আল্লাহর নবী হযরত সুলাইমান (আ.)-এর সময়কালের কথা। তিনি একদিকে ছিলেন আল্লাহর নবী, অপর দিকে ছিলেন জগতের বাদশাহ। আল্লাহর হুকুমে পশুপাখি, জিনপরির ওপরও তাঁর রাজত্ব চলত। তিনি সবার ভাষা বুঝতেন। একদিন খুব ভোরে এক লোক হযরত সুলাইমান (আ.)-এর দরবারে এসে হাজির। লোকটি ছিল ভয়ে বিচলিত, চেহারা তার ফ্যাকাশে। থরথর করে কাঁপছিল তার দেহ। সুলাইমান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন : ‘কী হে! তোমার এ অবস্থা কেন? ভয়ে কাঁপছ কেন?’ লোকটি বলল : ‘হে আল্লাহর নবী! আমি যখন আসছিলাম তখন পথে দেখলাম, আজরাইল দাঁড়িয়ে আছেন আর তির্যক দৃষ্টিতে আমাকে পরখ করে দেখছেন। তাঁর চোখেমুখে ভীষণ রাগ। মনে হলো, আমার জান কবয করতে চান।’ সুলাইমান (আ.) বললেন : ‘এখন তুমি কী চাও, বল। আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’ লোকটি বলল : ‘আপনি বাতাসকে হুকুম দিন, আমাকে যেন কাঁধে করে দূর হিন্দুস্তানে নিয়ে যায়। আজরাইল যেন সেখানে যেতে না পারে। আর আমি প্রাণে রক্ষা পাই।’ সুলাইমান (আ.) বাতাসকে হুকুম দিলেন : ‘দ্রুত এই লোকটাকে হিন্দুস্তানে রেখে আস।’
পরদিন ভোরে রাজ দরবারে মৃত্যুদূত ফেরেশতা হযরত আজরাইল (আ.) উপস্থিত। সুলাইমান (আ.) তখন আজরাইলকে জিজ্ঞাসা করলেন : ‘কী ব্যাপার! আমার লোকজনকে ভয় দেখাও কেন আজকাল? গতকাল দরবারে আসার পথে ঐ লোকটার দিকে নাকি ক্রোধের সাথে তাকিয়েছিলে? সে তো এখন দেশছাড়া, হিন্দুস্তানে পালিয়ে গেছে।’ আজরাইল বললেন : ‘আল্লাহর কসম! গতকাল লোকটার দিকে আমি রাগের বশে তাকাই নি; বরং আমি অবাক হয়ে বারবার দেখছিলাম তাকে। কারণ, আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছিলেন, দিনের মধ্যেই হিন্দুস্তানে এই লোকটার জান কবয করতে হবে। আমি ভাবছিলাম, কী করে সম্ভব! শত পাখা থাকলেও তো এই লোক আজকের মধ্যে ফিলিস্তিন থেকে সূদুর হিন্দুস্তানে যেতে পারবে না। কিন্তু আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য যখন আমি হিন্দুস্তান পৌঁছলাম, দেখলাম যে, লোকটা ওখানে হাজির। কাজেই সেখানেই তার জান কবয করে এসেছি।’
খরগোশ ও সিংহের গল্পে বনের পশুরা তাদের পক্ষে হযরত সুলাইমান (আ.) ও মৃত্যুভয়ে পলায়নকারী লোকটির ঘটনা প্রমাণ হিসেবে পেশ করে। বনের পশুদের যুক্তি ও বক্তব্য ছিল একটাই ‘তকদিরের লিখন কেউ খ-ন করতে পারবে না।’ তাদের ভাষায় মওলানা বলেন :
تو همه کار جهان را همچنین
کن قیاس و چشم بگشا و ببین.
“তো হামে কা’রে জাহা’ন রা’ হামচুনীন
কুন কিয়া’স ও চশ্ম বোগশা’-ও-বেবীন”
‘তুমি জগতের সকল কর্মযজ্ঞ এইভাবে
অনুমান কর, চোখ মেলে দেখ একে একে।’ ১/৯৬৯
কাজেই খামাখা কষ্ট করে সাধনা করে লাভ নেই। তার চেয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করেন, যা হবার তাই হবে। আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহই চালাবেন, আল্লাহই খাওয়াবেন। কিন্তু সিংহ এই যুক্তি মানতে নারাজ। সে তার যুক্তিতে অনড়। বলে :
شیر گفت آری ولیکن هم ببین
جهدهای انبیا و مؤمنین.
‘শীর গোফ্ত অ’রি ওয়ালেকিন হামবেবীন
জাহ্দহা’য়ে আম্বিয়া-ও মু’মেনীন’
‘সিংহ বলল : হ্যাঁ, কিন্তু দেখ একই সাথে
চেষ্টা ও সাধনার জীবন নবিগণ ও মুমিনদের।’ ১/৯৭১
حق تعالی جهدشان را راست کرد
آنچ دیدند از جفا و گرم و سرد.
‘হক তাআলা জাহদ্শা’ন রা’ রা’স্ত কর্দ
অঁ’চে দীদান্দ আয যফা’ ও গর্ম-ও সর্দ’
‘আল্লাহ তাদের চেষ্টা ও সাধনা করেছেন ফলবান
দুঃখ,অন্যায়, গরম, ঠান্ডা সয়ে তারা সফলকাম।’ ১/৯৭২
পয়গাম্বর (সা.) ও মু’মিন বান্দারা কালচক্রের দুর্বিপাকে গরম-শীতল, দুঃখ-অন্যায় যা কিছু ভোগ করেছেন, তাতে তাঁরা সফলকাম হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের যথার্থ পুরস্কারে ভূষিত করছেন। কাজেই ভাগ্যের দোহাই দিয়ে চেষ্টাহীন বসে থাকা উচিত নয়।
با قضا پنجه زدن نبود جهاد
زانک این را هم قضا بر ما نهاد.
‘বা’ কাযা’ পাঞ্জা যাদান নবুয়াদ জিহাদ
যা’নকে ইনরা’ হাম কাযা’ বর মা’ নেহা’দ’
‘ভাগ্যের সাথে পাঞ্জা লড়া, যুুদ্ধ বলে গণ্য নয়
কারণ, তাও আমাদের কপালে ভাগ্যেরই লিখন।’ ১/৯৭৬
ভাগ্য বা নিয়তিতে কী আছে তার জন্য বসে না থেকে চেষ্টা-সাধনা চালানো তকদিরের বিরুদ্ধে লড়াই ও জিহাদ বলে গণ্য হবে না। কারণ, তকদিরে কী লেখা আছে, তা উদ্ঘাটনের সংগ্রাম সাধনার ব্যাপারটিও তো ভাগ্যেই লেখা আছে। সিংহের জোরালো উপদেশ-
این جهان زندان و ما زندانیان
حفره کن زندان و خود را وارهان.
‘ইন জাহা’ন যেন্দা’ন ও মা’ যেন্দানিয়া’ন
হুফরে কুন যেন্দা’ন ও খোদ রা’ ওয়া’রেহান’
‘এ জগৎ কারাগার আর আমরা কারাবন্দি
ছিন্ন করো কারাগার আন নিজের মুক্তি।’ ১/৯৮২
এই দুনিয়াতে আমরা নফসের কারাগারে বন্দি। কাজেই কৃচ্ছ্রতা ও সাধনায় কারার প্রাচীর ছিদ্র করে মুক্তি বয়ে আনতে হবে। তখনই প্রেমাস্পদ আল্লাহতে মিলিত হওয়ার ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা হতে পারবে। প্রশ্ন আসে, তাহলে কি এই জগৎ, সংসার, জীবন, চাকরি-ব্যবসা কমর্যজ্ঞ সব ত্যাগ করতে হবে সাধনায় সিদ্ধি লাভের জন্য? সিংহের যবানীতে মওলানা বলছেন : ‘না তো, কথা তো সেরূপ নয়।’ তাহলে দুনিয়া, দুনিয়াদারি বলতে কী বুঝায়? আর দ্বীনদারী কোনটি?
چیست دنیا از خدا غافل بدن
نی قماش و نقره و میزان و زن.
‘চীস্ত দুনিয়া’ আয খোদা’ গা’ফেল বুদান
নায় কুমা’শ ও নোকরে ও মীযান ও যন’
‘দুনিয়া কী? আল্লাহকে ভুলে যাওয়ারই নাম
ধন সম্পদ, ব্যবসা ও পরিবার-পরিজন নয়।’ ১/৯৮২
আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার নামই দুনিয়াদারি, দুনিয়াপূজা। নচেৎ ধন-সম্পদ, ব্যবসা, চাকরি, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে যে জীবন যাপন তার নাম সেই নিন্দিত দুনিয়াদারি নয়।
مال را کز بهر دین باشی حمول
نعم مال صالح خواندش رسول.
‘মা’ল রা’ কায বাহরে দীন বা’শী হামূল
নে-মা মা’লু সা’লেহুন খা’ন্দাশ রাসূল’
‘ধন যদি রাখ দ্বীনের স্বার্থে তোমার কাছে
এ ধন কল্যাণময় রাসূলের ঘোষণা আছে।’ ১/৯৮৩
ধন-সম্পদ কখন দুনিয়ার জন্য নিন্দিত আর কখন দ্বীনের জন্য নন্দিত সেই ফারাক কীভাবে বুঝব? একটি উদাহরণ দিয়ে মওলানা বুঝিয়ে বলেছেন :
آب در کشتی هلاک کشتی است
آب اندر زیر کشتی پشتی است.
‘আ’ব দর কেশতি হালা’কে কিশতি আস্ত
আ’ব আন্দর যীরে কিশ্তী পুশতি আস্ত’
‘পানি নৌকার ভেতরে ঢুকলে নৌকা ধ্বংস করে
নৌকার নিচে পানি নৌকার সাহায্য করে।’ ১/৯৮৪
নদীর পানির সাহায্য ছাড়া নৌকা চলে না। কিন্তু পানি যখন নৌকার ভেতরে ঢুকে যায়, তখন নৌকা ডুবে যায়। আর যদি পানি নৌকার নিচে থাকে, তাহলে নৌকা বয়ে নিয়ে চলে যায়। অনুরূপ ধন-সম্পদও দেহের ভেতরে অন্তরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। আমাদের মোহ-লোভ তখন জীবনতরী ডুবিয়ে দেবে। কিন্তু যদি সম্পদকে মনের বাইরে রাখা হয়, তাহলে নৌকার নিচে পানির সাপোর্টের মতো জীবন তরীকে নিয়ে যাবে আখেরাতের গন্তব্যের ঘাটে। আরেকটি উদাহরণ:
کوزۀ سربسته اندر آب زفت
از دل پر باد فوق آب رفت.
‘কূযেয়ে সারবাস্তে আন্দর অ’াবে যাফ্ত
আয দেলে পুরবা’দ ফওকে অ’ব রাফত’
‘মুখবাঁধা কলসি ভাসে বিশাল সাগরের বুকে
বাতাসে ভর্তি কলসি পানিতে সাঁতার কাটে।’ ১/৯৮৭
باد درویشی چو در باطن بود
بر سر آب جهان ساکن بود.
‘বা’দে দরবেশী চো দর বা’তেন বুয়াদ
বর সার আ’বে জাহা’ন সা’কেন বুয়াদ”
‘দরবেশির বাতাস যদি ভরা থাকে আন্তরে, বুকে
জগৎ সাগরের পানির ওপরে সে সুস্থির থাকে।’
তার জ্বলন্ত উদাহরণ সুলাইমান (আ.)-এর জীবন। মানব-দানবের বাদশাহ, পশুপাখির রাজা, বাতাস যার হুকুমের তাঁবেদার, তাঁর অবস্থা কেমন ছিল।
چونک مال و ملک را از دل براند
زان سلیمان خویش جز مسکین نخواند.
‘চোঁকে মা’ল-ও-মুল্ক রা’ আয দেল বেরা’ন্দ
যান সুলাইমা’ন খেশ রা’ জুয মিসকীন ন খা’ন্দ’
‘ধন ও রাজত্ব যেহেতু দিয়েছিলেন মন থেকে বিদায়
সুলাইমান বলতেন, আমি অসহায় মিসকিন তাই।’ ১/৯৮৬
(সূত্র : মসনবী শরীফ, ১ম খ-, বয়েত নং ৯৬৫-৯৮৯)
মওলানা রূমী (রহ.)-এর মসনবী শরীফ
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী