মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা একজন ঈমানদারের ঈমান তথা বিশ্বাস এবং অন্তরের দৃঢ় প্রত্যয়ের পরিমাপক। আমাদের ঈমান শুধু তখনই সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ হবে যখন নবীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা এ দুনিয়ার সকল কিছু, এমনকি আমাদের নিজ জীবন অপেক্ষা অধিক হবে। পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী, ঈমানদারদের নিকট মহানবী (সা.) এমনকি তাদের নিজ জীবন অপেক্ষাও অধিক অগ্রগণ্য হবেন। (সূরা আহযাব : ৬)
এটি সংজ্ঞায়িতকরণ স¤পর্কিত একটি বাক্য, যা আমাদেরকে বাতলে দিচ্ছে ঈমানদার হওয়ার মানে কী অর্থাৎ মহানবী (সা.)-কে গুরুত্ব প্রদান করা, এমনকি নিজের জীবন অপেক্ষা। এটা নিশ্চিতকরণে উল্লেখ্য যে, নবী করীম (সা.) এক হাদিসে বলেন : ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার কাছে আমি নিজ সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, এমনকি সমগ্র মানবজাতি অপেক্ষা প্রিয়তর হব।’ (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য রেওয়ায়াতে আরো বর্ণিত আছে : ‘তার জীবন, তার সম্পত্তি এবং তার পরিবার (অপেক্ষা)।’
মুমিনদের মধ্যে যারা উত্তম সেই সকল সাহাবি, বিশেষত যাঁরা ছিলেন শ্রেষ্ঠতমদের অন্তর্ভুক্ত, তাঁরা নবীজীর প্রতি এ রকমেরই ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন। মদিনার জনগণের পক্ষ হতে নবী করীম (সা.) সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁরা বলেন : ‘মহানবী (সা.) আমাদের নিকট আমাদের সহায়-স¤পত্তি, সন্তানাদি, পিতামাতা, পূর্বপুরুষ এবং প্রচ- পিপাসার্ত অবস্থায় ঠাণ্ডা পানি অপেক্ষা প্রিয়তর।’
নবী (সা.)-এর প্রতি এরূপ ভালোবাসার অর্থ
কোনো কোনো অবস্থায় এটা বেশ ¯পষ্টভাবেই বুঝতে হবে যে, মুমিনরা নবীজীকে এভাবেই ভালোবাসবে : কারণ, তিনি তো তাদের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক এবং নেতা, আর তাঁর পক্ষে শিক্ষা দেওয়া, পথপ্রদর্শন করা এবং তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়া অসম্ভব যদি তারা তাঁকে ভালো না বাসে। তবে ঈমান-এর জন্য নবীর প্রতি ভালোবাসা অতীব প্রয়োজনীয়- এই নীতির আরও গভীর অর্থ আছে।
মহানবীর প্রতি ভালোবাসার অর্থ হলো চরিত্রের সকল সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, নম্রতা এবং অন্তঃশক্তি থাকা, যা মানুষ অর্জন করতে পারে এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে যা নবী করিম (সা.)-এর ছিল উচ্চতম মাত্রায়। মহানবীর প্রতি ভালোবাসা মানে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের ভিতরে যে সকল কল্যাণ ও মহত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন সে সবকিছু গ্রহণ এবং লালন করা ও সেগুলোর মহিমা প্রকাশ ও প্রচার করা।
এর আরও অর্থ হলো এই যে, মানবতাকে ভালোবাসা। শুধু এজন্য নয় যে, মানুষের মধ্যে পরিপূর্ণতার সম্ভাবনা রয়েছে; বরং এই সম্ভাবনার বিষয়টি উপলব্ধিতে মানুষের যে সাধারণ অক্ষমতা রয়েছে এবং তার নিজের আর যেসব ত্রুটি ও দুর্বলতা আছে সেগুলো সত্ত্বেও তাঁকে ভালোবাসা। কেননা, নবী করীম (সা.) শুধু পরিপূর্ণ ও নিখুঁত মানুষ ছিলেন তা নয়, তিনি হাশরের দিনে আল্লাহর সামনে মানবজাতির প্রতিনিধিত্বও করবেন এবং তাদের পক্ষে সুপারিশও করবেন তাদের অপূর্ণতা ও দুর্বলতার জন্য।
এভাবে মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা আমাদেরকে মনে-প্রানে পূর্ণতার আকাক্সক্ষা লালনের মাধ্যমে পূর্ণতা অর্জনের পথে নিয়ে যায়, অন্যদিকে এটি আমাদের অপূর্ণতাকে মেনে নেয়ার এবং আল্লাহ্র অনুতপ্ত বান্দা হিসেবে তাঁর করুণা লাভে আশান্বিত হয়ে নিজের মধ্যে শান্তিতে থাকার প্রেরণা যোগায়। এ কারণেই নবীর প্রতি ভালোবাসা ঈমানেরই শর্তবিশেষ। কেননা, ঈমান তাহলে কী, যদি না তা আমাদেরকে আমাদের অসম্পূর্ণতা আর দুর্বলতাগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে সেগুলোর জন্য অনুশোচনা করতে এবং অর্জন-অযোগ্য মনে হলেও পূর্ণতা অর্জনে উৎসাহিত করে? আর পূর্ণতা একেবারেই অর্জনাতীত কিছু নয়; বরং মানুষের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণতা অর্জনের যোগ্যতা দিয়েই রেখেছেন।
ঈমানের দুটি ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসংযুক্ত দিক রয়েছে : একটি হচ্ছে ঐশী দিক যাতে আল্লাহকে স্বীকার করে নেয়া হয় এবং তাঁর সাথে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রাখা হয়। অপরটি হলো : নিজেকে বা নিজের পরিচয়কে চেনা বা জানা এবং নিজের সাথে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রাখা। এ দুটি দিক যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ; একটিকে ছাড়া আরেকটি টিকতে পারে না। আল-কোরআন এবং হাদিসের বেশ কিছু বর্ণনায় এ দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ : মহানবী (সা.) এক হাদিসে বলেন : ‘যে ব্যক্তি নিজেকে চিনেছে, সে তার প্রভুকেও চিনেছে।’ বিষয়টি আরেক দিক থেকে বিবেচনা করে আল-কোরআনে বলা হয়েছে : ‘…যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন।’ (সূরা হাশর: ১৯)
ইসলাম শব্দের অর্থ হলো : আল্লাহ্র সাথে বোঝাপড়ার সম্পর্ক যাকে কোরআনে সেই আত্মার সাথে তুলনা করা হয়েছে যে নিজের সাথে শান্তি স্থাপন করে চলে।
মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ঈমানের মানবিক দিক প্রতিফলিত হয়। মানুষ হিসেবে মহানবী (সা.) একজন ঈমানদারের সত্যিকারের পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। নবীর প্রতি তার ভালোবাসার অর্থ সে তার সত্যিকারের নিজ সত্তাকে চিনতে পেরেছে এবং সে তার নিজের সাথে শান্তিতেই আছে।
এর মানে হলো যে সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে যার নিকট আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সে তাঁর সাথে শান্তিতেই আছে।
নবী করীমও (সা.) আমাদেরকে ভালোবাসতেন
ঈমানদারগণ যদি মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসেন তবে এই ভালোবাসার ক্ষেত্রে তারা কিন্তু প্রথম নয়। নবী করীমই সর্বপ্রথম ঈমানদারদেরকে ভালোবাসেন। আল-কোরআনই এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে এভাবে : ‘(নবী) তোমাদের ক্ষতিতে অত্যন্ত মর্মাহত; তিনি তোমাদের কল্যাণের জন্য যার পর নাই উদ্বিগ্ন। ঈমানদারদের জন্য তিনি অত্যন্ত দয়ার্দ্র আর রহমদিল।’ (সূরা তাওবা : ১২৮)।
মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা শুধু যে ঈমানদারদের মধ্যে সীমিত ছিল তা নয়, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিকেই তিনি ভালোবাসতেন। আল্লাহ তা‘আলা আল-কোরআনে বলেন : ‘আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি (হে নবী) সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতস্বরূপ।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)
একথা ঠিক যে, মহানবী (সা.)-কে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছিল যারা নিজেদের ওপর জুলুম করার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তাদেরকে তিনি দোজখের তিক্ত বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এটাও ছিল তাদের প্রতি দয়া ও ভালোবাসা থেকে, শত্রুতা কিংবা ঘৃণা থেকে নয়। যে সকল লোক নিজেদের ধ্বংসের পথে পা বাড়ায়, তাদেরকে তাদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া সব সময়ই একটি সহজ কাজ বটে। পক্ষান্তরে তাদেরকে ধ্বংসের সেই পথ থেকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন প্রচ- ভালোবাসা আর সৎসাহস। আর ঠিক এ কাজটাই করার চেষ্টা করে গেছেন মহানবী (সা.)। তিনি এ কাজে সফলও হয়েছিলেন জীবনের শেষ দিকে। এমনকি তাঁর শত্রুদের ক্ষেত্রেও তিনি যে রহমতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেটা সহজেই বুঝা যায় যখন মক্কা বিজয়কালে তিনি তাদের সকলকেই কত সহজেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন!
মহানবী (সা.) মানবতার জন্য কীভাবে কষ্ট ভোগ করেছিলেন
মানবজাতির জন্য মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসার একটি নিদর্শন হলো এই যে, তিনি তাঁর বিরোধীদের হাতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের স্বীকার হয়েও তাদেরকে তাঁর বিজয়ের পর অবলীলায় ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
মহানবী (সা.) যখন তাঁর নবুওয়াতি মিশনের কাজ শুরু করেন, তখন তাঁর শহরের প্রায় সকল লোকই তাঁর বিরোধিতা করে যদিও তারা তাঁর জীবনের শুরু থেকেই তাঁকে একজন ব্যতিক্রমী সৎ এবং বুদ্ধিমান লোক হিসেবেই জানত। প্রথমদিকে তারা মৌখিকভাবে তাঁকে আক্রমণ এবং তিরস্কার ও অপমান করতে থাকে। পরে তারা মৌখিক আক্রমণের সাথে দৈহিক আগ্রাসনও যুক্ত করে দেয়। তারা তাঁর পথের ওপর কাঁটা ছড়িয়ে দিত, তাঁর গায়ে ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করত। একবার তিনি যখন ঘরে ফিরলেন তখনও তাঁর মাথায় ধুলোমাটি লেগেই ছিল। তাঁর মেয়ে অশ্রুসজল নেত্রে সেই ধুলোবালি মুছে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তাঁর সমাজের মানুষেরা তাঁর সাথে যে আচরণ করেছে সেজন্য যতটা না কষ্ট পেয়েছিলেন তার চেয়ে অধিক কষ্ট পেয়েছিলেন নিজ কন্যার চোখে অশ্রু দেখে। তিনি এই বলে কন্যাকে সান্ত¡না দেন : ‘কেঁদো না, মা আমার! আল্লাহই তোমার বাবার সহায় হবেন।’
একবার তাঁর শহরের লোকজন নবী করীম (সা.)-এর ওপর ভিন্ন এক ধরনের আঘাত হানার চেষ্টা করল। একদিন নবীজী (সা.) কাজের লোক খুঁজতে বের হলেন। একটা লোকও তাঁর দিকে তাকালো না, কিংবা কথাও বলল না বা তাঁকে তিরস্কার বা অপমানও করল না। বাকহীন ভাষায় তারা নবীজীকে বুঝাতে চাইল : ‘তুমি আমাদের কেউ নও, কারণ, তুমি আমাদের ঐতিহ্যগত প্রথার বিরুদ্ধে কথা বল।’ আগে থেকে তিনি যেসব তিরস্কার ও অপমান সয়ে অভ্যস্ত ছিলেন এই ব্যাপারটাতে তিনি তার চেয়েও বেশি আহত হলেন।
মহানবী (সা.) যখন অনুভব করলেন যে, তিনি মক্কাবাসীদের সাথে পেরে উঠছেন না, তখন তিনি হজ উপলক্ষে মক্কায় আসা বাইরের লোকদের দিকে অধিকহারে নজর দিতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু আবু লাহাবের মতো লোকদের কারণে মক্কায় আগত তীর্থ যাত্রীদের মধ্যে তাঁর তৎপরতা বিফল হতে লাগল। আবু লাহাব নবীজীর পিছনে পিছনে যেত আর চিৎকার করে বলত : ‘এই লোককে বিশ্বাস করো না, সে মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক।’ একদিন নবীজী বিশেষভবে দুঃখভারাক্রান্ত হলেন। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না, শুধু ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘হে প্রভু! আপনি না চাইলে এমন হতে পারত না!’
৬২০ খ্রিস্টাব্দে নবীজী (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি মক্কার বাইরে গিয়ে তাঁর বাণী প্রচার করবেন যাতে মক্কার বাসিন্দারা তাঁকে অনুসরণ করতে না পারে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তায়েফকেই তাঁর প্রথম পছন্দ হিসেবে নির্বাচন করে। মক্কা থেকে ৬০ মাইল পূর্বে অবস্থিত এই তায়েফ ছিল নিকটতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। তায়েফের পথে ভ্রমণে যায়েদ ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। উঁচু-নিচু, পাহাড়-পর্বতসহ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে নবীজী (সা.) এক ক্লান্তিকর ভ্রমণে বের হলেন। তায়েফে তিনি ১০ দিন থাকলেন। গোত্রপ্রধান এবং সাধারণ মানুষের নিকট তাঁর বাণী পৌঁছালেন। কিন্তু তারা সবাই এ বলে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করল যে, নতুন এক ধর্মের জন্য তারা মক্কাবাসীদের সাথে স¤পর্ক নষ্ট করতে চায় না। যতই দিন যেতে লাগলো তায়েফবাসী ততই তাঁর ওপর চড়াও হতে থাকল। অবশেষে ১০ম দিনে তারা তাঁকে পথে পথে তাড়া করতে আর তাঁর ওপর প্রস্তর নিক্ষেপ করতে লাগল। এমনকি তিনি যখন শহর ছেড়ে চলে আসছিলেন, উত্তেজিত জনতা তাঁর পিছু নিল এবং তাঁকে তপ্ত মরু-বালুর মধ্য দিয়ে তাড়া করে মাইল তিনেক দূরে পাহাড়ের পাদদেশে না পৌঁছা পর্যন্ত ধাওয়া করতে থাকল। তখন তাঁর দুই পা থেকে রক্ত ঝরছিল। ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় রক্তমাখা পায়ে তিনি একটা বাগানে আশ্রয় নিলেন। যায়েদ নবীজীর প্রতি নিক্ষিপ্ত পাথর থেকে নবীজীকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করতে করতে অবশেষে নিজেই মাথায় পাথরের আঘাতে আহত হলেন।
কয়েক বছর পর নবীজী আরবের অন্যতম শহর মদিনায় যথেষ্ট সমর্থন লাভে সক্ষম হলেন। তিনি সেখানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন। কিন্তু মক্কাস্থ তাঁর শত্রুরা তাঁকে মদিনায় হিজরতের আগেই জানে মারার ষড়যন্ত্র করল, যা সফলতার দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি শত্রুতাপূর্ণ মক্কা থেকে তুলনামূলক বন্ধুভাবাপন্ন মদিনায় হিজরতের পরও মহানবীর দুর্ভোগ চলতেই থাকল। কুরাইশ বংশ এবং তাদের প্রভাবাধীন অন্যান্য আরব গোত্র তাঁর ও
তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই যুদ্ধ বাধাতে থাকল। মদিনাতেও ইহুদিরা তাঁর ওপর ক্ষেপে গেল এবং তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগল, এমনকি এক সময় নবীজীকে বিষ প্রয়োগে হত্যার উদ্যোগ নিতেও কুণ্ঠিত হলো না। মুনাফিকরা ছিল নবীজীর গোপন শত্রু; তারা মুসলমান হওয়ার ভান করত মাত্র। তারাও ষড়যন্ত্র এবং নবীজীর বিরুদ্ধে কানাকানি শুরু করে দিল। এসবের একটি নোংরা উদাহরণ হলো তারা নবীজীর স্ত্রী হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে চরিত্রগত অভিযোগ তুলল, যা নবীজীর জন্য যেমন বেদনাদায়ক ছিল তেমনি ছিল হযরত আয়েশার জন্যও। কখনো কখনো মুমিনগণও অনিচ্ছাসত্ত্বেও নবীজীর জন্য কষ্টের কারণ ঘটাত। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তারা কখনো কখনো অভদ্রজনোচিতভাবে নবীজিকে একা ফেলে রেখে তাঁর কাছ থেকে চলে যেত আর তিনি একা একা দাঁড়িয়ে থাকতেন। আল-কোরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতই এ কথার সাক্ষ্য বহন করে:
‘তারা যখন কোন ব্যবসাবাণিজ্য কিংবা ক্রীড়াকৌতুক দেখে, তখন আপনাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সেদিকে ছুটে যায়…’ (সূরা জুমআ : ১১)
অনেক বছর ধরেই মহানবী (সা.) এই সকল এবং এ রকম আরও বহু দুর্ভোগের স্বীকার হয়েছেন। নবুওয়াতি মিশন শুরুর আগে মানুষ সাধারণভাবে যা আশা করতে পারে এমন সবকিছুই তাঁর ছিল। সুস্বাস্থ্য, সমৃদ্ধ ব্যবসা, সুন্দরী স্ত্রী, সুন্দর সুন্দর সন্তানাদি, বিশ্বস্ত আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং সে সাথে ছিল নিজ এলাকাবাসীর আস্থা ও শ্রদ্ধা। চাইলেই তিনি মক্কায় অন্য যে কারো মতো আরামদায়ক জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কষ্ট আর দুর্ভোগের রাস্তাই বেছে নিয়েছিলেন। আর তিনি তা করেছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য এবং তাদের জন্য যারা অজ্ঞতাবশত তাঁকে নির্যাতন-নিপীড়নের স্বীকার বানিয়েছিল।
মহানবী (সা.)-এর কষ্ট-দুর্ভোগের অর্থ
মহানবীর জীবনের অন্য সকল দিকের মতো তাঁর কষ্ট-দুর্ভোগের মধ্যেও আমাদের জন্য শিক্ষণীয় আছে। এর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হলো যে, এই দুনিয়া হচ্ছে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা এবং সুবিচার-অবিচারের মধ্যে একটি যুদ্ধক্ষেত্র; যদিও আল্লাহ চান, পরিণতিতে ভালো বা শুভ, সত্য ও সুবিচারেরই জয় হবে। তিনি এও চান যে, এই বিজয় অতটা সহজ হবে না।
মহানবীর দুর্ভোগের মধ্যে এই মর্মে আমাদের জন্য রয়েছে ¯পষ্ট স্মরণিকা যে, মানুষের মধ্যে যেমন আছে প্রচণ্ড শুভ ও কল্যাণময়তা, তেমনি আছে বিশাল অশুভ ও খারাপের সম্ভাবনাও। মানুষের মধ্যে শুভ ও কল্যাণের যে উচ্চতম সম্ভাবনা রয়েছে মহানবী (সা.) ছিলেন সেই সম্ভাবনার প্রতীক। অপর দিকে, তাঁর বিরোধীরা ছিল ঠিক বিপরীত, অর্থাৎ সকল অকল্যাণ আর খারাপের প্রতীক। মহানবী (সা.) অবশ্য তাঁর আদর্শের বিরোধীদের এবং তাদের অশুভ তৎপরতাকে নিজ ভালোবাসা আর প্রজ্ঞার মাধ্যমে জয় করেছিলেন। তবে যারা মহানবীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল তাদেরকে নিন্দা করা আমাদের উচিত হবে না। কেননা, যে অজ্ঞতা আর গোয়ার্তুমীপূর্ণ লোকেরা মহানবীর দুর্ভোগের কারণ ছিল তা আমাদের সবার মধ্যেও আছে। কে জানে, আমাদের মধ্যকার কেউ মহানবীর জামানায় মক্কায় থাকলে সেই নবীজীর ওপর ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ কিংবা তাঁকে নির্যাতন করত না? না, মহানবী (সা.) এজন্য কষ্ট ভোগ করেন নি যে, আমরা কাউকে নিন্দা করব। তিনি ভুক্তভোগী হয়েছিলেন এ জন্য যে, আমরা যেন আশাবাদী আর বিনয়ী হই। তিনি দুর্ভোগ সয়েছিলেন এ জন্য যে, আমরা যেন আমাদের ভিতরে শুভ ও কল্যাণ কতখানি আছে তা খুঁজে নিতে পারি এবং একইভাবে খুঁজে বের করি সকল পাপের মূল কারণ অজ্ঞতা আর একরোখা ভাব কতখানি আছে। আমাদের ভিতরকার এ দুটি জিনিসেরই সম্ভাবনা আমাদেরকে দেখে নিতে হবে। প্রথমটি আমাদেরকে আমাদের এবং সাধারণভাবে মানুষের ভাগ্যে আশা যোগায় আর দ্বিতীয়টি আমাদেরকে বিনয়ী করে তোলে। আর সমৃদ্ধি অর্জনে আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো বিনয় এবং আশা।
এভাবে দেখা যাচ্ছে যে, ====== মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার কারণে আমাদের চিন্তা করা উচিত যে আমাদের সকলের ভিতরেই অশুভ-অকল্যাণের সম্ভাবনা আছে এবং সেই সাথে ঐ অকল্যাণকে আমাদের দমনও করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। পাপচিন্তাকে দমন করার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে মহানবীকে ভালোবাসা। কেননা, আমরা যত বেশি তাঁকে ভালোবাসব তত বেশি আমরা আমাদের ভিতরকার নেকচিন্তাকে শক্তিশালী করব এবং ঠিক ততই আমরা পাপচিন্তাকে দমন করতে সক্ষম হব। =====
মহানবী (সা.)-কে মহিমান্বিত করা
মহানবী (সা.)-এর প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করা যেতে পারে তাঁকে মহিমান্বিত করা ও তাঁর ওপর দরুদ ও সালামের মাধ্যমে। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে সালাত আলান্নাবী এর মতো একটিমাত্র পরিভাষার সাহায্যে তিনটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। আরবি সালাত আলা তিনটি অর্থ প্রকাশ করে থাকে :
১. ভালোবাসা ও অনুরাগের সাথে কারো প্রতি মনোযোগী হওয়া
২. কাউকে মহিমান্বিত করা বা তাঁর প্রশংসা করা
৩. কাউকে আশীর্বাদ বা অনুগ্রহ করা।
উপরিউক্ত আয়াতে সবগুলো অর্থ একসাথে মিলিয়ে আয়াতটির অনুবাদ করা যায় এভাবে :
‘নিঃসন্দেহে, আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর ভালোবাসা, মহিমা এবং আশীর্বাদ প্রেরণ করে; হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার ওপর ভালোবাসা, মহিমা এবং আশীর্বাদ প্রেরণ কর আর তাকে যথাযোগ্য সম্মানে সালাম করো।’ (সূরা আহযাব : ৫৬)
আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ কীভাবে নবীর ওপর ভালোবাসা, মহিমা এবং আশীর্বাদ প্রেরণ করেন আর আমরাই বা কীভাবে তা করি?
ন্যূনতম যেভাবে আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসেন তা হলো এই যে, যে-ই তাঁকে অনুসরণ করবে আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন। আল-কোরআন বলছে :
‘বলুন (মানবজাতিকে, হে মুহাম্মাদ!) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমার অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন…” (সূরা আলে ইমরান : ৩১)
আল্লাহ তা‘আলা আর কীভাবে নবী করিমকে ভালোবাসেন তা শুধু তিনিই জানেন।
আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে নবীকে মহিমান্বিত করেন সেগুলো নি¤œরূপ :
১. তিনি তাঁর নাম দিয়েছেন আহমাদ আর মুহাম্মাদ যার অর্থ মহিমান্বিত, প্রশংসিত।
২. তিনি অন্যান্য নবীর মাধ্যমে তাঁর আগমনের সুসংবাদ মানবজাতিকে দিয়ে এসেছেন। (সূরা আলে ইমরান : ৮১, সূরা আরাফ : ১৫৭, সূরা আনআম : ৬১)
৩. তিনি আসমান ও জমিনের বাসিন্দাদের মধ্যে তাঁর নাম ঘোষণা করে থাকেন : ‘আমরা আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি।’ (সূরা ইনশিরাহ : ৪)
আল্লাহ নবী (সা.)-কে আশীর্বাদ করে থাকেন মাঝেমাঝেই তাঁর মর্যাদা উন্নয়নের মাধ্যমে। মহানবীর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার ন্যূনতম আশীর্বাদ হলো : তিনি তাঁকে সমগ্র মানবজাতির নেতা ও প্রতিনিধি বানিয়েছেন।
ফেরেশতাগণ মহানবীকে ঠিক সেভাবেই ভালোবাসেন যেভাবে একজন রাজার পরিপূর্ণ বিশ্বস্ত চাকর রাজার প্রিয়ভাজনকে ভালোবেসে থাকে। তাঁরা জান্নাতে তাঁর নামের প্রশংসা করার মাধ্যমে নবীজীর মহিমা প্রকাশ করে থাকেন। আল্লাহকে বেশি বেশি নবী করীমের ওপর দরুদ পাঠ করতে বলার মাধ্যমে মহানবীর ওপর আশীর্বাদ প্রেরণ করে থাকেন।
মুমিনগণ ন্যূনপক্ষে যেভাবে মহানবীকে ভালোবাসতে পারে তা হলো তাঁকে সেইভাবে ভালোবাসা যেভাবে মানুষ তাদের নেতাকে ভালোবাসে। আর যে রকম উত্তমভাবে তাঁকে ভালোবাসা যায় তা হলো তাঁর নামে নিজের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা।
মুমিনগণ যেভাবে নবীজীর মহিমা প্রকাশ করতে পারে তা হলো কাব্যিক ভাষা ও গদ্যে তাঁর প্রশংসা করা, লেখনী ও কথার মাধ্যমে, রেডিও ও টেলিভিশনে, (আজকাল ইন্টারনেটে), মুসলমান ও অমুসলমানদের সমাবেশে ইত্যাদি।
মুমিনগণ যেভাবে নবীজীকে আশীর্বাদ করতে পারে সেটা হলো যে প্রচলিত যেসব বিভিন্ন রকমের দরুদ আছে সেগুলো পাঠ করা এবং আল্লাহর কাছে দোআ করা যেন তিনি নবীজীকে বেশি বেশি আশীর্বাদ করেন।
(কিছু কিছু ফকিহ বা মুসলিম আইনবিদের মতে, আলোচ্য আয়াতটির মর্ম অনুযায়ী জীবনে অন্তত একবার মহানবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পড়লে তাঁর ওপর দরুদ পড়ার ক্ষেত্রে মুমিনদের দায়িত্ব পালন হয়ে যায়। অন্যদের মতে, যত বার নবীজীর নাম উচ্চারিত হবে তত বারই দরুদ পড়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ ধরনের শুষ্ক আইনি ব্যাখ্যায় আয়াতটির প্রতি সুবিচার করা হয় বলে আমার মনে হয় না। ঈমানের দাবিই যদি হয় মহানবীকে আমাদের জীবনের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাঁকে ভালোবাসতে হবে আমাদের সন্তানাদি, পিতা-মাতা এবং সমগ্র মানবজাতি অপেক্ষা, তাহলে প্রথাগত একটা গৎবাঁধা ফর্মুলাকে ফরজ মনে করে কেন আওড়াতে হবে?)
দরুদ পাঠ : আয়াতটিতে মুমিনদেরকে যথাযথ সম্মানের সাথে নবীজীর ওপর দরুদ পড়তে বলা হয়েছে। দরুদ পড়ার মাধ্যমে আমরা নবীজীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। কেননা, সব ধরনের দরুদের মধ্যেই নবীজীর প্রতি প্রশংসাজ্ঞাপক ভাব আছে। এটা অবশ্য নবীজীকে সম্মান করার ন্যূনতম পন্থা। উত্তম পন্থা হলো নবীজীকে মনেপ্রাণে আমাদের নেতা হিসেবে এবং শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে মেনে নেয়া আর তাঁকে আন্তরিক চেতনার সাথে মান্য করা।
মহানবী (সা.)-এর মহিমা প্রকাশে আমরা কতদূর অগ্রসর হতে পারি?
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্য সব প্রশংসাই উপযুক্ত যদি তা মহানবীকে একজন মানুষ এবং আল্লাহর সৃষ্টির পর্যায় থেকে ওপরে না উঠায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা ঘোষণা করতে পারি যে, মহানবী (সা.) আল্লাহর সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। তিনি সকল সৃষ্টির সেরা ও মধ্যমণি। এই ধরনের প্রশংসাবাক্য যে নবী করীম (সা.)-এর ব্যাপারে প্রযোজ্য তার প্রমাণ পাওয়া যায় আল-কোরআনের ভাষ্য থেকে। কেননা, পবিত্র কোরআন অনাগত ভবিষ্যতের জন্য মহানবীকে আল্লাহর রাসূল এবং সমগ্র মানবজাতির ওপর রহমত হিসেবে উপস্থাপন করে, যেখানে অন্যান্য নবী-রাসূলের মিশন ছিল নির্ধারিত সময়কাল ও অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইসলামি আক্বিদার মধ্যে এও ¯পষ্ট যে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আগেকার নবিগণের মিশনকে পরিপূর্ণ করেছিলেন যারা মাত্র আংশিক বা অসম্পূর্ণ অহি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হাদিস থেকেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় যে, নবী মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন সর্বসেরা নবী (কাজেই সৃষ্টির সেরা, যেহেতু মানুষ আল্লাহর উত্তম সৃষ্টি এবং সর্বসেরা নবীই আল্লাহর সেরা সৃষ্টি)। এভাবে হাদিসের সকল গ্রন্থ থেকেই আমরা যে বর্ণনা পাই তাতে দেখা যায় : মহানবী (সা.)-কে মেরাজের উদ্দেশ্যে যখন মক্কা থেকে জেরুজালেমের মসজিদে নেয়া হয় তখন পূর্বেকার সকল নবীর সাথে তাঁর দেখা হয় এবং তিনি তাঁদের সাথে ইমাম হিসেবে জামাআতে নামায পড়ান। আবার, সহিহ মুসলিম শরীফে ‘সমগ্র সৃষ্টির ওপর মহানবীর শ্রেষ্ঠত্ব’ শিরোনামে একটি অধ্যায় আছে এবং এতে এ মর্মে একটি হাদিসও আছে :
আবু হুরাইরা বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (সা.) বলেন : ‘বিচার দিবসে আমিই হব সকল আদম সন্তানের নেতা। আমার কবরকেই প্রথম উন্মোচিত করা হবে। আমিই প্রথম শাফাআতকারী হব আর আমার শাফাআতই সর্বপ্রথম গৃহীত হবে।’
কিছুসংখ্যক মুসলমান মহানবী (সা.)-কে সকল নবীর সেরা ঘোষণা করতে দ্বিধান্বিত হয়ে থাকে। কেননা, কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তারা মুমিনগণ আল্লাহর নবিগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করে না’ (সূরা বাকারা : ২৮৫)
কিন্তু পবিত্র কোরআন এও বলছে : ‘এ সকল রাসূলের মধ্যে আমরা কাউকে কাউকে অন্যদের ওপরে প্রাধান্য দিয়েছি।’ (সূরা বাকারা : ২৫৩)
অন্যান্য আয়াতকে উপেক্ষা করে যদি আমরা প্রথম আয়াতটির ওপরেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত না করি, তাহলে এটা ¯পষ্ট হয়ে যায় যে, পবিত্র কোরআন নবিগণের প্রকৃতি এবং তাঁদের অবস্থান বা মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য করে থাকে। প্রথম আয়াতটি আমাদেরকে বলছে যে, প্রকৃতির দিক থেকে বিভিন্ন নবীর মধ্যে কোন তফাত নেই : তাঁরা সকলেই এক সত্যপ্রভু কর্তৃক প্রেরিত হয়েছিলেন, সকলেই আল্লাহর একই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন, সকলে মানুষ ছিলেন এবং এক খোদার নেক বান্দাদের একই ভ্রাতৃত্বের অংশ ছিলেন। দ্বিতীয় আয়াতটি বলছে যে, অবস্থান বা পদমর্যাদার দিক থেকে কোন কোন নবী-রাসূল অন্যদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
কাজেই, ==== এ মর্মে ঘোষণা দানের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই যে, নবী মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন সকল নবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ; কাজেই তিনি ছিলেন মহত্তম মানুষ এবং আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যমণি ও গৌরব। ===
কিছুসংখ্যক মুসলমান নবী করীম (সা.)-এর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসাকে নিরুৎসাহিত করেন দুটি কারণে : এক, অতিরিক্ত ভক্তি-ভালোবাসা নবীকে খোদার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ এতে র্শিক-এর আশঙ্কা আছে; দুই, ভক্তি-ভালোবাসা প্রকাশের কারণে নবীজীর বাণী এবং আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
দ্বিতীয় আশঙ্কাটি ভিত্তিহীন। কেননা, নবীজীর প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা প্রকাশ করা আল্লাহরই নির্দেশমাত্র। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‘তাকে ভালোবাস, আশীর্বাদ করো আর তার প্রতি দরুদ পাঠ করো যথাযথ সম্মানের সাথে।’
মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার প্রকাশ অবাধ্যতার দিকে নিয়ে যেতে পারে না। বস্তুত এটি বরং ঈমানের জন্যই প্রয়োজন। সত্যিকারের আনুগত্যের জন্যও এটি একান্ত প্রয়োজন।
প্রথম আশঙ্কাটির কিছুটা ভিত্তি আছে। সত্যি বলতে কি, নবীজী নিজেও আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা থেকে, বিশেষত যারা তাদের নবীদের প্রশংসায় অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট ছিল এবং নবিগণকে তারা খোদার আসনে বসিয়েছিল। এভাবে তারা শিরকে নিমজ্জিত হয়েছিল যা সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহ। তবে, র্শিক বা অংশী পূজার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নবীর প্রতি আমাদের ভক্তি-ভালোবাসার আগুনে শীতল পানি ঢেলে দেয়াও ভুল হবে। কেননা, সেটা হবে ঈমান ধ্বংস করে র্শিক ধ্বংসের শামিল, যা নিঃসন্দেহে অবিজ্ঞজনোচিত কৌশল।
ঈদে মিলাদুন্নবী (নবী করীম সা.-এর জন্মদিন) সহ অন্য আরো উপলক্ষসমূহে আমরা তাহলে আন্তরিক ও উদারভাবে এবং কৃপণতা না করে নবী করীম (সা.)-এর প্রতি আমাদের সেই রকম ভক্তি-ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি যা স্বয়ং আল্লাহ বাদে অন্য কারো প্রতি করা যায়।
মহানবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠের উপকারিতা
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরুদ প্রেরণ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর ওপর দরুদ ও সালাম প্রেরণ করো উপযুক্ত সম্মানের সাথে।’ (সূরা আহযাব : ৫৬)
১. যে ব্যক্তি একবার নবীর ওপর দরুদ পড়বে আল্লাহ তার ওপর দশ বার আশীর্বাদ পাঠাবেন, তার দশটি গুনাহ মুছে দেবেন এবং তার মর্যাদা দশ গুণ বাড়িয়ে দেবেন। (মিশকাত)।
২. শেষ বিচারের দিনে ঐ ব্যক্তি আমার নিকটতম হবে যে এই নশ্বর দুনিয়ায় আমার ওপর সর্বাধিক দরুদ পাঠ করেছে। (তিরমিযি)
৩. (সত্যিই) ঐ ব্যক্তি কৃপণ যে আমার নাম উচ্চারিত হতে শুনেও আমার ওপর দরুদ পড়ে না। (মিশকাত)
৪. তোমরা তোমাদের সভাসমূহ অলংকৃত করো আমার ওপর দরুদ পড়ার মাধ্যমে। কেননা, শেষ বিচারের দিনে এই দরুদই তোমাদের জন্য ঐশী আলোয় পরিণত হবে। (জামিউস সাহিহ)
৫. শুক্রবার বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো। কেননা, শুক্রবার হচ্ছে ‘সাক্ষী হিসেবে ফেরেশতাদের উপস্থিতির দিন’। এইদিন ফেরেশতারা আমার দরবারে হাজিরা দেয়। এবং নিঃসন্দেহে তোমাদের যে কেউ দরুদ পাঠ করবে, দরুদ পাঠ শেষ হওয়ার আগেই তা আমার দরবারে পৌঁছে যায়। (জামিউস সাহিহ)
৬. শুক্রবারের মহিমান্বিত রাতে অর্থাৎ বৃহ¯পতিবার ও শুক্রবারের মধ্যবর্তী রাতে এবং শুক্রবার দিবসে তোমরা আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পড়। কেননা, তোমাদের পাঠকৃত দরুদ ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমার কাছে উপস্থাপিত হয়। (জামিউস সাহিহ)।
৭. শুক্রবার এবং শুক্রবার রাতে (বৃহ¯পতিবার ও শুক্রবারের মধ্যবর্তী রাত) তোমরা অধিক হারে দরুদ পাঠ করো। কেননা, যে-ই এমন করবে আমি তার সাক্ষী হব এবং শেষ বিচারের দিনে আমি তার পক্ষে কথা বলব। (জামিউস সাহিহ)
ড. আহমাদ শাফাআত : অনুবাদ : মিয়া আব্দুল আউয়াল