খন্দকার মোঃ মাহফুজুল হক
গোটা বিশ্বের দৃষ্টি এখন আবারো মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নিবদ্ধ। কারণ, যুদ্ধের দামামা এখনো থামেনি সেখানে। এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও ঘটনা সেই একই। অর্থাৎ সংঘাত, হত্যাকাণ্ড এবং ব্যাপক ধংসযজ্ঞ। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল যেন জঙ্গিবাদ ও হানাহানির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এর কারণ কী বা কারা এর জন্য দায়ী?
এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকে হয়ত অভিযোগের অঙ্গুলি তুলবেন মুসলমানদের দিকে, আবার কেউ হয়ত দায়ী করবেন ইহুদিবাদী ইসরাইলকে। সহজ হিসাবে এমনটি মনে করাও স্বাভাবিক। কারণ, ইসরাইলের ইহুদিবাদী নেতারা ফিলিস্তিনে তাদের জবরদখল পাকাপোক্ত করতে জুলুম, নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা, অপহরণ ও কূটকৌশলের মতো এমন কোন হীন কাজ নেই যা করতে সামান্যতম দ্বিধা করে। ফলে গত কয়েক দশক ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি ও সংঘাতের স্থায়ী উপাদান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অপর দিকে আমরা দেখতে পাই, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি আরব দেশের অপরিণামদর্শী নীতি এবং ইরাকের প্রয়াত স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের ঔদ্ধত্যের কারণে এ অঞ্চলে দুটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়েই এ অঞ্চলে বিদেশী আগ্রাসনের পথ সুগম হয়েছে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করার জন্য কোন আরব বা পশ্চিমা দেশ সরাসরি নিজেদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে পাঠায় নি, তারা তা না করে মুসলমানদের মধ্যকার ধর্মীয় কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে রণাঙ্গনে পাঠায়। ফলে ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো যারা মূলত ফতোয়াবাজিতে সীমাবদ্ধ ছিল তারা উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সশস্ত্র হওয়ার সুযোগ পায়। আফগান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই গোষ্ঠীগুলোই তালেবান, আলকায়দা প্রভৃতি নামে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি একটি শক্তিশালী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে পুনরায় আতঙ্ক ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। এই জঙ্গিরা ইতিমধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই দুই দেশের প্রায় চল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা করায়ত্ত করে জঙ্গিরা এর নাম দিয়েছে ‘দি ইসলামিক স্টেট’ বা ‘আইএস’। গত ১০ জুন অনেকটা আকস্মিকভাবে আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত ‘আইএস’ জঙ্গিরা ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী মসুল দখল করে নেয় এবং ২৯ জুন তারা নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে ‘আইএস’ নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলে ইসলামী শরীয়ত প্রতিষ্ঠার নামে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে ধরে এনে নৃশংস কায়দায় গলা কেটে হত্যা করছে, সারিবদ্ধভাবে গুলি করে খুন করছে বিভিন্ন বয়সের তরুণ ও যুবকদেরকে। এমনকি হত্যার পর দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের উল্লসিত ছবি সাইবার জগতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের এই নৃশংসতা থেকে শিয়া-সুন্নি কেউই রেহাই পাচ্ছে না।
নারীর সাথে তাদের আচরণ আরও অমানবিক। আফগানিস্তানে তালেবান শাসকগোষ্ঠী নারী শিক্ষার ব্যাপারে যে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিল আইএস জঙ্গিরাও একই নীতি অনুসরণ করছে, তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কোন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। বিজিত এলাকার নারীদেরকে ক্রীতদাসীর পর্যায়ে গণ্য করা হচ্ছে, ফলে জঙ্গি সেনারা তাদের সাথে যৌনস¤পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে বৈধতা পেয়েছে। জঙ্গিদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে এরই মধ্যে অনেক নারী মানবাধিকার কর্মী ও ডাক্তারকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক পরিস্থিতির এই চিত্র লক্ষ্য করলে যে কারো মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হবে যে, এ অঞ্চলের সঙ্কট, সংঘাত ও নৈরাজ্যের জন্য ইহুদীবাদী এবং মুসলমান নামধারী জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোই দায়ী । কিন্তু সহজ কতগুলো প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে এর নেপথ্যের আরও কিছু মৌলিক কারণ সুস্পষ্ট হবে বলে মনে করি।
আমাদেরকে জানার চেষ্টা করতে হবে যে, ফিলিস্তিনীদের ভূমি জবরদখল করে কিভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো? ইসরাইলের ইহুদীবাদীরা এখনো কোন্ শক্তির বলে ফিলিস্তিনের নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে পার পেয়ে যাচ্ছে? মুসলমানদের মধ্যকার ধর্মীয় উগ্রবাদীরা কিভাবে এবং কার মাধ্যমে অত্যাধুনিক অস্ত্র পাচ্ছে? কারা এদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং অর্থ ও অন্যান্য রসদ সরবরাহ করছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনের দিকে যেতে হবে। ক্রুসেডের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে পরাজয়ের পর পশ্চিমা নেতাদের মনে ইসলাম সম্পর্কে যে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ জন্ম নেয় তা তারা কখনোই বিসর্জন দিতে পারে নি; বরং যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম পরস্পরায় ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে তারা এই বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ স্পৃহা লালন করেছে। পাশাপাশি বিশ্ব জুড়ে পাশ্চাত্যের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে ইসলামকে তারা বড় চ্যালেঞ্জ মনে করে আসছে।
পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা কতটা মুসলিমবিদ্বেষী তা অনুধাবন করা যাবে খ্যাতিমান গবেষক ও লেখক এডওয়ার্ড সাঈদের ‘ওরিয়েন্টালিজ্ম’ এবং ‘কভারিং ইসলাম’ নামক বই দুটি পড়লে। এডওয়ার্ড সাঈদের মতে ধর্ম হিসেবে ইসলাম নিয়ে পশ্চিমা পণ্ডিতদের কোন মাথা ব্যথা নেই, তাদের ক্ষোভ ও আতঙ্ক ইসলামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি এবং শক্তি নিয়ে।
সপ্তদশ শতাব্দীর পর সামরিক শক্তির দিক থেকে মুসলমানরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়লেও পশ্চিমা নেতারা ইসলাম আতঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। এরই ধারাবাহিকতায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইসলামী শক্তিকে চিরতরে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম বিশ্বকে ভেঙে ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করে। মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠা করে ইসরাইল। এ সময় তারা মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় মতপার্থক্যকে অত্যন্ত সফলভাবে কাজে লাগায় এবং মুসলমানদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দলকে উস্কে দেয়। গবেষকদের মতে এসময়টাতেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিশেষ করে ব্রিটিশদের দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টায় উপমহাদেশে কাদিয়ানী, ইরানে বাহাই এবং হেজাজ বা বর্তমান সৌদি আরবে ওয়াহাবী মতবাদ শেকড় গাড়তে সক্ষম হয়।
১৯৭০ এর দশকে প্রাকৃতিক তেলের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায় এবং ১৯৭৯ সালে সংঘটিত হয় ইরানের ইসলামী বিপ্লব। এ দুটি ঘটনা পশ্চিমা নেতাদের মনে মুসলিম শক্তির সম্ভাব্য উত্থানের আশঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা পণ্ডিতদের পুরানো বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল নতুন মাত্রা পায়। এ সময় থেকেই পশ্চিমা গণমাধ্যম বা প্রচারযন্ত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমন্বিত ও কৌশলি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৮০ এর দশক থেকে হলিউডে ইসলাম ও মুসলমানদের চেহারায় কালিমা লেপন করে চলচ্চিত্র নির্মিত হতে থাকে। হলিউড থেকে নির্মিত ‘প্রিন্সেস এপিসোড’, ‘ডেল্টা ফোর্স’, ‘ট্রু লাইস’, ‘জিহাদ ইন আমেরিকা’ নামক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গোটা দুনিয়াকে জানানো হয়, মুসলমানরা নিষ্ঠুর, কট্টরপন্থী, সন্ত্রাসী ও বোমা বিস্ফোরণকারী।
তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ভূখন্ডে যুগে কিছু কিছু উগ্রপন্থী দল সক্রিয় ছিল। এ রকম একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর রূপকার ছিলেন তকিউদ্দিন মুহাম্মাদ ইবনে তাইমিয়া। তিনি উনিশ শতকের শেষ দিকে তাঁর মতবাদ প্রচার করেন। প্রথম জীবনে তিনি হাম্বলী মাজহাবের একজন ফকীহ বা আইনজ্ঞ ছিলেন, পরবর্তীকালে নিজেকে ‘সালাফি’ বা পূর্বসূরীদের অনুসারী দাবি করেন। কট্টর হাদীসকেন্দ্রিক শরীয়ত অনুসরণ, কোরআন-হাদীসের কঠোর শব্দগত ব্যাখ্যা করা, অমুসলিম, সুফিপন্থী ও রাসূলে পাক (সা.)-এর বংশধরদের অনুসারী শিয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা, ইসলামের প্রাথমিক যুগে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা ইত্যাদি সালাফি মতবাদের বিতর্কিত বিষয়গুলোর অন্যতম। ‘সালাফ’ শব্দের অর্থ পূর্বপুরুষ। সালাফি ইসলাম মানে পূর্বপুরুষের ইসলাম। ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্ম যা করে নি এমন কিছু করাকে ‘বিদআত’ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন ইবনে তাইমিয়া। তিনি ফতোয়া দেন, মহানবী (সা.)-এর জন্মদিনে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন, সাহাবি ও অলি-আউলিয়াদের কবর যিয়ারত করা, তাঁদের মাযারকে কেন্দ্র করে সৌধ নির্মাণ ও তার পাশে মসজিদ নির্মাণ করা ইসলাম-পরিপন্থী কাজ।
ওয়াহাবী মতবাদ সালাফি মতবাদেরই আধুনিক সংস্করণ। এই মতবাদের অনুসারীরা নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীস’ পরিচয় দিয়ে থাকেন এবং তাঁরা ‘ওয়াহাবী’ পরিচয়টি বহন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। সৌদি আরবের নজ্দ এলাকার বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব ১৮ শতাব্দীর শেষভাগে এই মতবাদ প্রবর্তন করেন। ব্রিটিশদের সহায়তায় আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ নজ্দ ও হেজাজে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পর ঐ অঞ্চলে মুসলমানদেরকে তাদের এই ব্যতিক্রমী মতবাদ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। এর আগে আরবের কোথাও সালাফি বা ওয়াহাবী মতবাদের প্রাধান্য ছিল না। মদীনা শরীফ দখলের পর তাদের সেনারা জান্নাতুল বাকিতে অবস্থিত নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) ও বহু বিশিষ্ট সাহাবীর কবর ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা অন্যান্য মাজহাবের অনুসারীদের স¤পর্কে অত্যন্ত কট্টর মনোভাব পোষণ করে থাকে। সামান্য মতপার্থক্যের কারণেই তারা অন্য মুসলমানদেরকে কাফের-মুশরেক আখ্যা দিয়ে থাকে। এ জন্য মধ্যপ্রাচ্যে তারা ‘তাকফিরী’ গোষ্ঠী নামেও পরিচিত। সবকিছুতে ‘বিদআত’ আবিষ্কার করা এদের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা এবং উগ্র দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইবনে তাইমিয়া এবং পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব নিজেদের জীবদ্দশায় খ্যাতনামা আলেমদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন, বহু বার তাঁরা নিজ নিজ এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, এমনকি ইবনে তাইমিয়াকে তাঁর বিশেষ ধরনের বিশ্বাসের জন্য অনেক বার কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে।
আরব জগতে মুসলমানদের মধ্যে এমন কট্টরপন্থী মতাদর্শ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য বড় সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। তারা এই মতবাদ ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কা ও মদীনা শরীফে প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করে।
বর্তমানে যেসব জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী ইসলামের নাম ব্যবহার করে মুসলিম দেশগুলোতে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে এর সব ক’টি উপরিউক্ত মতাদর্শে বিশ্বাসী।
আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীকে হটানোর উদ্দেশ্যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সৃষ্টি করেছিল আলকায়দা। এ কাজে সিআইএ-কে সহযোগিতা করেছে পাকিস্তান ও কয়েকটি আরব রাষ্ট্র। আফগান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আলকায়দা ব্যবহৃত হয়ে আসছে সিআইএ-এর ক্রীড়নক হিসেবে। দলটির তৎপরতা বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, তারা ইসলাম সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক ধারণা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আলকায়দার তৎপরতা মূলত পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় খুব বেশি দৃশ্যমান। তাদের সন্ত্রাসী হামলায় নির্মমভাবে নিহত হয় এই মুসলিম দেশগুলোর সাধারণ মানুষ। ধ্বংস হয় মসজিদ, ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুসলিম দেশের অর্থনীতি।
ইসলামিক স্টেট বা আইএস মূলত আলকায়দারই অঙ্গ সংগঠন। জর্ডানের নাগরিক আবু মাসাব জারকাভী ২০০২ সালে ‘তাওহীদ ওয়াল জিহাদ’ নাম দিয়ে যে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি পরিচালনা করেছিল বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমানে তা ‘আইএস’ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই গোষ্ঠীর খুব কম সংখ্যকই ইরাকের অধিবাসী। বিশ্বের ৮১টি দেশের ৮০ হাজার জঙ্গি এই গোষ্ঠীর আওতায় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য মতে ‘আইএস’ এর অধীনে প্রশিক্ষিত যোদ্ধার সংখ্যা হবে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সালাফি মতবাদের ভিত্তিতে ইরাক ও আশশাম অর্থাৎ প্রাচীন সিরিয়ায় (লেবানন ও ফিলিস্তিনসহ) খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। এদের প্রতি রয়েছে কয়েকটি আরব রাষ্ট্র এবং সেসব রাষ্ট্রের মুফতিদের সমর্থন। এদের আকস্মিক উত্থান এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা বেশ রহস্যময়। কারণ, কোথা থেকে এবং কিভাবে এতো অস্ত্র তাদের হাতে এলো? ইরাকের মসুল দখল করার সময় সেখানে নিয়োজিত ৫০ হাজার সেনাকে কিভাবে তারা ম্যানেজ করতে সক্ষম হলো! ৩০/৩৫ হাজার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা কবে কোথায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করল? এটা তো নিশ্চয়ই একদিনে সম্ভব হয়নি। ৮১টি দেশের মুসলমান যুবক-যুবতীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ইরাকের রণাঙ্গনে জমায়েত করাটাও নিশ্চয়ই একদিনে ঘটেনি। তাহলে নিশ্চয়ই কোন শক্তিশালী দেশের তত্ত্বাবধানে এবং দীর্ঘ সময় ধরেই এর প্রস্তুতি চলেছে।
ইরাকের কোন কোন সূত্র দাবি করেছে, দেশটির আলআনবার প্রদেশের প্রায় জনমানবশূন্য বিস্তীর্ণ মরু এলাকায় আইএস জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এই এলাকাটি সৌদি আরবের সীমান্তের কাছে অবস্থিত। কট্টর ইসরাইলবিরোধী এবং ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আলআসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি আরব দেশ ‘আইএস’ এর জন্য অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ স¤পর্কে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি স¤পর্কে দেয়া এক বক্তৃতায় বলেছেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমাদের মিত্রদেশ সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক সন্ত্রাসবাদী ‘আইএস’ সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করেছে। জো বাইডেন ‘আইএস’ সৃষ্টির জন্য মিত্রদেরকে একতরফাভাবে দায়ী করলেও এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা শেষ পর্যন্ত গোপন রাখা যায় নি। গত ২০ সেপ্টেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস অনলাইনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ‘আইএস’ গড়ে ওঠার পেছনে তাদের নিজেদের ভূমিকার কথা ফাঁস হয়ে গেছে।
অতএব, দেখা যাচ্ছে জঙ্গিবাদের জন্ম এবং কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইসলাম ধর্মকে কলঙ্কিত করা। এর মাধ্যমে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত রেখে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং মুসলমানদের সম্পর্কে জনমনে বিরূপ ধারণা তৈরি করা।
পশ্চিমা নেতারা এ ক্ষেত্রে তাঁদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য কিছুটা অর্জন করতে সক্ষম হলেও এখন তা বুমেরাং হতে চলেছে। তাঁরাও এখন অনুধাবন করতে পারছেন যে, আগুন কোন সীমানা মানে না। আগুন জ্বলে উঠলে তার আঁচ সবার গায়েই লাগে। পরিস্থিতি এখন এমন যে, জঙ্গিবাদ শুধু মুসলিম দেশগুলোর জন্য সমস্যা বিবেচিত হচ্ছে না; বরং এটি এখন পাশ্চাত্যের জন্যও হুমকি হতে চলেছে। ‘আইএস’ যে ৮১টি দেশের নাগরিককে দলে ভিড়িয়েছে তার মধ্যে অনেক পশ্চিমা দেশের নাগরিকও রয়েছে। বিষয়টি পশ্চিমা নেতাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
এমতাবস্থায় সম্প্রতি পশ্চিমা দেশগুলো আরব মিত্রদেরকে নিয়ে জঙ্গিদেরকে নির্মূল করার জন্য এক জোট হয়েছে। তবে পরিস্থিতি যতটুকু গড়িয়েছে তাতে সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান আসবে বলে মনে হয় না। জঙ্গিবাদ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইলে সবকিছুর আগে মুসলমানদেরকে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে, পশ্চিমা নেতাদেরকেও ইসলামের বিরুদ্ধে কূটকৌশল পরিত্যাগ করতে হবে।
* লেখক : সাবেক পরিচালক, রেডিও তেহরান (বাংলা বিভাগ)