ও দুর্দশা তার থেকেই ঘটবে। তাহলে কেন আল্লাহ্ তাকে সৃষ্টি করলেন? আল্লাহ্ যদি মানুষকে ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে পূর্ণতা ও সৌভাগ্যে পৌঁছানোর জন্য সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে ধ্বংসাত্মক ও পূর্ণতার বিরুদ্ধ অস্তিত্ব শয়তানকে সৃষ্টি করার কী যুক্তি থাকতে পারে?
প্রথমত : আল্লাহ্ শয়তানকে মানব সৃষ্টির শুরু থেকে সৃষ্টি করেননি। কারণ, প্রথম থেকে তার সৃষ্টি ছিল পবিত্র ও ত্রুটিমুক্ত। আর এ কারণেই সে দীর্ঘকাল ধরে আল্লাহ্র ঘনিষ্ঠ ফেরেশেতাদের কাতারভুক্ত ছিল। যদিও সৃষ্টির দিক দিয়ে সে তাদের অংশ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে আল্লাহ্র দরবার ও ফেরেশতাদের মাঝ থেকে বিতাড়িত হয়। তখন ‘শয়তান’ কুখ্যাতি লাভ করে।
দ্বিতীয়ত : যদি আমরা সামান্য চিন্তা করি তাহলে জানব যে, শয়তান এই বিপজ্জনক শত্রুর উপস্থিতিও মানুষের পূর্ণতা ও উন্নতির জন্য একটি সহায়ক উপাদান। যারা ঈমানের অধিকারী এবং সত্যের পথে চলতে চায়, তাদের জন্য শয়তানের উপস্থিতি ক্ষতিকর নয়; বরং তাদের উন্নতি ও পূর্ণতা লাভে সহায়ক।
এ বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, সব সময় প্রতিরোধ ক্ষমতাগুলো জেদী শত্রুর মোকাবিলায় উজ্জীবিত হয় এবং স্বীয় পূর্ণতার পথ পাড়ি দেয়। মানুষের সামনে এক শক্তিশালী শত্রুর উপস্থিতি তার প্রতিপালন ও উৎকর্ষ অর্জনে সহায়ক হয়। কারণ, সব সময় বিরোধ ও প্রতিকূলতার মধ্যে উৎকর্ষ ও বিকাশ অর্থবহ হয়ে ওঠে।
শক্তিশালী শত্রুর মোকাবিলা করা ব্যতীত কোন সৃষ্টিই পূর্ণতার পথে এগিয়ে যেতে পারে না। অন্য কথায় বলা যায়, মানুষ যতক্ষণ না শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর শত্রুর মোকাবিলায় অবতীর্ণ হবে ততক্ষণ তার শক্তি ও প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে না এবং সক্রিয় হয় না। এই শত্রুই মানুষের কর্মচাঞ্চল্য ও উৎকর্ষের কারণ হয়। এ কারণে শক্তিশালী ও প্রতিভাবান সেনাধিনায়ক ও সৈনিক তারাই, যারা বড় বড় যুদ্ধে শত্রুদের সাথে কঠিন মোকাবিলায় অবতীর্ণ হয়েছে। অভিজ্ঞ ও শক্তিমান রাজনীতিক হলো তারাই, যারা কঠিন রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে শত্রুর সাথে সমান তালে লড়াই করেছে।
তারাই বীর, যারা নামযাদা প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে শক্তির পরীক্ষায় জয়ী হয়েছে। কাজেই, এটি কোন আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে, আল্লাহ্র মহান বান্দাগণ শয়তানের মোকাবিলায় নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে দিন দিন আরও শক্তিমান ও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। বিজ্ঞানীরা আজ ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী জীবাণুসমূহের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা ও দর্শন সম্পর্কে বলেন, যদি এগুলো না থাকতো তাহলে মানুষের দেহের কোষগুলো এক শৈথিল্য ও নিষ্কর্মা অবস্থার মধ্যে ডুবে যেত এবং সম্ভবত মানুষের বৃদ্ধি ৮০ সেন্টিমিটারের বেশি হতো না। সব মানুষই পরিণত হত লিলিপুটিয়ান সাইজে। কিন্তু মানুষের দেহ ঠিকই ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী জীবাণুসমূহের সাথে এক দৈহিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে অনেক বেশি বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করেছে।
এই একই কথা শয়তানের সাথে মানুষের রূহের সংগ্রামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদিও সে তার মন্দ ও গর্হিত কাজের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে, কিন্তু তার প্রলোভন ও কুমন্ত্রণা আল্লাহ্র সে সকল বান্দা, যারা সত্য পথে হাঁটতে চায়, তাদের কোনই ক্ষতি করবে না; বরং পরোক্ষভাবে তাদের জন্য সুফলদায়ক হবে।
উত্তর 02 (খ) : বেহেশতবাসী কি শুধুই আহার ও নিদ্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়বে না?
উত্তর : ইহজাগতিক মাপকাঠি দ্বারা পরজগৎ সম্বন্ধে বিচার করা সঠিক নয়। এ কথা ঠিক যে, দুনিয়ার অনেক বিষয়ই পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে তাতে কোন মজা ও আকর্ষণ থাকে না। কিন্তু এ দুনিয়ায় আমাদের যে মনঃজাগতিক অবস্থা, অর্থাৎ কোন কিছুর পুনরাবৃত্তি দেখলে মন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে, ক্লান্তি ও বিরক্তি বোধ করে এবং ক্রমে ক্রমে তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু পরকালে মনের অবস্থা ঠিক এর বিপরীত হতে পারে। অর্থাৎ মানুষ যতবার দেখবে ততই তার আগ্রহ ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে। যত বেশি পুনরাবৃত্তি করবে ততই তার মজা বাড়বে। ফলে পুনরাবৃত্তি বেশি বেশি মজা ও তৃপ্তিদায়ক হবে। আমাদের কাছে কী প্রমাণ রয়েছে যে, মানুষের আত্মিক অবস্থা ঐখানেও দুনিয়ার মতো হবে?
দ্বিতীয়ত : এ জগতেও এমন কিছু নেয়ামত রয়েছে, যেগুলো থেকে মানুষের কখনই মজা উবে যায় না ও মানুষ তা থেকে বিরক্ত ও বিমুখ হয় না। আমরা যত বেশি অক্সিজেনসমৃদ্ধ নির্মল বায়ু গ্রহণ করি না কেন, বিরক্ত বা ক্লান্ত হব না; বরং সর্বদা তৃপ্তি উপভোগ করব। পানি হল পুরোপুরি একটি সুস্বাদু পানীয়। যদি আমরা শত সহস্র বছর বেঁচে থাকি, তাহলেও পিপাসার্ত অবস্থায় সুপেয় পানি পান করা আমাদের কাছে অন্য যে কোন জিনিসের চেয়ে তৃপ্তিকর ও মজাদায়ক হবে। এ কারণেই আমরা বলি, ‘পানির অপর নাম জীবন’। সুপেয় স্বচ্ছ পানি সর্বদা প্রচণ্ড পিপাসাক্লিষ্ট মানুষের কাছে চমৎকার ও তৃপ্তিদায়ক। এতে তো কোন বাধা নেই যে, আল্লাহ্ সেখানেও মানুষের জন্য এমন ব্যবস্থা করবেন, যার কারণে সে সর্বদা বেহেশতের নেয়ামত থেকে অসাধারণ তৃপ্তি ও মজা উপভোগ করবে।
আমরা যদি একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে, ক্লান্তি ও অবসাদ সৃষ্টি এবং কিছু কিছু পার্থিব নেয়ামতের তৃপ্তি উবে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ আমরা নিজেরাই। আসলে আমাদেরই গ্রহণক্ষমতা স্বল্প এবং আমরা একটি তৃপ্তি কেবল নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখি। অবশ্য এই ধারণক্ষমতার স্বল্পতা কখনও কখনও আমাদের দৈহিক সীমাবদ্ধতার কারণে, আবার কখনও কখনও আমাদের আত্মিক সীমাবদ্ধতার কারণে। যেমন ক্ষুধার সময় আমরা কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবারই গ্রহণ করতে পারি। তা পূরণ হয়ে গেলে তখন এমনকি উৎকৃষ্টতম খাবারগুলোও গ্রহণ করার কোন আগ্রহ আমাদেরকে উৎসাহী করে না। তদপরিবর্তে এক অনাসক্তি বা ঘৃণা জেগে ওঠে। হয়তো কোন আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র দেখার জন্য বছরের পর বছর আফসোস করে কাটাই। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর এবং কয়েকদিন অবস্থান করে ঘুরে ফিরে দেখার পর আর থাকার আগ্রহ থাকে না; বরং প্রত্যাবর্তন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি। এ সবই হল বস্তুগত মজা ও তৃপ্তি উপভোগের ক্ষেত্রে ত্রুটির দিকগুলো, যা পার্থিব ও বস্তু জগতের অনুসঙ্গ। কিন্তু বেহেশতে ত্রুটি ও ঘাটতির কোন স্থান নেই। সেখানে সবকিছুই নিরঙ্কুশ উপভোগ্য। সেখানকার আহার পরিতৃপ্তি আনে। এমন নয় যে, তার প্রতি প্রয়োজন থাকবে ও শূন্য উদরকে পূর্ণ করবে এবং মল ত্যাগ করার দরকার হবে। সেখানকার সকল তৃপ্তিই সম্পূর্ণরূপে নিখাদ, নির্ভেজাল। তাছাড়া সেগুলো গ্রহণে আমাদের উপলব্ধি দুনিয়ার অনুরূপ নয়। তৃপ্তিকর খাবারের প্রতি (ভরা পেটের মানুষের জন্য কিছু সময় অতিবাহিত না হলে যার প্রতি নতুন করে আগ্রহ জাগে না) বেহেশতবাসীদের কোন বিরতি ও ব্যবধান ছাড়াই আগ্রহ ও আসক্তি জন্মাবে। আর এটা হল বেহেশতের অধিবাসীরা ও সেখানকার নেয়ামতসমূহের সাথে পৃথিবীর অধিবাসীরা ও এখানকার নেয়ামতসমূহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।
বেহেশতের নেয়ামতসমূহ সর্বদা দৈহিক নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ আত্মিক অথবা দৈহিক ও আত্মিক নেয়ামতের সংমিশ্রণ, যার মধ্যে কোনই বস্তুগত ও দৈহিক সীমাবদ্ধতা নেই। একজন বিজ্ঞানীর গবেষণা ও অধ্যয়নের প্রতি যে প্রেমাসক্তি এবং এর মাধ্যমে তিনি যে আত্মিক তৃপ্তি উপভোগ করেন, সেখানে কি কোন পুনরাবৃত্তি ও একঘেঁয়েমির অর্থ থাকে? নিঃসন্দেহে বেহেশতের মহা আত্মিক নেয়ামতসমূহ সহস্র গুণে এসব দৃষ্টান্তের চেয়ে উত্তম ও উৎকৃষ্ট। এমনকি বেহেশতের দৈহিক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নেয়ামতসমূহের বেলায়ও এই একই মূলনীতি বিদ্যমান। কেননা, যেহেতু আল্লাহ্র জাত ও সিফাত অশেষ ও অসীম, তাঁর প্রকাশও অশেষ ও অসীম। প্রতিক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে তাঁর সে অদৃশ্যলোকের অফুরান ভাণ্ডার থেকে নতুন নতুন নেয়ামত রাশি অবারিতভাবে ঝরে পড়বে বেহেশতবাসীর প্রতি। কোনক্রমেই সেখানে পুনরাবৃত্তি ও একঘেঁয়েমি থাকবে না। যা অসীম অশেষ তার কি কখনও পুনরাবৃত্তি ঘটে? বেহেশতের গাছগাছালি, নদনদী, পানির ঝরনাসমূহ, রং, ঘ্রাণ… সবই প্রতিদিনে প্রতিক্ষণে নতুন নতুন বর্ণ, রূপ ও ঘ্রাণে পরিণত হতে বাধা কিসে? এমনভাবে যে, বেহেশতের অধিবাসীরা একটি আহার কিম্বা একটি দৃশ্যকে গোটা জীবনে শুধু একবারই উপভোগ করবে?
আল্লাহ্ এ পৃথিবীতেই প্রতিদিন শত সহস্র মানুষ ও জীবজন্তু সৃষ্টি করে থাকেন, যেগুলোর একটিও অন্যটির মতো নয়। ইমাম সাদিক (আ.) বলেন : ‘আল্লাহ্ এমন এক বেহেশত সৃষ্টি করেছেন যা কোন চক্ষুই কোনদিন দেখেনি এবং কোন সৃষ্টিই তা সম্পর্কে অবগত নয়। আল্লাহ্ প্রত্যেক প্রত্যুষে তা খোলেন এবং বলেন : তোমার খোশবু বৃদ্ধি কর এবং তোমার মৃদু বাতাস বৃদ্ধি কর।’
কাজেই বেহেশতবাসীর জন্য বেহেশত ও এর নেয়ামতসমূহ থেকে কোন রূপ একঘেঁয়েমি, বিরক্তি বা ক্লান্তির কোন অর্থ ও তাৎপর্য নেই। বেহেশতবাসীর জন্য এমন সব দস্তরখানা বিছানো হবে যার ওপরে তাদের আকর্ষণের সব খাবারই রাখা হবে- যার চেয়ে সুস্বাদুতর ও তৃপ্তিকর আর কোন খাবার নেই।
‘আল্লাহ্র পক্ষ থেকে দুনিয়ার নামাযের ওয়াক্তসমূহে তাদের জন্য আসবে মূল্যবান ও চমৎকার উপহার। ফেরেশতাগণ তাদের ওপর সালাম ও দরূদ প্রেরণ করবে।’ বেহেশতে পূর্ণতা বিদ্যমান। প্রত্যেক পূর্ণতাই ঐ একই দৃশ্যের অভিনব এক সুন্দরের প্রকাশ ঘটাবে মানুষের কাছে। আর সে দৃশ্যও স্বয়ং পূর্ণতার পথযাত্রী।
কা’বা ঘর কেন্দ্রিক ইবাদাতের বিধান কি প্রতিমা পূজার সাথে তুলনীয় ?
প্রশ্ন 03 : ইসলামে কা’বা ঘর কেন্দ্রিক ইবাদাতের বিধান কি প্রতিমা পূজার সাথে তুলনীয় নয়? এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
উত্তর : ইসলাম একত্ববাদের ধর্ম। শির্ক তথা পৌত্তলিকতাবাদের কোন স্থানে এতে নেই। অংশীবাদকে ইসলামে অপবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কুরআনের ঘোষণা হল : ‘আল্লাহ্ সকল গোনাহ মার্জনা করবেন। কেবল শির্ক ছাড়া।’ আর মূর্তিপূজা হল অংশীবাদের জ্বলন্ত উদাহরণ। এ কারণে মহানবী (সা.) আপোষহীনভাবে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন সেটা হল হযরত আলী (আ.)-এর সাহায্য নিয়ে কা’বাঘরের অভ্যন্তর থেকে ছোট-বড় সকল মূর্তি নির্মূল করা। এটা শুধু মহানবী (সা.)-ই নন, আল্লাহ্র সকল পয়গম্বর এ ব্যাপারে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়েছেন। হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক মূর্তি ভাঙ্গার বিখ্যাত ঘটনা আমাদের সবারই জানা।
ইসলাম মূর্তিপূজা থেকে এতটাই বিমুখ যে, এর তাওহীদের (একত্ববাদের) দাওয়াতের সূচনা থেকে যাতে মুসলমানরা (যারা সবেমাত্র পৌত্তলিকতা ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল) কোনভাবেই মূর্তির দিকে মনোযোগী না হয় সেজন্য তাদের কা’বাঘরের দিকে ফিরে নয়; বরং বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায পড়ার নির্দেশ জারী করেছিল। যাতে তাদের দেহ-মন সর্বান্তকরণে যে কোন ধরনের পৌত্তলিকতা ও অংশীবাদী ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া থেকে পবিত্র থাকে। কারণ, কা’বা তখনও ছিল মূর্তিপূজকদের মূল প্রতিমালয়।
ইসলামের দীনি শিক্ষার আদর্শ হল আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি অশীরীরি, নিরাকার। আর আল্লাহ্-বিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ মানুষ কোন মাধ্যম ছাড়াই তার অন্তর্যামী অর্থাৎ আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম। তাঁর কাছে নিজের মনের কামনা নিবেদন করতে এবং তাঁর কাছে ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে।
এবার মূল প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। নিম্নোক্ত রেওয়ায়াতে উপরিউক্ত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ইবনে আবিল আওজা একজন কাফের, জিন্দিক (নাস্তিক) ও মুলহিদ ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ছিল। একদিন সে হজের মৌসুমে তার মতানুসারী একদল লোক নিয়ে মসজিদুল হারামে বসেছিল এবং হাজীবৃন্দের তাওয়াফ, সাঈ ইত্যাদি হজের আমলগুলো পর্যবেক্ষণ করছিল। এসব দেখে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও হাসাহাসি করছিল। মসজিদের আরেক স্থানে ইমাম সাদিক (আ.) অসংখ্য অনুসারী নিয়ে বসেছিলেন। তারা এ মহান ইমামের আসমানী জ্ঞানের ফায়েয লাভ করে চলেছিল।
এমন সময় ইবনে আবিল আওজা ইমামের মজলিসের নিকটবর্তী হয়ে বলল : ‘আর কতদিন এ খড়কুটোকে গুড়ো করবেন… এবং এ পাথর ও কাদার ঘরের ইবাদাত করবেন। আর চমকে ওঠা উটের পালের মতো ঐ ঘরের চারপাশে পড়বেন ও উঠবেন? যে কেউ এ ঘরের আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে চিন্তা করবে সে বুঝতে পারবে যে, এগুলোর নির্দেশদাতা বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞাবিবর্জিত ছিল।’
ইমাম সাদিক (আ.) উত্তর দিলেন : ‘এ (কা’বা) হল এমন ঘর যা প্রজ্ঞাবান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করার মাধ্যম হিসাবে নির্ধারণ করেছেন এবং তাদেরকে এর সম্মান ও যিয়ারত করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। যাতে এটা মহান আল্লাহ্র দরবারে বান্দাদের ইবাদাত ও বিনায়বনত হওয়ার ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও আত্মসমর্পণের দীপ্যমান মাপকাঠি হয়। আর নিখাঁদ ঈমানদার ও মহান আল্লাহ্র নির্দেশের নিষ্ঠাবান আনুগত্যকারীরা ঈমানহীন মুনাফিক লোকদের থেকে পৃথক হয়ে যায়। এ হল নবিগণের অবস্থান স্থল এবং নামায আদায়কারীদের কিবলা। আর পরম দয়াময় মহান আল্লাহ্র ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অর্জনের পথস্বরূপ। কাজেই, এখানে পাথরকে পূজা করাও উদ্দেশ্য নয়, মূর্তির ইবাদাত করাও উদ্দেশ্য নয়; বরং উপাস্য হলেন মানবের দেহ ও প্রাণের স্রষ্টা, যিনি যমিন ও আসমানের স্রষ্টাও বটে। এ গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং এ পাথরকে চুম্বন করা মূলত আল্লাহ্র নির্দেশ পালনার্থেই (বিহারুল আনওয়ার, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২০৯)।’
এ কারণেই আখলাক শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ বলেন : ‘যখন হজ পালনকারীর চোখ কা’বা ঘরের ওপরে পড়ে, তখন তার এ ঘরের মহিমা উপলব্ধিতে আনা উচিত এবং এমন কল্পনা করা উচিত যেন ঘরের মালিককে দর্শন করছে। আর আশা পোষণ করবে যেন তাকে তাঁর সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য দান করেন, যেমনভাবে তাঁর ঘরের সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য তাকে প্রদান করেছেন। আর আল্লাহ্কে শুকরিয়া জ্ঞাপন করবে। কেননা, তিনি তাকে নিজের ঘরে এনে পৌঁছিয়েছেন এবং তাঁর অতিথিবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সে আরও স্মরণ করবে কিয়ামতের কথা, যেদিন সকল সৃষ্টি বেহেশত লাভের আশা-নিরাশায় দুলতে থাকবে (জামেউস সা’দাত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৯১; হাজ্জে আরেফান, পৃ. ১০৭;)।’
এখন কা’বাঘর যিয়ারত ও মসজিদুল হারামে ইবাদাত করা আর মূর্তিপূজা ও প্রতিমালয়ে উপাসনা করার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মূর্তিপূজকরা স্বয়ং মূর্তির পূজা করে। আর তাদের পাথর বা কাঠের মূর্তিগুলোর সুরক্ষার জন্য প্রতিমালয় নির্মাণ করে। কিন্তু কা’বা নির্মাণ হয়েছে আল্লাহ্র নির্দেশে জমিনের ওপরে তাঁরই চিহ্ন হিসাবে, যা ইতিহাসের শুরু থেকেই নির্মিত হয়েছে।
মসজিদুল হারাম, যা কা’বাঘরকে বেষ্টন করে অবস্থিত, এর ইতিহাস খোদ কা’বা ঘরের ইতিহাসেরই সমান। সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আদম (আ.) ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীকালে হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এর পুনঃনির্মাণ করেন। মসজিদুল হারাম হল জমিনের বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মসজিদ। কুরআন মহা সম্মানে এর স্মৃতিচারণ করেছে এবং কাফের ও মুশরিকদের জন্য এর তত্ত্বাবধান তো দূরের কথা, এর ভেতরে প্রবেশকেই নিষিদ্ধ করেছে।
আল্লাহ্র মহান নবিগণ এবং তাঁর সৎকর্মশীল (সালেহ) ও সত্যবাদী (সিদ্দীক) বান্দাগণ এ ঘরে উপস্থিত হয়েছেন এবং আল্লাহ্র ইবাদাত-বন্দেগী করেছেন। অন্য সব মসজিদও তাঁরই ইবাদাত ও তাঁর কাছে দো‘আ করার স্থান, মুসলমানদের সমাবেত হওয়ার স্থান ও ঐক্যের কেন্দ্র। শুধু পবিত্র লোকেরাই এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। আর স্বয়ং আল্লাহ্ মসজিদের গুণ-বর্ণনা করেছেন এরূপে :
‘জমিনে মসজিদগুলোই হল আমার ঘর। এ ঘর আসমানবাসীর জন্য জ্বলতে থাকে, যেমনভাবে আকাশের তারকারাজি যমিনের বাসিন্দাদের জন্য আলো ছড়াতে থাকে। ধন্য সেই বান্দা, যে তার নিজের ঘরে ওযু গ্রহণ করে, অতঃপর আমার ঘরে আমাকে যিয়ারত করে..(ওসায়িলুশ শিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৬৮)।’
এখন আপনিই আল্লাহ্র মসজিদগুলোকে অন্যান্য উপাসনালয়ের (মন্দির, গীর্জা …) সাথে তুলনা করুন এবং এদের পার্থক্য চিত্রিত করুন। (সূত্র:প্রত্যাশা)
প্রশ্ন 04 : ইসলামে মদ এবং জুয়া নিষিদ্ধ কেন?
উত্তর : ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সূরা মায়িদা : ৯০)
আপনার প্রশ্নের প্রথম অংশের জবাবে বলছি, মানুষের জন্য আল্লাহর সবচাইতে বড় নেয়ামত হচ্ছে ‘বুদ্ধি’। মানুষের বুদ্ধি ও যুক্তিশক্তির জন্যই তাকে সৃষ্টির সেরা বলা হয়।
বুদ্ধির দুটি শত্রু রয়েছে : কামনা-বাসনা এবং ক্রোধ বা রাগ। বিবেক বা বুদ্ধিবৃত্তির এই দুই প্রধান শক্তি তরল অ্যালকোহল দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়। যখন তরল শরাব মানবদেহে প্রবেশ করে তখন তার দ্বারা প্রথম আক্রান্ত হয় মস্তিষ্কের সেই সব কেন্দ্রীয় উপাদান বা স্নায়ু কেন্দ্র যা মানুষের বিচার বোধ, দায়িত্বশীলতা, নৈতিক অবস্থা প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তখন মানবীয় চরিত্রের নেতিবাচক দিকগুলো বন্দিত্ব থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোর ওপর প্রাধান্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। নৈতিক এবং সামাজিক বাধাগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন নেশাগ্রস্ততা মানুষকে বাচাল, ভারসাম্যহীন এবং কলহপ্রিয় করে তোলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে ভাবে উত্তেজনাতাড়িত। বস্তুত এটা কোন উত্তেজনা বা উদ্দীপনা নয়। যেটাকে মাদকাসক্তিজনিত উত্তেজনা বলা হয় সেটা আসলে নেশাজনিত অবসাদগ্রস্ততা। কোন পরিমাণের অ্যালকোহলই বুদ্ধিবৃত্তিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে না।
কেউ কেউ ভাবেন যে, অল্প পরিমাণের অ্যালকোহল সেবন কোন ক্ষতির কারণ নয়। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে এটা একটা ভ্রান্তি বিলাস। রক্তে ০.১৫% অ্যালকোহলের উপস্থিতি মানুষের ইন্দ্রিয় বৃত্তিকে এতোটা দুর্বল করে ফেলে যে, আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে গাড়ি চালনা বিপজ্জনক হয়।
একজন পানাসক্ত ব্যক্তির পানাভ্যাসকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন বড় ধরনের ইচ্ছাশক্তি। অ্যালকোহল যেহেতু বিচারবোধকে নষ্ট করে এবং মানুষের বিবেকশক্তিকে নৈতিক শাসন থেকে মুক্ত করে ফেলে সেহেতু এটা ভাববার কোন অবকাশ নেই যে, একজন পানাভ্যস্ত ব্যক্তি তা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম কিনা। মাদকাসক্তির কারণে ইচ্ছাশক্তি লুপ্ত হওয়া শুরু হলে পানের অভ্যাস মানুষকে বুঁদ করে ফেলে এবং এর চূড়ান্ত রূপকে আমরা বলি মাতাল হওয়া। ইসলাম মানুষকে এই দুর্বলতার ফাঁদে পড়ার কোন সুযোগ রাখাকে সমর্থন করে না। আর এ কারণেই মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘কোন জিনিস যা অতিমাত্রায় গ্রহণের ফলে নেশা সৃষ্টি হয় তা এমনকি এক ফোটাও গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।’
জুয়া প্রসঙ্গে আপনার জবাবে বলতে হয় যে, আমাদের যুগের সর্বব্যাপী মন্দের উৎস হচ্ছে এই জুয়া। এর অগুন্তি নাম আর ধরন রয়েছে। তাস খেলা, বাজি ধরা, রেস্, ঘোড়দৌড়, লটারি, হাউজি, ঘূর্ণনচক্র এবং এরকম আরও নানান রকম খেলা। এ সবই মূলত জুয়া, তা যে নামেই সেগুলোর প্রচলন থাকুক না কেন। বলা বাহুল্য, এসবই এ যুগের বিনোদনের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় উপাদান।
জুয়া তা যে ধরনেই হোক না কেন ইসলামে তা নিষিদ্ধ। জুয়াড়ি ব্যক্তির দশা আমরা প্রায়শঃই প্রত্যক্ষ করে থাকি। সে হীন মনোবৃত্তি বা প্রবণতা দ্বারা প্ররোচিত হয়ে উত্তরোত্তর অপব্যয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এভাবে একপর্যায়ে জুয়ার তাড়নায় ‘আসক্ত’ হয়ে পড়ে। তার কষ্টার্জিত সম্পদ সে নিছক খেলার পেছনে নিঃশেষ করে। কিছু লোক সময় পার করার জন্য এসব খেলায় মেতে থাকে। তারা এতোই নির্বোধ যে, জীবনের সীমাবদ্ধ পরিসর যে কিছু সীমিত বছর, মাস আর ঘণ্টা তা আদৌ অনুধাবনে সক্ষম নয়। সময় ধ্বংস করা প্রকারান্তরে জীবন ধ্বংস করা। অথচ জীবন আমাদেরকে কেবল হেলাখেলায় ধ্বংস করার জন্য দেয়া হয়নি। অন্যরা অর্থলাভের বাসনায় এসব কাজে প্ররোচিত হয়। এটা সত্য যে, একেবারেই কিছু না পাওয়ার চাইতে কিছু একটা পাওয়ার তাগিদ মানুষের একটা আদি অভ্যাস। কিন্তু ইসলাম কোন অবস্থাতেই এটা উৎসাহিত করে না। বস্তুত জালিয়াতি, দস্যুবৃত্তি, প্রতারণা প্রভৃতি একই প্ররোচনা বা প্রবণতার অনুষঙ্গ। কিন্তু স্বভাবগত দাবির দোহাই দিয়ে কেউ কোন দিন এসব অন্যায় কাজকে জায়েয বলে দাবি করতে পারেনি।