আলী (আ.)’র শোকে রাসূল (সা.)’র ক্রন্দন
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.) ছিলেন মানুষের জন্য দয়া, ক্ষমাশীলতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, দানশীলতা, মহানুভবতা, পরোপকার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীলতা, সাহসিকতা, বীরত্ব ও ন্যায়পরায়নতাসহ সব মহৎ গুণের শীর্ষস্থানীয় আদর্শ। আর তাঁর পর এইসব গুণ সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখা গেছে তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের মধ্যে। বিশেষ করে, আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)’র আদর্শের পূর্ণাঙ্গ প্রতিভু তথা ইনসানে কামিলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদর্শ। আকাশের উদারতা ও স্বর্গীয় মহত্ত্বগুলো ছিল তাঁর ভূষণ। এই মহাপুরুষের শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং এই মহান ইমামের শানে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম। অনেকেই মনে করেন তাঁর শাহাদতের রাতটি ছিল পবিত্র শবে কদর।
আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.)’র জন্ম হয়েছিল বিশ্বনবী (সা.)’র নবুওত প্রাপ্তির ঘোষণার দশ বছর আগে (হিজরি-পূর্ব ১৬ বা ২২ সনের ১৩ ই রজব) পবিত্র কাবাঘরের ভেতরে। অর্থাৎ মহানবী যখন ইসলাম প্রচারের কাজ প্রথমবারের মত শুরু করেন সে সময় আলী (আ.)’র বয়স ছিল দশ বছর। তাঁর বাবা আবু তালিব ছিলেন মহানবীর অভিভাবক ও মহানবীর মিশনের সার্বিক সহযোগী এবং পৃষ্ঠপোষক। তিনি ইয়াতিম মহানবীকে শৈশবেই নিজ ঘরে রেখে লালন-পালনের মাধ্যমে বড় করেছিলেন। হযরত আবু তালিব (রা.) ছিলেন ভেতরে ভেতরে একজন মুসলমান। যদিও তিনি তা প্রচার করতেন না।
আলী (আ.)’র জন্মের ছয় বছর পর মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সময় মহানবী (সা.) চাচার আর্থিক দুরবস্থা দেখে শিশু আলীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর থেকেই সরাসরি বিশ্বনবী (সা.)’র অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত ও প্রশিক্ষিত হন আলী (আ.)। হেরা গুহায় রাসূলের কাছে ওহি বা ঐশী বাণী নাজিলের মাধ্যমে নবুওত প্রাপ্তির ঘটনা ঘটেছিল। আর হেরা থেকে ঘরে ফেরার পথে আলীর সঙ্গে রাসূলের দেখা হলে তিনি তাঁকে ঘটনাটি খুলে বলেন। আলী (আ.) সাথে সাথেই মহানবীর প্রতি ঈমান আনেন।
এরপর বিশ্বনবী (সা.) নিকট আত্মীয়দের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য তাদের সবাইকে নিজের ঘরে ভোজসভায় আমন্ত্রিত করেন। সে অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আপনাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম আমার আহ্বানে সাড়া দেবেন তথা ইসলাম গ্রহণ করবেন তিনিই হবেন আমার খলিফা, উত্তরাধিকারী ও প্রতিনিধি। কিন্তু উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাসূলের আহ্বানে যিনি সাড়া দেন তিনি ছিলেন দশ বছরের বালক আলী। আর মহানবীও তাঁর ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন করেছিলেন।
এভাবে পুরুষদের মধ্যে আলী (আ.)-ই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলিম। তিনি কখনও মূর্তি পূজা করেননি। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করা পর্যন্ত তিনিই ছিলেন মহানবীর নিত্যসঙ্গী। হিজরতের রাতে আলী(আ.)ই মহানবীর (সা.) বিছানায় শুয়েছিলেন যখন কাফিররা শেষ রাতের অন্ধকারে শেষ নবীকে বিছানায় শায়িত অবস্থায় হত্যার জন্য বাড়ী ঘেরাও করেছিল। কিন্তু মহানবী ওই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই মদিনায় পাড়ি জমান। এরপর আলী (আ.) মহানবীর (সা.) নির্দেশে তাঁর কাছে গচ্ছিত জনগণের আমানতের মালামাল মালিকদের কাছে পৌঁছে দেন।এরপর তিনিও নিজের মা, নবী-কন্যা ফাতিমা (সা. আ.) ও অন্য দু’জন স্ত্রীলোকসহ মদিনায় আসেন।
মদীনায়ও আলী (আ.) ছিলেন মহানবীর নিত্যসঙ্গী। বিশ্বনবী (সা.) মহান আল্লাহর নির্দেশে আলী(আ.)’র কাছে নিজ কন্যা ফাতিমাকে বিয়ে দেন। তিনি সাহাবিদের উপস্থিতিতেই আলী (আ.)’র সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দেন। বিশ্বনবী (সা.)’র জীবদ্দশায় তাবুকের যুদ্ধ ছাড়া আর সব যুদ্ধেই অংশ নেন আলী (আ.)। তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে মদিনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। এ সময় তিনি আলীকে বলেছিলেন: তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মুসা ও তার ভাই হারুনের সম্পর্কের মত, শুধু পার্থক্য হল তুমি নবী নও। আলী (আ.) সব যুদ্ধেই বীরত্ব দেখিয়েছেন। তিনি কখনও রাসূলের কোনো আদেশের অবাধ্য হননি। তাই মহানবী (সা.) বলেছেন: আলী কখনও সত্য থেকে অথবা সত্য কখনও আলী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।
মহানবীর মৃত্যুর সময় আলী (আ.)’র বয়স ছিল প্রায় তেত্রিশ। সব ধরনের মহৎ গুণের অধিকারী হওয়ার সত্ত্বেও অনেকেই আলী (আ.)’র সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করতো। এর কারণ, মহানবীর জীবদ্দশায় সংঘটিত নানা যুদ্ধে তাদের অনেকেরই আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠজন আলীর হাতে নিহত হয়েছিল। আর এ কারণেই মহানবীর ইন্তিকালের পরপরই আলী (আ.)-কে খিলাফতের পদাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় বলে অনেকেই মনে করেন। অথচ বিদায় হজের পরই মহানবী (সা.) আলী (আ.)কে আবারও নিজের স্থলাভিষিক্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন।
মহানবী (সা.)’র মৃত্যুর ২৫ বছর পর আলী (আ.) জনগণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধে খলিফা হন। এই ২৫ বছরে তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে ব্যক্তি প্রশিক্ষণে নিয়োজিত হয়েছিলেন। তাঁর খিলাফতকাল ছিল প্রায় চার বছর নয় মাস। মহানবীর আদর্শ অনুসরণ করে তিনি তাঁর খিলাফতকে আন্দোলনমুখি বিপ্লবী রূপ দেন ও ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। আলী (আ.)’র ন্যায়বিচারমূলক সংস্কারগুলো সুবিধাবাদীদের ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলে তারা এই মহান ইমাম ও খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ওসমান হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার দাবিকে তারা আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং অরাজকতা সৃষ্টি করে। ফলে আলী (আ.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে বাধ্য হন। বিদ্রোহীরা জামাল নামক ওই অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত হয়। মহানবীর এক স্ত্রী এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া সত্ত্বেও তারা পরাজিত হয় এবং রাসূলের ওই স্ত্রী তথা বিবি আয়শা নিজের ভুল স্বীকার করেন ও ক্ষমা চান। আলী (আ.)’র শাহাদতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন: ‘হে রাসূল (সা.)! আপনার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি আজ শহীদ হলেন! আজ এমন এক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন যিনি ছিলেন রাসূল (সা.)’র পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।’
ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তে বিদ্রোহী মুয়াবিয়া সিফফিন নামের যুদ্ধে লিপ্ত হতে আলী (আ.)-কে বাধ্য করেন। এ যুদ্ধ চলে দেড় বছর ধরে। এ যুদ্ধ শেষ না হতেই মুয়াবিয়ার কূটচালের ফলে সৃষ্ট বিভ্রান্তির শিকার ধর্মান্ধ ও সরলমনা খারেজিরা নাহরাওয়ান নামের এক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় আলী (আ.)’র ওপর। ইসলামের নীতিমালা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে খাওয়ারেজ বা বহিষ্কৃত বলা হত। নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারিজিরা পরাজিত ও প্রায় নির্মূল হয়ে যায়।
অবশেষে এক ধর্মান্ধ খারিজি ৪০ হিজরির ১৯ শে রমজান কুফার মসজিদে ফজরের নামাজের ইমামতিরত আলী (আ.)’র মাথায় বিষাক্ত তরবারির আঘাত হানে। ফলে ২০ রমজান দিবাগত রাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। যেই ব্যক্তির আঘাতে তিনি শহীদ হন সেই কুলাঙ্গারকে বন্দী করা হলে তার অধিকার রক্ষা করা হচ্ছে কিনা খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন আলী (আ.) এবং তাকে পান করতে দিয়েছেন নিজের জন্য আনা দুধের অংশ! জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সদা-সচেতন খোদা-ভীরু ছিলেন বলে এবং এমনকি প্রাণের শত্রুর সঙ্গেও কিংবদন্তীতুল্য ন্যায়বিচার করার কারণে আলী (আ.) মানুষের হৃদয়ে অক্ষয় ভালবাসার আসনে সমাসীন হয়ে আছেন।
শত্রু ও মিত্র সবাই আলী (আ.)’র শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি স্বীকার করে গেছেন। মহানবীর পর আর কারো জীবনী নিয়ে এতো বেশি বই লেখা বা গবেষণা হয়নি যতটা হয়েছে আলী (আ.)’র জীবনী নিয়ে। আলী (আ.)ই ছিলেন ইসলামী যুক্তি-ভিত্তিক দর্শনের প্রথম প্রচলনকারী এবং সাহাবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। কুরআনের এমন কোনো আয়াত নেই যার বিশদ ব্যাখ্যা, শানে-নজুল ইত্যাদি নিয়ে তিনি রাসূলের সঙ্গে আলোচনা করেননি। মহানবী বলেছিলেন, আমি জ্ঞানের নগর আর আলী তার দরজা। কুরআনের বাহ্যিক শব্দগুলোকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনিই প্রথম আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্র রচনা করেন। বীরত্ব ও সাহসিকতার জন তাঁকে বলা হত আসাদুল্লাহ বা খোদার সিংহ। কঠিন যুদ্ধ ও সংকটেও তিনি কখনও ভীত, অস্থির বা বিচলিত হননি। আলীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নেমে কোনো খ্যাতিমান যোদ্ধাও কখনও প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি। কিন্তু মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও আলী (আ.) কখনও কোনো দুর্বল লোককে হত্যা করেননি এবং প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে ধাওয়া করেননি। তিনি কখনও রাতের আঁধারে শত্রুর ওপর অতর্কিত হামলা চালাননি। শত্রুপক্ষের জন্য কখনও পানি সরবরাহও তিনি বন্ধ করেননি। আলী (আ.)’র মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক ওসবোর্ন তাঁকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মার অধিকারী মানুষ’ বলে অভিহিত করেছেন।
খাইবার যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দুর্গম দুর্গের বিশাল লোহার দরজাটি হাতের সামান্য ধাক্কায় উপড়ে ফেলেছিলেন আলী (আ.)। বদর যুদ্ধে নিহত মোট কাফিরের সংখ্যা ছিল ৭০। তার মধ্যে আলী (আ.) একাই ৩৬ জন কাফেরকে হত্যা করেছিলেন যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল নেতৃস্থানীয় কাফের সর্দার ও ততকালীন আরব বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় খ্যাতিমান যোদ্ধা। আলী (আ.) এই প্রথমবারের মত তরবারির যুদ্ধে তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য দেখানোর সুযোগ পান।
বহু বছর পরে মুয়াবিয়া হযরত আলী (আ.)’র খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে এক চিঠিতে আমিরুল মু’মিনিন তাকে সতর্ক করে দিয়ে লিখেছিলেন, “যে তরবারি দিয়ে আমি তোমার নানা (উতবা), তোমার মামা (ওয়ালিদ) ও ভাই হানজালার ওপর আঘাত হেনেছিলাম (তথা তাদের হত্যা করেছিলাম) সে তরবারি এখনও আমার কাছে আছে।”
মক্কা বিজয়ের দিন মহানবীর (সা.) নির্দেশে কাবা ঘরের সর্ববৃহৎ মূর্তিসহ অন্য মূর্তিগুলো ধ্বংস করেছিলেন আলী (আ.) একটি লাঠি দিয়ে। এ সময় সবচেয়ে উঁচুতে রাখা বড় মূর্তি ভাঙ্গার জন্য মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে নিজের কাঁধে চড়ান, যদিও আলী (আ.) মহানবীর কাঁধে পা রাখতে আপত্তি জানিয়েছিলেন লজ্জা ও সম্মানের কারণে। আলী (আ.) এই কাজের জন্য রাসূলকে (সা.) নিজের কাঁধে বহন করার প্রস্তাব দিলে তিনি জানান, আমার নেতৃত্ব তথা নবুওতি বেলায়াত তুমি বহন করতে পারবে না, কিন্তু আমি তোমার বেলায়াত বা ইমামতের ভার বহন করতে সক্ষম হব। হজের সময় কাফির- মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে মহান আল্লাহ যে নির্দেশ দিয়েছিলেন পবিত্র কুরআনে সেই আয়াতগুলো হাজিদের জানিয়ে দেয়ার জন্য মহানবীর পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছিল আলী (আ.)-কে।
জনৈক ব্যক্তি মহানবী (সা.)’র কাছে জানান যে আলী (আ.) তার সঙ্গে কঠোর বা রুক্ষ আচরণ করেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘আলীকে তিরস্কার করো না। কারণ, সে তো আল্লাহ প্রেমিক।’
বিশ্বনবী (সা:) আরো বলেছেন: আমি আলী থেকে, আর আলী আমার থেকে, যা কিছু আলীকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা কিছু আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকে কষ্ট দেয়।’
“হে আলী! ঈমানদার কখনও তোমার শত্রু হবে না এবং মুনাফিকরা কখনও তোমাকে ভালবাসবে না।” অনেক সাহাবী এ হাদিসের ভিত্তিতেই মুনাফিকদের সনাক্ত করতেন।
আলী (আ.)-এর জীবনের শেষ রমজান মাস ছিল অন্য এক রকম রমজান। এ মাস ভিন্ন এক পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছিল। হযরত আলী(আ.) বলেছেন,‘যখন এ আয়াত-‘মানুষ কি ভেবে নিয়েছে আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না’ (আনকাবুত ১-২)- নাযিল হলো তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর এ উম্মতের জন্য ফিতনা ও কঠিন পরীক্ষা আসবে। তখন রাসূলকে প্রশ্ন করলাম : হে রাসূলাল্লাহ্! এ আয়াতে আল্লাহ যে ফিতনার কথা বলছেন সেটা কি? তিনি বললেন : ‘হে আলী! আমার পর আমার উম্মত পরীক্ষার সম্মুখীন হবে।’যখন আলী শুনলেন রাসূল মৃত্যুবরণ করবেন এবং তাঁর পরে কঠিন পরীক্ষা আসবে তখন ওহুদের যুদ্ধের কথা স্মরণ করে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ওহুদের দিনে যারা শহীদ হওয়ার তাঁরা শহীদ হলেন, আমি শাহাদাত থেকে বঞ্চিত হলাম এবং খুবই দুঃখ পেয়ে আপনাকে প্রশ্ন করলাম, কেন এ মর্যাদা আমার হলো না।আপনি বললেন, যদিও এখানে শহীদ হওনি কিন্তু অবশেষে শাহাদাত তোমার ভাগ্যে ঘটবে।’ আলী(আ.) এ সময় পঁচিশ বছরের যুবক ছিলেন এবং এক বছর হলো হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.)-কে বিবাহ করেছেন ও এক সন্তানের জনক। এ বয়সের যুবক যখন জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর স্বপ্ন দেখে তখন আলী(আ.) শাহাদাতের প্রত্যাশী!
ইবাদত করার সময় আলী (আ.) আল্লাহর ভয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতেন। ফলে কেউ কেউ মনে করতো যে তিনি হয়তো মারা গেছেন। অধীনস্থদের প্রতি দয়া, অসহায় ও নিঃস্বদের প্রতি ব্যথিত হওয়া এবং ইয়াতিম, দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি পরম উদারতার বহু ঘটনায় ভরপুর আলী (আ.)’র জীবন।
ইমাম বা খলিফা হওয়ার আগেও হযরত আলী (আ.) সবার সঙ্গে ন্যায় আচরণ করতেন। হযরত আলী (আ.) নিজে একজন সুশৃঙ্খল ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। মনুষ্যত্বের প্রতিটি সদগুণের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। তাঁর মন ছিল গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তা ছিল করুণায় ভরপুর ও স্নেহরাশিতে আপ্লুত। দৈহিক, আধ্যাত্মিক ও মানসিক সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন পূর্ণত্বের অধিকারী।আলী (আ.) রাতে যখন তিনি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতেন তখন আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকত না। আবার দিনে ছিলেন জনগণের মাঝে কর্মমূখর। দিনের বেলায় জনগণ তাঁর দয়া ও সততায় মুগ্ধ হতেন আর তাঁর উপদেশ, পরামর্শ ও জ্ঞানপূর্ণ কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। অন্যদিকে রাতে আকাশের তারকারাজি দেখত হযরত আলী (আ.) কিভাবে আল্লাহর ইবাদতে অশ্রু বিসর্জন করছেন আর আকাশ তাঁর প্রেমপূর্ণ মুনাজাত শুনত।
হযরত আলী (আ.)’র চরিত্রে আমরা দেখতে পাই দার্শনিক, বিপ্লবী নেতা, একজন সুফী শায়খ এবং নবী-রাসূলদের অনেক বৈশিষ্ট্য। হযরত আলী (আ.)’র দর্শন হচ্ছে জ্ঞান ও চিন্তার দর্শন, বিপ্লবের দর্শন, আত্মসমর্পণ ও শৃঙ্খলার দর্শন এবং মহত্ত্ব, সৌন্দর্য, পরমানন্দ ও গতিময়তার দর্শন।
হযরত আলী (আ.) একাধারে একজন জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, রহস্যবাদী ব্যক্তি, সমাজের নেতা, আত্মসত্তা বিসর্জনকারী ব্যক্তি, মুজাহিদ, বিচারক, শ্রমিক, একজন বাগ্মী ও লেখক। তাঁর সব আকর্ষণীয় গুণ নিয়ে তিনি ছিলেন পূর্ণতার সব অর্থেই একজন পূর্ণাঙ্গ মানব।
আসলে মানুষের মনে উত্তেজনা ও প্রভাব সৃষ্টিতে আমিরুল মু’ মিনিন আলী (আ.)’র সুবিশাল ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব ইতিহাসে দখল করে আছে অনন্য ও শীর্ষস্থানীয় এক বিশেষ অবস্থান। বিশ্বনবী (সা.)’র পর এ ব্যাপারে তিনি সত্যিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুতাহহারি (র.) লিখেছেন:
‘আমিরুল মু’ মিনিন হযরত আলী (আ.)’র মহত ও সুন্দর ব্যক্তিত্ব এত বিশাল বিস্তৃত ও এত বিচিত্রময় যে একজন মানুষের পক্ষে তাঁর সব বৈশিষ্ট্য ও পরিধি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাও সম্ভব নয়। মানুষ কল্পনার ফানুস উড়াতে পারবে কিন্তু এর কিনারার নাগালও পাবে না।’
ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট সুফী সাধক ও চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা খাজা মুইনউদ্দিন চিশতি (র.) বলেছেন, সমুদ্রকে যেমন ঘটিতে ধারণ করা অসম্ভব তেমনি বর্ণনার মাধ্যমে আলী (আ.)’র গুণাবলী তুলে ধরাও অসম্ভব।
ওমর ইবনে খাত্তাব আলী (আ.)’র পরামর্শ ও জ্ঞানগত সহযোগিতার কাছে নিজের ঋণ স্বীকার করে বলেছেন, “আলী ইবনে আবি তালিবের মত আরেকজনকে গর্ভে ধারণ ও প্রসব করার ক্ষমতা নারীকূলের কারো নেই। আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত।”
বিশ্বনবী (সা.)’র একটি হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আলী(আ.)-কে পুরোপুরি বা পরিপূর্ণভাবে চেনেন কেবল আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.) এবং আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.)-কে ভালভাবে চেনেন কেবল আলী (আ.)। মহানবী (সা.) একবার বলেছিলেন, আমি যদি আলীর প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরি তাহলে লোকেরা আলীকে সম্মান দেখাতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করবে।
রাসূল (সা.) বলতেন, আলীর দিকে তাকানোও ইবাদত। আল্লাহ আমাকে ও আলীকে সৃষ্টি করেছেন একই নূর হতে।
আলী (আ.) জিহাদ থেকে ফিরে আসলে মহানবী (সা.) তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যেতেন এবং তাঁর মুখের ঘাম মুছে দিতেন নিজ হাতে। তাঁকে জিহাদ বা সফরের সময় বিদায় দিতে গিয়ে তাঁর বিজয়ের জন্য দোয়া করতেন এবং বলতেন: হে আল্লাহ, আলীর সঙ্গে এটাই যেন আমার শেষ দেখা না হয় কিংবা বলেছেন: হে আল্লাহ, আমার মৃত্যুর আগে আলীকে যেন আরো একবার দেখতে পারি ।
আলী (আ.) বলেছেন, উট-শাবক যেমন মায়ের পিছে পিছে থেকে সব সময় মাকে অনুসরণ করে আমিও শৈশব থেকেই রাসূল (সা.)-কে সেভাবে অনুসরণ করতাম। রাসূল শৈশবে আমাকে কোলে নিতেন, খাইয়ে দিতেন, ঘুম পাড়িয়ে দিতেন ও বুকে চেপে ধরতেন। রাসূলের (সা.) কাছে ওহি নাজিল হওয়ার সময় আমিও দেখতে পেতাম ফেরেশতাদের। মহানবী (সা.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন আলী (আ.)’র কোলে মাথা রেখেই এবং তাকে গোসলও দেন তিনি।
হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, আলীর চারটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য ছিল যা অন্য কারো ছিল না। আরব ও অনারবের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসূলের সাথে নামাজ আদায় করেছেন। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক জিহাদেই তাঁর হাতে ঝান্ডা থাকতো। তৃতীয়তঃ লোকেরা যখন রাসূলের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেত তখনও আলী তাঁর পাশেই থাকতো। চতুর্থতঃ আলীই রাসূল (সাঃ)কে শেষ গোসল দিয়েছিলেন এবং তাঁকে কবরে শায়িত করেছিলেন।
আলী (আ.)’র শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণী করেন বিশ্বনবী (সা.) ও আলীর শোকে রাসূলের আগাম কান্না
শাবান মাসের শেষ শুক্রবারে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্বনবী (সা.) ভাষণের শেষ পর্যায়ে কাঁদতে থাকেন। তা দেখে হযরত আলী (আ.) এর কারণ জানতে চান। জবাবে মহানবী বহু বছর পর রমজান মাসে আলী (আ.)’র মর্মান্তিক শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন,”হে আলী, এই মাসে তোমার ওপর যা নেমে আসবে সে জন্য আমি কাঁদছি। (আমি নিজেকে কল্পনা করছি) তোমার স্থানে যখন তুমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছ এবং সামুদ জাতির কাছে পাঠানো (খোদায়ী) উটের পা কর্তনকারী লোকটির মতই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটি তোমার মাথার ওপর আঘাত হানবে এবং তোমার দাড়ি তাতে (রক্তে) রঞ্জিত হবে।”
নিজের শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শুনে সব কিছুর আগে হযরত আলী (আ.)’র মনে যে চিন্তাটির উদয় হয়েছিল তা এই বস্তু-জগত সম্পর্কিত ছিল না, বরং তা ছিল নিজের ঈমান সম্পর্কিত। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন: ” হে আল্লাহর রাসূল,সে সময় আমি কী ঈমানের ওপর অবিচল থাকব? “রাসূল (সা.) বললেন: ” হ্যাঁ,সে সময় তোমার ঈমান নিরাপদ থাকবে।”
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলতে লাগলেন,
“হে আলী, যে তোমাকে হত্যা করে সে (বাস্তবে) আমাকে হত্যা করল, যে তোমাকে বিরক্ত করে সে আমাকে বিরক্ত করল এবং যে তোমার অবমাননা করল সে আমার অবমাননা করল, কারণ তুমি আমার আত্মা বা প্রাণের সমতুল্য। তোমার ও আমার মানসিকতা এবং স্বভাব অভিন্ন। নিঃসন্দেহে প্রশংসিত ও গৌরবান্বিত আল্লাহ প্রথমে আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং এরপর সৃষ্টি করেছেন তোমাকে,তিনি প্রথমে বেছে নিয়েছেন আমাকে এবং এরপর বেছে নিয়েছেন তোমাকে। আল্লাহ আমাকে নবুওতের জন্য মনোনীত করেছেন,আর তোমাকে মনোনীত করেছেন ইমামতের জন্য। আর যে তোমার ইমামতকে অস্বীকার করবে সে (কার্যত) আমার নবুওতকে প্রত্যাখ্যান করল। হে আলী,তুমি আমার উত্তরাধিকারী,আমার সন্তানদের তথা নাতী-নাতনীর পিতা এবং আমার কন্যার স্বামী আর আমার উম্মতের জন্য আমার জীবদ্দশায় ও আমার মৃত্যুর পর আমার প্রতিনিধি বা খলিফা। তোমার নির্দেশ হল আমারই নির্দেশ,তোমার নিষেধাজ্ঞা হল আমারই নিষেধাজ্ঞা। সেই শক্তির শপথ করে বলছি যেই শক্তি আমাকে নবুওত দান করেছেন এবং আমাকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে তৈরি করেছেন,তুমি হচ্ছ সৃষ্টিকুলের জন্য হুজ্জাতুল্লাহ বা আল্লাহর নিদর্শন এবং তাঁর রহস্যগুলোর আমানতদার বা ট্রাস্টি ও সৃষ্টিকুলের ওপর আল্লাহর খলিফা।”
মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ যে তিনি মানবজাতিকে উপহার দিয়েছিলেন আলী (আ.)’র মত মহান ব্যক্তি।
এবারে হযরত আলী (আ.)’র প্রবাদতুল্য কয়েকটি বাণী তুলে ধরছিঃ
*বাহ্যিক অলংকার ও পোশাক-পরিচ্ছদ সৌন্দর্য নয়, সৌন্দর্য হল-জ্ঞান ও সভ্যতা। যার পিতা-মাতা মারা গেছে সে এতীম নয়, প্রকৃত এতীম সে যার মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক নেই।
*সত্যকে আঁকড়ে ধর, যদি তাতে তোমার ক্ষতিও হয় এবং মিথ্যাকে বর্জন কর যদি মিথ্যা দিয়ে তোমার লাভও হয়। আর এটাই হল ঈমান।