মহানবী (সা.)-এর বাণী কি শুধুই পুরুষের উদ্দেশে, নাকি তিনি নারীদেরও সম্বোধন করে কিছু বলেছেন?
অন্যান্য নবী-রাসূলের মতোই মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-ও দুটি কারণে মানুষের প্রতি তাঁর দীনী আহ্বান ও পথনির্দেশনা শুরু করেন এবং তা অব্যাহত রাখেন :
১. ঐশী জ্ঞানের সাথে মানুষকে সুপরিচিত করানো ও
২. মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস এবং তার আত্মিক ও নৈতিক পূর্ণতা সাধন।
একদিকে সেগুলো হলো ঐশী গ্রন্থ ও প্রজ্ঞার শিক্ষা, অন্যদিকে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি, যেমনটি পবিত্র কোরআন বলছে : ‘অবশ্যই আল্লাহ বিশ্বাসীদের অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদের জন্য তাদের (জাতির) থেকেই এক রাসূল প্রেরণ করেছেন যে তাদের আল্লাহর আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে শুনিয়ে থাকে, তাদের (আত্মাগুলো) বিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়; এবং নিশ্চয় তারা এর পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।’- সূরা আলে ইমরান : ১৬৪
সুতরাং নবী প্রেরণের বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- তিনি এসেছিলেন সমাজকে ঐশী জ্ঞানের দিকে পরিচালিত করার জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে এবং সমাজকে পরিশুদ্ধ ও মানুষের আচরণকে সঠিক করার জন্য। তিনি এসেছিলেন মানুষকে ব্যবহারিক দিক থেকে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনে সাহায্য করার জন্য। এই পথনির্দেশনার সম্বোধিত সত্তা ছিল মানুষের আত্মা, তার দেহ নয়। সুতরাং মহানবী (সা.)-এর বাণীর সম্বোধিত সত্তা পুরুষ ও নারী উভয়েই।
মানুষের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হলো মানুষের আত্মা, তার দেহ নয়, আবার দেহ ও আত্মা একত্রেও নয়। যেটি শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত হয় সেটি হলো তার আত্মা; এই আত্মা পুরুষও নয়, নারীও নয়। সুতরাং মানুষের পূর্ণতার ক্ষেত্র, সেটি যা-ই হোক না কেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আকীদা-বিশ্বাস অথবা নৈতিকতা, তা পুরুষ ও নারীর জন্য অভিন্ন। যদিও প্রশাসনিক ও কায়িক পরিশ্রম সংক্রান্ত কর্মের ক্ষেত্রে মানুষের শারীরিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে কিছু অভিন্ন ও কিছু বিশেষ বা ভিন্ন ধরনের দায়িত্ব রয়েছে, কিন্তু তাদের দায়িত্বের ভিন্নতা তাদের পূর্ণতার স্তরের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না।
পুরুষের মতো নারীও পূর্ণতায় পৌঁছতে সক্ষম এবং পবিত্র কোরআন যখনই উচ্চ মানবীয় মূল্যবোধের বিষয় আলোচনা করেছে তখন নারীকে পুরুষের সমান হিসেবে উল্লেখ করেছে। এর অর্থ হলো পুরুষের মতোই নারী উচ্চ আত্মিক ও মানবীয় মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছতে পারে।
বিশ্বাস, আনুগত্য, সততা, ধৈর্য, আল্লাহভীতি, রোযা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আল্লাহর স্মরণ প্রত্যেক নারীর জন্য অর্জন করা সম্ভব এবং নিশ্চয়ই তার পুণ্যকর্মেরও পুরুষের মতোই পার্থিব ও অপার্থিব ফলাফল রয়েছে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘নর হোক অথবা নারী- যে কেউ সৎকর্ম করে এবং সে বিশ্বাসী হয়, আমরা তাকে পবিত্র (অনাবিল) জীবন দান করব এবং অবশ্যই আমরা তাদেরকে তারা যে উত্তম কর্ম সম্পাদন করত তদনুযায়ী প্রতিদান দেব।’- নাহল : ৯৭
এই ভূমিকার আলোকে আমরা নিম্ন লিখিত বিষয়গুলো আলোচনা করব :
মেয়ে হওয়ার জন্য গর্বিত হওয়া
যখন সমাজ নারী হওয়াকে বিব্রতকর মনে করত এবং নারীর প্রতি ঘৃণা এমন এক পর্যায়ে ছিল যে, তারা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, সেই পরিবেশে ইসলাম কন্যাসন্তানের মর্যাদাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে এবং তাকে ‘রায়হানা’ নামে পরিচিত করিয়েছেÑ যার অর্থ গোলাপ কলি। মহানবী (সা.)-এর অন্যতম উপহার হলো নারীর ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-এর নিকট হতে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো :
কন্যাসন্তানরা আশীর্বাদস্বরূপ এবং সুন্দর।
তোমাদের সবচেয়ে উত্তম সন্তানরা হলো তোমাদের কন্যাসন্তান।
কোন নারীর সৌভাগ্যের একটি নিদর্শন হলো তার প্রথম সন্তান কন্যা হওয়া।
উত্তম কন্যাসন্তান হলো সেই কন্যা যে দয়ালু, সাহায্যকারী, বন্ধুভাবাপন্ন, এবং সৌভাগ্যবান এবং দুঃখ-কষ্ট দূরকারী।
যেসব পিতামাতার একটি কন্যাসন্তান রয়েছে তাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য, আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ রয়েছে।
যখন মহানবী (সা.)-কে কোন কন্যাসন্তানের জন্ম গ্রহণের সংবাদ দেয়া হতো তখন তিনি বলতেন : ‘সে একটি ফুল, যাকে আল্লাহ রিযিক দেন।’
নিজেকে নিয়ে গর্বিত হও এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত হও যাদের সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘সেই মেয়েরা কত উত্তম সন্তান, যারা যথাযথ পর্দা করে চলে এবং নিজেদেরকে (অনৈতিকভাবে) প্রদর্শন করে না!’
সুযোগের সদ্ব্যবহার করা
যৌবনকাল একটি অস্থায়ী সুযোগ। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার জন্য রয়েছে মৃত্যু ও (আল্লাহর নিকট) প্রত্যাবর্তন। একটি উক্তি আমরা শুনে থাকি : ‘দুনিয়া একটি মাত্র ঘণ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।’
প্রকৃতপক্ষেই জীবন খুবই ছোট এবং একই সাথে এটি খুবই মূল্যবান যাকে অবমূল্যায়ন করা উচিত না। মহানবী (সা.) বলতেন : ‘বিচার দিবসে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিনের জন্য ২৪টি নথি খোলা হবে যা একটি দিনের ঘণ্টাসমূহের সমান।’
ধার্মিকরা আলো ও আনন্দে পরিপূর্ণ একটি নথি পাবে এবং এমন বেশি সুখ ও আনন্দ অনুভব করবে যে, যদি তা জাহান্নামের অধিবাসীদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে তা জাহান্নামের আগুনের সকল কষ্টকে তাদের থেকে অপসারিত করবে। আর এটি হলো আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য তাদের প্রতি পুরস্কার।
নিজেকে প্রদর্শন করা হতে বিরত থাকা
নিজেকে প্রদর্শন না করা হলো প্রত্যেক সৌন্দর্যের উৎস। এর অনুপস্থিতিতে কোন উত্তম কর্ম সম্পাদিত হতে পারে না এবং কোন অনৈতিক কর্মও পরিহার করা যায় না। নিজেকে প্রদর্শন না করা হলো পবিত্রতা, ভদ্রতা এবং অনৈতিক কর্মকা- পরিহার, বিশেষ করে যখন কেউ অনুভব করে যে, কেউ তাকে দেখছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘এজন্য সতর্ক হও যে, আল্লাহ তোমার সকল কর্ম সম্পর্কে অবগত।’
মূসা (আ.) যেভাবে শোয়াইব (আ.)-এর কন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং শোয়াইব (আ.)-এর কন্যা কীভাবে নিজেকে প্রদর্শন না করে শালীনতার সাথে চলে গিয়েছিলেন তা চিন্তা করে দেখ। এ বিষয়টি তোমার জন্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক হতে পারে।
সঠিক পোশাক-পরিচ্ছদ নির্বাচন করা
ইসলামের নবী (সা.) নারীর পোশাক পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং অবৈধ প্রদর্শনী ও অশ্লীলতাকে নিষেধ করেছেন। আর পবিত্র কোরআন যখন পুরুষদেরকে নারীর প্রতি না তাকানো এবং তাদের সামনে যথাযথ পোশাক পরিধানের উপদেশ দিয়েছে তখন নারীদেরকেও কামনার দৃষ্টিতে পুরুষের প্রতি না তাকানোর উপদেশ দিয়েছে এবং নিজেদেরকে হেফাজতের উপদেশ দিয়েছে। নিম্নের দুটি আয়াত লক্ষ্য কর :
১. হে নবী! তুমি তোমার পত্নিগণকে, কন্যাগণকে এবং বিশ্বাসীদের নারিগণকে বলে দাও যেন তারা তাদের চাদরগুলোর অবগুণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখে; নিশ্চয়ই এটা তাদের (শালীন) পরিচিতির নিকটতর; ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, অনন্ত করুণাময়।- সূরা আহযাব : ৫৯
২. বিশ্বাসী নারীদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে (নিষিদ্ধ বস্তু থেকে) নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গকে সংরক্ষণ করে এবং তাদের শোভা প্রকাশ না করে; তবে যা আপনা হতেই প্রকাশিত তা স্বতন্ত্র; এবং তাদের ওড়না দিয়ে যেন গ্রীবা ও বক্ষদেশ ঢেকে রাখে এবং তাদের শোভা যেন তাদের স্বামী, পিতৃবর্গ, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগিনীপুত্র, তাদের (সমধর্মী) নারী, তাদের বাঁদী, সেসব সেবক ও অনুগত পুরুষ যারা নারীদের প্রতি আসক্তিহীন এবং নারীদের গোপনাঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারও নিকট প্রকাশ না করে; এবং চলার সময় ভূমিতে এভাবে পদক্ষেপ না করে যাতে যে শোভা তারা গোপন করেছিল তা প্রকাশ পেয়ে যায়।- সূরা নূর : ৩১
পর্দার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোরআন বলছে যে, তাহলে সম্মানিতরা উত্যক্ত হবে না।
সবসময় জ্ঞান অন্বেষণ করা
সবসময় শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে আগ্রহী হবে। কারণ, যারা ঈমানদার এবং জ্ঞান অন্বেষণ করে, তাদের মহান আল্লাহ মর্যাদায় উন্নীত করেন। কখনও অধ্যয়ন ও শিক্ষা গ্রহণে ক্লান্ত হয়ো না এবং কখনই প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির ব্যাপারে চিন্তা কর না। মহানবী (সা.)-এর বাণী স্মরণ রাখবে, যিনি বলেছেন :
‘প্রত্যেক বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তির চারটি বিষয়ের প্রতি অবশ্যই অনুগত থাকতে হবে: জ্ঞান অর্জন, একে সংরক্ষণ, এর প্রচার প্রসার ও তা অনুশীলন করা।’
‘সকল পাত্রই ধারণক্ষমতা হারায় যখন সেটার মধ্যে কিছু রাখা হয়, কেবল জ্ঞানের পাত্র ছাড়া, যখন এতে কিছু যোগ করা হয় তখন তা আরো ধারণক্ষমতা অর্জন করে।’
মহানবী (সা.) বলেন : ‘আনসার নারীরা উত্তম। লজ্জাশীলতা তাদেরকে ধর্মের ব্যাপারে জ্ঞান অর্জনে বাধা দেয় না।’
সর্বশ্রেষ্ঠ যে জ্ঞান যুবকদের অর্জন করা উচিত সেটি হলো যা তাদের বয়স কালে তাদের জন্য কল্যাণদায়ক হবে এবং তাদের জীবনে তাদের দ্বারা যে জ্ঞান ব্যবহৃত হবে।
পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া
তোমার পিতামাতার সেবা করতে ইতস্তত কর না এবং তাঁদের প্রতি নম্র ও বিনয়ী হও। সেই সৌভাগ্যবান যে তার পিতামাতার সেবা করে। এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে সর্বোৎকৃষ্ট কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তিনি উত্তর দিলেন : ‘প্রথম হলো ওয়াক্তের শুরুতেই নামায আদায় করা, তারপর হলো পিতামাতার সেবায় নিয়োজিত হওয়া।’
একদিন মহানবী (সা.)-এর দুধ বোন তাঁর কাছে এলেন। যখন তিনি তাঁকে দেখলেন তখন আনন্দিত হলেন এবং একটি চাদর বিছিয়ে দিয়ে তাঁকে সেটার ওপর বসালেন। এরপর তিনি তাঁর দিকে ফিরে তাঁর সাথে কথা বললেন ও স্মিত হাসলেন। সেই বোনটি তাঁর নিকট থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁর ভাই সেখানে আসলেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাঁর বোনের সাথে যেরূপ আচরণ করেছিলেন, তাঁর ভাইয়ের সাথে সেরূপ আচরণ করলেন না। সাহাবিগণ তাঁকে এই আচরণগত পার্থক্যের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জবাব দিলেন : ‘কারণ, সে তার ভাইয়ের চেয়ে তার পিতামাতার প্রতি অধিকতর দয়ালু।’
এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এলেন এবং পিতামাতার সেবা করার বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন : ‘তোমার মায়ের সেবা কর। তোমার মায়ের সেবা কর। তোমার মায়ের সেবা কর।’ এরপর তিনি একথার সাথে একবার যোগ করলেন : ‘তোমার পিতার সেবা কর।’
মহানবী (সা.) প্রথমে মায়ের সেবা করার উপদেশ দিয়ে কথা শুরু করেছিলেন।
আর তোমরা নবীর অনুসারী কন্যারা! অন্যদের দ্বারা সমালোচিত হওয়ার আগেই তোমরা নিজেদেরকে বিশ্লেষণ কর। আর মহানবী (সা.)-এর বাণীসমূহকে মূল্য দাও।
অনুবাদ : মো. আশিফুর রহমান
(মাসিক মাহজুবা, অক্টোবর, ২০১৬)
মুহাম্মাদ বাকের আমীনপুর