কাজী নজরুল ইসলামের মহররম কবিতার আবৃত্তি
কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের নানা দিক ও বিশেষ করে এ বিপ্লবের মহানায়ক ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং মহান সঙ্গীদের শাহাদতসহ তাঁদের নানা ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক শোক-গাঁথা বা মর্সিয়া, কবিতা ও শোকের সঙ্গীত। এখানে নজরুলের বিখ্যাত ‘মহররম’ কবিতার টেক্সট ও অডিও ফাইল দেয়া হল।
মহররম
কাজী নজরুল ইসলাম।
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া –
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া,
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?
সে কাঁদনে আসু আনে সিমারের ও ছোরাতে।
রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া দামেস্কে –
জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?
হায় হায় হোসেনা ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তলোয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের পাঞ্জায়
উন্ মাদ দুল দুল ছুটে ফেরে মদিনায়
আলীজাদা হোসেনের
দেখা হেথা যদি পায়।
মা ফাতিমা আসমানে কাঁদি খুলি কেশপাশ
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস
রণে যায় কাসিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা
মেহেদির রঙটুকু মুছে গেল সহসা !
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা—-
‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেল সকীনা!’
কাঁদে কে রে কোলে ক’রে কাসিমের কাটা-শির ?
খান্ খান্ হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর !
কেঁদে গেছে থামি’ হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র !
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
“আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!”
নিয়ে তৃষা সাহারার,দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার !
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্ মনও ‘সাব্বাস্’ !
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর “শির দেগা,নেহি দেগা আমামা !
কলিজা কাবাব সম ভূনে মরু রোদ্দুর
খাঁ খাঁ করে কারবালা নাই পানি খজ্জুর
মার স্তনে দুধ নাই বাচ্চারা তড়পায়
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়টায়
দাও দাও জ্বলে শিরে কারবালা ভাস্কর
কাঁদে বানু পানি দেও মরে যাদু আসগর
পেলনাতো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন
ডাকে মাতা পানি দেব ফিরে আয় বাছা শোন –
পুত্র হীনা আর বিধবার কাঁদনে
ছিড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাধনে
তাম্বুতে সজ্জায় কাঁদে একা জয়নাল
দাদা তেরি ঘর কিয়া বরবাদ পয়মাল
‘হাইদরী-হাঁক-হাঁকি দুলদুল-আসওয়ার
শম্ শের চম্ কায় দুষমনে ত্রাস্ বার।
খ’সে পড়ে হাত হ’তে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার!
নিঃশেষ দুষমন্ ; ও কে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত ?
কোথা বাবা আস্ গর? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাঁজরা !
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয় নি রে বাছাদের মুখে কম্ জাত্ রা !
অঞ্জলি হ’তে পানি প’ড়ে গেল ঝর্-ঝর্,
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জ্জর !
হল্ কুমে হানে তেগ ও কে ব’সে ছাতিতে ?
–আফ্ তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে ।
‘আস্ মান’ ভ’রে গেল গোধূলিতে দুপুরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে !
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে,আহ্-
‘আরশের’ পায়া ধরে,কাঁদে মাতা ফাতেমা,
“এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জ্জনা কর গোনাহ পাপী কম্ বখতের ।”
কত মোহর্ রম এলো,গেল চ’লে বহু কাল-
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল !
মুসলিম তোরা আজ জয়নাল আবেদীন
ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা কেঁদে তাই যাবে দিন
ফিরে এল আজ সেই মহরম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।
উষ্ণীষ কোরআনের হাতে তেগ আরবীর
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শীর।
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা
শমশের হাতে নাও বাধ শিরে আমামা
বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নাকিবের তুর্য
হুঁশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য
জাগো ওঠো মুসলিম হাঁকো হায়দারী হাঁক
শহীদের দিলে সব লালে লাল হয়ে যাক।
নওশার সাজ নাও খুন খচা অস্তিন
ময়দানে লুটাতেরে লাশ এই খাস দিন
হাসানের মত পিব পিয়ালা সে জহরের
হোসেনের মত নিব বুকে ছুরি কহরের
আসগর সম দেব বাচ্চাদের কুরবান
জালিমের দাদ নেব দেব আজগোর জান
সখিনার শ্বেত বাস দেব মাতা কন্যায়
কাশিমের মত দেব জান রুধি অন্যায়
মহরম কারবালা কাঁদো হায় হোসেনা
দেখ মরু সূর্য এ খুন যেন শোষে না।