ড. সুসান সাইফ
পিতা-মাতারা ভালো করেই জানেন যে, প্রতিটি শিশুরই কিছু ভয়ভীতি ও উদ্বিগ্নতা থাকে। কিন্তু তাঁদের অনেকেই হয়তো জানেন না যে, শিশুদের এই ভয়-ভীতি ও উদ্বেগের কারণ কী বা উৎস কোথায়। এই নিবন্ধে শিশুদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কিছু কিছু কারণ বর্ণনা করা হয়েছে এবং এসব ব্যাপারে তাদের সাথে কী ধরনের আচরণ করতে হবে তাও তুলে ধরা হয়েছে।
একটি শিশুর সবচেয়ে মৌলিক ভীতি হচ্ছে তার পরিবার থেকে আলাদা হওয়ার ভয়। এ ধরনের অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগ শিশুদের জীবনে নানা রকমের আচরণগত সমস্যা সৃষ্টি করে। একটি শিশুকে পরিত্যাগ করা বা ফেলে যাওয়া আমাদের কখনই উচিত নয়। ‘তুমি যদি এখনই না আস তাহলে আমি তোমাকে এখানে রেখেই চলে যাব’- এই জাতীয় বাক্য মায়েরা প্রায়ই ব্যবহার করে থাকেন, কিন্তু তা শিশুমনে অহেতুক দুঃখবোধ সৃষ্টি করে। হাসপাতালে ভর্তি বা ভ্রমণ ইত্যাদি অনিবার্য কারণে পিতা-মাতাকে শিশুদের থেকে যদি আলাদা থাকতেই হয় তাহলে আগে থেকেই তা তাদেরকে অবহিত করা উচিত। সমীক্ষায় দেখা গেছে, মায়েরা যদি শিশুদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত না করেই বাইরে চলে যান তাহলে শিশুরা সাধারণত মানসিক চাপের শিকার হয় ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নিমজ্জিত হয়। এমনকি কখনও কখনও শিশু মনে করে যে, তার মা মারা গেছে। তাই সাময়িক বিচ্ছিন্নতার কোন ঘটনা সামনে থাকলে শিশুদের তা আগাম অবিহত করতে হবে, যাতে তারা বিচ্ছিন্নতাজনিত পরিস্থিতিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে। বিচ্ছিন্নতা বিষয়ে ছেলেমেয়েকে অবহিত করতে হয় খুব সাধারণ ও অনাড়ম্বর ভাষায় এবং প্রয়োজন হলে সেই সাথে তাদেরকে খেলাধূলার উপকরণ দিয়ে বুঝাতে হবে।
একটি শিশুকে যখন কোন কাজে অংশগ্রহণ ও দায়িত্ব নেয়া থেকে বিরত রাখা হয় তখন ভিতরে ভিতরে সে রাগান্বিত হয় ও অনুশোচনাবোধ করে। এই রাগান্বিত ভাব এক সময় তার মধ্যে অপরাধবোধের জন্ম দেয়। এ অবস্থায় শিশুর জীবন বিকাশে অপর্যাপ্ততা দেখা দেয়। অর্থাৎ শিশুর দক্ষতা বৃদ্ধি, যেমন- জুতার ফিতা বাঁধা, সাইকেলে চড়া, ঘরের দরজা-জানালা ঠিকমতো বন্ধ করা ইত্যাদি শেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় নেয়। পিতামাতার তরফ থেকে একজন শিশুকে সহায়তা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ধৈর্য ও প্রয়োজন মতো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়া। এসব ক্ষেত্রে সহানুভূতি বজায় রাখা এবং ‘কাজটি খুব কঠিন’ এই জাতীয় কথা বলা খুবই জরুরি। এই পন্থায় একটি শিশুর আত্মবিশ্বাস উন্নত হয়। কাজটিতে সে যদি সফল হয় তাহলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে ও খুশি হবে। আর যদি ব্যর্থও হয় তাহলে নিরুৎসাহিত হবে না। পিতামাতা কোন কঠিন কাজ সম্পাদনে শিশুকে সহায়তা করে তার কাজকে সহজ করে দিতে পারেন, এতে শিশুর সাথে পিতা-মাতার আন্তরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, সকল ক্ষেত্রে শিশুদের দক্ষতা প্রশ্নে পিতামাতার উচিত হবে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ না করা।
পিতামাতা কখনও একে অপরের সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলে শিশুদের মনে তার একটি প্রতিক্রিয়া হয়। শিশুরা মনে করতে পারে যে, তাদের কারণেই হয়তো পিতা-মাতা ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছেন। তখন তারা হয় পিতা, না হয় মায়ের পক্ষ নেয়। এসব ঘটনা শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। পিতা ও পুত্র অথবা মাতা ও কন্যার মধ্যে মতানৈক্য পরিবারের মধ্যে একজন পুত্র ও কন্যার যথাযথ ভূমিকা জানা ও পালন করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। একজন পিতাকে তাঁর পুত্রের ভাবী পিতা হওয়ার দিকে খেয়াল রেখে এই মর্মে সচেতন থাকতে হবে যে, সে তার পরিবার থেকে কী অভিজ্ঞতা অর্জন করছে! মাতা ও কন্যার ব্যাপারেও অনুরূপ সচেতনতা প্রয়োজন।
পিতা-মাতা যদি তাঁদের সন্তানদের কাছে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পাওয়ার প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, তাহলে তাতে সন্তানদের মধ্যে মিথ্যা, প্রতারণা ও গোপন করার শিক্ষা বিস্তার লাভ করবে।
সন্তান লালন-পালন খুবই কঠিন কাজ। তাই সকল পিতামাতাকে তাঁদের সন্তানদের জন্য পরিবারে একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
কিছু কিছু সমাজে জীবনযাত্রার আধুনিকতম পদ্ধতি ও বিশেষ ধরনের পরিবেশের দরুন শিশুরা সীমাবদ্ধতা বোধ করে। এই ধরনের বিধি-নিষেধ শুরু হয় একেবারে শৈশব থেকে। উদাহরণস্বরূপ, কোন শিশুকে হয়তো বিছানার ওপর দাঁড়াতে দেয়া হয় না বা কোন শিশুকে চেয়ার বা সিঁড়িতে উঠতে দেয়া হয় না। শিশুদেরকে ড্রইং রুমের মতো জায়গাগুলোতেও দৌড়াদৌড়ি বা খেলাধূলা করতে দেয়া হয় না। এই ধরনের বিধি-নিষেধ বা সীমাবদ্ধতা শিশুদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হতে পারে। শিশুদের জন্য কিছুটা কায়িক পরিশ্রম প্রয়োজন। এ কারণে তাদের জন্য দৌড়াদৌড়ি ও খেলাধুলার উপযোগী জায়গা ও পরিবেশের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।
মোট কথা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সকল দিক ও বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে এ কথা বলা চলে যে, ছেলেমেয়েরা হয় পিতা-মাতার প্রতিবিম্ব এবং পিতা-মাতার আচার-আচরণ শিশুদের দেহ ও আত্মায় প্রভাব ফেলে। ছেলে-মেয়েদেরকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে পিতা-মাতা ও শিশুর মধ্যে সঠিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ও বজায় রাখা।
অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করে যে, উৎসাহ দান একটি শিশুর মধ্যে আত্ম-নির্ভরতা ও নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত করে। আবার সত্যিকার অর্থে উৎসাহ দান কখনও কখনও উত্তেজনা ও দুর্ব্যবহারের কারণ হতে পারে। কিন্তু কেন? যখন কোন পিতা-মাতা তাঁদের শিশুকে বলেন : ‘তুমি কতই ভালো!’ এতে এমনটি ঘটারও সম্ভাবনা থাকে যে, শিশুটি এই কথাটি ভালোভাবে গ্রহণ করছে না, কারণ, তার সম্পর্কে তার নিজের ধারণা অত উচ্চ নয়। এ ধরনের অতিরিক্ত উৎসাহ ও অতিরিক্ত প্রশংসায় সে অধিকতর খারাপ আচরণ শুরু করতে পারে। কেননা, শিশুটি প্রকৃতপক্ষে যা তাই তা প্রকাশ করবে। কোন কোন পিতা-মাতা জানিয়েছেন যে, একটি ভালো কাজের জন্য প্রশংসতি হওয়ার পর এমনভাবে সে আচরণ করতে থাকে যে, সে যেন ঐ উৎসাহ ও প্রশংসা প্রত্যাখ্যান করতে চায়। এর অর্থ এই নয় যে, শিশুদেরকে উৎসাহ দান বন্ধ করতে হবে, কিন্তু এটা করতে হবে একজন হুশিয়ার ডাক্তারের মতো পেনিসিলিন ওষুধ প্রদানের পন্থায়। যথেচ্ছভাবে বা বেপরোযা পন্থায় নয়। ওষুধ প্রয়োগের সময় যেমন কতকগুলো নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, তেমনি এসব ব্যাপারেও নিয়ম-কানুন মেনে চলা অপরিহার্য। প্রশংসা করারও কতকগুলো নিয়ম আছে, সঠিকভাবে তা অনুসরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিশুকে উৎসাহ দিতে হবে তার কাজ শেষ করার পর। যে কাজটি সম্পন্ন হয়েছে তার চেষ্টা-সাধনের জন্য-তার ব্যক্তিত্ব ও মানগত অবস্থার জন্য নয়।
উৎসাহ দানের দু’টি দিক রয়েছে : ১. পিতা-মাতার কথাবার্তা এবং ২. শিশুর অনুধাবন ক্ষমতা ও ধারণা। শিশুটির কাজ, সে ব্যাপারে তার প্রচেষ্টা ও কাজের ফলাফল সম্পর্কে পিতা-মাতার বক্তব্য হতে হবে সুস্পষ্ট এবং শিশুর সৃষ্টিশীলতা ও বিভিন্ন কাজে তার সহায়তার প্রসংসা করতে হবে।
শিশুদেরকে কখনও নিরুৎসাহিত করা উচিত নয়। এ ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা দরকার : দুর্ঘটনাক্রমে একটি শিশু নাশতার টেবিলে বসে একটি গ্লাসের দুধ ঢেলে ফেললো। এমন সময় শিশুটির মা রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে বহুবার বলেছি সাবধান হতে।’ শিশুটির পিতা বললেন, ‘একথা বলে কোন লাভ নেই। সেতো সব সময়ই তার দুধ ঢেলে ফেলে।’ এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, এক গ্লাস দুধের মূল্য খুবই কম, কিন্তু এই ধরনের কথাবার্তায় শিশুটির মধ্যে আস্থার অভাব সৃষ্টি হয় যার পরিণতিতে অনেক ক্ষতি দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, তখনই সে ত্রুটি করে। তার ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে এমন কোন শিক্ষামূলক কথা বলা ঠিক নয়। ঐ সময় সমস্যাটির প্রকৃত সমাধান কি সেটাই দেখিয়ে দিতে হবে।
তারপরে কি করতে হবে তা দেখতে হবে। এমন সময় মাকে বলতে হবে : ‘ও তুমি দুধ ফেলে দিয়েছ। ঠিক আছে, এখানে আরেক গ্লাস দুধ আছে। আর এখানে ফেলে দেয়া দুধটুকু মুছে ফেলার মতো স্পঞ্জ আছে।’ একথা বলে মায়ের উচিত শিশুকে আরেক গ্লাস দুধ দেয়া। এভাবে একটি সমস্যা একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতায় মোড় নিতে পারে।
অপ্রিয় ও নির্দয় শব্দ চয়ন বিষাক্ত তীরের মতো; এ জাতীয় শব্দাবলি প্রতিপক্ষীয় শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা চলে, শিশুদের ক্ষেত্রে নয়।
কেউ যদি কখন বলে, ‘এই চেয়ারটির ধরন ভালো নয়’, তাহলে চেয়ারটির কোন ক্ষতি হয় না। তাতে চেয়ারের মান কমে যায় না, চেয়ারটি যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই থাকবে। কিন্তু যখন কোন শিশুকে অসভ্য, বোকা ও বিশ্রী বলা হয়, তখন তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সে রাগান্বিত, মনঃক্ষুণ্ন ও বিরক্ত হতে পারে এবং তার মধ্যে একটি প্রতিবাদ প্রতিশোধের মনোবৃত্তি জাগ্রত হতে পারে। সংক্ষেপে বলা চলে, সে এমন এক পন্থায় প্রতিক্রিয়া দেখাবে যে, সে ঐ ত্রুটিকেই গ্রহণ করে সেভাবেই নিজেকে প্রকাশ করবে। যখন কোন শিশুকে কটু কথা বলা হয়, তখন প্রথমত সে তা মেনে নেয় না। কিন্তু সে মনে মনে ভাবতে থাকে যে, তার পিতা-মাতা হয়ত তাকে মন্দ মানুষ বলেই ভাবে এবং তার প্রতি তার পিতা-মাতার কোন ভালবাসা নেই। অনুরূপভাবে পিতা-মাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকা যদি নিয়মিতভাবে কোন শিশুকে নির্বোধ বলতে থাকেন তাহলে ভাবতে পারে যে, আসলেই সে হয়ত নির্বোধ। কাজেই শেখার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।
পিতা-মাতাকে তাদের শিশুদের এই ধরনের আবেগ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এই ধরনের ঘটনার মধ্যে শিশুদেরকে সঠিক শিক্ষা দেয়া এবং আবেগের মুহূর্তে তাদের সাথে সঠিক আচরণ করা পিতামাতার দায়িত্ব। আবেগে বাধাদান শিশুকে পরিবারে তার অবস্থান সম্পর্কে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। শিশুরা সব সময় চায় তাদের প্রতি পিতা-মাতার স্নেহ-মমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। পরিবারে যখন কোন নতুন শিশু আসে তখন আগের শিশুটির মনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ জাগ্রত হয়। সে ভাবে যে, নতুন শিশুটির চাহিদা মেটাতে পিতা-মাতার যে বাড়তি ভালোবাসা তা পাওয়া সম্ভব হবে না। এজন্য পিতা-মাতার যে বাড়তি সময় ব্যয় হবে তাতে তার আর পিতা-মাতার ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব হবে না। এজন্য পিতা-মাতার উচিত হবে সংক্ষিপ্ত হলেও পূর্বের শিশুটির জন্য একান্ত কিছু সময় দান করা, বিশেষ করে নবজাতকের দিবাভাগে নিদ্রার সময়। এমনকি নবজাতকের পরিচর্যাসহ পিতা-মাতার সকল কর্মকাণ্ডে বড় শিশুকেও সাথে রাখা উচিত।