অসত আনন্দের চেয়ে পবিত্র বেদনা মহত। কারণ, পবিত্র বেদনা মানুষকে যোগায় শক্তি। তাই মানুষের জন্য কোনো কোনো বেদনা বা শোকেরও রয়েছে অশেষ শক্তি এবং গুরুত্ব। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) শৈশবেই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র গলায় মাঝে মধ্যে চুমো খেতেন এবং সেসময় তিনি কাঁদতেন।
তিনি বলেছিলেন, “ হুসাইন আমার থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে।”
কারণ, নানার ধর্মকে রক্ষার জন্য নবী পরিবারের বহু সদস্যসহ প্রিয় নাতী যে শাহাদত বরণ করবেন তা বিশ্বনবী (সা.) জানতেন। পবিত্র কুরআনে শহীদদেরকে জীবন্ত বলা হয়েছে। আজ বিশ্বের বুকে ইমাম হুসাইন (আ.)’র মত জীবন্ত সত্তা আর কি কেউ আছেন? শাহাদতের মাধ্যমে কারবালার বীর শহীদান ইসলামকেই প্রাণ যুগিয়ে গেছেন চিরদিনের তরে।
তাই তো বাংলাদেশের জাতীয় কবি বলেছেন:
আঁজলা ভরে আনলো কি প্রাণ কারবালাতে বীর শহীদান ?
মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে রাজা, বাদশাহ, ধনী-ফকির সবাইই যুগ যুগ ধরে অশ্রুর নদী বইয়ে যাচ্ছেন ইমাম হুসাইনের (আ.)জন্য। এক সময় ইসলামের শত্রু বনি উমাইয়ারা বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের নাম নিশানাই বিশ্বের বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা তো সফল হয়নি, বরং ইসলামের জন্য নবী পরিবার তথা আহলে বাইতের সদস্যদের চরম আত্মত্যাগ মহাকালের পাখায় তাদের নাম চিরস্থায়ী, চির-অম্লান করে রেখেছে। বিশ্বের মুসলমানদের কণ্ঠে সব সময় শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হচ্ছে তাঁদের নাম।
অন্যদিকে কেউ তাঁর শিশুর নামটিও ইয়াজিদ, মুয়াবিয়া, আবু সুফিয়ান, শিমার বা ইবনে জিয়াদ ইত্যাদি রাখে না।
সম্পদ ও ক্ষমতা-লোভী উমাইয়ারা ইসলামী সমাজ পরিচালনার মত যথেষ্ট ধার্মিক এবং যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতক ও শয়তানের দোসরে পরিণত হয়। ইমাম হুসাইন (আ.)’র সেই কালজয়ী আত্মত্যাগ ও মহাবিপ্লব ইসলামকে চিরতরে নির্মূলের এবং মানবিকতা ও ধর্মের সম্মান ধ্বংসের প্রক্রিয়া রুখে দিতে সক্ষম হয়।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.) তাঁর সাহাবী রাইয়ান ইবনে ইবনে শাবিবকে বলেছিলেন:
হে ইবনে শাবিব! আইয়ামে জাহিলিয়্যার যুগ তথা অজ্ঞতার যুগেও লোকেরা মহররম মাসে দমন-পীড়ন চালাত না এবং যুদ্ধ ও সংঘাতে লিপ্ত হত না। এসব ছিল সে সময় নিষিদ্ধ। অথচ (ইয়াজিদের যুগে) মুসলমানরাই এ পবিত্র মাসের ও তাদের নিজ নবী (সা.)’র প্রতি মর্যাদা দেখায়নি (কারবালার ঘটনা প্রবাহের সময়)। তারা এই মাসেই নবী(সা.)’র বংশধরকে হত্যা করেছে। …. আল্লাহ তাদের কখনও ক্ষমা করবেন না।
হে ইবনে শাবিব! তুমি যদি কাঁদতে চাও, তাহলে হুসাইনের (আ.) জন্য কাঁদ যাকে হত্যা করা হয়েছিল ভেড়ার মত। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাথে। তাঁর সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল এমন ১৮ ব্যক্তিকে বিশ্বে যাদের সমকক্ষ আর কেউ ছিল না। সাত আকাশ ও সাত জমিন তাঁর শাহাদতে শোক প্রকাশ করেছে।
হে ইবনে শাবিব! যদি তুমি ইমাম হুসাইন (আ.)’র জন্য এমনভাবে কাঁদ যে তোমার গণ্ডদেশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তাহলে আল্লাহ তোমার সব ছোট বড় গোনাহ মাফ করবেন তা সেইসব গোনাহর সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন।
হে ইবনে শাবিব! যদি তুমি নিষ্পাপ অবস্থায় মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাও তাহলে ইমাম হুসাইন (আ.)’র মাজার জিয়ারত করতে যাও।
হে ইবনে শাবিব! যদি তুমি বেহেশতে আমাদের সঙ্গে উচ্চ মর্যাদা নিয়ে থাকতে চাও তাহলে আমাদের দুঃখে দুঃখী এবং আমাদের সুখে সুখী হও।
সুন্নি হাম্বালি মাজহাবের প্রধান ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল ‘আল মুসনাদ’ বইয়ে একটি বিখ্যাত ঘটনা বা হাদিস উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি হল, মুহাম্মাদ বিন উবাইদ বলেছেন শারহাব বিন মালিক থেকে, তিনি জেনেছেন আবদুল্লাহ বিন নুজাই থেকে, নুজাই জেনেছেন তার বাবার কাছ থেকে যে,
তিনি হযরত আলী (আ.)’র সঙ্গে যাচ্ছিলেন সিফফিনের দিকে (বিদ্রোহী মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের জন্য)। যখন তাঁরা নেইনাভা বা নিনেভায় পৌঁছলেন তখন তাঁরা উচ্চস্বরে চিতকার করে বললেন: “ হে আবা আবদুল্লাহ! ধৈর্য ধর। হে আবা আবদুল্লাহ! ধৈর্য ধর ফোরাত নদীর পাশে।” নুজাইর বাবা তখন বললেন: কেন এ কথা বললেন? হযরত আলী (আ.) বললেন:
একদিন আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে গিয়ে দেখি তিনি কাঁদছেন। আমি প্রশ্ন করলাম: হে আল্লাহর নবী কেন আপনি ব্যথিত হলেন? রাসূল (সা.) বললেন: কিছুক্ষণ আগে জিবরাইল এসেছিলেন। তিনি আমাকে জানালেন যে হুসাইন (আ.) ফোরাত নদীর পাশে নিহত হবে। তখন তিনি অর্থাত রাসূল (সা.) বললেন: তুমি কি তাঁর নিহত হওয়ার স্থানের মাটির ঘ্রাণ নিতে চাও। আমি বললাম: হ্যাঁ। তিনি তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং এক মুঠো মাটি আমাকে দিলেন। ফলে আমার চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল অনিয়ন্ত্রিতভাবে।
শহীদদের সর্দার হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র মর্মান্তিক শাহাদত নিয়ে যিনি সর্ব প্রথম শোক গাঁথা রচনা করেছেন তিনি হলেন হযরত যেইনাব (সা.)।
“ হে মুহাম্মাদ (সা.)! হে মুহাম্মাদ(সা.)! আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা তোমার ওপর দরুদ ও সালাম পাঠায়। আর এই তোমার আদরের হুসাইন, কী ভীষণভাবে লাঞ্ছিত, অবহেলিত, রক্তাপ্লুত খণ্ডিত লাশ হয়ে আছে! আল্লাহর কাছে নালিশ জানাচ্ছি।
হে মুহাম্মাদ (সা.)! তোমার কন্যারা আজ বন্দিনী, তোমার জবাই করা পরিবার আজ অপেক্ষা করছে পূবের হাওয়ার জন্য, কখন ধুলো এসে তাঁদের ঢেকে দেবে!”
হযরত যেইনাব (সালামুল্লাহি আলাইহার) মর্মভেদী বিলাপ শত্রু-মিত্র সবাইকে অশ্রু সজল করে তুলেছিল। হযরত যেইনাব (সা.)’র বিলাপ ও বাগ্মীতাপূর্ণ ভাষণ কাঁপিয়ে তুলেছিল কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবার এবং দামেস্কে ইয়াজিদের দরবার। তাঁর ভাষণ জনগণের ঘুমিয়ে পড়া চেতনায় বিদ্যুতের প্রবাহ ছড়িয়ে দেয়। ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত ইয়াজিদ নবী-(সা.)’র পরিবারকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে হযরত যেইনাব (সা.)ই সর্বপ্রথম কারবালার শহীদদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে শোক-অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে সক্ষম হন। দামেস্কেই একটি বাড়ী শোক-সমাবেশের স্থান হিসেবে ঠিক করা হয়।
দামেস্কের অনেক মহিলা আসলেন সেই শোক অনুষ্ঠানে। কিন্তু তারা ছিল উতসবের সাজে সজ্জিত। হযরত যেইনাব (সা.) তাদেরকে শোকের পোশাক পরে আসতে বলেন। ফলে তারা অলঙ্কার ও সাজ-সজ্জা ছেড়ে কালো পোশাক পরে ফিরে আসেন। ইতিহাসে সেটাই ছিল নবী (সা.) পরিবারের জন্য প্রথম আনুষ্ঠানিক শোক-পালন। এভাবে চালু হয় আশুরার শোক পালনের প্রথা যা ছড়িয়ে পড়ে গোটা মুসলিম জগতে।
এভাবে শাহাদত মুসলিম সমাজের প্রাণশক্তি ও জীবনের সঞ্চার করে। কারবালার বীর শহীদান হয়ে পড়েন আগের চেয়েও জীবন্ত। কারবালায় সংঘটিত মর্মান্তিক ও বীরত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর প্রতিটি মুহূর্তের বর্ণনা এভাবেই ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে গেছে শোক-গাঁথা ও বিলাপের সুবাদে।
নিজ নিবাস মদীনায় ফিরে এসে হযরত যেইনাব (সা.) কারবালার ট্র্যাজিক ঘটনা প্রচার ও শোক-প্রকাশ অব্যাহত রাখেন। ফলে জনগণ সচেতন হয়ে উঠতে থাকে এবং হুসাইন (আ.)-কে যথাসময়ে সাহায্য করতে না পারার জন্য তারা বিবেকের দংশনে জ্বলতে থাকে।
কারবালায় নবী(সা.) পরিবারের ওপর হত্যাযজ্ঞের ও চরম নির্যাতনের খবর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। সেখানে রাসূল (সা.)’র স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালমা (সা.) স্মরণ করেন রাসূল (সা.)র সেই ভবিষ্যদ্বাণী যা তিনি তাঁর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে বলেছিলেন ৫০ বছর আগে। মুমিনদের জননী কাঁদলেন ও শোক প্রকাশ করলেন। পুরো মদীনা শহরে ধ্বনিত হতে লাগল শোকের মাতম “ইয়া হুসাইন ইয়া হুসাইন”।
হযরত আলী (আ.)’র বিধবা স্ত্রী উম্মুল বানিন (সা.) ছিলেন হযরত আবুল ফজল আব্বাস (রা.)’র মাতা। অর্থাত হযরত আব্বাস (রা.) ছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র সত ভাই। তিনি কারবালায় ইমাম শিবিরের অন্যতম প্রধান সেনাপতি ও পতাকাধারী ছিলেন। শত্রুদের চরম হামলা প্রতিহত করে তিনি পানি আনার চেষ্টা করেছিলেন। ফোরাতেও নেমেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রায় তিন দিন ধরে তৃষ্ণার্ত থাকা সত্ত্বেও ভাই ইমাম হুসাইন (আ.)সহ ইমাম শিবিরের সবার তৃষ্ণার্ত অবস্থার কথা ভেবে তিনি পানি পান করেননি। মশক ভরে পানি আনার পথে তাঁর দুই হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল শত্রুদের হামলায়। তা সত্ত্বেও তিনি দাঁত দিয়ে মশক কামড়ে ধরে ইমাম শিবিরের পিপাসার্ত শিশুদের জন্য পানি আনার চেষ্টা করে যান শেষ পর্যন্ত, কিন্তু শত্রুদের প্রচণ্ড হামলার কারণে ব্যর্থ হন। আর এ জন্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত শহীদ হতে হয়েছিল। এই মহান শহীদের মা তথা হযরত আলী (আ.)’র বিধবা স্ত্রী উম্মুল বানিন তাঁর ঘরে ইমাম হুসাইন (আ.)সহ কারবালার শহীদানদের জন্য শোক প্রকাশের আয়োজন করেছিলেন। মহিলারা সমবেত হয়েছিল সেই শোকের মজলিসে।
হযরত উম্মুল বানিন (সালামুল্লাহি আলাইহা) নিজের ছেলের চেয়েও ইমাম হুসাইন (আ.)-কে বেশি ভালবাসতেন। ইমামের শাহাদতের খবর শুনে তিনি বলেছিলেন: আমার হৃদয়ের সব ধমনী ছিঁড়ে গেছে। আমার সব সন্তান এবং নীল আকাশের নীচে থাকা সব কিছু ইমাম হুসাইন (আ.)’র জন্য কুরবানি হোক।
হযরত উম্মুল বানিন ছিলেন একজন বড় কবি। তিনি ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)’র জন্য শোকগাথা আবৃত্তিকারী প্রথম ব্যক্তি। তিনি নিয়মিত জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে অত্যন্ত করুণ সুরে শোক-গাঁথা গাইতেন। তার শোকগাথা শুনে উপস্থিত সবাই কেঁদে আকুল হতেন। এভাবে তিনি মদীনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানকে ইমাম হুসাইন (আ.)’র জন্য শোক প্রকাশের কেন্দ্রে পরিণত করেন। হযরত উম্মুল বানিন (সা.)’র রচিত শোক-গাঁথাগুলো আরবী সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। এসব শোকগাথা বা মর্সিয়া ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল জনগণের ওপর। আর এ জন্যই কারবালার ট্র্যাজেডি সৃষ্টিকারী উমাইয়া শাসকরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এ ধরনের শোক-প্রকাশের প্রথাকে বিলুপ্ত করার জন্য ও এ বিষয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য নানা প্রচারণা চালাত। #
রেডিও তেহরান