কারবালার ইতিহাস ও ‘বিষাদ সিন্ধু’র কাহিনী

কারবালার ইতিহাস ও ‘বিষাদ সিন্ধু’র কাহিনী

বিষাদ সিন্ধু-কথা সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনের বিখ্যাত উপন্যাস। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দৌহিত্র ও বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হৃদয়বিদারক শাহাদাতের ঘটনা এর প্রধান উপজীব্য।

এ উপন্যাস রচিত হয়েছে উপক্রমণিকা,মহররম পর্ব,উদ্ধারপর্ব,এজিদবধ পর্ব ও উপসংহার সহকারে। প্রতিটি বিভাগ সম্পর্কে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

উপক্রমণিকা : উপক্রমণিকায় মহানবী (সা.) কর্তৃক তাঁর দুই নাতি ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের (হোসেনের) শাহাদাতের সংবাদ দেওয়ার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। যখন তিনি এ দুঃসংবাদ তাঁর সাহাবীদের সম্মুখে দেন তখন সাহাবীরা জানতে চান যে,কে এ হত্যাকাণ্ড ঘটাবে। মহানবী (সা.) মু‘আবিয়ার (মাবিয়ার) পুত্র ইয়াযীদের (এজিদের) নাম উল্লেখ করেন। যেহেতু মু‘আবিয়া তখনও বিয়ে করেননি,তাই তিনি এ খবর শোনার পর বিয়ে না করার শপথ করেন। কিন্তু মহানবী বলেন,তাঁর এমন শপথ করা উচিত নয়। পরে মু‘আবিয়া এক কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে এ ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভের জন্য মহানবী (সা.) তাঁকে বিয়ে করার পরামর্শ দেন। যেন কোন সন্তানের জন্ম না হয় সেজন্য মু‘আবিয়া এক বৃদ্ধাকে বিয়ে করেন। কিন্তু এ বৃদ্ধার গর্ভেই ইয়াযীদের জন্ম হয়। মু‘আবিয়া ইয়াযীদকে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের নিকট থেকে দূরে রাখার জন্য দামেশকে চলে যান। সময়ের পরিক্রমায় মহানবী (সা.),হযরত ফাতেমা,হযরত আলী ইন্তেকাল করেন। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন মদীনায় বয়ঃপ্রাপ্ত হন। অন্যদিকে ইয়াযীদ দামেশকে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়।

এরপর থেকেই মহররম পর্ব,উদ্ধার পর্ব ও এজিদ বধ পর্ব এ তিন পর্বে উপন্যাসের মূল ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছে। নিচে সংক্ষেপে এ তিনটি পর্ব সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হল।

মহররম পর্ব : এ পর্বের বিষয়বস্তু হল ইমাম হাসানের সাথে ইয়াযীদের বিরোধ,ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা ও কারবালায় ইমাম হুসাইনকে হত্যা। বিষয়গুলো নিম্নরূপ :

আবদুল জব্বারের স্ত্রীর নাম জয়নাব। খুবই রূপবতী। মু‘আবিয়ার পুত্র ইয়াযীদ তাকে দেখে মুগ্ধ হয় এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। ইয়াযীদের মা মারওয়ানের সাথে পরামর্শ করে এবং প্রলোভন দেখিয়ে জয়নাবের সাথে আবদুল জব্বারের বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করে। আবদুল জব্বার জয়নাবকে তালাক দেয়। এরপর ইয়াযীদ জয়নাবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দূত প্রেরণ করে। পথিমধ্যে এ দূতের সাথে ইমাম হাসানের সাক্ষাৎ হয়। ইমাম হাসান জয়নাবের কাছে তাঁর পক্ষ থেকেও বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য দূতকে অনুরোধ করেন। জয়নাব ইয়াযীদের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে এবং ইমাম হাসানের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ইমাম হাসান জয়নাবকে বিয়ে করেন। ইয়াযীদ ক্রোধে ফেটে পড়ে। অন্যদিকে ইমাম হাসানের অপর স্ত্রী জায়েদা জয়নাবকে হিংসা করতে শুরু করে।

ইতিমধ্যে মু‘আবিয়া অসুস্থ হয়ে মারা যান। ইয়াযীদ বাদশাহ হয়। সে মদীনার অধিবাসীদের তার আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেয়। মদীনার অধিবাসীরা তা অস্বীকার করলে ইয়াযীদ মারওয়ানকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্রেরণ করে। মদীনার সেনাদলের সাথে মারওয়ানের সেনাদলের যুদ্ধ হয় এবং মারওয়ান পরাজিত হয়। পরে মারওয়ান মায়মুনা নামের এক বৃদ্ধার সাথে ইমাম হাসানকে হত্যার ব্যাপারে ষড়যন্ত্র করে। মায়মুনা ইমাম হাসানের স্ত্রী জায়েদার মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে ইমাম হাসানকে হত্যা করে। ইমাম হুসাইন এ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

এদিকে কুফার শাসক উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ (আবদুল্লাহ জেয়াদ) ধোঁকা দিয়ে ইমাম হুসাইনকে বন্দী করার জন্য বাহ্যিকভাবে ইমাম হুসাইনকে নেতা বলে স্বীকার করে এবং তাঁকে কুফায় আসার আহ্বান জানিয়ে পত্র প্রেরণ করে। ইমাম হুসাইন কুফার অবস্থা যাচাইয়ের জন্য মুসলিম ইবনে আকীলকে প্রেরণ করেন। মুসলিম কুফার ব্যাপারে ইতিবাচক পত্র প্রেরণের পর ইমাম ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে কুফার দিকে রওয়ানা হন। পথে তিনি মুসলিমের শাহাদাতের খবর পান। মুহররম মাসের আট তারিখে ইমাম হুসাইন কারবালার প্রান্তরে পৌঁছেন। এখানে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হন। তারা ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়। ইমামের পরিবার ও সাথীরা ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন। এ অবস্থার মধ্যেও ইমাম হুসাইন তাঁর মেয়ে সাকীনার সাথে ইমাম হাসানের ছেলে কাসেমের বিয়ে দেন। অবশেষে মুহররমের দশ তারিখে ইয়াযীদের সেনাদলের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ইমাম হুসাইন তাঁর সকল সঙ্গী-সাথীসহ শাহাদাত বরণ করেন।

উদ্ধার পর্ব : এ পর্বের বিষয়বস্তু হল ইমাম হুসাইনের পরিবারের বন্দী হওয়া,ইয়াযীদের দরবারে ইমাম হুসাইনের পবিত্র মাথা নিয়ে যাওয়া এবং এর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া,মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়ার (মোহাম্মদ হানিফার) দামেশক আক্রমণ ও ইমাম যায়নুল আবেদীনের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যাওয়া। যা সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণিত হল।

কারবালার হত্যাকাণ্ডের পর নবী পরিবারের তাঁবুতে ইয়াযীদের সৈন্যরা আক্রমণ করে। মারওয়ান নবী পরিবারের সদস্যদের বন্দী করতে এলে ইমাম হুসাইনের মেয়ে সাকীনা আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে শিমার পুরস্কারের লোভে ইমাম হুসাইনের কাটা মাথা নিয়ে দামেশকের দিকে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে রাত হলে সে আজর নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। আজর সীমারের নিকট থেকে নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানতে পেরে তাকে পরামর্শ দেয় যেন সে তা তার হেফাজতে রাখে যাতে রাতে কেউ তা চুরি করে নিয়ে যেতে না পারে। শিমার এতে রাজি হয়। আজর তার পরিবারের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে,এ মাথা তারা কারবালায় নিয়ে যাবে এবং সেখানে দাফন করবে। পরদিন সকালে শিমার তার নিকট থেকে মাথা চাইলে সে তা দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু শিমার একটি কাটা মাথা হলেই চলে যাবে এ কথা বললে আজর প্রথমে তার বড় ছেলেকে হত্যা করে মাথা কেটে এনে শিমারকে দেয়। কিন্তু শিমার এ মাথা নিতে অস্বীকার করে আবারও একটি কাটা মাথার কথা বলে। এভাবে এ ব্যক্তি পরপর তার তিন ছেলেকেই হত্যা করে মাথা কেটে শিমারকে দেয়। কিন্তু শিমার মনে করে আজর হয়ত অর্থের লোভে ইমামের মাথা দিতে চাচ্ছে না। অবশেষে শিমার আজরকে হত্যা করে ইমামের মাথা নিয়ে ইয়াযীদের দরবারে উপস্থিত হয়। ইয়াযীদের দরবার হতে সেই মাথা ঊর্ধ্বে উঠে যেতে যেতে একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়।

অপরদিকে ইমাম হুসাইনের বৈমাত্রেয় ভাই মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়া এ সময় আম্বাদ নগরীর রাজা ছিলেন। হযরত আলী হযরত ফাতিমার অজ্ঞাতসারে এক নারীকে বিয়ে করেন যাঁর গর্ভে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার জন্ম হয়। তিনি কারবালায় ইমাম হুসাইনের আগমন ও সেখানে তাঁর অবরুদ্ধ হবার কথা জানতে পেরে সৈন্যসহ বের হন। কিন্তু তিনি পথিমধ্যে সংবাদ পান যে,ইমাম হুসাইন শহীদ হয়েছেন এবং নবী পরিবার দামেশকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে প্রথমে মদীনা অভিযানে বের হন এবং তা দখল করে নেন। তিনি শিমারকে শাস্তি দেন। এরপর দামেশক অভিমুখে যাত্রা করেন। দামেশকে ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর সাথে তাঁর যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিমধ্যে ইমাম যায়নুল আবেদীন বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যান।

এজিদ বধ পর্ব : এ পর্বের বিষয়বস্তু হল ইয়াযীদের পলায়ন ও গুপ্তপুরীতে প্রবেশ এবং মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়ার বন্দীত্ব। নিচে এ বিষয়গুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল।

মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়ার সেনাদলের সাথে ইয়াযীদের সেনাদলের প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ইয়াযীদের বাহিনী পরাজিত হয় এবং ইয়াযীদ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়া তার পশ্চাদ্ধাবন করেন। অনেক চেষ্টার পরও তিনি ইয়াযীদকে ধরতে ব্যর্থ হন। ইয়াযীদ দামেশকের রাজপ্রাসাদের পাশে একটি ভূগর্ভস্থ গুপ্তপুরীতে প্রবেশ করে। তাকে ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় যুদ্ধ শেষেও হানাফীয়ার ক্রোধ থেকে যায়। তিনি অনেককে হত্যা করেন। এ অপরাধে তাঁর জন্য গায়েবী শাস্তি অবতীর্ণ হয়। অত্যুচ্চ প্রস্তরময় প্রাচীর তাঁকে ঘিরে ফেলে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তিনি সেখানে বন্দী থাকবেন।

উপসংহার : এ অংশে ইমাম যায়নুল আবেদীনের সিংহাসনে আরোহণ,নবী পরিবারের মুক্তি ও ইমামের সপরিবারে মদীনায় প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে।

পর্যালোচনা

মীর মোশাররফ হোসেন রচিত বিষাদ সিন্ধু একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নাকি ঐতিহাসিক গ্রন্থ এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকে একে ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসও বলেছেন। তবে বাস্তবতা হল বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি মুসলমানের কাছে এটি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসাবেই সমাদৃত। এতে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনাকে এ দেশের মানুষ সত্য বলে গ্রহণ করে এবং এ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে। সম্ভবত মীর মোশাররফ হোসেন নিজেই চেয়েছেন মানুষ একে ধর্মীয় ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করুক। এরূপ ধারণা করার কারণ হল তিনি মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধর্মীয় বিধানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন,যেমন পর্দার বিধান,দেনমোহরের বিধান ইত্যাদি।

এ উপন্যাসে যে বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে সেগুলো হল :

১. মহান আল্লাহর ওপর সকল অপকর্মের দায়ভার চাপানো অর্থাৎ অদৃষ্টবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা।

২. ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের প্রতি আমীরে মু‘আবিয়ার অপরিসীম ভালবাসা প্রদর্শন।

৩. ইমাম হাসানের সাথে ইয়াযীদের সংঘাতের মূল কারণ একজন নারী। যে নারীকে ইয়াযীদ বিয়ে করতে চেয়েছিল ইমাম হাসানও তাকেই বিয়ে করতে চান। আর এ থেকেই ইয়াযীদের সাথে ইমামের শত্রুতা শুরু হয় এবং তাঁকে ইয়াযীদের প্ররোচণায় বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।

৪. ইমাম হুসাইন তাঁর ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। অবশেষে কারবালায় নির্মমভাবে নিহত হন।

অর্থাৎ একটি বিয়ের বিষয়কে কেন্দ্র করে পুরো উপন্যাস রচিত হয়েছে। বনু উমাইয়্যার শাসনব্যবস্থার অত্যাচার ও তাদের অনৈসলামী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ইমামগণের প্রতিরোধের বিষয়কে তিনি তাঁর উপন্যাসে কোথাও আনেননি।

সাহিত্যের কোন বিষয় যখন নিরেট সাহিত্যের মধ্যে অবস্থান না করে সমাজ জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন তা নিয়ে আলোচনা,পর্যালোচনা ও সমালোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিষাদ সিন্ধুর ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটিই ঘটেছে। যেভাবে এ উপন্যাস লেখা হয়েছে তাতে এর মধ্যে ধর্মীয় বিষয় ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের বিকৃত ইতিহাসকে উপজীব্য করা হয়েছে। আর এজন্যই এ নিয়ে প্রবন্ধ লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি। প্রয়োজন রয়েছে এমন রচনার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপনেরও।

যে কোন রচনারই সমাজের জনগণের ওপর কম-বেশি প্রভাব থাকে। মীর মোশাররফ হোসেনের এ উপন্যাসও এ দেশের মানুষের মনে প্রভাব ফেলে;শুধু প্রভাব ফেলে বললে ভুল বলা হবে;বরং বলতে হবে মানুষের মনের গভীরে স্থান লাভ করে। এমনকি এ গ্রন্থকে ধর্মীয় গ্রন্থের মর্যাদাও দেওয়া হয়। এমন সময়ও ছিল যখন মানুষ ভক্তিভরে একে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রেখে দিত। পাঠ করার পর এতে চুমু খেত।

সমাজে প্রচলিত যে কোন ভুল ধারণার অপনোদন বা যে কোন কুসংস্কারের মূলোৎপাটন সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ বিষয়। অনেক সময় কোন অপপ্রচার বা বিকৃতিকে দূর করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু আমাদের সমাজে কারবালার মহান ঘটনার বিকৃত রূপই প্রচার করেছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত,জ্ঞানী-মূর্খ নির্বিশেষে সকলের কাছে বিষাদ সিন্ধুই সত্য। এর কারণ হল লেখক একে এভাবেই উপস্থাপন করেছেন। যেমন কোথাও কোথাও এভাবে বলেছেন যে,এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে যেন পাঠক মনে করে যে,এতে বর্ণিত অন্য সকল বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই অর্থাৎ এগুলোর সবই সত্য।

আমাদের সমাজে এ বাস্তবতারই একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বইমেলায় এক শিক্ষিত ভদ্রলোক তাঁর স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। একটি স্টলে ইমাম হুসাইনের শাহাদাত সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ দেখে ছেলেটি বাবার কাছে সে গ্রন্থ কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করে। কিন্তু এ বাবা তাকে বিষাদ সিন্ধু কিনে দেওয়ার কথা বলে নিয়ে গেলেন। এ ঘটনা একটি নমুনা মাত্র। আমি অনেক ব্যক্তির কাছেই এমন শুনেছি যে,বিষাদ সিন্ধুতেই কারবালার প্রকৃত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু একটি কাল্পনিক উপন্যাস বা উপাখ্যান। এতে শুধু কয়েকটি ঐতিহাসিক নাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা ও কাবাবালায় ইমাম হুসাইনের সপরিবারে শাহাদাতবরণের সত্য কথা বলা হয়েছে। কিন্তু উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিকভাবে সত্য আর কোন ঘটনাই বর্ণিত হয়নি। তাই এটাকে ‘ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস’বলাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটাও বিবেচনার বিষয়। মাত্র কয়েকটি নামের ব্যবহারেই একটি উপন্যাস ইতিহাস আশ্রিত বলা যায় না।

বিষাদ সিন্ধুর সাহিত্যমান নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। মীর মোশাররফ তাঁর সহজাত প্রতিভার মাধ্যমে এর ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন। তিনি যেভাবে ঘটনার পট সাজিয়েছেন এবং ধীরে ধীরে মানুষের মনে পরবর্তী ঘটনা জানার ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন,যেভাবে ঘটনাকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করেছেন তা সত্যিই অনবদ্য। পাঠকদের মনে তিনি ঔৎসুক্য সৃষ্টি করেছেন,তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে দিয়েছেন,কারবালার ঘটনা বর্ণনায় পাঠকদের কাঁদিয়েছেন খুব সাবলীলভাবে। তাই উপন্যাসের সাহিত্যমান নিয়ে লেখার কিছু নেই।

কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের আহত করে এবং যে দিকটিকে এতকাল উপেক্ষা করা হয়েছে তা হল এ উপন্যাসের চরিত্র ও ঘটনা নির্বাচন। তিনি এমন দু’জন মহান ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের জীবনের মর্মান্তিক ঘটনাকে উপন্যাসের উপজীব্য করেছেন যে,মনে হয় তিনি জানতেন এ দেশের পাঠকমাত্রই তাঁর এ গ্রন্থ লুফে নেবে। আপত্তি থাকত না যদি তিনি সত্য ঘটনাকে আশ্রয় করে তা লিখতেন। কিন্তু তিনি এ উপন্যাস সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের মহান ব্যক্তিত্ব ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছেন। ইমাম হুসাইনের মহান আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করেছেন। সে কারণে আমার আলোচনা এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই।

ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন কেবল মুসলমানদের আদর্শ নন;বরং তাঁরা মানব জাতির জন্য আদর্শ। অমুসলিম বিখ্যাত ব্যক্তিগণ,যেমন টমাস কার্লাইল,মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ ইমাম হুসাইন থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদের ‘বেহেশতের যুবকদের নেতা’ বলেছেন। তাই আমরা এটা কখনই সমর্থন করতে পারি না যে,তাঁদের নিয়ে এমন কিছু লেখা হোক যেটা তাঁদের মর্যাদার পরিপন্থী।

লেখকদেরও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন রয়েছে। দায়বদ্ধতার ব্যাপার রয়েছে। ইচ্ছা করলেই যে কোন বিষয় সম্পর্কে বা যে কোন ব্যক্তি সম্পর্কে যা খুশি লেখা যায় না। আমরা যদি আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা লিখতে চাই তবে এ মহান যুদ্ধের প্রতি সম্মান রেখে যা সত্য তা-ই লিখতে হবে। যদি আমাদের জাতীয় নেতাদের নিয়ে কিছু লিখতে চাই তবে তাঁদের সম্মানের দিকটি লক্ষ্য রেখে সত্য বিষয়গুলোই লিখতে হবে,কোন কল্পকাহিনী নয়। কোন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের সম্মানহানী করে লেখা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে তো নয়ই,এমনকি সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও মিথ্যা বলার মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্বকে অপমান করার অধিকার কারও নেই। আবার কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে কিনা সেটি বিবেচনার ব্যাপার রয়েছে। ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ইসলামের পুনরুজ্জীবন দানের মহা ঘটনাকে মীর মোশাররফ হোসেন এমন এক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত করেছেন যা ইসলামের এ মহান আন্দোলনের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে।

বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে রচিত গল্প,উপন্যাসগুলোতে তাঁদের বাস্তব চরিত্রকে আশ্রয় করা হয়েছে। মোঘল সম্রাট আকবর,বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলা,কিংবা শেরে মহীসূর টিপু সুলতানকে নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলোকে আমরা ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস বলতে পারি। ইতিহাসের সত্যতার দিকে লক্ষ্য রেখে কিছু কিছু কাল্পনিক চরিত্র ও ঘটনা ঔপন্যাসিকরা এতে যোগ করেছেন। কিন্তু মূল ঘটনা বর্ণনায় তাঁরা ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উপন্যাসে এসেছে ইতিহাসকে অবলম্বন করেই। আকবরের কাহিনীতে বাস্তবতা দেখতে পাই। অন্যদিকে বিষাদ সিন্ধুতে কয়েকটি সত্য নাম ও কারবালায় হত্যাকাণ্ডের সত্য ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। এর বাইরে আগাগোড়া এটি একটি কাল্পনিক উপন্যাস। যদি মীর মোশাররফ হোসেন চাইতেন তাহলে ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই তিনি তা রচনা করতে পারতেন।

আবার এ নামগুলো ব্যবহার না করে এ ধরনের উপন্যাস রচনা করাও মীর মোশাররফ হোসেনের পক্ষে সম্ভব ছিল। কিন্তু তাঁর ভয় ছিল এটাকে পাঠক কর্তৃক সমাদৃত হওয়ার জন্য ধর্মের আশ্রয় না নিলে চলবে না। তিনি খুব চতুরতার সাথে সে কাজটিই করেছেন। তাই একে ইতিহাস আশ্রয়ী না বলে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি আশ্রয়ী উপন্যাস বলা যায়। বিষাদ সিন্ধুর শুরুতে উপক্রমণিকায় মুসলমানদের হৃদয়ের মনিকোঠায় যাঁদের অবস্থান সেসব মহান ব্যক্তিত্ব প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর দুই নাতির বিষয় বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) কর্তৃক তাঁর দুই নাতির শাহাদাতের ভবিষ্যদ্বাণী করার মাধ্যমে এ উপন্যাসের প্রতি পাঠকদের চরমভাবে আকৃষ্ট করা হয়েছে। পাঠকমাত্রই এ কয়েকটি অনুচ্ছেদ পড়ার পর এ গ্রন্থের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ না করে পারবেন না। যদি তিনি ধর্মীয় অনুভূতিকে আশ্রয় না করতেন তবে এ গ্রন্থ পাঠকপ্রিয় হত কিনা সন্দেহ রয়েছে। থাক না এতে চমৎকার বাক্যগঠন,ভাষার সাবলীলতা অথবা অন্য কোন চমক।

বহুল প্রচলিত মিথ্যা

মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধুর যে বিষয়গুলো আমাদের সমাজে বেশি বেশি চর্চা হয় সেগুলো সম্পর্কে কিছু কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি যেন বিশেষভাবে এগুলোর মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে আমাদের মনে সংশয়ের সৃষ্টি না হয়।

সত্য হল এটাই যে,ইয়াযীদের রাজত্বকালে ইমাম হাসান জীবিত ছিলেন না। মু‘আবিয়ার জীবদ্দশাতেই ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। মুহররম পর্বে বর্ণিত ইমাম হাসানের সাথে জয়নাবের বিয়ের ঘটনা,মদীনার সেনাবাহিনীর সাথে ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ এবং কারবালায় ময়দানে কাসেমের সাথে সাকীনার বিয়ের বিষয়টি একেবারেই কাল্পনিক।

উদ্ধারপর্বে বর্ণিত সাকীনার আত্মহত্যা,আজরের একে একে তিন সন্তানকে হত্যা,ইমাম হুসাইনের শির মোবারকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া,হযরত ফাতিমার জীবদ্দশায় হযরত আলীর অন্য নারীকে বিয়ে করা,সেই নারীর সন্তানকে রাসূলের কাছে নিয়ে আসা,মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়ার সাথে ইয়াযীদের যুদ্ধ এবং ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর পলায়নের ঘটনা সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক।

এজিদ বধ পর্বে বর্ণিত যুদ্ধে ইয়াযীদের পরাজয় ও গুপ্তপুরীতে প্রবেশ এবং মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়ার কিয়ামত পর্যন্ত বন্দি থাকার ঘটনাও কাল্পনিক।

সত্য ইতিহাস

যদি কারবালার সত্য ইতিহাসের কিছুই উল্লেখ না করি তবে এ প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই খুব সংক্ষেপে কারবালার মহাঘটনা সংঘটনের ইতিহাস এখানে তুলে ধরা হল। হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (আ.) খলীফা হন। কিন্তু মু‘আবিয়া হযরত আলীকে অস্বীকার করার মত ইমাম হাসানকেও খলিফা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ইমাম হাসান মু‘আবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে বের হন। কিন্তু মু‘আবিয়া অর্থ-সম্পদ ও পদমর্যাদার প্রলোভন দেখিয়ে ইমাম হাসানের সৈন্যদের কিনে নেন। এমনকি ইমাম হাসানের প্রধান সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসও রাতের অন্ধকারে নিজের দীন বিক্রি করে মু‘আবিয়ার দলে যোগ দেন। ইমাম হাসান মু‘আবিয়ার সাথে সন্ধি করেন। সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল মু‘আবিয়ার মৃত্যুর পর খেলাফত ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে আসবে। আর তিনি জীবিত না থাকলে তা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছে আসবে। কিন্তু মু‘আবিয়া মৃত্যুর পূর্বেই সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে তাঁর ফাসেক পুত্র ইয়াযীদকে মুসলমানদের খলিফা মনোনীত করেন। মু‘আবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াযীদ খলিফা হয়। সে মদীনার গভর্নরকে নির্দেশ দেয় যাতে সে ইমাম হুসাইনের নিকট থেকে তার খেলাফতের পক্ষে স্বীকারোক্তি আদায় করে। ইমাম হুসাইন ইয়াযীদকে খলীফা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং তাঁর দীনি আন্দোলন শুরু করেন। তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে চলে যান। সেখানে অবস্থানকালে তাঁকে কুফায় গিয়ে নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে কুফা থেকে হাজার হাজার চিঠি প্রেরণ করা হয়। অন্যদিকে হজ্বের সময় তাঁকে গুপ্তঘাতক দ্বারা হত্যা করা হবে জানতে পেরে তিনি হজ্ব অসমাপ্ত রেখেই কুফার দিকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তিনি ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কারবালায় নীত হন। এখানে ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্য এবং সঙ্গী-সাথীসহ তিন দিনের পিপাসার্ত অবস্থায় হাজার হাজার শত্রুসৈন্যের মোকাবিলায় শাহাদাত বরণ করেন।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের নারী ও শিশুদের তাঁবুগুলোতে ইয়াযীদের সেনারা আক্রমণ চালিয়ে লুটপাট করে এবং পরে অগ্নিসংযোগও করে। ইমাম হুসাইনের একমাত্র জীবিত পুত্র ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ও ইমাম হুসাইনের বোন হযরত যায়নাবসহ সকলকে বন্দি করা হয়। তাঁদের হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে প্রতিটি জনপদ ও বাজারে ঘুরিয়ে প্রথমে কুফায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের দরবারে ও পরে দামেশকে ইয়াযীদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। ইয়াযীদের সৈন্যরা যাত্রাপথে ইমাম হুসাইনসহ তাঁর সঙ্গীসাথীদের কাটা মাথাগুলো বর্শায় বিদ্ধ করে এ বন্দি কাফেলার সম্মুখভাগে বহন করে যাতে ইমাম- পরিবারের সদস্যদের দুঃখ আরও বৃদ্ধি পায়। ইয়াযীদের দরবারে ইমাম হুসাইনের পবিত্র মাথা একটি পাত্রে রাখা হলে ইয়াযীদ উল্লাস প্রকাশ করে।

ইয়াযীদ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে হত্যা করতে চায়,কিন্তু হযরত যায়নাবের সাহসী ভূমিকার কারণে সে এ কাজ হতে বিরত হয়। কিছুদিন বন্দি অবস্থায় রাখার পর ইমাম হুসাইনের পরিবার-পরিজনকে মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়ার সাথে শিমারের কোন যুদ্ধ হয়নি এবং তিনি শিমারকে শাস্তিও দেননি;বরং যখন মুখতার সাকাফী কুফার শাসনক্ষমতা থেকে বনী উমাইয়্যাকে উচ্ছেদ করেন তখন তিনিই শিমার,উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদসহ ইমাম হুসাইনের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সবাইকে শাস্তি দেন।

মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়া ইমাম হুসাইনের পরিবারকে উদ্ধারের জন্য দামেশকেও কোন অভিযান পরিচালনা করেননি। আর তিনি আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের খেলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে যে,আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়াকে রাযওয়া নামক স্থানে নির্বাসনে প্রেরণ করেন। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন যে,তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ

যা হোক,ইমাম হুসাইন কেন পবিত্র মদীনায় অবস্থান না করে মক্কা শরীফে গেলেন,আর কেনই বা কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার অতীত ইতিহাস জানা সত্ত্বেও কুফায় যাওয়ার জন্য মক্কা থেকে বের হলেন,কেন তিনি মু‘আবিয়ার সময় বিদ্রোহ করলেন না,অথচ ইয়াযীদের সময় বিদ্রোহ করলেন,তাঁর আন্দোলনের কারণই বা কী ছিল এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিভিন্ন গ্রন্থে এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে। অনেক গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.) আন্দোলনের শুরু থেকে তাঁর শাহাদাতবরণ পর্যন্ত যেসব বক্তব্য প্রদান করেছেন সেসব ভাষণ উদ্ধৃত হয়েছে। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত যেসব গ্রন্থ আমাদের এ বিষয়গুলো জানতে সাহায্য করবে সেগুলো হল :

১. ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস কর্তৃক প্রকাশিত শেইখ আব্বাস কুম্মী সংকলিত নাফাসুল মাহমুম গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ‘শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস’(১ম ও ২য় খণ্ড);

২. ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর কর্তৃক প্রকাশিত আয়াতুল্লাহ শহীদ মূর্তাজা মোতাহ্হারী প্রণীত হামাসায়ে হুসাইনী গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ ‘ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লব’;

৩. হযরত আয়াতুল্লাহ আল উযমা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ হুসাইন ফাযলুল্লাহ’র দপ্তর,কোম,ইরান থেকে প্রকাশিত আয়াতুল্লাহ আল উযমা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ হুসাইন ফাযলুল্লাহ প্রণীত ‘আশুরার শিক্ষা’;

৪. ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর কর্তৃক প্রকাশিত আয়াতুল্লাহ মূর্তাজা মোতাহ্হারী প্রণীত ‘শহীদ’;

৫. ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর কর্তৃক প্রকাশিত ড. আলী শরীয়তী প্রণীত ‘জাগো সাক্ষ্য দাও’;

৬. আল হোসেইনী প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সাইয়েদ ইবনে তাউস প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থ লুহুফ-এর বাংলা অনুবাদ ‘কারবালা ও হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত’;

৭. ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর কর্তৃক প্রকাশিত ‘আশুরা সংকলন’।

গ্রন্থগুলো অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা ইমাম হুসাইনের আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাগুলোকে জেনে নিতে পারব।

একটা সময় যখন বাংলা ভাষায় ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করে বা শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনার সত্যচিত্র তুলে ধরে এমন গ্রন্থ ছিল না তখন মানুষ বিষাদ সিন্ধুকে সাদরে গ্রহণ করেছিল তাদের জিজ্ঞাসু মনের পিপাসা মেটাবার জন্য। কিন্তু আজ যখন সত্য ঘটনার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা সম্বলিত গ্রন্থ পাওয়া যাচ্ছে তারপরও এ দেশের মানুষের কাছে বিষাদ সিন্ধুর সেই ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গ্রন্থের মর্যাদা অটুট রয়ে গেছে।

অনেক উপন্যাস,নাটক,গল্প ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা রাজনৈতিক উপন্যাসের বিরুদ্ধেও সমালোচনা হয়েছে। আশ্চর্য বোধ হয় যে,মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের চরিত্র হননের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠেনি। একই সাথে ব্যথিত হই এ ভেবে যে,বেহেশতের যুবকদের নেতাদের চরিত্রের ওপর কালিমা লেপনকারী সাহিত্য কীভাবে মুসলমানদের কাছে গ্রহণীয় হয়ে গেল? পরিশেষে বলতে চাই,যদি লেখকের যা খুশী লেখার অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয় তবে নীতি-নৈতিকতাকে আমাদের বিদায় জানাতে হবে। মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি খেলো হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আমরা আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে উপহাস বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে পারি না। যদি আমরা তা করি তবে সভ্য মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতে আমাদের বারবার ভাবতে হবে।

আসুন,সত্য ইতিহাস প্রচারের মাধ্যমে কারবালার ঘটনা সম্পর্কে মানুষের মনে যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তার অপনোদন করি। মানুষ হিসাবে আমাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করি।

(সূত্র: প্রত্যাশা, বর্ষ ১,সংখ্যা ৩)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.