মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলসমূহ

মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলসমূহ

মুহাম্মাদ মুহাম্মাদ রেজায়ী

অনুবাদ : মো. রফিকুল ইসলাম

সারসংক্ষেপ

এ প্রবন্ধে আমরা মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলসমূহ পর্যালোচনার চেষ্টা করব। যে সকল দলিল এখানে পর্যালোচনা করা হবে সেগুলো হল :

১. ফিতরাত বা সহজাত প্রবণতার দলিল।

২. যৌক্তিকতার দলিল।

৩. ন্যায়বিচারের দলিল।

৪. প্রজ্ঞা বা হিকমতের দলিল।

৫. আত্মার অবস্তুগত হওয়ার দলিল।

৬. আখলাকী বা নৈতিকতার দলিল।

সার্বিকভাবে এই দলিলসমূহকে দুই ভাগে বিভক্ত করা সম্ভব :

১. সে সকল দলিল যেগুলোতে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন প্রমাণের জন্য আল্লাহ্‌ এবং তাঁর সিফাত বা গুণাবলীর সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন : ফিতরাত, ন্যায়বিচার ও হিকমাতের দলিলের বর্ণনা।

২. সে সকল দলিল যেগুলোতে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন প্রমাণের জন্য আল্লাহ্‌ এবং তাঁর সিফাতের সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়নি; সিফাতের সহযোগিতা ছাড়া সরাসরি এ বিষয়টি প্রমাণ করা হয়েছে। যেমন : যুক্তিসঙ্গত, অবস্তুগত আত্মা ও আখলাকী দলিলের বর্ণনা।

ফিতরাতের দলিলে মানুষের চিরন্তন বেঁচে থাকার কামনার যুক্তিতে, ন্যায়বিচারের দলিলে আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচারক হওয়ার গুণের ভিত্তিতে এবং হিকমত বা প্রজ্ঞার দলিলে আল্লাহ্‌র প্রজ্ঞাবান হওয়ার যুক্তির মাধ্যমে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে প্রমাণ করা হয়েছে। যুক্তিসঙ্গত হওয়ার দলিলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি নির্দেশ করে যে, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রতি অবিশ্বাস থেকে এর প্রতি বিশ্বাস অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আখলাকী বা নীতিভিত্তিক দলিলে নৈতিকতার দৃষ্টিতে এবং অবস্তুগত আত্মার দলিলে আত্মার অবিনশ্বর হওয়ার বৈশিষ্ট্য থেকে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণ করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে এ সকল দলিল বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

মূল পরিভাষাসমূহ

বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল, মৃত্যু, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, আখেরাত, আত্মা, শরীর, ঐশী হিকমত, আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচার, ফিতরাত, আখলাকী দলিল।

ফিতরাতের দলিল

বিশেষ ধরনের সৃষ্টিকে ফিতরাত বলা হয়। কোন বিষয়ের ফিতরাত ঐ বিষয়ের সৃষ্টির মধ্যেই বিদ্যমান এবং ঐ বিষয়ের সাথে ফিতরাতের সত্তাগত সম্পর্ক রয়েছে। মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, তার চিরন্তন বেঁচে থাকার আগ্রহ রয়েছে এবং সে ধ্বংস ও বিলীন হওয়ার বিষয়ে অসন্তুষ্ট। অন্যদিকে দুনিয়ার জীবন চিরন্তন হওয়ার যোগ্য নয়। এ কারণেই মৃত্যুর পরবর্তী চিরন্তন জীবন অত্যাবশ্যক। কোন বৈশিষ্ট্য ফিতরাতগত হওয়ার তিনটি চিহ্ন রয়েছে :

১. একই শ্রেণির সৃষ্টির সবার মধ্যে একই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে। যদিও গুণগত দিক থেকে তীব্রতা ও ক্ষীণতার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে।

২. এ বৈশিষ্ট্য চিরকাল বিদ্যমান থাকবে। যেভাবে কুরআন বর্ণনা করে : ‘আল্লাহ্‌র সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই।’ (সূরা রূম : ৩০)

৩. এ বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য শিক্ষা-প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। যদিও এর শক্তিশালীকরণ, স্মরণ এবং দিক নির্দেশনার জন্য শিক্ষা-প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে, যেভাবে কুরআন বর্ণনা করে : ‘অতএব তুমি উপদেশ (স্মরণ করিয়ে) দাও; তুমি তো একজন উপদেশদাতা (স্মারক)।’ (সূরা গাশিয়া: ২১)

মৃত্যু-পরবর্তী জীবন অর্থাৎ কিয়ামত দিবস প্রমাণের জন্য ফিতরাতের দলিলটির বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথমে সেগুলোকে বর্ণনা করে অতঃপর বিশ্লেষণ করব। সাদরুল মুতা‘আল্লেহীন ‘আসফার’ গ্রন্থে এ দলিলটি এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘মানুষের সত্তাসমূহের চিরন্তন বেঁচে থাকার কামনা এবং চিরন্তন হওয়ার প্রতি ভালবাসা তাদের চিরন্তন পারলৌকিক জীবনের দলিল। কারণ, এই প্রাকৃতিক জগতে অর্থাৎ পৃথিবীতে চিরন্তন জীবন সম্ভব নয়। যদি সত্তার চিরন্তন পারলৌকিক জীবন না থাকে যেখানে সে স্থানান্তরিত হবে তাহলে তার সত্তার মধ্যে আমানত হিসেবে চিরদিন বেঁচে থাকার যে কামনা স্থাপন করা হয়েছে তা অনর্থক ও অন্তঃসারশূন্য হবে। কিন্তু ঐশী দার্শনিকরা বর্ণনা করেছেন, প্রকৃতিতে কোন অনর্থক ও বৃথা কিছুর অস্তিত্ব নেই।’ (সাদরুল মুতা‘আল্লেহীন, সংখ্যা ১৩৮৩, পৃ. ২৫৩)

ফাইজ কাশানী মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের ফিতরাতের দলিলকে এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘কিভাবে মানুষের সত্তাসমূহ ধ্বংস হবে যখন আল্লাহ্‌র হিকমত অনুসারে মানুষের প্রকৃতিতে অস্তিত্বমানতা ও চিরন্তনভাবে বেঁচে থাকার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার জীবনের ফিতরাতে (সহজাত প্রকৃতিতে) ধ্বংস ও অনস্তিত্বের প্রতি ঘৃণা ও বিরক্তি স্থাপন করা হয়েছে? একদিকে অস্তিত্ব নির্ভেজাল কল্যাণ ও পূর্ণ আলো। অপরদিকে পৃথিবীতে চিরন্তন জীবন অসম্ভব (‘যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাকে খুঁজে বের করবেই’Ñ সূরা নিসা : ৭৮)। যদি অন্য কোন জগৎ না থাকে যেখানে মানুষ স্থানান্তরিত হবে তাহলে আল্লাহ্‌ যে মানুষের মধ্যে নিজ অস্তিত্বের বিদ্যমানতা ও অব্যাহত থাকার প্রতি ভালবাসা ও বেঁচে থাকার ইচ্ছা ও কামনা দিয়েছেন তা অনর্থক এবং অন্তঃসারশূন্য হবে। কিন্তু আল্লাহ্‌ অনর্থক কাজ থেকে ঊর্ধ্বে।’ (ফাইজ কাশানী, ১৪১৮ হিজরি, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৩৭)

ইমাম খোমেইনী (র.) কিয়ামত দিবসকে প্রমাণের জন্য ফিতরাতের দলিলকে এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘মানবজাতি যে ঐশী ফিতরাতের (প্রকৃতির) ওপর সৃষ্টি হয়েছে তা হল আরাম, শান্তি ও স্বস্তির প্রতি ভালবাসার প্রকৃতি। যেহেতু এ জগতে নিরঙ্কুশ, সীমাহীন ও অবিমিশ্র আরাম, শান্তি ও স্বস্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়… অতএব অবশ্যই বাস্তব ও অস্তিত্বের জগতে এমন এক জগৎ থাকতে হবে যেখানে আরাম, শান্তি ও স্বস্তির সাথে দুঃখ ও বেদনা থাকবে না। ঐ জগৎ আল্লাহ্‌র নেয়ামত ও কারামতের জগৎ।’ (ইমাম খোমেইনী : ১৩৭৮ ফারসি শতাব্দী, পৃ. ১৮৬)

এ দলিল এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, মানুষকে মৃত্যু-পরবর্তীকালে জীবিত থাকতে হবে যে জগতে সে নিরঙ্কুশ ও অবিমিশ্র আরাম, শান্তি ও স্বস্তি খুঁজে পাবে।

পর্যালোচনা

ফিতরাতের দলিল ঐশী হিকমতের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত। যদি এ দলিলে ঐশী হিকমতের সাহায্য গ্রহণ করি তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, এ দলিলে মানুষের চিরন্তন জীবন প্রমাণের জন্য প্রথমে আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব প্রমাণের প্রয়োজন এবং ঐশী হিকমত অর্থাৎ ‘আল্লাহ্‌ কখনই অনর্থক কাজ করেন না’- এর সাহায্যে এ দলিল প্রমাণ করা হয়। যেহেতু চিরন্তন জীবনের প্রতি আকর্ষণ মানুষের ফিতরাতের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে, সেহেতু বাস্তব জগতে অবশ্যই চিরন্তন জীবন থাকতে হবে। তা না হলে ঐশী হিকমতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। ফাইজ কাশানী এবং সাদরুদ্দীন মুতা‘আল্লেহীনের বক্তব্যে প্রমাণ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ঐশী হিকমতের সাহায্য গ্রহণের বিষয়টি স্পষ্টরূপে লক্ষ্য করা যায়। কেননা, সাদরুল মুতা‘আল্লেহীন মোল্লা সাদরা বলেন : ‘মুসলিম খোদামুখী দার্শনিকরা এ বিশ্বাসে বদ্ধপরিকর যে, প্রকৃতিতে কোন বাতিল বিষয়ের প্রবেশাধিকার নেই; কারণ, তা ঐশী হিকমতের পরিপন্থী।’

ইমাম খোমেইনীর বর্ণনায় এ দলিলে ঐশী হিকমতের ওপর নির্ভরশীলতার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। কিন্তু তাঁর বর্ণনায় যে কথাটি এসেছে- ঐশী ফিতরাতগুলোর মধ্যে একটি ফিতরাত যা দিয়ে সকল মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে- তা এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্‌ই এ ধরনের ফিতরাত সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহ্‌র কাজ হিকমত সহকারে হয়ে থাকে। যেহেতু মানব সত্তার মধ্যে চিরন্তন আরাম, শান্তি ও স্বস্তির প্রতি আকাঙ্ক্ষা দান করা হয়েছে, সেহেতু এ আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের ক্ষেত্র বহির্জগতে অবশ্যই থাকতে হবে।

মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের ক্ষেত্রে ফিতরাতের দলিলের অন্য একটি ব্যাখ্যা রয়েছে যেখানে ঐশী হিকমতের সাথে বিষয়টি সম্পৃক্ত না করেও প্রমাণ করা সম্ভব। যদি ফিতরাতের দলিলে বিপরীত সমাপতন (coincidence of opposite) এর দলিল ব্যবহার করি অর্থাৎ এক পার্শ্ব প্রমাণের মাধ্যমে অপর পার্শ্ব প্রমাণ করি তাহলে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন প্রমাণ করা সম্ভব। কেননা, দু’টি বিপরীত সমাপতন বিষয়ের মধ্যে আবশ্যিক সহানুমান (syllogism) সম্পর্ক বিদ্যমান। দু’টি বিপরীত সমাপতন বিষয় সম্ভাব্য রূপের হোক (possible form) বা সুপ্ত রূপের (potential state) অথবা বাস্তব রূপের (real state), তার যে কোন একটির অস্তিত্ব লাভের মাধ্যমে অপরটি আবশ্যিকভাবে অস্তিত্ব লাভ করে। যেমন, উঁচু-নিচু, পিতা-সন্তান, প্রেমিক-প্রেমিকা সম্পর্ক ইত্যাদি। যেহেতু উঁচু-নিচু বিপরীত সমাপতন বিষয়, তাই উঁচু প্রমাণ করলে নিচু প্রমাণিত হয়। তেমনিভাবে যেহেতু চিরন্তন আরাম, শান্তি ও স্বস্তির ঐশী ফিতরাত মানুষের সত্তার মধ্যে নিহিত রয়েছে, তাই এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রও বহির্জগতে বিদ্যমান থাকতে হবে।

পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তাবিদরাও এ ক্ষেত্রে বিপরীত সমাপতনের দলিল থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, চিন্তাবিদ এডওয়ার্ডজ বলেন : ‘আমাদের সকল কাল্পনিক এবং শারীরিক ইন্দ্রিয় অনুভূতিগুলোর নিজ নিজ বাস্তবক্ষেত্র রয়েছে। এ সকল ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব থাকার কারণে এদের বাস্তবক্ষেত্রের অস্তিত্বও অপরিহার্য। চোখের বর্তমান গঠন এ বিষয়টি অপরিহার্য করে যে, আলো থাকতে হবে যেন সে দেখতে পায়। ধ্বনি ও শব্দের অস্তিত্ব ছাড়া কান থাকার বিষয়টি অনুভব বা বর্ণনা করা যায় না। এভাবে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতির আকাঙ্ক্ষা অপরিহার্য করে যে, আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব থাকতে হবে।’ (এডওয়ার্ডজ, ১৩৭১ সংখ্যা, পৃ. ১১৩)

এডওয়ার্ডজ ফিতরাতের দলিল অর্থাৎ আল্লাহ্‌র প্রতি আকাঙ্ক্ষা থেকে আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। এভাবে মানুষের চিরন্তন বেঁচে থাকার প্রবণতা থেকে এর বাস্তব ক্ষেত্র অর্থাৎ চিরন্তন জীবন প্রমাণ করা যায়।

এ কারণে ফিতরাতি দলিলের এ বর্ণনায় ঐশী হিকমত বিষয়টি ব্যবহৃত হয়নি।

যৌক্তিকতার দলিল 

মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের জন্য আরেকটি দলিল থেকে সাহায্য নেওয়া সম্ভব, আর তা হল যৌক্তিকতার দলিল। এ দলিলকে ‘সম্ভাব্য ক্ষতি প্রতিরোধ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। পশ্চিমা বিশ্বে ব্লেইজ প্যাসকেলের মতো অনেক দার্শনিক এ দলিলকে ‘বাজি ধরা’ দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদি মানুষ মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, কিয়ামত দিবস এবং এর প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর বিশ্বাসের সাথে এর প্রতি অবিশ্বাসের তুলনা করে তাহলে বুদ্ধিবৃত্তি মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, কিয়ামত দিবসের বিশ্বাসকে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মনে করে। কারণ, যদি এ ধরনের বিশ্বাস বাস্তব রূপ লাভ করে তাহলে আমরা চিরন্তন দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা পাব। আর যদি এ বিশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলেও কোন ক্ষতির সম্মুখীন হব না। এ কারণে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, কিয়ামত দিবসের বিশ্বাস অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।

মাসুম ইমামদের মধ্যে মুমিনদের নেতা ইমাম আলী (আ.) এবং ইমাম রেজা (আ.) এর হাদীসে আমরা এ ধরনের দলিলের সন্ধান পাই। আলী (আ.) বলেন : ‘জ্যোতির্বিদ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা (সকল জ্যোতির্বিদ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী নয়) ধারণা করে যে, কিয়ামত দিবসের অস্তিত্ব নেই। তাদের উদ্দেশে বলি : যদি তোমাদের বিশ্বাস সঠিক হয়, তবে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। আর যদি আমার বিশ্বাস সঠিক হয় তাহলে তোমরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’ (মাজলিসী, ১৪০৩ হিজরি, ৭৮তম খণ্ড, পৃ. ৮৭)

ইমাম রেযা (আ.) এক রেওয়ায়েতে এ বিষয়টির প্রতি নির্দেশ করেছেন। একজন নাস্তিক কোন একটি অনুষ্ঠানে প্রবেশ করে যেখানে ইমাম রেযা (আ.) উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেই নাস্তিকের উদ্দেশে বলেন : ‘যদি তোমার বিশ্বাস সঠিক হয়-অবশ্য বাস্তবে বিষয়টি সত্য নয়-তাহলে আমাদের ক্ষতি হবে না।’ ঐ ব্যক্তি চুপ হয়ে গেল। অতঃপর তিনি বললেন : ‘আর যদি আমাদের বিশ্বাস সত্য হয় যা আসলেই সত্য, তাহলে এ রকম নয় কি যে, তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে, আর আমরা চির সৌভাগ্য অর্জন করব?’ (কুলাইনী, ১৩৮৮ হিজরি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৮)

এ দু’জন পবিত্র ইমামের বর্ণনা অনুসারে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, মৃত্যর পরবর্তী জীবনের প্রতি বিশ্বাস রাখা, এর প্রতি অবিশ্বাস থেকে অধিকতর যুক্তিযুক্ত। ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ বিশ্লেষণ করে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, বুদ্ধিবৃত্তি এ সকল আদেশ-নিষেধের ভাল-মন্দ অনেকটাই নির্ধারণ করতে পারে। যেমন : পিতা-মাতার প্রতি ইহসান করা, নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা না করা, দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা না করা, খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা, সদা সত্য কথা বলা, অন্যদের অপবাদ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি।

দার্শনিক ব্লেইজ প্যাসকেল এ দলিল সম্পর্কে বলেন : ‘মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বাজিতে জিতে গেলে তো সব জিতে গেলে; আর যদি হেরে যাও তাহলে তোমার হাতে আর কিছুই রইল না।’ (ক্যাপিলাস্তন, ১৩৮০, পৃ. ২১৫)

এ কারণে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের বিশ্বাস এবং এর প্রতি অবিশ্বাসের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তি আমাদের এ নির্দেশ করে যে, এর প্রতি বিশ্বাস অধিকতর যুক্তিযুক্ত। যদিও এ দলিলটি অন্য জগতে জীবন অব্যাহত থাকার সাথে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু অপরিহার্য সম্পর্কের কারণে এটি প্রমাণ করে যে, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন অব্যাহত রয়েছে।

ন্যায়বিচারের দলিল

মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের আরেকটি বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল হল ন্যায়বিচারের দলিল। আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচার অনুসারে প্রমাণ হয় যে, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন অব্যাহত রয়েছে।

বিস্তারিত  ব্যাখ্যা

ন্যায়বিচার আল্লাহ্‌র সিফাত বা বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ্‌র সৃষ্টি ব্যবস্থা ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইমাম আলী (আ.) ন্যায়বিচারের সংজ্ঞায় বলেছেন : ‘প্রত্যেক বিষয় বা বস্তুকে তার স্বস্থানে স্থান দেয়াই হচ্ছে ন্যায়বিচার।’ (নাহজুল বালাগা, হিকমত : ৪৩৭)

ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা অনুযায়ী সৃষ্টি এবং শরীয়তের জগতে সকল ব্যক্তি ও বস্তুকে যোগ্যতা অনুসারে আল্লাহ্‌ এমনভাবে স্থাপন করেছেন যেন কারও কোন অধিকার এবং অবস্থান নষ্ট না হয়।

আল্লাহ্‌ তা‘আলা ন্যায়বিচারক। কখনই কোন অন্যায় কাজ করেন না। যে কর্মসম্পাদনকারী অন্যায় কাজ করে সে কতগুলো অবস্থার কারণে তা করে থাকে। হয় সে এর নিকৃষ্টতা সম্পর্কে জ্ঞাত নয় অথবা সে নিজের অভাব ও ঘাটতি পূরণের জন্য এ ঘৃণিত কর্মের ওপর নির্ভরশীল অথবা মন্দ বৈশিষ্ট্য, যেমন হিংসা, বিদ্বেষ ও নিজেকে অন্যের কাছে ছোট মনে করার কারণে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ্‌ তা‘আলা নিরঙ্কুশভাবে পূর্ণ এবং অসীম জ্ঞানের অধিকারী এবং সকল প্রকার অপছন্দনীয় বৈশিষ্ট্য ও অপূর্ণতা থেকে মুক্ত। এ কারণে আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রে এ ধরনের অপছন্দনীয় বৈশিষ্ট্যের কোন স্থান নেই। তিনি কখনই অন্যায় ও অপছন্দনীয় কাজ করেন না।

আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচার এত বিস্তৃত যে, সকল ক্ষেত্রেই তা প্রজ্ঞার সাথে বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ্‌র ন্যায়বিচারের বিভিন্ন দিক হল :

অস্তিত্বের পর্যায়ে বা সৃষ্টি সংক্রান্ত বিষয়ে ন্যায়বিচার 

আল্লাহ্‌ তা‘আলা সৃষ্টি জগতের সকল সৃষ্টিকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী নেয়ামত দান করেছেন। এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, ‘বিশ্বজগৎ ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ (মিজানুল হিকমা, রেইশাহরী, ১৪২২ হিজরি, হাদীস নং ৪০০৮)

বিধানগত পর্যায়ে বা শরীয়ত সংক্রান্ত বিষয়ে ন্যায়বিচার

আল্লাহ্‌ তা‘আলা শরীয়ত অর্থাৎ আইন নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ধারণ-ক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রেখে নিয়ম-নীতি অর্থাৎ শরীয়ত প্রণয়ন করেছেন। ‘আমরা কাউকে তার সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি দায়িত্ব দেই না।’ (সূরা মুমিনূন: ৬২)

বিচার সংক্রান্ত ন্যায়বিচার

আল্লাহ্‌ তা‘আলা কিয়ামত দিবসে মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার করবেন। এ রকম নয় যে, অন্যায়কারী ও মুমিন ব্যক্তির বিচার এক রকম হবে। ‘আমরা কিয়ামত দিবসে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব।’ (সূরা আম্বিয়া: ৪৭)

কিন্তু এ দুনিয়াতে ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের পরম ক্ষেত্র নেই। কেননা, অনেক পূর্ণ মানব দুনিয়াতে তাদের সৎ কর্মের পুরস্কার পায় না এবং অনেক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ তাদের অসৎ কর্মের শাস্তি পায় না। অন্যদিকে যেহেতু আল্লাহ্‌ তা‘আলা ন্যায়বিচারক এবং কারও অধিকারের ক্ষেত্রে অন্যায় করেন না, তাঁর দৃষ্টিতে সৎ কর্মশীল ও অত্যাচারী সমান নয়। ফলে দুনিয়া-পরবর্তী আরেকটি জগৎ থাকতে হবে যেখানে মানুষকে তার কর্ম অনুযায়ী পুরস্কৃত করা অথবা শাস্তি দেয়া হবে।

এ কারণে এ দলিল থেকে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মানুষের মৃত্যুর পরের জীবন থাকতে হবে যে জগতে সে ন্যায়বিচারের বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করবে।

প্রজ্ঞা ও হিকমতের দলিল

মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের আরেকটি দলিল হচ্ছে হিকমতের দলিল। এটি আল্লাহ্‌র প্রজ্ঞাময় হওয়ার সিফাত বা গুণ এবং তাঁর সকল কর্ম প্রজ্ঞার ভিত্তিতে হওয়া থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে।

বিস্তারিত ব্যাখ্যা

আল্লাহ্‌র অন্যতম সিফাত হচ্ছে হাকীম বা প্রজ্ঞাময় হওয়া। হিকমত দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়।

১. হিকমত বলতে কর্মসম্পাদনকারীর কর্মসমূহ সর্বোচ্চ দৃঢ়তা ও পূর্ণতার সাথে সম্পাদিত হওয়াকে বুঝায় এবং তার কর্মে কোন ধরনের ত্রুটির পথ খোলা থাকে না। আল্লাহ্‌ তা‘আলা এ অর্থে হাকীম। তাঁর সকল কর্ম সবচেয়ে উত্তম ও পূর্ণভাবে সম্পাদিত হয় এবং তিনি সকল ধরনের অপূর্ণতা থেকে মুক্ত।

এ ধরনের অর্থের কারণ হল, প্রভাব-গ্রহণকারীর সাথে প্রভাব-দানকারীর উপযুক্ত সম্পর্ক। প্রত্যেক প্রভাব-দানকারীর সাথে এর প্রভাব-গ্রহণকারীর উপযুক্ত সম্পর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ্‌ তা‘আলা, যিনি সর্বজনীন ও নিরঙ্কুশ পূর্ণতার অধিকারী এবং সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত, অবশ্যই তাঁর প্রভাব সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উত্তমরূপে হতে হবে এবং তাঁকে সর্বাধিক দৃঢ়তা ও পূর্ণতার অধিকারী হতে হবে। এর অর্থ বিশ্বজগৎ এবং এর মধ্যে অস্তিত্ববান সকল বস্তু উত্তম বিন্যাসের অধিকারী হবে।

২. হাকীম ব্যক্তির কর্ম দুর্বল ও ত্রুটিযুক্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। কোন কর্ম ত্রুটিযুক্ত হওয়া সাধারণত কর্তার জ্ঞান ও সামর্থ্যরে অভাব অথবা কর্তার অকল্যাণকামী ও কৃপণ হওয়ার বৈশিষ্ট্য অথবা ঐ কর্মের প্রতি তার অমনোযোগ বা অনীহা থেকে উৎসারিত। উল্লিখিত কারণগুলোর কোনটিই আল্লাহ্‌ তা‘আলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ, আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমান এবং নিরঙ্কুশভাবে কল্যাণদাতা। সুতরাং আল্লাহ্‌র কর্মের ক্ষেত্রে কোন দুর্বলতা ও ত্রুটি থাকার অর্থ হয় না। ফলে তিনি হাকীম।

হিকমতের আরেকটি অর্থ হল হাকীম ব্যক্তির কর্ম অনর্থক হবে না। এ অর্থ অনুযায়ী যখন বলব, ‘আল্লাহ্‌ তা‘আলা হাকীম’, এর অর্থ হল তিনি মন্দ ও অনর্থক কর্ম করেন না। মন্দ ও অনর্থক কর্মের সৃষ্টি হয় কোন সত্তার জ্ঞান, শক্তি ও অভাবের কারণে। কিন্তু আল্লাহ্‌ এ সকল অপূর্ণতা ও ত্রুটি থেকে মুক্ত। তিনি কখনই এ ধরনের মন্দ ও অনর্থক কর্ম করতে পারেন না।

আল্লাহ্‌ তা‘আলা এ অর্থেও হাকীম যে, কখনই এ ধরনের মন্দ ও অনর্থক কর্ম করেন না। মানুষের মধ্যে চিরন্তন বেঁচে থাকার কামনা রয়েছে। যদি আল্লাহ্‌ মানুষের এই চিরন্তন বেঁচে থাকার কামনা দিয়ে সৃষ্টি করে থাকেন, কিন্তু এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্র সৃষ্টি না করেন তাহলে তাঁর সৃষ্টি অনর্থক হবে। যেহেতু আল্লাহ্‌ হাকীম এবং অনর্থক কাজ করেন না, তাই তিনি এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্র অবশ্যই সৃষ্টি করেছেন। অতএব, মানুষ চিরন্তন জীবনের অধিকারী এবং মৃত্যুর পরেও তার জীবন অব্যাহত থাকবে। নিম্নলিখিত আয়াতসমূহ এ দলিলের প্রতি ইঙ্গিত করে :

১. ‘তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমরা তোমাদের অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করানো হবে না?’ (সূরা মুমিনূন: ১১৫)

২. ‘মানুষ কি মনে করে তাকে অনর্থক ছেড়ে দেয়া হবে?’ (সূরা কিয়ামাহ: ৩৬)

নীতিভিত্তিক বা আখলাকী দলিল

মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের আরেকটি দলিল হল নৈতিক বা আখলাকী দলিল। এ দলিলটি নীতিগত কয়েকটি প্রতিজ্ঞা (premise) দিয়ে শুরু হয়। এ দলিলটি এর ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, কাঙ্ক্ষিত নৈতিক পূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য অথবা নৈতিক নির্দেশ পালনের জন্য মানুষের ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন যার মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব যে, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন অব্যাহত থাকবে অর্থাৎ মানুষ চিরজীবী হবে। পশ্চিমা বিশ্বের দার্শনিকদের অন্যতম বড় দার্শনিক হলেন ইমানুয়েল কান্ট (১৮০৪-১৮২৪ খ্রি.) যিনি নৈতিক দৃষ্টিতে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণ করেছেন। তবে ইসলামী দর্শনে ফিতরাতী দলিলের একটি ব্যাখ্যার সাথে নৈতিক দলিলের অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু তা নৈতিক দলিল থেকে অধিক শক্তিশালী।

বিস্তারিত ব্যাখ্যা

কান্ট বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহারকে দুই প্রভাববলয়ে বা ক্ষেত্রে কার্যকরী মনে করেন। এর একটি হল তত্ত্বীয় (Theoretical), অপরটি হল ব্যবহারিক (Practical)। তিনি মনে করেন, তত্ত্বীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মানুষের আত্মার (সত্তার) চিরন্তনতা, অখণ্ডতা ইত্যাদি বিষয় প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কেননা, তত্ত্বীয় বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার কেবল দৃশ্যমান বস্তু বা বিষয়, স্থান এবং কালের সাথে সম্পৃক্ত অর্থাৎ তত্ত্বীয় বুদ্ধিবৃত্তির বিভিন্ন রূপ রয়েছে; ঐ রূপগুলোর সঠিক ও কার্যকর প্রয়োগ কেবল ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভবযোগ্য বিষয়ের ক্ষেত্রেই সম্ভব। যেহেতু আত্মাকে নিরীক্ষণ পদ্ধতি অর্থাৎ ইন্দ্রিয় এবং অভিজ্ঞতালব্ধ উপাত্ত দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, ফলে এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের তত্ত্বীয় সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। কান্ট আরও প্রমাণ করেন যে, আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করার সকল দলিল অপযুক্তি মিশ্রিত; তাই এ দলিলগুলো সঠিক নয়। (ক্যান্ট, ১৯৫৬ খ্রি., পৃ. ২৫৬)। কিন্তু তিনি ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে আত্মার (যা মানুষের সারসত্তা বলে গণ্য) অস্তিত্ব এবং এর চিরজীবী হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করেন। মানুষের ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি আমাদের নির্দেশ করে যে, আমরা যেন সর্বোত্তম কল্যাণ অর্জন করি। সর্বোত্তম কল্যাণ এক দিক থেকে নৈতিক কল্যাণও বটে। সর্বোত্তম কল্যাণের সাথে সামঞ্জস্যশীল নৈতিক কল্যাণই হল পুণ্যতম (সবচেয়ে বড় পুণ্য বলে গণ্য) বিষয় (Best Virtue) এবং এটিই সেই পবিত্রতা (Sacredness) যাতে মানুষের ইচ্ছা শক্তি এবং নৈতিক বিধির মধ্যে পূর্ণ সংগতি ও মিল রয়েছে। সর্বোত্তম কল্যাণ অন্য দিক থেকে সৌভাগ্য বলেও গণ্য। সৌভাগ্য হল মানুষের সমগ্র জীবনে সকল কামনার প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টির নাম যা এখানে আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। কেননা, এর কার্যকারিতা হল আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে।

নৈতিক কর্মসম্পাদনকারী হিসেবে মানুষ এক্ষেত্রে পুণ্যকর্মের সাথে সম্পর্কিত হয়। সর্বোচ্চ কল্যাণের সাথে সামঞ্জস্যশীল পুণ্যকর্ম অর্থাৎ সেই পুণ্যকর্ম যাতে নৈতিক মূলনীতি এবং মানুষের ইচ্ছা শক্তির মধ্যে পরিপূর্ণ মিল রয়েছে তাকেই পবিত্রতা বলা হয়। এ কারণে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি তাকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীল করে যে, সে যেন নিজের মধ্যে পুণ্যতম বিষয় ও পবিত্রতাকে বাস্তবায়িত করে। অর্থাৎ ইচ্ছা শক্তিকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তির নৈতিক নির্দেশাবলীর অনুগত হতে হবে। অন্যদিকে মানুষের ইন্দ্রিয়গত চাহিদা রয়েছে। এ ধরনের চাহিদা আমাদের পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং ইচ্ছা শক্তিকে ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তির নির্দেশের অনুগত হতে বাধা দান করে। এ কারণেই মানুষ এ ধরনের ইন্দ্রিয়গত চাহিদা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করতে পারে না।

অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গত চাহিদাকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে পবিত্রতা অর্জন এমন এক পূর্ণতা যে, বস্তুজগতে কোন বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণি ইন্দ্রিয়গত চাহিদা সহকারে এ ধরনের পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে না। বুদ্ধিবৃত্তি এমন এক অবস্থায় পবিত্রতা অর্জনের নির্দেশ দান করে যখন ইন্দ্রিয়গত চাহিদা এ পূর্ণতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে। অতএব, মানুষকে বাধ্য হয়ে ইন্দ্রিয়গত চাহিদাকে (ক্রমে ক্রমে) দুর্বল করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের পথে পা বাড়াতে হয় এবং এ পথে অভিযাত্রা কখনই শেষ হবে না। এ অসীম অভিযাত্রা কেবল বুদ্ধিমান প্রাণির চিরন্তন অস্তিত্বের অপরিহার্যতা ধরে নিলে সম্ভব অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর পরও অস্তিত্ব থাকতে হবে যেন সে এ অসীম পথ অতিক্রম করতে পারে। (কান্ট, ১৯৫২ খ্রি., পৃ. ৩৪৪)। এ কারণে কান্ট নৈতিক বিধি প্রবর্তিত একটি মূলনীতির মাধ্যমে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। কান্টের নৈতিক দলিলের ভিত্তিগুলো নিম্নরূপ :

১. মানুষের ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি পবিত্রতা ও পুণ্য অর্জনের নির্দেশ দেয়।

২. ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি কোন অনর্থক বিষয়ে নির্দেশ দান করে না। এ কারণে অবশ্যই আমাদের এরূপ নির্দেশের প্রতি অনুগত থাকতে হবে।

৩. পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে ইচ্ছা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তির নৈতিক নির্দেশের অনুগত করব।

৪. মানুষ ইন্দ্রিয়গত চাহিদার কারণে ইচ্ছা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তির নৈতিক নির্দেশের অনুগত করতে পারে না।

৫. মানুষ এক অসীম অভিযাত্রার মাধ্যমে এ ধরনের পবিত্রতা ও মর্যাদা অর্জন করতে পারে।

৬. এ ধরনের অসীম অভিযাত্রার তখনই অর্থ হয় যখন এক বুদ্ধিমান প্রাণির জীবন সীমাহীনভাবে অব্যাহত থাকে। এ কারণে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন অব্যাহত থাকবে।

পর্যালোচনা এবং সমালোচনা

কান্টের মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের নীতিভিত্তিক দলিলের অনেক সমালোচনা করা হয়েছে। এর মধ্য হতে বিশেষ কয়েকটির প্রতি ইশারা করব।

অনেকে মনে করেন, এ দলিলের প্রতিজ্ঞাগুলো একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেননা, এক প্রতিজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘পবিত্রতা অর্জন সম্ভব।’ অন্য একটি প্রতিজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মানুষের জন্য পবিত্রতা অর্জন সম্ভব নয়।’ এ কারণে এ দলিলের প্রতিজ্ঞাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বৈপরীত্য রয়েছে।

অনেকে বুদ্ধিবৃত্তি কর্তৃক পবিত্রতা অর্জনের নির্দেশদানের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন যে, বুদ্ধিবৃত্তি আদৌ এ ধরনের নির্দেশ দান করে না। নৈতিক বিধি হিসেবে এ ধরনের নির্দেশের অস্তিত্ব যখন থাকবে না তখন এর বিষয়বস্তুরও কল্পনা করা সম্ভব হবে না।

এ দলিলে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি রয়েছে তা হল বস্তুগত শরীরের ওপর নির্ভরশীল ইন্দ্রিয়গত চাহিদা। মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে সন্দেহাতীতভাবে বস্তুগত শরীরও ধ্বংস হয়ে যাবে; কিন্তু অবিনশ্বর এক সত্তা হিসেবে আত্মার জীবন অব্যাহত থাকবে। যদি মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে ইন্দ্রিয়গত চাহিদার ধারক অর্থাৎ বস্তুগত শরীর ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে পবিত্রতা অর্জনের বাধা দূর হয়ে যাবে; ফলে সম্ভাব্য পবিত্রতায় পৌঁছানো এবং আত্মার অসীম অভিযাত্রার বিষয়টি বাতিল হয়ে যাবে।

যা-ই হোক, কান্টকে অবশ্যই মৃত্যু-পরবর্তী জীবন অথবা মানুষের চিরজীবী হওয়ার বিষয় প্রমাণের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়সমূহকে স্পষ্টরূপে বর্ণনা করতে হবে :

১. আত্মার সাথে বস্তুগত শরীরের পার্থক্য।

২. আত্মা ও দেহের মধ্যে সম্পর্ক।

৩. ইন্দ্রিয়গত চাহিদার ধারকের বিষয়টি স্পষ্ট করা।

৪. মানুষের প্রকৃত সত্তা কি তার আত্মা দ্বারা গঠিত, না কি আত্মা ও শরীর উভয়ের সমন্বয়ে গঠিত।

যদি এ বিষয়গুলো স্পষ্ট না হয় তাহলে পবিত্রতায় পৌঁছানো এবং মানুষের চিরজীবী হওয়ার বিষয়টি প্রমাণে সমস্যা সৃষ্টি হবে।

আত্মার অবস্তুগত হওয়ার দলিল

মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণের আরেকটি দলিল হল অবস্তুগত আত্মার দলিল। এ দলিলটি মানুষের প্রকৃত সত্তার দ্বি-মাত্রিকতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে গঠিত। মানুষের প্রকৃত সত্তা তার আত্মার দ্বারা গঠিত যা অবস্তুগত হওয়ার কারণে ধ্বংসশীল নয়, চিরজীবী। বস্তুগত দেহের মৃত্যুর পরও মানুষের জীবন অব্যাহত থাকে।

কিন্তু দেহের সাথে তুলনা করেও আত্মার ধ্বংসশীল না হওয়ার বিষয়টি বলা সম্ভব। কেননা, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য সবাই সম্ভাব্য সত্তা। সকল সম্ভাব্য সত্তার অস্তিত্ব আল্লাহ্‌র ওপর নির্ভরশীল। যদি আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করেন তাহলে মুহূর্তের মধ্যে সকল অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে।

মানুষের সত্তার দ্বি-মাত্রিকতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দলিল কী? আমরা স্পষ্টরূপে এমন এক অস্তিত্বের বিষয় অনুধাবন করতে পারি যা দেহের সাথে সম্পৃক্ত। দেহের ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও আত্মার স্থায়িত্ব বজায় থাকে যা মৌলিক এবং কখনই ভগ্নাংশ হয় না।

আমরা আরও অনুধাবন করতে পারি, এ ধরনের অস্তিত্ব দেহের সাহায্য ছাড়াই চিন্তা করা যেতে পারে। এ কারণেই ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক রনে দেকার্ত মানুষের দেহ ও আত্মার মূলকে দু’টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিশ্বাস করেন। দেহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিস্তৃতি, আর আত্মার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চিন্তা। (রনে দেকার্ত, ১৩৬১ সংখ্যা, পৃ. ১২২)

আত্মার অবস্তুগত হওয়ার বিষয়ে অনেক দলিল আনা হয়েছে। ইসলামী দার্শনিক মোল্লা হাদী সাবজিবারী তাঁর দার্শনিক গ্রন্থ ‘সারহি-মানযুমা’-তে আত্মার অবস্তুগত হওয়ার বিষয়ে বারোটি দলিল এনেছেন (সিরাজী, ১৩৮৩ সংখ্যা, পৃ. ১৩৩৫)। বস্তুর অভিন্ন নিয়ম আত্মার বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে না- এ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ঐ গ্রন্থের দলিলসমূহ আত্মার অবস্তুগত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে। এ লেখনীতে আত্মার অবস্তু হওয়ার একটি দলিলের প্রতি ইশারা করা হল :

যখন আমরা নিজ সত্তার দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করব তখন অনুধাবন করতে পারব যে, মানুষ চিন্তাশীল অস্তিত্ব এবং এই অস্তিত্ব মৌলিক এবং কখনই ভগ্নাংশ হয় না। তার আমিত্বকে দু’ভাগে ভাগ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বস্তুর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একে ভগ্নাংশ করা সম্ভব। ভগ্নাংশ করার বৈশিষ্ট্য আত্মার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। যদি আমাদের আত্মা বস্তুগত হত তাহলে বস্তুর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এর মধ্যে বিদ্যমান থাকত অর্থাৎ একে দুই ভাগে বিভক্ত করা সম্ভব হত। যেহেতু আত্মাকে বিভক্ত করা সম্ভব নয়, এ কারণে আত্মা অবস্তুগত উপাদান। (সিরাজী, ১৩৮৩ সংখ্যা, পৃ. ১৩৩৫; মোতাহহারী, ১৩৮০ সংখ্যা, পৃ. ১১৯)

উল্লিখিত আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি, মানুষ দু’টি উপাদান- আত্মা ও দেহ দ্বারা গঠিত হয়েছে। এ দু’টি উপাদান থেকে তার প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে তার আত্মা- যা ধ্বংসশীল নয় ও মৌলিক এবং মৃত্যুর পর তার দেহ ধ্বংস হওয়ার পরও আত্মার জীবন অব্যাহত থাকে। এ কারণে মানুষের প্রকৃত বাস্তবতা হল মৃত্যুর পরেও জীবন রয়েছে।

সিদ্ধান্ত

এ প্রবন্ধে ছয়টি দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে যেগুলোতে বিভিন্নভাবে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন প্রমাণ করা সম্ভব। তবে এর কিছু দলিল ফিতরাতী দলিলের ভিন্ন রূপ। হিকমত এবং ন্যায়বিচারের দলিলকে কালামশাস্ত্রের দলিল হিসেবে নামকরণ করা যায় যেখানে এ বিষয়টি প্রমাণের জন্য আল্লাহ্‌র সিফাত থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে। অন্যান্য দলিল, যেমন যৌক্তিক, নৈতিক ও আত্মার অবস্তুগত হওয়ার দলিলে তা প্রমাণের জন্য আল্লাহ্‌র সিফাতের সাহায্য নেয়া হয়নি। এ সকল দলিল যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী এবং সুশৃঙ্খল।

গ্রন্থপঞ্জি

১. কুরআন

২. নাহজুল বালাগা

৩. সাইয়্যেদ রূহুল্লাহ্‌ খোমেইনী, ১৪২২ হিজরি, চেহেল হাদীস, তেহরান, মুওয়াসসেসে নাশ্‌র এবং তানজীমে আসারে ইমাম খোমেইনী

৪. মোহাম্মদ রেইশাহরী, ১৪২২ হিজরি, মুনতাখাবুল মিযানুল হিকমাহ, কোম, দারুল হাদীস

৫. সাইয়্যেদ রাজী সিরাজী, ১৩৮৩ হিজরি, দারসহয়ে সারহি-মানযুমা, ২য় খণ্ড, তেহরান, হিকমাত

৬. সাদরুদ্দিন মুহাম্মদ সিরাজী, ১৩৮৩ হিজরি, আসফার, তারজেমে মুহাম্মদ খজাবী, ৪/২ খণ্ড, তেহরান, ইনতিশারাতে মাওলা

৭. হিকমাতুল মুতাআলিয়া ফি আসফারিল আকলিয়াল আরবায়া, ১৪১৯ হিজরি, ৯ম খণ্ড, বৈরুত, দারুল ইহইয়া তুরাসুল আরাবি

৮. ফাইজ কাশানী, মুহাম্মদ ইবনে শাহ মুরতাজা, ১৪১৮ হিজরি, ইলমুল ইয়াকীন ফি উসূলুদ দ্বীন, মুহাক্কেক মুহসেন বিদরফারদ, কোম, ইনতিশারাতে বিদর

৯. কপিলাস্তুন ফেড্রিক, ১৩৮০ সংখ্যা, তারিখে ফালসাফে, ৪র্থ খণ্ড, তেহরান, ইনতিশারা্‌তে সুরুশ, ইনতিশারাতে ইলমী ফারহাঙ্গী

১০. মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব কুলাইনী, আল-কাফী, তাহকিক আলী আকবর গাফফারী, দারুল কুতুবুল ইসলামীয়া

১১. মুহাম্মদ বাকির মাজলিসী, ১৪০৩ হিজরি, বৈরুত, দারুল ইহইয়া তুরাস

১২. মুরতাজা মুতাহ্‌হারী, মাজমুয়ে আসার, ৬ষ্ঠ খণ্ড (উসূলে ফালসাফে রাভেশে রিয়ালিজ্‌ম), তেহরান, ইনতিশারাতে সাদরা

১৩. Kant, Immanuel, 1956, Critique of Practical Reason, Tr, Beck.L.W. New York, The Library of Liberal Arts.

১৪. Kant, Immanuel, 1952, The Critique of Practical Reason, Tr, Abbott, T.K. PP, 289-361, great Book of the western word, eds.

১৫. Hutchins, R.M. Chicago…, Encyclopedia Britannica INC, Vol, 42.

(ইরান থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক কাবাসাত, ১২তম বর্ষ, সংখ্যা ৪৬, ১৩৮৬ ফারসি সাল থেকে অনূদিত)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.