ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.)

সংকলন : মোঃ আশিফুর রহমান

সংক্ষিপ্ত জীবনী
ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) ৩৮ হিজরির ৫ শাবান বৃহস্পতিবার পবিত্র মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। এ শুভ সংবাদ হযরত আলী (আ.)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য সিজদা করেন। তিনি এই নবজাতকের নাম রাখেন ‘আলী’। পরবর্তীকালে ইবাদত-বন্দেগির কারণে তাঁর প্রকৃত নামের পাশাপাশি সকলের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন দু’টি মহান উপাধি দ্বারা। একটি হলো ‘যায়নুল আবেদীন’ (ইবাদতকারীদের সৌন্দর্য) আর অপরটি হলো ‘সাইয়্যেদুস সাজেদীন’ (সিজদাকারীদের নেতা)। ইসলামের এই মহান ব্যক্তিই হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের ধারার চতুর্থ ইমাম; পরবর্তী ইমামগণ তাঁরই বংশধারায় এই পৃথিবীতে জন্মলাভ করেছেন। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর কুনিয়াত বা ডাক নাম হলো আবু মুহাম্মাদ।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) শৈশবের প্রথম কয়েক বছর অতিবাহিত করেন পিতামহ আলী ইবনে আবু তালিবের স্নেহক্রোড়ে এবং পরবর্তীকালে চাচা ইমাম হাসান ও পিতা ইমাম হুসাইনের কাছে লালিত-পালিত হন । তাঁদের কাছ থেকেই তিনি লাভ করেন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা এবং সেই শিক্ষা নিয়েই নিজেকে তিনি গড়ে তোলেন মহান আল্লাহর প্রতি নিবেদিত একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসাবে।
শৈশব থেকেই তিনি আহলে বাইতের ও তাঁদের অনুসারীদের ওপর বনু উমাইয়্যার অত্যাচার-নির্যাতন প্রত্যক্ষ করছিলেন এবং নবী পরিবারের সদস্য হিসাবে তিনি নিজেও এই নিপীড়ন সহ্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এর মধ্যেই ৫০ হিজরিতে ইমাম হাসান (আ.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ব্যথাও তাঁকে বহন করতে হয়। এরপর কেটে যায় আরো দশটি বছর। অবশেষে ৬১ হিজরির কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা যেন তাঁর ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা হিসাবে দেখা দেয়।
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার সময় ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনায় তিনি তাঁর পিতা ইমাম হুসাইন (আ.), চাচা হযরত আব্বাস (আ.), তাঁর ভাই হযরত আলী আকবার ও আলী আসগারসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং ইমামবংশের অনুসারীদের শাহাদাত প্রত্যক্ষ করেন। অসুস্থতার কারণে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সেই কারণে নিহত হওয়া থেকে রেহাই পান।
শাহাদাতের আগে ইমাম হোসাইন (আ.) শেষ বারের মতো যখন নিজ তাঁবুতে পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে আসেন তখনও হযরত যায়নুল আবেদীন রোগশয্যায় শায়িত। এই অবস্থাতেই ইমাম হোসাইন তাঁর এই পুত্রকে পরবর্তী ইমাম হিসাবে স্থলাভিষিক্ত করে যান।
কারবালার ঘটনার পর ইয়াযীদের বর্বর বাহিনীর হাতে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) লাঞ্ছনার শিকার ও বন্দি হন। নারীদের সাথে তাঁকেও বন্দি করে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ইয়াযীদের রাজপ্রাসাদে হযরত যায়নাব (সা. আ.) ও হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় জনমত বিগড়ে যাবার ভয়ে ইয়াযীদ তাঁদেরকে সসম্মানে মদীনায় পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
মদীনায় ফিরেও ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) চরম নির্যাতনের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেন। তাঁর চলাফেরার ওপর আরোপ করা হয় কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কোন ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ইমাম যায়নুল আবেদীনকে তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন : ‘আমাদের অবস্থা ফিরআউন বংশীয়দের মাঝে বনু ইসরাইলের ন্যায়- তারা তাদের শিশুদের হত্যা করত এবং তাদের নারীদের ছেড়ে দিত।’
উমাইয়্যা গভর্নর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল লোকদেরকে সবসময় হুমকির মধ্যে রাখত। তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়েছিল। তারা প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি চালাত। আহলে বাইতের প্রতি অনুরক্ত হওয়ার কারণে লোকদেরকে বন্দি করা হতো এবং তাদের অনেককে হত্যা করা হতো।
অন্যদিকে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) কিছুদিন নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। নিভৃতে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) অধিক পরিমাণে নামায পড়তেন, দোয়া ও মোনাজাতে মশগুল থাকতেন আর ইমাম হোসাইন (আ.)-এর স্মরণে সবসময় চোখের পানি ফেলতেন। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর নিভৃতে অবস্থান করার পেছনে কিছু কারণও ছিল। যেমন :
১. ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) কোন গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নন- এটি শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রতিষ্ঠা করা। ইয়াযীদের অনুচররা সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল এবং তারা সব সময় ইমামের সাথে দেখা করতে আসা লোকদের প্রতি নজরদারি করত। আর এটাও যাচাই করত যে, ইমাম যায়নুল আবেদীন ইয়াযীদের বিরুদ্ধে কোনরকম গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কিনা। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারা ইমাম কর্তৃক এমন কোন কর্মকাণ্ডের অস্তিত্ব খুঁজে পায় নি।
২. নিভৃতে অবস্থান ও রাজনীতি থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে তিনি ইয়াযীদ ও বনু উমাইয়্যাকে এ ধারণা দেন যে, বর্তমান অবস্থায় রাজনীতির বিষয়ে তাঁর কোন আগ্রহ নেই।
৩. উম্মতের সামনে মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে আদর্শ উপস্থাপন।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর আন্দোলন
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার পর ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর আন্দোলন শুরু করেন। বনু উমাইয়্যা ও তাদের অনুসারীরা মুসলমানদের দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন ও আহলে বাইতের মর্যাদা এবং ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবগত ছিল। তাই তারা ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে ধূ¤্রজাল সৃষ্টি করতে চেষ্টা করল যাতে যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা এড়াতে পারে, বিশেষ করে তাদের প্রধান অবস্থান সিরিয়ায়। তারা ইমাম হোসাইনকে একজন বৈধ খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হিসাবে দেখাতে প্রয়াস পায়। যদি ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) এর বিরোধিতা না করেই ছেড়ে দিতেন তাহলে উমাইয়্যাদের অপপ্রচারটাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। আর তাই ইমাম যায়নুল আবেদীন প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনি ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের কারণ স্পষ্টভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন। হযরত যায়নাব, হযরত উম্মে কুলসুমও বনু উমাইয়্যার কুৎসিত রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন করে দেয়ার পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
বন্দি অবস্থায় সিরিয়ায় উপনীত হলে এক বৃদ্ধ তাঁদের পরাজয় ও ইয়াযীদের বিজয় লাভের জন্য মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কিন্তু ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) পবিত্র কুরআনের কতিপয় আয়াত থেকে আহলে বাইত তথা নিজেদের পরিচয় তুলে ধরেন এবং ইয়াযীদের অপকর্মকে প্রকাশ করে দেন। একইভাবে ইয়াযীদের দরবারে ও সিরিয়ার মসজিদেও তিনি নিজের পরিচয় তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন এবং এতে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর
মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ভিন্ন পদ্ধতিতে তাঁর আন্দোলন কর্মকা- অব্যাহত রাখেন। তিনি এক্ষেত্রে যেসব কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. জ্ঞানকেন্দ্র স্থাপন : ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) মদীনার মসজিদে নববী ও তাঁর ঘরকে জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত করেন। তাঁর নিকট আগত লোকদেরকে তিনি সত্যিকার ইসলামের জ্ঞান বিতরণ করতে থাকেন।
২. জাল হাদীস ও জাহেলি রীতির পুনঃপ্রচলন রোধ : তিনি ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আ.) এবং আলী (আ.)-এর নিকট থেকে প্রাপ্ত মহানবী (সা.)-এর সহীহ হাদীসগুলো প্রচার করতেন। বনু উমাইয়্যা যেসব জাহেলী রীতির পুনঃপ্রচলন ঘটাতে চাচ্ছিল সেগুলোকে তিনি প্রকাশ করে দেন।
৩. কারবালার ঘটনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা : যেহেতু কারবালার ঘটনা ছিল ইয়াযীদ ও বনু উমাইয়্যার চরিত্র উন্মোচনকারী, অত্যাচারীদের মোকাবিলায় দাঁড়ানোর ভিত্তি এবং ধর্মের পুনরুজ্জীবন, আর এটাই ছিল ইসলামী চরিত্রের মানদণ্ড সেহেতু ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) কারবালার ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতেন।
৪. ইমাম হোসাইনের স্মরণকে জাগরুক রাখা :
ক. ক্রন্দন করা : ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীসাথিদের স্মরণ ও তাঁদের জন্য ক্রন্দন করার মাধ্যমে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) মানুষের স্মৃতিতে ইমাম হোসাইনকে জাগরুক রাখেন। তিনি মানুষের মনে ইমাম হোসাইনের জন্য বেদনাবোধ সৃষ্টি করতেন এবং তাদেরকে অন্তর দিয়ে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতেন। তিনি তাঁর বাড়ির সন্নিকটে একটি জায়গাকে বেছে নেন ইমাম হোসাইনকে স্মরণ করার জন্য।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) কারবালার স্মরণে প্রতিনিয়ত ক্রন্দন করতেন। চোখের পানিতে তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। যখন তিনি খাবার খেতেন ও পানি পান করতেন তখন কাঁদতেন। নানা উপলক্ষেও। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে তিনি ক্রন্দন করতেন। যখনই মুহররম মাস আসত ইমামের চেহারায় বিষাদের ছায়া আরো ঘনীভূত হতো। যখন তিনি দেখতেন, কোন কসাই পশুকে জবাইয়ের জন্য নিয়ে যাচ্ছে তখন তিনি জিজ্ঞেস করতেন যে, সেটাকে পানি খাওয়ানো হয়েছে কিনা। কসাই ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি বলতেন : ‘কিন্তু আমার পিতাকে, আমার পরিবার-পরিজনকে পানি না দিয়ে পিপাসার্ত অবস্থায় শহীদ করা হয়েছে।’ এরপর তিনি ভীষণভাবে ক্রন্দন করতেন।
ইবনে আসাকির তাঁর সূত্রে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-কে প্রশ্ন করা হলো : ‘কেন আপনি ইমাম হুসাইনের জন্য এত অধিক কান্নাকাটি করেন?’ তিনি জবাবে বলেন : ‘আমাকে এজন্য সমালোচনা কর না। কারণ, ইয়াকুব (আ.) তাঁর এক সন্তান নিখোঁজ হওয়াতে এতটা ক্রন্দন করেন যে, তাঁর চোখ সাদা হয়ে যায়। অথচ তিনি জানতেন তাঁর সন্তান জীবিত আছেন। আর আমি আমার চোখের সামনে আমার পরিবারের চৌদ্দজন সদস্যকে জবেহ করে হত্যা করতে দেখেছি। তোমরা কি এ চরম দুঃখ-কষ্টের বিষয়টি আমার মন থেকে মুছে ফেলতে চাও?’ (তারীখে দামেশ্ক, ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) জীবনী অধ্যায়, পৃ. ৫৬)
তবে তিনি এজন্যও কাঁদতেন যেন মুসলমানদের মধ্যে ইমাম হোসাইনের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। লোকজনও তাঁর সাথে ক্রন্দন করে তাঁর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করত এবং ইয়াযীদ ও বনু উমাইয়্যার নিষ্ঠুরতাকে স্মরণ করত। আর এভাবে ইমাম হোসাইনের স্মরণের মধ্য দিয়ে প্রকৃত দ্বীনকে ফিরে পাওয়া ও আনুগত্যের আবহ সৃষ্টির প্রয়াস পেতেন। ইমাম যায়নুল আবেদীন সারা জীবন কারবালার শোকে ক্রন্দন করেছিলেন। আর তাঁর সাথে ক্রন্দনকারীদের সংখ্যাও দিনে দিনে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল।
খ. কারবালায় যিয়ারত : ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) প্রতি বছর কারবালায় যেতেন। তিনি সকলকে কারবালায় যিয়ারত করার জন্য আহ্বান জানাতেন। সফরের জন্য সময় বের করা, সফরের কষ্ট সহ্য করা এবং অর্থ ও শারীরিক শক্তি ব্যয় করার প্রয়োজন হতো। এভাবে তিনি মুসলমানদেরকে কারবালার ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করতে চাইতেন।
গ. আশুরার দিবস পালন : ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) প্রতি বছর আশুরার দিবস পালনের জন্য লোকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি লোকদেরকে এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও বক্তব্য শোনার জন্য উৎসাহিত করতেন যাতে তারা আশুরার ঘটনাকে স্মরণ করে ইসলামের পথে যে কোন প্রকার ত্যাগের জন্য নিজেদেরকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করতে পারে।
৫. সর্বসাধারণের সাথে সংযোগ স্থাপন : পূর্ববর্তী ইমামগণের ন্যায় ইমাম যায়নুল আবেদীন ও উম্মাহর প্রতি ভীষণভাবে মনোযোগী ছিলেন। তাদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে তিনি তাঁদের নিকট একজন দয়ার্দ্র পিতা, একজন জ্ঞানী নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন যিনি উম্মাহর দুঃখ-যন্ত্রণা লাঘবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আস-সাজ্জাদ মদীনার ১০০টি দরিদ্র পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অনাথ, অভাবী, দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ ব্যক্তি এবং যাদের কোন সহায় নেই এমন ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি নিজেই তাদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। যাদের স্ত্রী-পরিজন ছিল তারাও ইমামের কাছ থেকে খাবার পেত। শারীরিকভাবে দুর্বল প্রতিবেশীদের জন্য তিনি রাতের বেলা পানি বহন করে আনতেন এবং ক্রীতদাস ক্রয় করে মুক্ত করে দিতেন।
৬. ইমামতের ব্যাখ্যা : ইমামত ও ইমামগণের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি এবং ঐশীভাবে মনোনীত হিসাবে ইসলাম ধর্মে তাঁদের আবশ্যকীয় ভূমিকা ব্যাখ্যা করতেন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)। যেমন একটি দোয়ায় তিনি বলেন : ‘হে প্রভু! তোমার আহলে বাইতের ওপর রহমত বর্ষণ কর, যাদেরকে তুমি তোমার (পথে) কর্ম সম্পাদনের জন্য পছন্দ করেছ এবং তাদেরকে তোমার জ্ঞানের সংরক্ষক ও তোমার ধর্মের অভিভাবক করেছ; পৃথিবীর বুকে তোমার খলিফা নিযুক্ত করেছ এবং তোমার জান্নাত লাভের পথ করেছ।’ (হোসাইন বাকের প্রণীত আল-সাজ্জাদ, পৃ. ৫০)
উমাইয়্যাদের প্রতিক্রিয়া ও ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত
উমাইয়্যা খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান আহলে বাইতের অনুসারীদের দমন-পীড়নের চিন্তা করতে থাকে। এজন্য সে কুখ্যাত হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে কুফার গভর্নর হিসাবে নিয়োগ করে। সে কুফায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, কঠোর হস্তে আহলে বাইতের অনুসারীদের দমন করে, সামান্য সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অনেক লোককে সে হত্যা করে।
ইমাম বাকের (আ.) বলেন : ‘তারপর আগমন ঘটে হাজ্জাজের। সে তাদেরকে (আহলে বাইতের অনুসারীদের) নৃশংস পন্থায় হত্যা করত। বিন্দুমাত্র সন্দেহের বশে সে তাদেরকে নির্যাতন করত। অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে, কোন ব্যক্তি হযরত আলীর অনুসারী হিসাবে নিজেকে পরিচয় দেয়ার চেয়ে নাস্তিক অথবা কাফির বলে পরিচয় দেয়াকে নিজের জন্য উত্তম বলে মনে করত।’
অনেক ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, হাজ্জাজ ৯৫ হিজরিতে ইরাকের ওয়াসিত নামক স্থানে মারা যায়। সে ১২০০০০ মুসলমানকে হত্যা করেছিল, ৫০০০০ পুরুষ ও ৩০০০০ নারীকে বন্দি করেছিল। সে পুরুষ ও নারী বন্দিদেরকে একটি জায়গায় বন্দি করে রাখত।
ইমামগণের উপস্থিতিকে বনু উমাইয়্যা নিজেদের জন্য হুমকি হিসাবে মনে করত। তারা এজন্য ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত যে, ইমামগণের প্রভাবে একদিন জনগণ তাঁদের নেতৃত্বে সংগঠিত হবে এবং বনু উমাইয়্যার শাসনক্ষমতার পতন ঘটাবে।
আবদুল মালিকের মৃত্যুর পর তার পুত্র ওয়ালিদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। সে ইমাম যয়নুল আবেদীনের সামাজিক সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে ভীত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে ইমামকে কেবল ভয়-ভীতি দেখিয়ে এ কাজ থেকে বিরত রাখা যাবে না। তখন সে ইমামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এই ষড়যন্ত্রের ফলেই অবশেষে পঁয়ত্রিশ বছর পবিত্র ইমামতের দায়িত্ব পালনের পর চতুর্থ ইমাম হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.) ৯৫ হিজরিতে (৭১২ খ্রিস্টাব্দে) শাহাদাত বরণ করেন। ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করে। মদীনার জান্নাতুল বাকী করবস্থানে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে সমাহিত করা হয়।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
মুসলিম লেখকগণ প্রতিভা, জ্ঞান এবং ধার্মিকতার জন্য ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ইমাম যুহরী বলেন : ‘আমি এই (মহানবীর) পরিবারের মধ্য থেকে আলী ইবনুল হোসাইনের চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও প্রতিভাবান কোন ব্যক্তিকে দেখার সুযোগ পাইনি।’
ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর ‘সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ’ গ্রন্থে বলেন : ‘যায়নুল আবেদীন হলেন এমন ব্যক্তি যিনি তাঁর পিতার জ্ঞান, দুনিয়াবিমুখতা ও ইবাদত উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছিলেন।’
আস-সহীফা আস-সাজ্জাদিয়া
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ওপর অধিক কঠোরতা আরোপ করা হলে তিনি আন্দোলনের বিকল্প পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। আর সেটা হলো আল্লাহর কাছে নিবেদন পেশ করার জন্য মোনাজাত করা। ‘আস-সাহীফা আল-কামিলাহ’ বা ‘আস-সাহীফা আস-সাজ্জাদীয়া’ বলে খ্যাত তাঁর মোনাজাতের এসব মূল্যবান সংগ্রহ ‘আলে মুহাম্মাদের যাবুর’ বলেও পরিচিত। ‘আস-সহীফা আস-সাজ্জাদীয়া’ গ্রন্থে ৫৭টি দোয়া রয়েছে। এসব দোয়ার মধ্যে রয়েছে মহান আল্লাহর প্রশংসা, মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর দরুদ, ফেরেশতাদের প্রতি দরুদ, নবিগণের অনুসারীদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ চাওয়া, আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাওয়া, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা, শত্রুদের শত্রুতাকে প্রতিহত করার দোয়া ইত্যাদি। এসব মোনাজাতের মাধ্যমে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) মুসলমান ও বিশ্ববাসীর জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
‘রিসালাতুল হুকুক’ (অধিকার পত্র)
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম হলো ‘রিসালাতুল হুকুক’ (অধিকার পত্র)। এটি অধিকার সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থে মহান আল্লাহর অধিকার, নিজের প্রতি অধিকার, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অধিকার, আত্মীয়-স্বজনের অধিকার, প্রতিবেশীর প্রতি অধিকার এভাবে ৫০টি অধিকারের প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : ‘তোমার কাঁধে এই পঞ্চাশটি অধিকার রয়েছে যা থেকে তুমি বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না এবং সেগুলো মেনে চলা ও পালন করার চেষ্টা করা আর এ কাজে মহামহিম আল্লাহর সাহায্য চাওয়া তোমার ওপর আবশ্যক।’
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর প্রজ্ঞা ও উপদেশমূলক বাণীসমূহ থেকে
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর এক পুত্রকে বলেন : প্রিয় পুত্র আমার ! পাঁচ ব্যক্তি থেকে বিরত থাকবে, তাদের সাথে ওঠা বসা করবে না, তাদেরকে আলাপের সাথি ও পথের সাথি করবে না। সে বলল : হে পিতা! তারা কারা? ইমাম বললেন : কখনই মিথ্যাবাদীর সাথে ওঠাবসা করবে না। কারণ, সে হলো মরীচিকাসদৃশ, দূরকে নিকট এবং নিকটকে তোমার কাছে দূর করে দিবে। কখনই ফাসেক ও খারাপ ব্যক্তির সাথে চলাফেরা করবে না। কেননা, সে তোমাকে এক লোকমা কিংবা তার চেয়েও কম মূল্যে বিক্রি করে দিবে। কৃপণ লোকের সহচর হবে না। কেননা, তার প্রতি তোমার চরম প্রয়োজনের দিনে সে তোমাকে ত্যাগ করবে। কোনো বোকার বন্ধু হয়ো না। সে তোমার উপকার করতে গিয়ে ক্ষতি করে বসবে। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথেও বন্ধুত্ব কর না। কারণ, আমি তাকে কোরআনে অভিশপ্ত পেয়েছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.