হযরত আলী (আ.)এর আদর্শ সজীব রেখেছেন আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেনী (রহ.)

হযরত আলী (আ.)এর আদর্শ সজীব রেখেছেন আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেনী (রহ.)

আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র আদর্শের পরিপূর্ণতম অনুসারী। এর কারণ, মহানবী (সা.) নিজ হাতে ও নিজের মনের মত করেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁকে। তাঁর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয়েছিল বিশ্বনবী (সা.)’র সুন্নাত ও অনুপম চারিত্রিক সৌন্দর্য্যের আলোকচ্ছটা। মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) কাছেও আলী (আ.) ছিলেন রাসূলের পরই সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় নেতা। কারণ, তিনি মনে করতেন জ্যোতির্ময় এ মহামানব রাসূল (সা.)’র যোগ্যতম উত্তরসূরি বা তাঁরই স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মহাসম্মানিত নেতা। তাঁর মতে বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের সদস্যরাই ছিলেন শেষ নবী (সা.)’র উত্তরসূরী ও মানবজাতির পরবর্তী নেতা।   বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন মানব জাতির সর্বকালের সেরা শিক্ষক। আর তাঁর পরই মানব জাতির সবচেয়ে বড় শিক্ষক হলেন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)। এ মহামানবের প্রতি মরহুম ইমামের অপরিসীম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বা উপলক্ষে। একবার তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “অশেষ সালাম ও দরুদ বর্ষিত হোক রাসূলে আজমের প্রতি যিনি (হযরত আলী-আ.’র মত) এমন এক সৃষ্টিকে নিজের আশ্রয়ে রেখে প্রশিক্ষিত করেছেন এবং তাঁকে মানবতার পূর্ণতায় উন্নীত করেছেন। আমাদের এ মহান মাওলা বা নেতার প্রতি সালাম ও দরুদ যিনি আদর্শ মানব এবং জীবন্ত কোরআন। তাঁর নাম চিরকাল টিকে থাকবে, তিনি মানুষের জন্য মডেল ও আল্লাহর মহতী নাম বা ইসমে আযমের অন্যতম প্রকাশ।”
মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের জীবনধারা অনুসরণের চেষ্টা করেছেন। অত্যন্ত খোদাভীরু বা তাকওয়াশীল ও পরহিজকার হিসেবে এই ইমাম সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত আলেমদের চেয়েও ছিলেন অগ্রবর্তী। বিশ্বনবী (সা.)’র বংশধারায় জন্ম নেয়া এই মহান আলেম আধুনিক যুগেও বিশ্বের প্রধান পরাশক্তির জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রামের ধারা সৃষ্টি করে তাগুতি শক্তিগুলোর ঘুম হারাম করেছিলেন।মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) নিজ জীবনকে ইমাম আলী (আ.)র আদর্শের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে তুলতে সফল হয়েছিলেন বলেই বিশ্বের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মতে, আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) ছিলেন ইসলাম ও কোরআনের বাস্তব প্রকাশ। উন্নত জীবনের সব দিক বা ক্ষেত্রেই (রাসূল সা.’র পর) আলী (আ.)কে মানুষের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ বা দৃষ্টান্ত বলে মনে করতেন এই মহান ইমাম। যেমন, জোহদ বা সংযম সাধনায়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায়, দূর্বল ও বঞ্চিতদের প্রতি দয়ায়, যুদ্ধক্ষেত্রে নির্ভিকতায় ইত্যাদি ক্ষেত্রসহ উন্নত মানব জীবনের সব দিকেই আলী (আ.)-কে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যায়। যেখানে কোমলতা দরকার সেখানে কোমলতায় এবং যেখানে কঠোরতার দরকার সেখানে কঠোরতায়ও তিনি ছিলেন আদর্শ বা দৃষ্টান্ত। মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) দৃষ্টিতে এরকম হাজারও মহান দিক নিয়ে গড়ে উঠেছিল হযরত আলী (আ.)’র মহান ব্যক্তিত্ব।মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) মতে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র মহাবিস্ময়কর ব্যক্তিত্বে কোমলতা ও কঠোরতার মত বিপরীতমুখী নানা দিকের অপূর্ব সংমিশ্রণ ছিল লক্ষ্যনীয়। তিনি ছিলেন একাধারে জাহেদ বা সংযম-সাধক, আরেফ বা খোদাপ্রেমের গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী এবং ধর্মের শত্রুদের মোকাবেলায় অপরাজেয় যোদ্ধা। তিনি জ্ঞান ও জিহাদি তৎপরতায় ব্যস্ত থাকার মাঝেও চালিয়ে যেতেন অর্থনৈতিক তৎপরতা এবং এর পাশাপাশি সক্রিয় থাকতেন রাষ্ট্র পরিচালনায় ও নীতি নির্ধারণে। এরি ফাঁকে সময় দিতেন পরিবারকে ও সন্তানকে প্রশিক্ষিত করার কাজে। আল্লাহর দরবারে গভীর রাতে নির্জন পরিবেশে এবাদত, মুনাজাত ও কাকতি-মিনতি কিংবা গভীর খোদাপ্রেমের আলাপচারিতা তাঁকে বিচ্ছিন্ন করেনি সমাজ থেকে।
মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) মতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা পদের চাকচিক্য কখনই বিন্দুমাত্র আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেনি ইমাম আলী (আ.)’র হৃদয়ে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা পদ তাঁর কাছে কখনও লক্ষ্য ছিল না, ছিল নানা মহৎ উদ্দেশ্য পূরণের মাধ্যম মাত্র। তিনি ইবনে আব্বাসকে বলেছিলেন, “তোমাদের শাসক হওয়া আমার কাছে একটি জুতার চেয়েও কম মূল্যের বিষয়, অবশ্য এই শাসনের মাধ্যমে আমি যদি তোমাদের মধ্যে সত্য বা ইসলামকে প্রতিষ্ঠা ও বাতিল তথা অন্যায্য আইন ও ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করতে পারি তা ভিন্ন কথা।”
মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) মতে, হযরত আলী (আ.)’র শাসন-ব্যবস্থা থেকে উপনিবেশবাদীদের এ ধারণার অসারতা ফুটে উঠে যে রাজনীতি ও ধর্ম পৃথক। মুসলমানদের সামাজিক জীবনের ওপর ধর্মের প্রভাবকে বিলুপ্ত করার জন্যই উপনিবেশবাদীরা ও ইসলামের শত্রুরাই এই প্রতারণাপূর্ণ বা অসুস্থ ধারণা প্রচার করছে বলে মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) মনে করতেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন: রাসূল (সা.)’র যুগে এবং আমিরুল মুমিনিন (আ.)’র যুগে কি রাজনীতি ধর্ম থেকে পৃথক ছিল?”

মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) দৃষ্টিতে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছিল হযরত আলী (আ.)’র শাসন-ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বায়তুল মালের সম্পদ সবার মধ্যে সমান মাত্রায় বণ্টণের নীতি- যা ছিল রাসূল (সা.)’রই সুন্নাত তা পুনরায় চালু করায় হযরত আলী (আ.)’র প্রশংসা করেছেন মুসলিম ও অমুসলিম অনেক মনীষী। তাঁর ৫ বছরের শাসনকালকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ বলে উল্লেখ করেছেন মরহুম ইমাম।
ইমাম আলী (আ.)’র জীবন থেকে অন্যায়, জুলুম, শোষক ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোসহীন ও অকুতোভয় সংগ্রামের শিক্ষা নিয়েছেন এই যুগের মহানায়ক ইমাম খোমেনী (র.)। তিনি একে ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করতেন। ইমাম খোমেনী (র.) ইমাম আলী (আ.)’র মতই বাধা-বিঘ্ন আর সংকটের পাহাড় দেখে হতাশ হতেন ন, আবার বিপুল অনুসারী দেখেও গর্বিত হননি। কঠিনতম মুহূর্তেও ইমাম থাকতেন প্রশান্ত ও অবিচল। তাই জনগণ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল আল্লাহর প্রতি তার এই গভীর আস্থাশীলতায়।

কঠোরতা ও কোমলতার প্রচণ্ড সংমিশ্রণ ঘটেছিল এ যুগের এই মহানায়কের চরিত্রেও। তাই পরাশক্তিগুলোর হৃদয়ে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছিলেন আলী (আ.)’র অনুসারী এই ইমাম যিনি নির্ভিক চিত্তে গভীর আস্থা নিয়ে বলতেন: আমেরিকা আমাদের কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। অন্যদিকে গভীর স্নেহের ধারায় ধন্য করতেন যুব সমাজ ও শিশুদেরকে। ইরাকে নির্বাসিত থাকা অবস্থায় ইমাম খোমেনী (র.) প্রতি রাতেই আমিরুল মুমিনিন (আ.)’র পবিত্র মাজার জিয়ারত করেছেন এবং এক রাতের জন্যও এই জিয়ারত ত্যাগ করেননি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর ভাষায় ইমাম খোমেনী (র.)’র চরিত্রের মধ্যে সমন্বিত হয়েছিল ঈমানী শক্তি ও সৎকর্মের, নৈতিক সাহসিকতার সাথে প্রজ্ঞার, আধ্যাত্মিক পবিত্রতার সাথে বিচক্ষণতার, বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বের সাথে স্নেহ ও দয়া-মায়ার…।”

ইমাম খোমেনী (র.) মনে করতেন, আমিরুল মুমিনিন (আ.)’র প্রশংসা পুরোপুরি ব্যক্ত করা কখনও কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত জ্ঞানী, গুণী, দার্শনিক, আরেফ ও কবিরা তাঁর সম্পর্কে যা বলে গেছেন, তা এ মহাপুরুষের প্রকৃত ব্যক্তিত্বের অতি সামান্য দিক মাত্র। #

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.