ইদানিং একশ্রেণীর মানুষ আশুরা কেন্দ্রিক আলোচনায় আশুরার দিন রোজা পালনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ একটি সুন্নত রোজা হিসাবে প্রচার করছেন। আসলে কি এই রোজাটি মহানবী (স.) পালন করে ছিলেন ? আহলে সুন্নতের অনুসারীগণ উল্লেখিত রোজাটির সনদ বা প্রমাণস্বরূপ বিভিন্ন রেওয়ায়েত উপস্থাপন করে থাকেন যা থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে আশুরার দিন রোজা পালন একটি ফজিলতপূর্ণ সুন্নত রোজা। অথচ আহলে সুন্নাতের গ্রহণযোগ্য ঐসব হাদিস গ্রন্থ গুলোতেই এমন অনেক হাদিস রয়েছে যা তাদের উপস্থাপিত হাদিস সমূহের সম্পূর্ণ বিরোধী। আর ঐ সকল হাদিস গুলোই প্রমাণ করে যে আশুরার রোজা পালন কেন্দ্রিক সমস্ত হাদিসই জাল বা বানোয়াট হাদিস সমূহের অর্ন্তভুক্ত।
এবার একটু লক্ষ্য করুন: আহলে সুন্নাতের মনীষিগণ যে হাদিস গুলোর উপর ভিত্তি করে আশুরার দিন রোজা পালন মুস্তাহাব ফতোয়া দিয়েছেন তা’হলো নিম্নরূপ:
উদহারণ স্বরূপ
(১)ইসলামপূর্ব জাহিলিয়্যাত যুগের অনুসরণ করে মহানবী (সা.) আশুরার দিন রোজা পালন করেন:
عَنْ عَائِشَةَ رضی الله عنها قَالَتْ: کَانَ یَوْمُ عَاشُورَاءَ تَصُومُهُ قُرَیْشٌ فِی الْجَاهِلِیَّةِ، وَکَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلی الله علیه وسلم یَصُومُهُ، فَلَمَّا قَدِمَ الْمَدِینَةَ صَامَهُ، وَاَمَرَ بِصِیَامِهِ، فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ تَرَکَ یَوْمَ عَاشُورَاءَ، فَمَنْ شَاءَ صَامَهُ، وَمَنْ شَاءَ تَرَکَهُ
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহিলিয়্যাতের যুগে কুরাইশগণ ‘আশূরার রোজা পালন করত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ সাওম পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখনও এ সাওম পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমযানের সাওম ফরয করা হল তখন ‘আশূরার সাওম ছেড়ে দেয়া হল, যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না। [সহি বোখারী/পরিচ্ছেদঃ ১২৫১. আশুরার দিনে সাওম পালন করা/হাদিস নম্বর ১৮৭৬ ]
(২) আশুরা সংক্রান্ত রোজা পালন সম্পর্কে মহানবী (সা.) কিছুই জানেন না !!
حَدَّثَنَا اَبُو مَعْمَرٍ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَارِثِ حَدَّثَنَا اَیُّوبُ حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَعِیدِ بْنِ جُبَیْرٍ عَنْ اَبِیهِ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ – رضی الله عنهما – قَالَ قَدِمَ النَّبِیُّ – صلی الله علیه وسلم – الْمَدِینَةَ. فَرَاَی الْیَهُودَ تَصُومُ یَوْمَ عَاشُورَاءَ. فَقَالَ «مَا هَذَا». قَالُوا هَذَا یَوْمٌ صَالِحٌ. هَذَایَوْمٌ نَجَّی اللَّهُ بَنِی اِسْرَائِیلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ. فَصَامَهُ مُوسَی. قَالَ «فَاَنَا اَحَقُّ بِمُوسَی مِنْکُمْ». فَصَامَهُ وَاَمَرَ بِصِیَامِهِ؛
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করেন তখন দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীগণ ‘আশূরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেনঃ কি ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে সাওম পালন কর কেন?) তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মূসা (আলাইহিস সালাম) সাওম পালন করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে রোজা পালন করেন এবং রোজা পালনের নির্দেশ দেন। [সহি বোখারী/পরিচ্ছেদঃ ১২৫১. আশুরার দিনে সাওম পালন করা/হাদিস নম্বর ১৮৭৮]
উপরোক্ত হাদিসদ্বয়ের পর্যালোচনা
উপরোক্ত হাদীসদ্বয় পরস্পর বিরোধী হাদিস। কেননা (১) প্রথম হাদিসটিতে উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্নিত হয়েছে যে কুরাইশরা জাহিলিয়্যাতের যুগের অনুসরণ করে যে রোজা রাখতেন সে রোজা মহানবীও (সা.) মক্কার জীবনে [তেরটি বছর] যখন ইসলামী শরিয়াতের রোজা পালনের নির্দেশ আসেনি তখন থেকেই আশুরার দিন রোজা পালন করেন। অতপর তিনি যখন মদিনাতে আগমন করেন তখন রমজান মাসের রোজা পালনের নির্দেশের কারণে আশুরা সংক্রান্ত রোজা পরিত্যাগ করেন এবং আশুরার রোজা পালন হয়ে যায় একটি ঐচ্ছিক বিষয়।
অথচ (২) দ্বিতীয় হাদিসটিতে বলা হচ্ছে মহানবী (স.) মদিনাতে আগমনের পূর্বে আশুরা সংক্রান্ত রোজার খবরই জানতেন না এবং মদিনাতে আগমনের পর যখন ইহুদীদের মাধ্যমে জানতে পারলেন তখন তিনি অত্যন্ত বিষ্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলেন; কেন তারা এদিনে রোজা পালন করেন? তাদের উত্তর শুনে তিনি খুশী হয়ে রোজা পালন করা শুরু করলেন এবং অন্যদেরকেও রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন!! এবার আসুন তৃতীয় শ্রেণীর হাদিস গুলোর প্রতি লক্ষ্য করি।
(৩) রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পরপরই আশুরার দিন রোজা পালন পরিত্যাগ করা হয়।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضی الله عنهما قَالَ: صَامَ النَّبِیُّ صلی الله علیه وسلم عَاشُورَاءَ، وَاَمَرَ بِصِیَامِهِ، فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ تُرِکَ. وَکَانَ عَبْدُ اللَّهِ لاَ یَصُومُهُ،
আবদুল্লাহ ইব্ন উমর (রাঃ) বলেন: মহানবী (সা.)আশুরার দিন রোজা পালন করতেন এবং রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে যখন রমজান মাসের রোজা পালন ফরজ হলো তখন আশুরার রোজা পরিত্যাগ করা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর আশুরার রোজা পালন করতেন না।[সহি বোখারী/৩য় খন্ড/২৪ পৃষ্ঠা/১৮৯২ নম্বর হাদিস/ কিতাবুল সাওম রমজান মাসে রোজা ফরজ পরিচ্ছদ]
(৪) রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক ইহুদী ধর্মের শরিয়ত পালন বা পালনে মহানবীর (সা.) সম্মতি প্রকাশ:
وَکَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلی الله علیه وسلم یُحِبُّ مُوَافَقَةَ اَهْلِ الْکِتَابِ فِیمَا لَمْ یُؤْمَرْ فِیهِ بِشَیْ ءٍ….؛
রাসুলুল্লাহ আহলে কিতাবদের (ইহুদী ও খৃষ্টান) শরীয়ত অনুসরণ করতে পছন্দ করতেন বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ অবর্তীণ হয়নি। [সহি বোখারী/ ৪র্থ খন্ড/২৬৯ পৃষ্ঠা/৩৫৫৮ নম্বর হাদিস]
(৫) মহানবী (সা.) আশুরা উপলক্ষে রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু তিনি নিজে রোজা রাখেননি।
ان رسول الله صلی الله علیه وسلم امر بصوم عاشوراء وکان لا یصومه
রাসুলুল্লাহ আশুরার রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু তিনি নিজে রোজা রাখতেন না। [ইবনে হাজার হিসামী/ মাজমাউজ জাওয়ায়েদ গ্রন্থ/ ৩য় খন্ড/ ১৮৭ নম্বর পৃষ্ঠা]
সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
(১) ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত যে তৎকালীন ইহুদীদের বর্ষপঞ্জি ছিল সৌরবর্ষ অনুযায়ী । আর আরবী বর্ষ হলো চন্দ্রবর্ষ অনুসারে । তাই ১০ অক্টোবর ইহুদীদের Yom Kippur দিবস কখনও আশুরার দিনের সাথে একত্রে একই দিন হতে পারে না। বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রতি ৩৬ বছর পর একবার আশুরা ও ১০ অক্টোবর ইহুদীদের Yom Kippur দিবস একত্রে অবস্থান করবে । সুতরাং সহি বোখারীর হাদিস অনুযায়ী কেউ যদি ইহুদীদের Yom Kippur দিবস উপলক্ষে রোজা পালন করতে চায় তাহলে তাকে প্রতি অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখতে হবে যার সাথে আশুরার কোন সম্পর্ক নেই । আর যদি ইহুদীদের Yom Kippur দিবস উপলক্ষে আশুরার দিন রোজা রাখতে চায় তাহলে তাকে প্রতি ৩৬ বছর পর পর আশুরার দিনে রোজা পালন করতে হবে।
(২) আমরা জানি রাসুলুল্লাহ (সা.) সোমবার ১২ রবিউল আওয়াল মদীনাতে প্রবেশ করেন। আর এখান থেকেই হিজরী বর্ষের পরিগণনা শুরু। মহানবী (সা.) মদিনায় আগমনের ছয় মাস পর প্রথম রমজান মাস আর ৯ মাস পর মহরম । ইসলামী শরীয়তে হিজরী প্রথম সনে রোজা পালনের ঐশী নির্দেশ প্রাপ্ত হন মহানবী (স.) । সহি বোখারী ও মুসলিমের হাদিস অনুযায়ী মহানবী (সা.) রোজার হুকুম লাভের পর তিনি আশুরার দিন রোজা পালন পরিত্যাগ করলেন। এখন প্রশ্ন পবিত্র মদিনাতে গমনের ৬ মাস পর রমজান আর ৯ মাস পর মহরম তাই মদিনায় আগমনের পর ইহুদীদের ঈদ উপলক্ষ্যে আশুরার দিন রোজা পালনের কোন সুযোগই মহানবী (সা.) পাননি।
১. Moharram মহরম
২. Safar সফর
৩. Robiul Awal রবিউল আউয়াল
৪. Rabius Sani রবিউস সানি
৫. Jamadiul Awal জমাদিউল আউয়াল
৬. Jamadius Sani জমাদিউস সানি
৭. Rajab রজব
৮. Shaban শাবান
৯. Ramjan রমজান
১০. Shawal শওয়াল
১১. Jelkad জিলক্বদ
১২. Jilhaj জিলহজ্জ
(৩) ইহুদীদের রোজা রাখার পদ্ধতি সন্ধ্যা থেকে শুরু করে পরবর্তী দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত অতএব ২৪ ঘন্টা যা মুসলমানদের রোজা পালনের পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। তাই নি:সন্দেহে মুসলিম উম্মাহের শরীয়তের দৃষ্টিতে একটি শরীয়ত বিরোধী কাজ। অতএব মহানবী (স.) এমন শরীয়ত বিরোধী কাজ কখনোই করতে পারেন না।
(৪) সব চেয়ে মজার ব্যাপর হলো রাসুলুল্লাহ জগতের শ্রেষ্ঠ শরীয়তের ধারক ও প্রচারক তাই তিনি ভিন্ন শরীয়তে আমল করবেন এই চিন্তা কখনোই কল্পনা করা যায় না। বিশেষ করে ইবাদতগত বিষয়ে মহান প্রতিপালকের নির্দেশ আসার আগেই রোজা পালন করবেন ধারণা করলে ইসলামী শরীয়তের আরো অনেক বিষয়ে এই সন্দেহ থেকে যাবে যে হয়ত ইসলামী শরীয়তের অনেক হুকুম-আহকাম থাকতে পারে যা ভিন্ন ধর্মালম্বিদের থেকে ধার করে নেয়া হয়েছে। অথবা মহান আল্লাহর নির্দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে। তাই কোন ক্রমেই বিশ্বাস করা যায় না যে মহানবী (স.) ইহুদীদের প্রথা থেকে এমন একটি শরীয়াতকে নিজ ইচ্ছামত কপি করেছেন!!
আশুরার রোজা বনি ওমাইয়াদের মাধ্যমে জন্মলাভ করেছে
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন: إن آل أمیة علیهم لعنة الله ومن أعانهم على قتل الحسین من أهل الشام، نذروا نذرا إن قتل الحسین علیه السلام وسلم من خرج إلى الحسین علیه السلام وصارت الخلافة فی آل أبی سفیان، أن یتخذوا ذلك الیوم عیدا لهم، وأن یصوموا فیه شكرا.
বনি উমাইয়া [আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক] এবং শ্যামের লোকেরা ইমাম হোসাইনকে (আ.) হত্যার জন্যে মানত করে ছিল। তাদের মানত ছিল যদি ইমাম হোসাইনকে হত্যা করে তাদের মসনদকে আবু সুফিয়ানের বংশধরদের মধ্যে বহাল রাখতে পারে তাহলে ঐদিনকে তারা ঈদ পালন করবে এবং আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞাপ্রকাশের জন্যে রোজা পালন করবেন। [ শেইখ তুসী (রহ:) , আমাল গ্রন্থ, ৬৬৭ নম্বর পৃষ্ঠা]