ইরানের রেইহানা জাব্বারি নামে এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে সারা বিশ্বে ব্যাপক অপপ্রচার চলছে; এর বাইরে নেই বাংলাদেশও। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঝড় উঠেছে ওই নারীর পক্ষে, তবে নিতান্তই অসত্যের পক্ষে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য লেখাটি লিখলাম। যাঁরা সত্য অনুসন্ধান করতে চান আশা করি তাঁরা সত্যের সন্ধান পাবেন।
প্রথমেই বলে নিই- বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হলো বিদেশী খবর যাচাই বাছাই করার সুযোগ নেই। সে কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যম বিশেষ করে এএফপি, রয়টার্স, এপি, ভোয়া বা বিবিসি যা দেয় তাই যেন চোখ বন্ধ করে গিলতে হয়।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে রেইহানাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আরো বলা হচ্ছে, ধর্ষণ থেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে মহিলাটি ওই লোকটিকে খুন করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে, ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। তারপরও তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে! তার মানে হচ্ছে নারীর এই প্রতিরোধকে স্বীকার করা হলো না, নারীর অধিকারকে স্বীকার করা হলো না। কেউ কেউ বলছেন, এই বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণকে উৎসাহ দেয়া হলো।
অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো রেইহানা ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন করেন নি। ঘটনাটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইরানের বিচার বিভাগ আদৌ নারীবিদ্বেষী নয় যে, অন্যায়ভাবে একজন নারীকে ফাঁসি দেবে। হত্যাকাণ্ডটি ওই মহিলা উক্ত খুনের কথা স্বীকার করেছেন আদালতে পূর্বপরিকল্পিত ছিল। আর সার্বিক তদন্তের সাপেক্ষে রেইহানা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘটনাটি হচ্ছে, দু’জনের অবৈধ সম্পর্কের জের ধরে এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং এই খুনের ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ লোকটি যে ভালো মানুষ ছিলেন তা বলার সুযোগ নেই। টানাপড়েনের এক পর্যায়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যার কারণে রেইহানা লোকটিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। খুনের দুই দিন আগে রেইহানা নতুন ছুরি কিনেছিলেন এবং তাঁর এক বান্ধবীকে এসএমএস করেছিলেন যে, খুনের ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার, তা হলো- এই মহিলার সঙ্গে ইরানের আদালতের এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি যে, তাঁকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ে দেবে। অথবা এই মহিলা ইরানের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন সে কারণে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হলো। বরং যদি এমন হতো যে, খুন হয় নি বরং অবৈধ সম্পর্ক বা ধর্ষণের ঘটনার বিচার হচ্ছে তাহলে ওই পুরুষ লোকটিও মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়তেন। আর এ ক্ষেত্রেও ইরানের আইন অনুসরণ করা হতো- দেখা হতো না কে পুরুষ আর কে নারী; যেমনটি দেখা হয় নি রেইহানার ক্ষেত্রে।
৭ বছর আগের ঘটনা এটি; এমন নয় যে, তাড়াহুড়ো করে একজন নারীকে ফাঁসি দিয়ে আদালত একটি বিরাট কিছু করে ফেলছে। বাস্তবতা হচ্ছে- এটা নিতান্তই পশ্চিমা গণমাধ্যম ও কথিত মানবাধিকার কর্মীদের প্রচারণা। আমি তো ইরানে থাকি, এখানকার নারীরা যে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করেন তা বেশ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে… এবং ইরানের সমাজে নারীর যে কত মূল্যায়ন তা অনেকের জানা নেই এবং জানলেও তা প্রকাশ করবেন না; বরং বলার চেষ্টা করবেন ইসলামী সরকার এতটা বর্বর এবং এ কারণে একজন নারীকে ফাঁসি দিল ইত্যাদি ইত্যাদি। কল্পনা করা যাক- যদি ঘটনাটা পুরুষের বেলায় ঘটত তাহলে কি পুরুষ লোকটি বেঁচে যেতেন ফাঁসির হাত থেকে। নিশ্চয় নয়। ইরানের আইনের মূল ভিত্তি হচ্ছে ইসলামী বিধান। যে অন্যায় ঘটেছে তার জন্য নারী-পুরুষ মুখ্য বিষয় নয়; মুখ্য বিষয় হচ্ছে আইন এবং তার বাস্তব প্রয়োগ। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর বহু খুনের ঘটনার বিচার হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে দোষীদেরকে; সেখানে নারী-পুরুষ কখনো বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে নি; বিচার হয়েছে অপরাধের।
২০০৭ সালে সংঘটিত হয় আলোচ্য হত্যাকাণ্ডটি। ঘটনাটি সাত বছর ধরে পুঙ্খানুপঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে তারপর ইরানের আদালত রায় দিয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে পরে আবার বিচার হয়েছে এবং উচ্চ আদালত রায় বহাল রাখে। তারপরও এক মাস দেরী করা হয়েছে যে, ভিক্টিম পরিবার যদি মাফ করে দেয় তাহলে ফাঁসিটি কার্যকর করা হবে না। কিন্তু ওই পরিবার মাফ করে নি। ইরানের বিচার ব্যবস্থায় খুনের ঘটনায় কারো মৃত্যুদণ্ড হলে ভিক্টিম পরিবার ছাড়া কারো পক্ষে সে রায় পরিবর্তনের সুযোগ নেই, এমনকি প্রেসিডেন্ট বা সর্বোচ্চ নেতাও পারেন না। এটা ইসলামের বিধান- তা কারো ভালো লাগুক আর না লাগুক। মনে রাখতে হবে, ইরান সম্পূর্ণ স্বাধীন-সার্বভৌম ইসলামী বিপ্লবের দেশ। ইসলামী আইন হচ্ছে এখানকার বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কারো কথায় তার বিচারবিভাগ প্রভাবিত হবে না; কারো কথায় আদালতের রায় পাল্টায়ও না।
যাই হোক, নারীবাদী অ্যাঙ্গেল থেকে জাব্বারির মৃত্যুদণ্ডের ঘটনাটি দেখলে সত্য এড়িয়ে যাওয়া হবে। ইরানে নারীবাদ বা পুরুষবাদ বলে কিছু নেই। পরিশেষে বলব, সবারই তো, বিশেষ করে সংবাদকর্মীদের জানা থাকার কথা যে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো কেমন করে খবর বিকৃত করে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করে! আর মানবাধিকার যেন তাদের একান্ত নিজস্ব; এটি তারা ছাড়া রক্ষা করার আর কেউ নেই! ইরাক-আফগানিস্তানে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এরা, কিন্তু ভাবখানা এমন যে, তা কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পড়বে না… ইরানে এক নারীকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেটা বিরাট বড় ঘটনা! মানবাধিকার ইস্যুকে তারা এভাবেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ।
লেখক : সিরাজুল ইসলাম, সাংবাদিক, রেডিও তেহরান