শেরে খোদা হযরত আলী (আ:)’র ক্ষমতা ও অলৌকিক জ্ঞানের কিছু ঘটনা

গতকাল ছিল বেদনা-বিধুর ঐতিহাসিক ২১ রমজান। আজ হতে ১৩৯৭ বছর আগে এই দিনে শাহাদত বরণ করেন আমিরুল মু’মিনি হযরত আলী (আ)। ইরানসহ বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে মহাশোকের এই দিবস।

তাঁর জন্ম হয়েছিল বিশ্বনবী (সা.)’র নবুওত প্রাপ্তির ঘোষণার দশ বছর আগে (হিজরি-পূর্ব ১৬ বা ২২ সনের ১৩ ই রজব) পবিত্র কাবা ঘরের ভেতরে। ৪০ হিজরির ১৯ রমজান হযরত আলী (আ) কুফার গ্র্যান্ড মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ার সময় এক খারিজি সন্ত্রাসীরা তরবারির হামলায় আহত হয়েছিলেন এবং তিনি একুশে রমজান শাহাদাত বরণ করেন।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.) ছিলেন মানুষের জন্য দয়া, ক্ষমাশীলতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, দানশীলতা, মহানুভবতা, পরোপকার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীলতা, সাহসিকতা, বীরত্ব ও ন্যায়পরায়নতাসহ সব মহৎ গুণের শীর্ষস্থানীয় আদর্শ। আর তাঁর পর এইসব গুণ সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখা গেছে তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের মধ্যে। বিশেষ করে, আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)’র আদর্শের পূর্ণাঙ্গ প্রতিভু তথা ইনসানে কামিলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদর্শ। আকাশের উদারতা ও স্বর্গীয় মহত্ত্বগুলো ছিল তাঁর ভূষণ। এই মহাপুরুষের শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং এই মহান ইমামের শানে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম। অনেকেই মনে করেন তাঁর শাহাদতের রাতটি ছিল পবিত্র শবে কদর।

আলী (আ.)’র জীবনের অনেক বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনা বা মু’জিজা রয়েছে। যেমন, জন্মের সময় পবিত্র কাবা ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে আবার তা মিলিয়ে যাওয়া যাতে তাঁর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ তাঁকে জন্ম দিতে পারেন, রাসূলের (সা.) ওফাতের পর কুবা মসজিদে রাসূল (সা.)-কে জীবিত অবস্থায় দেখানো, সূর্যকে পেছনে ঘুরিয়ে দেয়া যাতে সঙ্গীরা নামাজ আদায় করতে পারেন সময়মত ইত্যাদি ।

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন: মক্কা বিজয়ের পর ফেরার পথে এক রাতে মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে বলেন যে, সূর্য যখন উদিত হবে তখন তুমি সূর্যের সঙ্গে কথা বলবে। আমি ফজলকে বললাম দেখবো আলী কিভাবে সূর্যের সঙ্গে কথা বলে। সূর্য ওঠার পর আলী (আ.) সূর্যকে লক্ষ্য করে বলেন: সালাম তোমায় হে সূর্য, তুমি আল্লাহর সৎ দাস ও আল্লাহর নির্দেশ পালনে অবিচল।

সূর্য জবাবে বলল: ওয়া আলাইকাসসালাম হে আল্লাহর রাসূলের ভাই!

আসমা বিনতে উমাইস বর্ণনা করেন হযরত ফাতিমা জাহরা (সা. আ.) বলেছেন: কোনো এক রাতে আলী (আ.) ঘরে প্রবেশ করলে আমি ভীত হয়ে পড়ি। আসমা বলেন: হে বিশ্বের নারীকুলের নেত্রী! কিভাবে ভয় পেয়েছিলেন আপনি! তিনি বলেন: আমি শুনলাম যে জমিন বা মাটি আলীর সঙ্গে কথা বলছে এবং আলীও জমিনের সঙ্গে কথা বলছেন!

একবার আলী (আ.) একদল সঙ্গীসহ কুফার মসজিদে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি ইমাম আলী (আ.) বলে: আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, আমি বিস্মিত যে এই দুনিয়া এই গ্রুপের হাতে রয়েছে এবং আপনি এই দুনিয়া থেকে কিছুই পাচ্ছেন না! আলী (আ.) বললেন, তুমি কি মনে কর আমরা (বিশ্বনবীর-সা. আহলে বাইত) যদি দুনিয়াকে চাইতাম তাহলে কী আমাদের দেয়া হত না? এরপর তিনি এক মুঠো পাথরের কণা হাতে নিয়ে সেগুলোকে মূল্যবান পাথরে পরিণত করে প্রশ্ন করেন-এসব কি? লোকটি বলল: সবচেয়ে মূল্যবান পাথর। আমরা দুনিয়া চাইলে তা দেয়া হয়, কিন্তু আমরা তা চাই না-এ কথা বলে তিনি সেগুলো দূরে ফেলে দেন এবং সেগুলো আবারও সাধারণ পাথরের কণায় পরিণত হয়!

এ ছাড়াও একবার বেশ কিছু সময় ধরে ভূমিকম্প হতে থাকলে ও পাহাড়গুলো কাঁপতে থাকলে লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আলী (আ.)’র শরণাপন্ন হন। আলী (আ.) সে সময় খলিফা ছিলেন না। তিনি ভূমিকে লক্ষ্য করে বলেন: তোমার কি হলো? শান্ত হও। ফলে ভূমিকম্প বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিস্মিত লোকজনকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন: “আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন:

«اذا زلزلت زلزالها و اخرجت الارض اتقالها و قال الانسان مالها»

-যখন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে, যখন সে তার বোঝা বের করে দেবে। এবং মানুষ বলবে, এর কি হল ?

আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন জমিনকে বলবো, তোমার কি হলো? (এরপর কুরআনে এসেছে) یومئذ تحدث اخبارها- সেদিন সে তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে, ফলে আমার জন্য খবরগুলো বর্ণনা করবে জমিন।”

আলী (আ.)’র একদল সঙ্গী তাঁকে বললেন: মুসা ও ঈসা নবী জনগণকে অনেক মু’জিজা দেখিয়েছেন। আপনিও যদি সে ধরণের কিছু দেখাতেন তাহলে আমাদের হৃদয় সুনিশ্চিত হত। আলী (আ.) বললেন: তোমরা এ জাতীয় নিদর্শন দেখা সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু তারা বার বার একই অনুরোধ করতে থাকায় তিনি এক শুষ্ক উপত্যকায় একটি কবরস্থানের দিকে তাদের নিয়ে যান। সেখানে তিনি দোয়া পড়ে ধীর কণ্ঠে বললেন: তোমার পর্দা সরিয়ে ফেল। ফলে হঠাৎ কিছু বাগান ও নহর বা খাল দেখা গেল একদিকে এবং অন্যদিকে জাহান্নামের আগুন দেখা যাচ্ছিল। একদল বলে উঠলো: যাদু যাদু। কিন্তু অন্য একদল এই মু’জিজাকে বিশ্বাস করে বললেন: বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: কবর হচ্ছে বেহেশতের বাগান অথবা জাহান্নামের গর্ত।

একবার জনগণ বৃষ্টির অভাবে আলী (আ.)’র কাছে গিয়ে নালিশ করায় তিনি দোয়া করলে সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়। এতো বৃষ্টি হলো যে এবার জনগণ বলতে লাগলো: খুব বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তিনি আবারও দোয়া করায় বৃষ্টি কমে যায়। (সূত্র: বিহারুল আনোয়ার)

বলা হয় একবার হযরত আলী (আ)-কে একইসঙ্গে ১৫০টি জটিল প্রশ্ন করা হয়েছিল। আলী (অ) সব প্রশ্ন শোনার পর একে-একে সেসবের জবাব দিয়েছিলেন এবং একবারও প্রশ্নকারীকে বলেননি যে তোমার অত নম্বর প্রশ্নটা কি ছিল আবার বল! তিনি একনাগাড়ে এভাবে বলছিলেন যে, তোমার ১ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই, ২ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই… তোমার ১৫০ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই।

হযরত আলী (আ)-কে জব্দ করার জন্য তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয় আপনি সেইসব প্রাণীর নাম বলুন যেগুলো ডিম পাড়ে ও যেগুলো বাচ্চা প্রসব করে। আলী (আ) বললেন, যেসব প্রাণীর কান মাথার ভেতরে থাকে সেসব ডিম পাড়ে আর যাদের কান মাথার বাইরে থাকে সেসব বাচ্চা প্রসব করে। প্রশ্নকারীরা ভেবেছিল, আলী (আ) এই জটিল প্রশ্নে উত্তর দিতে দিতে অনেক সময় নেবেন এবং সময়ের অভাবে সব প্রাণীর নাম বলতে পারবেন না। ফলে তিনি এ বিষয়ে পুরোপুরি জানেন না বলে অপবাদ দেয়া সম্ভব হবে!

আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ) একবার যখন বলেছিলেন, আমাকে হারানোর আগেই যা কিছু জানার জেনে নাও, আমাকে যে কোনো বিষয়ের প্রশ্ন কর না কেন আমি তার জবাব দেব। তখন এক ব্যক্তি বললো, হে আলী! বলুন তো আমার মাথার কতটি চুল আছে? আলী (আ) বললেন, এটাও আমি বলতে পারব, কিন্তু এটা জেনে তোমার তো কোনো লাভ হবে না। অর্থাৎ এর মধ্যে তো উপকারী জ্ঞান নেই।

একটি বর্ণনায় এসেছে, সে যুগে ইরানের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ জুন্দিশাপুর বিশ্ববিদ্যালয় হযরত আলী (আ)-কে অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু হযরত আলী (আ) তা সম্ভব নয় বলে জানান এবং বলেন যে, কোনো প্রশ্ন থাকলে তিনি তার জবাব দেবেন। উটের একটি বিশেষ রোগের চিকিৎসা- যে রোগ এই জন্তুর শরীরে গর্ত সৃষ্টি করে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আলী (আ) জানান, কেবল ভারতের একটি উপাসনালয়ের একটি লোহার খুঁটি যা লোহা হওয়া সত্বেও তাতে আঘাতের ফলে সৃষ্ট শব্দ অন্য যে কোনো লোহার মধ্যে আঘাতজনিত শব্দের মত হয় না, তার স্পর্শই কেবল এ রোগ ভালো করতে পারে। বলা হয় ইউরোপীয়রা গবেষণার জন্য ওই খুঁটি নিয়ে যায় এবং আজো তার কোনো হদিস নেই।

রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস থেকে জানা যায় আলী (আ) নিকৃষ্ট ধাতুকে স্বর্ণে পরিণত করার বিদ্যাও জানতেন। কিন্তু তাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হত। #

পার্সটুডে/মু.আ. হুসাইন/২৮

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.