শেকল খুলে হারুনের জেল থেকে অদৃশ্য হয়ে মদিনা গেলেন ইমাম!

শেকল খুলে হারুনের জেল থেকে অদৃশ্য হয়ে মদিনা গেলেন ইমাম!

শেকল খুলে হারুনের জেল থেকে অদৃশ্য হয়ে মদিনা গেলেন ইমাম!

আজ হতে ১২৫৪ চন্দ্র-বছর আগে ১৮৩ হিজরির এই দিনে (২৫ রজব) বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য এবং হযরত ইমাম জাফর আস সাদিকের (আ.) সন্তান ইমাম মুসা কাযিম (আ.) শাহাদত বরণ করেন। ইরান ও ইরাকসহ বিশ্বব্যাপী আজ পালন করা হচ্ছে মহাশোকের এই দিবস। ইরাকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভিড় জমিয়েছেন তাঁর পবিত্র মাজার প্রাঙ্গনে।

 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) ১২৮ হিজরির ৭ সফর জন্ম-গ্রহণ করেন ‘আবওয়া’ নামক এলাকায়। এই এলাকাটি ছিল পবিত্র মক্কা ও মদীনার মধ্যে কোনো একটি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।

 

পিতা ইমাম জাফর আস সাদিকের (আ.) শাহাদতের পর ২০ বছর বয়সে ঐশী ইমামত লাভ করেন মুসা কাযিম (আ.)। পিতার মত তাঁকেও বিষ প্রয়োগে শহীদ করেছিল খলিফা নামধারী তৎকালীন মুসলিম শাসক। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর (১৮৩ হিজরি) । আব্বাসীয় জালিম শাসকদের মধ্যে মনসুর, মাহদি, হাদি ও হারুন ছিল তাঁর সমসাময়িক। অশেষ ধৈর্য ও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের গুণের জন্য এই মহান ইমামকে বলা হত কাযিম।

 

তিনি ছিলেন পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.)’র মতই নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পিতার মহত গুণগুলোর সবই অর্জন করেছিলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.)। তাঁর ৩৫ বছরের ইমামতির জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে কারাগারে ও নির্বাসনে।

 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আব্বাসীয় শাসকদের শত অত্যাচার ও নিপীড়ন এবং কারাদণ্ড ও নির্বাসন সত্ত্বেও ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচারের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

বাগদাদের উপকণ্ঠে তাঁর সুদৃশ্য মাজার আজ কোটি কোটি আহলে-বাইত প্রেমিকের জিয়ারতগাহ। অথচ জালিম আব্বাসিয় শাসকদের কবরেরও কোনো চিহ্ন নেই তাদের প্রাসাদগুলো তো থাক দূরের কথা।

 

হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)’র শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বনবী (সা) ও ইমাম মুসা কাযিমসহ মহানবীর আহলে বাইতের সব সদস্যের প্রতি জানাচ্ছি অশেষ দরুদ ও সালাম এবং সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।

 

এবারে আমরা এই নিষ্পাপ বা মাসুম ইমামের জীবনের কয়েকটি মু’জিজা তুলে ধরছি:

 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.)-কে বিভিন্ন সময়ে নানা কারাগারে রাখা হয়েছিল। যেমন ইমামকে বসরায় ঈসা ইবনে জাফর নামক এক জল্লাদের কারাগারে এক বছর বন্দী রাখা হয়। সেখানে ইমামের ইবাদত-বন্দেগি ও উত্তম চরিত্র জাফরের ওপর এমন প্রভাব রাখে যে ওই জল্লাদ হারুনের কাছে এক লিখিত বার্তায় জানিয়ে দেয় যে: তাঁকে আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে নাও, নতুবা আমি তাঁকে মুক্ত করে দেব। এরপর হারুনের নির্দেশে ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)-কে বাগদাদে ফাযল ইবনে রাবির কাছে কারারুদ্ধ করা হয়। এর কিছু দিন পর ফাযল ইবনে ইয়াহিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয় এই মহান ইমামকে। কয়েক দিন পর সেখান থেকেও তাঁকে পাঠানো হয় কুখ্যাত জল্লাদ সানদি ইবনে শাহাকের কারাগারে।

ইমাম কাযিম (আ.)-কে এক কারাগার থেকে বার বার অন্য কারাগারে স্থানান্তরের কারণ ছিল এটাই যে হারুন প্রতিবারই কারা প্রহরীকে নির্দেশ দিত ইমামকে গোপনে হত্যা করার। কিন্তু তাদের কেউই রাজি হয়নি এ কাজ করতে। অবশেষে সানদি ইমামকে বিষ প্রয়োগ করতে রাজি হয়।

যাই হোক ইমামের কারারক্ষী মুসাইব বলেছে:

“শাহাদতের তিন দিন আগে ইমাম আমাকে ডাকিয়ে এনে বলেন: আমি আজ রাতে মদীনা যাব যাতে আমার পুত্র আলীর ( ইমাম আলী ইবনে মুসা রেজা-আ.) কাছে ইমামতের এবং আমার পর আমার খলিফা ও ওয়াসির দায়িত্ব অর্পণ করতে পারি।

আমি বললাম: এতসব প্রহরী বা কারারক্ষী, তালা ও শেকল (যা দিয়ে ইমামকে বেঁধে রাখা হয়েছিল) থাকার পরও কি আপনি আশা করেন যে এখান থেকে আপনাকে বের হতে দেয়ার সুযোগ করে দেব!!!?

ইমাম বললেন: হে মুসাইব, তুমি কি মনে কর আমাদের ঐশী বা খোদায়ী শক্তি কম?

আমি বললাম: না, হে আমার মাওলা বা নেতা।

ইমাম বললেন: তাহলে কী?

বললাম, দোয়া করুন যাতে আমার ঈমান আরো শক্তিশালী হয়।

ইমাম বললেন: হে আল্লাহ! তাকে দৃঢ়চিত্ত রাখ।

এরপর তিনি বললেন: আমি ঠিক সেই ‘ইসমে আযমে ইলাহি’ দিয়ে- যা দিয়ে আসফ বিন বারখিয়া (হযরত সুলায়মান-আ’র মন্ত্রী) বিলকিসের (সাবার রানী) প্রাসাদকে চোখের এক পলক ফেলার সময়ের মধ্যেই ইয়েমেন থেকে ফিলিস্তিনে নিয়ে এসেছিল- আল্লাহকে ডাকব ও মদীনায় যাব।

হঠাৎ দেখলাম যে ইমাম একটি দোয়া পড়লেন ও অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন এবং নিজের হাতেই কারাগারের শেকলগুলো দিয়ে নিজের পা মুবারক বাঁধলেন।

 

এরপর ইমাম মুসা কাযিম (আ.) বললেন: আমি তিন দিন পর দুনিয়া থেকে বিদায় (শহীদ) হব।

 

আমি কাঁদতে লাগলাম। আর ইমাম বললেন: কেঁদো না, জেনে রাখ, আমার পর আমার ছেলে আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) তোমার ইমাম বা নেতা। (বিহারুল আনোয়ার, খণ্ড-৪৮, পৃ-২২৪)

রাসূল (সা.)’র জ্ঞানের দরজাগুলো আমিরুল মু’মিনিন (আলী-আ.)’র সামনে খুলে গিয়েছিল এবং সেই ঐশী জ্ঞান প্রত্যেক ইমামের মাধ্যমে পরবর্তী ইমামের কাছে পৌঁছেছে।

 

গাভী জীবিত করলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.)

আলী বিন মুগিরা বলেছেন, ইমাম মুসা কাযিমের (আ.)’র সঙ্গে মিনায় যাচ্ছিলাম। পথে দেখলাম এক মহিলা ও তার ছোট ছেলে বেশ ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে?

ইমাম প্রশ্ন করলেন: কেন কাঁদছ?

ওই নারী ইমামকে চিনত না। সে বলল: আমার ও আমার এই ইয়াতিম সন্তানের একমাত্র পুঁজি ছিল এই গাভীটি। তার দুধ দিয়ে আমরা জীবিকা নির্বাহ করতাম। এখন গাভীটি মরে যাওয়ায় আমরা উপায়হীন হয়ে পড়লাম।

ইমাম বললেন: তোমরা কি চাও এই গাভীটিকে আমি জীবিত করি?

সে বলল: হ্যাঁ, হ্যাঁ।

ইমাম এক কোনায় গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়লেন এবং নামাজ শেষে আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া করলেন। এরপর তিনি মৃত গাভীর কাছে এসে তার শরীরের এক পাশে আঘাত করলেন। হঠাত গাভীটি জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াল।

ওই নারী এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো: দেখে যাও, কাবার প্রভুর শপথ, ইনি হচ্ছেন ঈসা ইবনে মরিয়ম!

লোকের ভিড় জমে গেল এবং তারা গাভীটি দেখতে ও ওই নারীর কথা শুনতে লাগল। ইমাম (আ.) মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে নিজেকে আড়াল করে নেন এবং নিজের পথে চলতে থাকেন। (বাসায়ের আদ দারজাত, পৃ-৫৫ এবং বিহারুল আনোয়ার, খণ্ড-৪৮)

 

বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতভুক্ত নিষ্পাপ ইমামগণ সব জীবন্ত প্রাণীর ভাষা ও বক্তব্য বোঝেন এবং তা তাঁদের খোদায়ী ইমামতের অন্যতম প্রমাণ। (অর্থাৎ যার এই ক্ষমতা নেই তিনি ঐশী ইমাম নন।)

 

আবু বাসির ইমাম মুসা কাযিম (আ.)-কে প্রশ্ন করেন: ঐশী ইমামকে চেনার উপায় কি কি?

ইমাম বললেন: সত্যিকারের ইমামের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পূর্ববর্তী ইমাম তাঁকে ইমাম হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবেন, যেমনটি রাসূল (সা.) আলী ইবনে আবি তালিবকে মুসলমানদের ইমাম হিসেবে ঘোষণা করে গেছেন।

 

দ্বিতীয় লক্ষণ হল, তাঁকে তথা ইমামকে যে প্রশ্নই করা হোক না কেন, তিনি তার জবাব দেবেন এবং কোনো বিষয়েই তিনি অজ্ঞ বা বেখবর নন।

তৃতীয় লক্ষণ হল ইমাম কখনও সত্যের প্রতিরক্ষায় নীরব থাকবেন না। তিনি ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী সম্পর্কে খবর দেন এবং সব ভাষাতেই কথা বলেন।

এরপর ইমাম মুসা কাযিম (আ.) বললেন: এখন তোমাকে একটি লক্ষণ দেখাব যাতে তোমার হৃদয় নিশ্চিত হয়।

 

ঠিক সে সময় খোরাসান অঞ্চলের এক ব্যক্তি ইমামের কাছে আসেন এবং ইমামের সঙ্গে আরবিতে কথা বলতে থাকেন। কিন্তু ইমাম ফার্সিতে জবাব দিলেন। খোরাসানের লোকটি তখন বললেন: আমি ভেবেছিলাম যে আপনি ফার্সি ভাষা বুঝবেন না।

 

ইমাম বললেন: সুবাহান আল্লাহ! যদি তোমার প্রশ্নের জবাব তোমার ভাষাতেই দিতে না পারি তাহলে তোমার চেয়ে আমার শ্রেষ্ঠত্ব থাকলো কোথায়?

এরপর তিনি বললেন: ‘ইমাম হচ্ছেন তিনি যার কাছে কোনো ব্যক্তির ভাষাই গোপন বা আড়াল নয়। তিনি প্রত্যেক ব্যক্তি ও জীবিত বস্তুর কথা বোঝেন। এইসব বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই ইমামকে চেনা যায় এবং যাদের এইসব বৈশিষ্ট্য নেই তারা ইমাম নন।’ #

 

মু. আমির হুসাইন/৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.