মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পর ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত নাম হলো আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)। তৎকালীন আরবে (সপ্তম শতাব্দী) যিনি একাধারে তাত্ত্বিক, সুবক্তা, লেখক, চিন্তক ও কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান ও পবিত্রতার সাগর, ধর্মের কুতুব, ধর্মপথের প্রদর্শক, আল্লাহ্র রাসূলের চাচাত ভাই ও শেরে খোদা। তাঁর উপাধি মুরতাজা ও মুজতাবা। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর স্বামী, আল্লাহ্র রাসূলের জামাতা। রাসূলের সাহাবিগণের মাঝে যিনি মর্যাদা ও সত্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকলেই একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও অতুলনীয় বীর যোদ্ধা।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (আ.) ২৩ হিজরি পূর্বাব্দের ১৩ রজব শুক্রবার আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমাহ্ বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম। তিনি প্রথম ঈমানদারদের একজন। রাসূল (সা.) হযরত আলীকে তাঁর শিশুকালেই নিজ গৃহে নিয়ে আসেন এবং তাঁর পবিত্র বিছানার পাশেই তাঁর দোলনাটি রাখা হয়েছিল। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে দোল দিতেন, গোসল করাতেন এবং দুধ খাওয়াতেন। এ সম্পর্কে হজরত আলী তাঁর বিখ্যাত ‘খুত্বাতুল ক্বাসেয়াহ্তে বলেছেন : ‘রাসূলের সাথে আমার বিশেষ জ্ঞাতিত্ব ও আত্মীয়তার কারণে আমার মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জান। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনই তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর পবিত্র বুকে চেপে ধরতেন, বিছানায় তাঁর পাশে শোয়াতেন, আমার শরীরে হাত বুলাতেন। তখন আমি তাঁর পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিয়েছি। তিনি খাবার চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন…. সে সময় থেকেই আমি তাঁকে এমনভাবে অনুসরণ করতাম যেভাবে উটের বাচ্চা তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। প্রতিদিন তিনি আমাকে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাতেন এবং তা অনুসরণ করতে আদেশ দিতেন। প্রতিবছর তিনি হেরা পাহাড়ে নির্জনবাসে যেতেন। সেখানে আমি ব্যতীত আর কেউ তাঁকে দেখেনি। সে সময় খাদিজার ঘর ব্যতীত আর কোথাও ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না আর সেসময় দু’জনের পর আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ও ঐশী বাণীর তাজাল্লি আমি দেখতাম এবং নবুওয়াতের সুঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করতাম।’
একান্ত অনুগত বুদ্ধিদীপ্ত আলীকে রাসূল (সা.) ভীষণ ভালবাসতেন। জন্মের পর থেকে আলীও রাসূলকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, একই গৃহের ভেতরে একই ছাদের নিচে একান্ত নিবিড়ভাবে। ছোটবেলা থেকে হযরত আলীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। মাত্র তের বছর বয়সে তিনি নিজেকে সত্যের পয়গাম গ্রহণকারী, রাসূল (সা.)-এর রিসালাতের স্বীকৃতি দানকারী ও দ্বীনের পথে প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে বনু হাশিমের সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি দানের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে নিজের ভাই, ওয়ালী ও খলিফা বলে উপস্থিত সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর অনুসারিগণ হাবশা ও মদিনায় হিজরত করতে শুরু করেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ এলে মহানবী হযরত আলী (আ.)-কে নিজের বিছানায় রেখে রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর আলী (আ.) মক্কায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। তৃতীয় বা চতুর্থ দিন মদিনার উদ্দেশে প্রকাশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথে ছিল তাঁর মা, নবীকন্যা হযরত ফাতেমা, হযরত উম্মে আইমানসহ আরও কয়েকজন মহিলা। তিনি মদিনায় পৌঁছলে মহানবী (সা.) নিজে এগিয়ে এসে তাঁদের কাফেলাকে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রিয় ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় মহানবীর চোখ মমতা ও আনন্দে ভরে গিয়েছিল।
মদিনায় হযরত আলীর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। হযরত আলী তখন ২২-২৩ বছরের প্রাণবন্ত যুবক। মদিনা সনদ সম্পাদনের মাধ্যমে একটি জাতি গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২য় হিজরিতে বদরের যুদ্ধে হযরত আলী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিতে মক্কার কাফেররা পরের বছর পুনরায় যুদ্ধের আয়োজন করে। এই যুদ্ধে মদিনার মুসলমানদের অবহেলার জন্য ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় সংযোজিত হয়। রাসূলুল্লাহ্র আদেশ অমান্য করার ফলে মুসলমানরা নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ্র মৃত্যুর গুজবে মুসলিম বাহিনী হতাশ হয়ে পালাতে থাকে। সেসময়ে হযরত আলী বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে একত্রিত করে কাফিরদের ওপর আক্রমণ করেন। কুরাইশদের পতাকাবাহী নয়জন শ্রেষ্ঠ বীরকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ্কে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওহুদের যুদ্ধে হযরত আলীর দেহে সত্তরটির মতো আঘাত লেগেছিল।
৫ম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধে মদিনা যখন মক্কার কাফেরদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয় তখন আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা ‘আমর ইবনে আবদে উদ্দ’ মল্লযুদ্ধের জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান করে। সে ছিল এক অপরাজেয় বীর। তাই তাকে বলা হতো ‘এক হাজার ঘোড় সওয়ারের সমতুল্য’১০। রাসূল (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে হযরত আলী আমর ইবনে আবদে উদ্দকে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং মল্লযুদ্ধের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করেন।
৬২৮ সালে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী (আ.)। সপ্তম হিজরিতে মহানবী (সা.) খায়বর অভিযানে বের হন। খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ কামুস জয় করা মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কামুস দুর্গের প্রধান ছিল ‘হাজার বীরের শ্রেষ্ঠ বীর’ খ্যাত মারহাব। দ্বন্দ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) মারহাবের মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে তরবারি মারহাবের শিরস্ত্রাণ পরিহিত মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত নেমে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে দুর্ভেদ্য কামুস দুর্গের পতন ঘটে এবং মুসলমানরা খায়বর জয় করে। খায়বরবাসী খারাজ প্রদানের শর্তে সন্ধি করে।
মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন মক্কায় প্রবেশ করেন। হযরত আলী ‘কাদ’-র দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। এক বিন্দু রক্তপাত ছাড়াই হযরত আলী তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেন।
মক্কা বিজয়ের পর ঐ একই বছর হোনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিন ‘হাওয়াযিন গোত্রের’ আক্রমণে মুসলিম সৈন্যবাহিনী যখন দিশেহারা তখন হযরত আলী ও আব্বাস (রা.) সমগ্র আনসার বাহিনীকে একত্রিত করে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে মুসলমানগণ জয় লাভ করে।
অষ্টম হিজরিতে হেজাজ অঞ্চলের চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলো। এরই প্রেক্ষিতে হযরত খালিদ ইবনে ওলীদকে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়। খালিদ দীর্ঘ ছয় মাস এখানে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করল না। মহানবী (সা.) তাঁর স্থলে হযরত আলীকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, আভিজাত্যপূর্ণ মার্জিত ব্যবহার, রাসূলের প্রতিনিধিসুলভ ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপনের সারল্য ইয়েমেনীদের মুগ্ধ করল। ইয়েমেনের হামদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে গেল। পরের বছর পুনরায় ইয়েমেনের মাযহাজী গোত্রের কাছে হযরত আলীকে প্রেরণ করা হয়। গোত্রপতিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ইয়েমেন ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসে।
দশম হিজরিতে রাসূল (সা.) শেষ হজ করার জন্য মক্কায় গমন করলে হযরত আলী (আ.) তাঁর সহগামী হন। সেই বিখ্যাত বিদায় হজের ভাষণ শেষ করে মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। মহানবী (সা.) সমবেত সাহাবিগণকে নিয়ে যোহরের নামায আদায় করে উটের হাওদার তৈরি মঞ্চে আরোহণ করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন যা ‘খুত্বায়ে গাদীর’ নামে প্রসিদ্ধ। এই খুত্বাতে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : ‘আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা ও তাদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অধিকার রাখি এবং তাদের ওপর অধিকার রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ততর। হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা ও নেতা।’
গাদীরে খুমের ভাষণের সত্যতা লিপিবদ্ধ করেছেন আত তাবারী, আবু নাঈম ইসফাহানী, ইবনে আসাকের, আবু ইসহাক হামুইনী, আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতীর মতো বিখ্যাত আলেমগণ।
হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলিফার পঁচিশ বছরের শাসনামলে অধিকাংশ সময় নিজ গৃহে এবং মসজিদে নববীতেই কাটাতেন। এই সময় তিনি যেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সেগুলো হলো :
প্রথমত, তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল থাকা।
দ্বিতীয়ত, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের তাফসীর, মুতাশাবেহ আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা, দুর্বোধ্য বিষয়াবলির সমাধান অন্বেষণ করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে শিক্ষা দান করে তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রস্তুত করে তা উম্মাহ্র মাঝে প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর পরে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
তৃতীয়ত, খলিফাদের দরবারে অনাহূত সমস্যাগুলোর সমাধান বাতলে দেওয়া। জটিল বিষয়ে হযরত আলী তাঁর বিজ্ঞ মত ব্যক্ত করতেন যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল।
চতুর্থত, একদল নিঃস্বার্থ, পবিত্র অন্তর ও আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও পরকালীন যাত্রার পথে আগ্রহী অনুসারী তৈরি করা যাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারেন।
পঞ্চমত, বিধবা, অনাথ ও অসহায়দের প্রতিপালন ও পুনর্বাসনের জন্য অনুসারীদের মাঝে কর্ম তৎপরতা তৈরি করা এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে বাগান তৈরি করে, কূপ খনন করে সেগুলো ওয়াক্ফ করা।
অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) দ্বীন ইসলাম ও উম্মতের খিদমতের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
এছাড়াও এই পঁচিশ বছর সময়ে তিনি মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি নুস্খা বা অনুলিপি তৈরি করেন এবং মহানবী (সা.)- এর পবিত্র জীবনের অমিয় বাণী ও সুন্নাহ্র উপর একটি সংকলন তৈরি করেন যা মুসনাদে ইমাম আলী ইবনে আবি তালেব নামে প্রসিদ্ধ।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর খলিফাদের শাসনকালে হযরত আলী ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেই অধিক গুরুত্ব দেন এবং খলিফাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।
হযরত আলীর পরামর্শক্রমেই হযরত ওমর বায়তুল মুকাদ্দাসে যাত্রা করেছিলেন। নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ, ইয়ারমুকের যুেদ্ধ হযরত আলীর পরামর্শেই মুসলিম বাহিনী ও রাজধানী মদিনা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। খলিফাদের সময় হযরত আলী কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ঐতিহাসিক রায়সমূহ মুসলিম আইনের বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এমনি আরও বহু ঘটনা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই।
হযরত আলী তাঁর খিলাফতকালে চেয়েছিলেন মুসলমানদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র শাসনকালীন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মহানবীর পদ্ধতিকে পুনর্জীবিত করে মুসলিম উম্মাহকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। খিলাফতের প্রথমদিকে বাইতুল মালের বণ্টনের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর তাদের জেনে রাখা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় অধিকারের দিক থেকে সকলে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র যা তোমাদের মাঝে সমভাবে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টিত হবে আর এতে আরব-অনারব এক সমান।’
তিনি পূর্ববর্তী খলিফার সময়ে দুর্নীতিপরায়ণ আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে অপসারণ করে তদস্থলে নতুন গভর্নরদের নিয়োগ দেন। একমাত্র সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ব্যতীত অন্য সকলেই খলিফার আদেশ মেনে নিয়ে নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানবিক ও অতি সংবেদনশীল যুদ্ধনীতি ঘোষণা করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর তেষট্টি বছরের ঘটনাবহুল জীবনের বাস্তব চিত্র পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট না হলে এবং ইসলামের চরম সংকটে তাঁর অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলে ইতিহাসের সত্য দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।
‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জ্ঞাননগরীর দরজা’ খ্যাত হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন। ইয়াকীনপূর্ণ জ্ঞান আর বোধে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেনÑ ‘আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচার কার্যে সকলের চেয়ে উত্তম।’ ইয়েমেনের সিংহের গর্তে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর মতামতকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের নিগূঢ় জ্ঞানরাশি মুহাম্মাদ (সা.) হযরত আলীকে শিখিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন তিনি ফিরে আসলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘কী আলোচনা হলো?’ তিনি বললেন : ‘মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন, প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্রটি দ্বার উন্মুক্ত হয়।’ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে হযরত আলী মসজিদে নববীতে জ্ঞানচর্চার মুক্তাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় খুতবার মাধ্যমে ও সাহাবিগণের আলাপচারিতায় তিনি যে সমস্ত বিদগ্ধ আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তা পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি সত্যিকার অর্থে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ কর্তৃক ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হযরত আলী (আ.)-এর খুতবা ও পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে তাঁর জ্ঞানজগতের বিশালতা ও পরিব্যাপ্তি বোঝা যায়। এই সমস্ত খুতবার বিষয়বস্তু ছিল মহাজগৎ সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র অস্তিত্ব, ফেরেশ্তা সৃষ্টি, আদম সৃষ্টি ঈমান, রুহ্, রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা, অন্যান্য আসমানি কিতাবের আলোচনাসহ বিভিন্ন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞান-নগরীর দরজা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এই সমস্ত জ্ঞানপূর্ণ সমাবেশে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিগণ উপস্থিত থাকতেন। তাঁরা তাঁর কাছে বিভিন্ন জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন আর হযরত আলী (আ.) অত্যন্ত সুবিজ্ঞ উত্তরসহ মতামত দান করতেন।
তানবীর মুহাম্মদ
সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
সরকারী সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম।
গ্রন্থসূত্র:
১. হযরত শেখ ফরীদ উদ্দীন আত্তার (রহ.), মানতিকুত্ তায়োর, বাংলা অনুবাদ- আবদুল জলীল, প্রকাশক- রেহানা হক, সবর্ণ ১৫০, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, দোতলা, ঢাকা ১০০০। প্রকাশকাল : আগস্ট ২০০৮।
২. আয়াতুল্লাহ্ জাফর সুবহানী কর্তৃক লিখিত ‘ফুরুগে¦ বেলায়েত’ গ্রন্থটি পড়তে পারেন। এই গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আব্দুল কুদ্দুস বাদশা ও মোঃ মাঈন উদ্দিন। ‘বেলায়েতের দ্যুতি’ নামে গ্রন্থটি দারুল কোরআন ফাউন্ডেশন থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
৩. আল আবাকিয়াতুল ইসলামিয়্যাহ্, লেখক- আল আক্কাদ।
৪. তারীখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, ৬ষ্ঠ ভাগ।
৫. সীরাতুন নবী (সা.), আল্লামা শিবলী নোমানী (র.)।
–তানবীর মুহাম্মদ
বিশ্বমানবের জন্য (সা.)-এর শিক্ষা
বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম্
‘(হে রাসূল!) বলুন : এসো আমি পাঠ করি তা তোমাদের রব্ তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন, তা হচ্ছে এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কোনো কিছু শরীক করো না এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ কর এবং দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। বস্তুত আমিই তোমাদেরকে ও তোমাদের ব্যতীত অন্যদেরকে রিয্ক প্রদান করে থাকি। আর তোমরা প্রকাশ্য বা গোপনীয় কোনো ধরনের নির্লজ্জতার কাছেও যেও না। আর ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যতীত আল্লাহ্ যাকে হত্যা করাকে হারাম করেছেন এমন কাউকে হত্যা করো না। তিনি তোমাদেরকে এ উপদেশ দিচ্ছেন; আশা করা যায় যে, তোমরা বিচারবুদ্ধি দ্বারা তা উপলব্ধি করবে। আর (তাদেরই) কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যতীত তোমরা ইয়াতীমের সম্পদের কাছেও যেও না যতক্ষণ না তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। আর তোমরা মাপক পাত্র ও তুলাদ-কে ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যবহার কর। বস্তুত আল্লাহ্ কারো ওপরে তার সাধ্যের অতীত দায়িত্ব চাপান না। আর তোমরা যখন কথা বলবে তখন ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি বজায় রাখবে, এমনকি তোমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের বেলায় হলেও। আর তোমরা আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ কর। তিনি তোমাদেরকে এ উপদেশ দিয়েছেন, আশা করা যায় যে, তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।’ (সূরা আল্-আন্‘আম : ১৫১-১৫২)
মক্কা শরীফে সফরের উদ্দেশ্যে আগত এক ব্যক্তিকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছিল যে, তিনি যেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কথা না শোনেন, কারণ, (নিষেধকারীদের বক্তব্য অনুযায়ী) তাহলে ঐ সব কথা তাঁকে জাদুগ্রস্ত করে ফেলবে। কিন্তু তিনি ছিলেন বিচারবুদ্ধির অনুসরণকারী একজন মুক্ত বিবেক মানুষ। এ কারণে তিনি তাদের এ মন্দ উপদেশ উপেক্ষা করেন এবং মসজিদুল হারামে গিয়ে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে দেখা করেন। অতঃপর কোরআন মজীদের উপরিউক্ত আয়াত দু’টি শুনে তিনি সাথে সাথে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং অনুভব করেন যে, এ আয়াত দু’টিতে নিহিত শিক্ষা তাঁর সম্প্রদায়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করবে।
ঐ ব্যক্তিটি মক্কায় সফরে এসেছিলেন মদীনা থেকে- যে শহরটি অচিরেই রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নতুন বাসভূমিতে পরিণত হয়। আর তিনি সেখানে উপরিউক্ত ঐশী ও সুবিচারপূর্ণ মূলনীতিমালা এবং অন্তরঙ্গতার ভিত্তিতে একটি নতুন সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রবের পক্ষ থেকে মানুষকে এ শিক্ষা দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, তারা যেন একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো ইবাদত-বন্দেগি না করে এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক না করে। তাঁকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয় যে, তিনি যেন লোকদেরকে পৌত্তলিকতার ন্যায় মানবতার জন্য অবমাননাকর যুলুম থেকে এবং কুসংস্কারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন। তিনি লোকদেরকে শিক্ষা দেন যে, তারা যেন একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পণ করে; সমাজের কাছে নয়, শাসকদের কাছে নয় বা সংখ্যাগুরু জনগণের কাছে নয়, কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে। তিনি এ শিক্ষা প্রদান করেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যেই নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা নিহিত রয়েছে।
মুক্তি ও স্বাধীনতার শিক্ষা দিতে গিয়ে তিনি আমাদেরকে সকল লজ্জাকর গুনাহ্র কাজ পরিহার করার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে আমাদের নিজেদের কাছে, আমাদের মূল্যবোধ সমূহের কাছে ও আমাদের আদর্শের কাছে ন্যায়নিষ্ঠ ও আন্তরিক হবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং আমাদেরকে পাপপ্রবণ প্রবৃত্তির আশা-আকাক্সক্ষার মধ্যেÑ যাতে আমাদের প্রকৃত ও চূড়ান্ত ধ্বংস নিহিত রয়েছে, তাতে নিমজ্জিত হওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, কোনো ব্যক্তি যখন গুনাহের পথ বেছে নেয় সে ক্ষেত্রে সে যদি এ পথে ধীর পদবিক্ষেপেও অগ্রসর হতে থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত তার ধ্বংস অনিবার্য।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আমাদেরকে জীবনের মর্যাদা শিক্ষা দিয়েছেন। আর তিনি এমন এক সময় এ শিক্ষা প্রদান করেন যখন প্রতিশোধমূলক হত্যার ও তথাকথিত মর্যাদা রক্ষার জন্য হত্যার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। তখন অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে যে কাউকে হত্যা করা হতো। সে পরিস্থিতিতে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) লোকদেরকে শিক্ষা দেন যে, কেবল ন্যায়সঙ্গতভাবে ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি ব্যতীত কাউকে হত্যা করা যাবে না, যদিও ক্ষমা সর্বাবস্থায়ই সর্বোত্তম।
তখন এমন একটি সময় ছিল যখন পিতা কেবল এ কারণে স্বীয় সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত যে, সে ভয় করত যে, এ শিশুর ভরণ-পোষণ বহনে সক্ষম হবে না। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এ শিক্ষা প্রদান করেন যে, পিতা-মাতা ও সন্তান নির্বিশেষে সকলকে আল্লাহ্ তা‘আলাই রিয্ক্ প্রদান করেন।
বর্তমানে আমরা এমন এক পৃথিবীতে বসবাস করছি যখন প্রতিদিন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময়কর সংখ্যক প্রাণ বিনষ্ট হচ্ছে। যখন প্রাণসমূহ এমনকি মাতৃগর্ভের নিরাপদ আশ্রয় থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই বিনষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কিছুতেই জীবনের মর্যাদা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আমাদেরকে সুবিচার ও সত্য শিক্ষা দিয়েছেন এবং নৈতিকতা ও সামাজিক আচরণের ভিত্তিসমূহ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, আসমান ও যমীন সুবিচার বা ভারসাম্যের ওপর ভিত্তিশীল। তিনি সব সময় ও সর্বাবস্থায়ই সুবিচারকে সমুন্নত রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, সর্বাবস্থায়ই সত্য বলতে হবে, এমনকি তা আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও।
তিনি বলেন যে, সুবিচার প্রতিষ্ঠার কাজে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করা সত্তর বছর (নফল) ইবাদত করার চেয়েও অধিকতর উত্তম।
আমরা সকলেই বেশ ভালোভাবেই জানি যে, অন্যায়, অবিচার ও মিথ্যাচার, বিশেষ করে তা যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে হয়, কীভাবে আমাদের এ বিশ্বকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করতে পারে। তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে সুবিচার ও সত্যবাদিতার ওপর অবিচলতা কীভাবে আমাদেরকে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও বৈশ্বিক সমস্যাবলির সমাধানে সাহায্য করে।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন এমন একজন মহান শিক্ষক যিনি সব সময়ই ব্যক্তিগত আচার-আচরণের ক্ষেত্রে গভীর আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গতার পরিচয় দিতেন। কখনো যদি এমন হতো যে, তাঁর কোনো বন্ধু বা স্বজনের সাথে তিন দিন পর্যন্ত তাঁর দেখা হয় নি তাহলে তিনি তাঁকে দেখতে যেতেন এবং তাঁর খোঁজখবর নিতেন। তিনি চলার পথে যদি কোনো শিশুকেও দেখতে পেতেন তাহলে তার প্রতি হাসিমুখে তাকাতেন এবং তাকে আগে সালাম দিতেন। তিনি যখন তাঁর সাহাবীদের সাথে বসতেন তখন তিনি তাঁদের সকলের প্রতি সমানভাবে দৃষ্টিপাত করতেন যাতে সকলেই নিজেদেরকে সমানভাবে ধন্য মনে করতেন এবং অনুভব করতেন যে, তাঁদেরকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
তাঁর ক্বওমের লোকেরা তাঁর আন্তরিকতা এবং দয়া-অনুগ্রহে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বর্ণিত আছে যে, একবার জনৈকা মহিলা তাঁর পুত্রকে দান হিসেবে কিছু পাবার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে পাঠান। যেহেতু মহিলা জানতেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) খুবই দানশীল ছিলেন এবং এ কারণে কখনো কখনো এমন হতো যে, তাঁর কাছে দান করার মতো কিছুই থাকতো না। সেহেতু মহিলা তাঁর পুত্রকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে যদি দান করার মতো কিছু না থাকে তাহলে সে যেন তাঁর কাছে তাঁর গায়ের জামাটি চায়। ঘটনাক্রমে সেদিন তাঁর কাছে দান করার মতো কিছুই ছিল না। তাই ছেলেটি তাঁর কাছে তাঁর পরিধানের জামাটি চায়। তখন তিনি তাঁর কক্ষের দরজা বন্ধ করে তাঁর গায়ের জামাটি খুলে দরজার ফাঁক দিয়ে ছেলেটিকে দান করেন। এরপর আরেকটি জামার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর গৃহে আবদ্ধ থাকেন।
আরেক বার তিনি তাঁর চাচাতো ভাই, তাঁর ঘনিষ্ঠতম সাহাবী ও তাঁর ওয়াসী হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর জন্য একটি জামা কিনে আনতে বাজারে পাঠালেন। হযরত আলী তাঁর জন্য বারো র্দেহাম মূল্যে একটি জামা কিনে আনলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অপেক্ষাকৃত কম দামি একটি জামা চাচ্ছিলেন। তাই তিনি হযরত আলীকে সাথে নিয়ে বাজারে গেলেন। তিনি ঐ জামাটি বিক্রেতাকে ফিরিয়ে দিয়ে চার র্দেহাম মূল্যের একটি জামা নিলেন এবং অবশিষ্ট আট র্দেহাম সহ তিনি ঘরে ফিরে আসার পথ ধরলেন। পথে একজন গরীব লোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো যার গায়ের জামাটি ছিল ছিন্ন ও মলিন। তখন তিনি তাকে চার র্দেহাম্ দিলেন এবং একটি জামা কিনে নিতে বললেন।
এরপর এক ধনী পরিবারের এক ক্রীতদাসী বালিকার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। মেয়েটির মনিব তাকে চার র্দেহাম্ দিয়ে মুদি দ্রব্যাদি কেনার জন্য পাঠিয়েছিল, কিন্তু সে তা হারিয়ে ফেলেছিল, তাই সে তার মনিবের ভয়ে কাঁদছিল। তখন নবী করীম (সা.) তাঁর অবশিষ্ট চার র্দেহাম্ ঐ মেয়েটিকে দান করলেন। কিন্তু এরপরও সে কাঁদতে লাগল। সে বলল যে, সে দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে বসে কাঁদছিল এবং এখন দেরীতে ঘরে ফিরলে তার মনিব তাকে দেরী করার কারণে প্রহার করবে। তখন মেয়েটির মনিব যাতে তাকে প্রহার না করে সে জন্য নবী করীম (সা.) তার সাথে তার মনিবের গৃহে গেলেন।
তিনি মেয়েটির মনিবের গৃহের দরজায় পৌঁছে গৃহবাসীদের উদ্দেশে সালাম করলেন। জবাব আসতে দেরী হওয়ায় তিনি তিন বার সালাম করলেন। এরপর তারা জবাব দিল। নবী করীম (সা.) তাদের গৃহে আসায় তারা নিজেদেরকে ধন্য মনে করল এবং তাঁর সম্মানার্থে মেয়েটিকে ক্ষমা করে দিল। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সম্মানার্থে তারা ক্রীতদাসীটিকে মুক্ত করে দিল। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তিন বার সালাম না করা পর্যন্ত তাদের জবাব না দেয়ার কারণ জানতে চাইলেন। জবাবে তারা বলল : ‘আমরা আপনার কণ্ঠের সুমিষ্ট সম্ভাষণ তিন বার শুনতে চাচ্ছিলাম।’
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নেতৃত্বের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং বিশ্ববাসীর প্রতি সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অনুগ্রহ ছিল হযরত আলী (আ.)-কে স্বীয় উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীতকরণ। কারণ, নিষ্পাপ ব্যক্তিত্ব হযরত আলী (আ.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ততার জন্য উপযুক্ততম ব্যক্তিত্বÑ যিনি রাসূলুল্লাহ্র নীতিমালা ও শিক্ষাকে সমুন্নত রাখেন, বিশেষ করে তাঁরই মতো সুবিচার ও সত্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়ন করেন।
হযরত আলীকে যখন মুসলিম উম্মাহ্র নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ও পরিচালনার সুযোগ দেয়া হয় তখন তিনি বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে জনগণের মধ্যে সামাজিক সুবিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলমানদের নেতৃত্বের জন্য পরিপূর্ণ জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করেন। বস্তুত হযরত আলী (আ.) মানব জাতির মধ্যে সুবিচারের কণ্ঠস্বরে পর্যবসিত হন এবং তিনি সত্য ও সুবিচার নিয়েই বেঁচে থাকেন এবং সত্য ও সুবিচার নিয়েই শাহাদাত বরণ করেন।
অনুবাদ নূর হোসেন মজিদী