সমসাময়িক পশ্চিমা বিশ্ব, ধর্ম এবং ইসলাম
[ড. চার্লস জোসেফ অ্যাডাম্স। কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক। তাঁর জন্ম ২৪ এপ্রিল ১৯২৪ সালে টেক্সাসের হিউস্টনে। টেক্সাসের বেলোর বিশ্ববিদ্যালয় (Bay lore University) থেকে তিনি গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। এই সময় থেকেই প্রফেসর অ্যাডাম্স ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বর্তমানে সাক্ষাৎকারটি তিনি মন্ট্রিলে প্রদান করেন। আমরা আশা করি সুধী পাঠক সমাজ এই সাক্ষাৎকার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারবেন।]
প্রশ্ন : প্রথমেই আমরা জানতে চাইব কি কারণে আপনি ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়টি বেছে নিলেন?
উত্তর : এই প্রশ্নের উত্তর আমার অতীত জীবনের সাথে জড়িত। আমার মা একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান ছিলেন। তাঁর সাথে আমি নিয়মিত চার্চে যেতাম। স্বাভাবিকভাবেই এই ধর্মানুরাগ আমার ওপর এত বেশি প্রভাব বিস্তার করে যে, ১২/১৩ বছর বয়সে আমি ধর্মযাজক হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। অন্তরে এই বাসনা পোষণ করেই আমি কলেজে ভর্তি হই। আমার ধর্মানুরাগের পরিচয় পেয়ে কর্তৃপক্ষ আমাকে বৃত্তি প্রদান করেছিলেন। বছরের শেষেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। চার বছরের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে আমাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে হয়। ওখান থেকে যখন আমি ফিরে আসি তখন খ্রিস্টধর্মের প্রতি কোন আকর্ষণই ছিল না। যাজক হওয়ার বাসনা আমার মন থেকে মুছে যায়। কিন্তু বিশ্ব ধর্মসমূহের ইতিহাস এবং দর্শনের প্রতি আমার সবিশেষ আগ্রহ ছিল। তাই এই বিষয়ের ওপর লেখাপড়া করার সিদ্ধান্ত নেই। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ের ওপর পণ্ডিত জোয়াকিম ওয়াচের সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে ইসলাম ধর্ম অধ্যয়ন করার পরামর্শ দেন। তাঁর অনেক ছাত্রই বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং বিবিধ প্রাচীন ধর্ম বিষয়ে লেখাপড়া করত। কেউ ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহ বোধ করত না। মিস্টার জোয়াকিম আমাকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর রচনা লেখার উপদেশ দিতেন। আমি যখন পিএইচডি লাভ করি তখন ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ-এর ওপর একটি আলাদা ইনস্টিটিউশন খোলা হয়। আমি এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। এই প্রতিষ্ঠানে এসে আমি যা শিখেছি তার চর্চা করা শুরু করলাম। ইতিমধ্যে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় আমার জন্য একটি বৃত্তিরও ব্যবস্থা করল। এভাবে ইসলাম ধর্মচর্চায় আত্মনিয়োগ করি।
তিরিশ বছর বয়স থেকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে ইসলামের অধ্যয়ন এবং আরবি ও উর্দুভাষা শেখা শুরু করি। এর পর থেকে আরব দেশের তুলনামূলক ধর্ম, ধর্মের উৎপত্তি ও ধর্মের ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় প্রবৃত্ত হই। আমার ডক্টরেটের থিসিস ছিল ধর্মের ইতিহাসের ওপর। তবে এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মচর্চার ওপর আমার সবিশেষ আগ্রহ ছিল। ম্যাকগিলে এসে ইসলাম ধর্ম গবেষণায় আমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। বিখ্যাত ইসলাম গবেষক কান্ট ওয়েল স্মিথের (Cant Well Smith) লেখা আমাকে এ কাজে অংশ নিতে উৎসাহ যুগিয়েছিল।
প্রশ্ন : বিভিন্ন ইসলামী দেশে অনেকে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। আবার পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেকে ইসলাম অধ্যয়ন করে থাকে। আপনার দৃষ্টিতে ইসলামী দেশের ধর্মীয় কেন্দ্রে ইসলাম শিক্ষা করা আর পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম শিক্ষা করার মাঝে কি পার্থক্য রয়েছে?
উত্তর : কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ম অনুষদে খ্রিস্টধর্ম অধ্যয়ন আর কোন গির্জায় বা খ্রিস্টীয় শিক্ষা কেন্দ্রে খ্রিস্টধর্ম অধ্যয়নের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, আমি মনে করি এক্ষেত্রেও ঠিক সেরকম পার্থক্য বিদ্যমান। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায়, এই দু’টি ক্ষেত্রে যে পার্থক্য তা বৈজ্ঞানিকভাবে ইসলাম অধ্যয়ন আর গতানুগতিকভাবে ইসলাম অধ্যয়নে যে পার্থক্য তার মতো।
গতানুগতিক শিক্ষাকেন্দ্রে ছাত্ররা কিছু নির্দিষ্ট মূল্যবোধ নিয়ে অগ্রসর হয় এবং এতেই তাদের বিশ্বাস নিবদ্ধ থাকে। কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইসলামের অধ্যয়নে ‘বিশ্বাস’কে আলাদা করে রেখে ধর্মের বিশ্লেষণ করা হয়। এখানে বিশ্বাস প্রয়োজনমাফিক কাজে আসে। ধর্ম অধ্যয়নে বিশ্বাস-এর ভূমিকা একই সাথে আসে না। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে স্বীকার করা হয় যে বিশ্বাস বা ঈমান হলো যে কোন ধর্মের প্রধান স্তম্ভ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথমে নিরপেক্ষভাবে ধর্মের আলোচনা করা হয়, তারপর এর অধ্যয়ন করা হয়। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয় এবং জনপ্রিয় সামাজিক সংস্থাগুলোর সাথে এদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়।
গতানুগতিক ব্যবস্থায় শিক্ষার উদ্দেশ্য থাকে ধর্মীয় বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে তোলা যাতে ছাত্রদের মাঝে নির্দিষ্ট ধর্মের পরিচয়টা পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। যে ধর্ম নিয়ে তারা অধ্যয়ন করে সেই ধর্মকেই শুধু সত্য ধর্ম বলে মেনে নিতে পারে।
প্রশ্ন : খ্রিস্টীয় ধর্মালয়ের গতানুগতিক ধর্মীয় শিক্ষা পদ্ধতি আর মুসলিম দেশগুলোর পুরানো মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতির মাঝে কি কোন পার্থক্য আছে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে এক জটিল ঐতিহাসিক রূপ ধর্মের আবরণে প্রতিষ্ঠিত এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে খ্রিস্টীয় দার্শনিকরা কাজ করেন। এখানে যেমন মৌলবাদ রয়েছে তেমনি ধর্মীয় ব্যাপারে প্রচলিত বিশ্বাসকে অন্ধের মতো আঁকড়ে থাকার প্রবণতাও রয়েছে। তবে এটা বলাও ঠিক হবে না যে, তাদের মাঝে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়েছে। তবে আধুনিক ধর্ম শিক্ষালয়গুলোতে যে সকল খ্রিস্টান ছাত্র অধ্যয়ন করেন সেখানে ছাত্ররা বাইবেলের কোন বর্ণনার সমালোচনাকে খুব গুরুতর মনে করেন। এখানে তাঁরা বাইবেলের শুধু বাণী পাঠ আর এর সাহিত্যিক মূল্যকে পর্যালোচনা করেন না। এর ঐতিহাসিক অবস্থাও পর্যালোচনা করেন। আমি মনে করি, মুসলিম দেশগুলোতে ঠিক এভাবে ব্যাপারটা নেই। সেখানে নানা প্রকার সামাজিক চাপের মুখে ধর্মের প্রবক্তারা যেভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করেন তা ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী ধ্যান-ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্র্ণ। অর্থাৎ ইচ্ছে করেও ইসলামের মৌল বিষয়গুলোকে কেউ বিকৃত করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইসলামের অবমাননার লক্ষ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির অনেক সময় ভুল ব্যাখ্যা করা হয়।
প্রশ্ন : ইসলামী সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্যের ইসলাম গবেষকদের অবদানকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তর : আমি মনে করি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অবদান তাঁরা রেখেছেন তা হলো ইসলামী সংস্কৃতির অনেক মূল্যবান উৎসকে তাঁরা ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। এর পিছনে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও তাঁরা যে যে কাজ করেছেন তা প্রশংসার দাবিদার। বিশেষ করে ইসলামের ইাতহাস নিয়ে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতবর্গের আগ্রহের কারণে অনেকে দুষ্প্রাপ্য ইসলামী পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ, সম্পাদনা করা এবং তা প্রকাশ করার ব্যাপারে উৎসাহ বোধ করেন। এই কাজ না হলে ইসলামের অনেক মূল্যবোন স্মৃতি আজ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যেত। তাই আমার মতে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের এই কাজ ইসলামী সংস্কৃতিতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। ইসলামী সম্প্রদায় বহির্ভূত লোকজনের দ্বারা ইসলামের এই খেদমতে অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের প্রতি যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে তা কোন ছোট ব্যাপার নয়। এরই কাজের ফলে স্বয়ং মুসলমানরা তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ব্যাপারে আরো সচেতন হয়েছে, এর মূল্যায়নে আরো মনোযোগী হয়ে উঠেছে।
প্রশ্ন : পাশ্চাত্যে ইসলামচর্চার ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানরা কেমন ধারণা পোষণ করে বলে আপনার মনে হয়? আপনি জানেন এক্ষেত্রে সন্দেহপ্রবণতাও কাজ করে। এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি? পাশ্চাত্যের হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের আলোকে এই প্রবণতাকে কি আপনার সঠিক বলে মনে হয়?
উত্তর : আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে ওরা কিছুটা সঠিক অবস্থানে রয়েছে। তবে অতীতে এ অবস্থা ছিল এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
আমি আগেও বলেছি, বৈজ্ঞানিক মনোভাব এবং শান্তিপূর্ণ দৃষ্টিকোণে চিন্তা করলে আগের অনেক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিবর্তন সাধিত হয়। সন্দেহ প্রবণতা সত্যিই দুঃখজনক। এই সন্দেহ প্রবণতা না থাকলে মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও যৌথ কার্যক্রম হতে পারত। এটা অবশ্য ঠিক যে, কেউ যদি প্রতিষ্ঠিত কোন ধারণা বা মতবাদের বিপরীত কোন কিছুর অবতারণা করে তাহলে সেই নতুন কিছু যত ভালো ও উন্নতমানের হোক না কেন, অসন্তোষের সৃষ্টি করবে।
এই ক্ষেত্রে একটি ঘটনার কথা আমার স্মরণ হয়। একবার আমি বাইবেলের কিছু বর্ণনার ব্যাপারে সমালোচনার ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমার কাছে এটা অসহ্য মনে হয়েছিল। এটা এক মারাত্মক অপরাধ বলে আমি মনে করেছিলাম আর আমি যাজক এবং ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে যা শিখেছিলাম, যা আমার মনমানসে দৃঢ় আসন গেড়ে বসেছিল- এই সমালোচনা তার মূলে কুঠারাঘাত করেছিল। এই ধরনের পরিস্থিতি আমি কল্পনাই করতে পারছিলাম না। তবুও আমি বিশ্বাস করি, ধর্মকে আরো সম্যকরূপে অবগত হওয়ার জন্য এই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রশ্ন : পাশ্চাত্য জগতে ইসলাম গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের পিছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : এসব কেন্দ্র এবং প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পিছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করছে তা বলা অবশ্য কঠিনই বটে। আসলে এ ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান আমার নেই। কিংবা এ সম্পর্কে ভালো সচেতন নই। তবে মোটের ওপর এটা বলা যেতে পারে যে, সাধারণ সমাজবিজ্ঞানীদের নির্লিপ্ত রেখে মানবিক বিজ্ঞান শাখার পণ্ডিতদেরকে এ ব্যাপারে সচেতন করে রাখাই এর উদ্দেশ্য।
প্রশ্ন : ইসলামের একজন গবেষক এবং পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ব্যক্তিত্ব হিসাবে সমসাময়িক বিশ্বে ইসলামের ভবিষ্যৎ কিরূপ বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : বর্তমানে প্রচলিত ইসলামী আন্দোলনগুলোর গুরুত্ব সবদিক দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। নেতিবাচক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এসব আন্দোলনে সাধারণভাবে সারাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত মুসলমানদের মোহমুক্তিই প্রকাশ পাচ্ছে। একজন খুব বিখ্যাত লেখকের মতে গোটা মুসলিম জাহানই নানা কারণে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। ঔপনিবেশিকতার অভিজ্ঞতা, বিদেশী আধিপত্য, সামরিক ক্ষেত্রে বিদেশীদের হাতে পরাজয়, দারিদ্র এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা, আরব-ইসরাইল সংঘাত প্রভৃতি বিষয় মুসলিম জাহানকে নিদারুণ পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে।
এ সকল সামাজিক সমস্যা সমাধানের বহু প্রচেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কোনটাই সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। এই সকল প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে উদারনৈতিক গণতন্ত্র চর্চা, সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং মিলিটারি একনায়কতন্ত্রের প্রচলন প্রভৃতি। এই বিবিধ প্রচেষ্টার কোনটাই মুসলিম জাহানের জন্য কোন সুফল বয়ে আনেনি।
মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সমাধানের ইসলামী আধুনিকতাবাদ (Islamic modernism) নিয়েও চেষ্টা চালানো হয়। সম্ভবতঃ আর একটি প্রচেষ্টাকে এক্ষেত্রে যোগ করা যায়। আর তা হলো ‘ইসলামে প্রত্যাবর্তন’ প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টা বেশ আকর্ষণীয় এই কারণে যে, ইসলামের মূলের সাথে এর সরাসরি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।
আমি তাদের সাথে একমত নই যারা মনে করে যে, আমরা এখন চারদিকে যেসব ধর্মীয় উদ্দীপনা লক্ষ্য করছি তা নিছক একটি সাময়িক জোয়ার মাত্র। অর্থাৎ এটি এমন একটি প্রবণতা যা লোকজনকে শুধু কতিপয় আনুষ্ঠানিক ইবাদতে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে আমরা বলতে পারি, এখন সর্বত্র যা আমরা অবলোকন করছি তা হলো সমাজে বিদ্যমান সমস্যারই কিছুটা প্রতিফলন এবং এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নতুন কিছু একটা করার জন্য তারা উদগ্রীব এবং এক্ষেত্রে ‘ইসলামে প্রত্যাবর্তন’ একটি গতিশীল প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে একটি নতুন পরিচিত দানা বেঁধে উঠছে এবং একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তারা এগিয়ে যাবার সুযোগ পাচ্ছে।
আমার মতে যে কোন মূল্যে এই অবিরাম প্রচেষ্টা (ইসলামে প্রত্যাবর্তন প্রচেষ্টা) অত্যন্ত যুক্তিসংগত এবং সুবিধাজনক। সমস্যা সমাধানে এটি একটি ভালো প্রচেষ্টা এবং জনগণের কাছ থেকেও এর সপক্ষে প্রচুর সাড়া পাওয়া যায়। কারণ, মূল সমস্যার সমাধানে ইসলামে প্রত্যাবর্তন ছাড়া গত্যন্তর নেই।
মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে গেলে আমি বলব যে সকল সরকার একটি ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায় বা যাদের দেখলে ইসলামী বলে মনে হয় তাদের জয় বা পরাজয় নির্ভর করে দু’টি মৌলিক বিষয়ের ওপর।
প্রথম বিষয়টি হলো জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে সংশ্লিষ্ট সরকারের সামর্থ্য থাকা। যেমন খাদ্য, বস্তু, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, গৃহ সংস্থান, শিক্ষা এবং এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যাদির সমাধানে উপায় খুঁজে বের করা। সরকার যদি এই সকল সমস্যা সফলভাবে কাটিয়ে উঠতে পারে তাহলে শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তারা সক্ষম হবে এবং পৃথিবীতে চিরস্থায়ী দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
আমার মতে দ্বিতীয় যে উপাদান তা হলো নেতৃত্ব। মুসলিম বিশ্বে কেউ যদি ব্যক্তিগত গুণাবলি ও চরিত্র মাধুর্যের মাধ্যমে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন, মুসলমানদের সমস্যাবলি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হন এবং মুসলমানদের সার্বিক আনুগত্য লাভে সক্ষম হন তাহলে মুসলিম জাতি এক বিরাট সাফল্য অর্জনের সুযোগ পায়। আমি মনে করি, আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (রহ.) এই আদর্শ ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়েছেন। শুধু শিয়া মুসলমানদের মাঝেই নয়, সুন্নি মুসলমানদের মাঝেও তিনি এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীর বেশির ভাগ এলাকাতেই তিনি শিয়া ব্যক্তিত্ব হিসাবে গণ্য নন; বরং আধুনিক এক মুসলিম নেতৃত্ব হিসাবেই স্বীকৃত। তিনি এমন এক ধার্মিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত যিনি নিজ সমাজের অবস্থার উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন এবং আধুনিক জটিল সমাজ জীবনে এক নৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন। একটি দুর্নীতিবাজ অসৎ প্রশাসনকে তিনি উৎখাত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
মন্ট্রিলে সুন্নিদের মাঝে একটি জনমত জরিপ করা হয়েছিল। এতে ইমাম খোমেইনীর প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। অথচ মন্ট্রিলের সুন্নি মুসলমানরা তাঁর ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে তেমন বেশি জানত না।
যদি ইমাম খোমেইনীর মতো প্রতিভা এবং প্রভাব নিয়ে কোন নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে তাহলে আমি মনে করি চলতি ইসলামী আন্দোলনগুলো দীর্ঘ জীবন লাভে ধন্য হবে এবং নিজেদের দেশে শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে।