দর্শনে মুসলমানদের অবদান

শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী

মুসলিম বিশ্বে দর্শন প্রবেশের পর থেকে প্রায় বারশ’ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ বিগত বার শতাব্দী ধরে মুসলমানরা বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন যাপন করে আসছে, যাকে আমরা দর্শনভিত্তিকও বলতে পারি।

মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সূচনা হয় ইসলামের আবির্ভাব এবং ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে। পবিত্র কুরআন বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং বেশ কিছু ন্যায়ানুগ ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে। মহানবী (সা.) এবং হযরত আলী (আ.) বর্ণিত হাদীসে যুক্তিভিত্তিক বিষয়গুলোর ওপর খুবই স্পষ্ট ও বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এগুলো স্বতন্ত্রভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। ইসলামী কালামশাস্ত্রবিদগণ দর্শনশাস্ত্রের বিষয়সমূহ আরবিতে অনুবাদের আগে ধারাবাহিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তমূলক আলোচনায় ব্যাপৃত হয়েছিলেন। এর ভিত্তিতেই মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতর হয়েছে, যার চৌদ্দটি শতাব্দী ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ইসলাম আবির্ভাবের দুশ’ বছর পর যার যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের একটি বিশেষ ধরন। আর একেই আমরা বলি দর্শনভিত্তিক, যা শুরু হয়েছিল গ্রীক ও আলেকজান্দ্রীয় শাস্ত্রের অনুবাদের মাধ্যমে। এ অনুবাদের যুগ খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তৃতীয় থেকে নবম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে অনুবাদ যুগ চলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চুতর্থ হিজরি শতাব্দীতে। মুসলমানদের মধ্যে (দর্শনশাস্ত্রের ক্ষেত্রে) লেখালেখি, সংকলন-সংগ্রহ ও অনুসন্ধানকাল শুরু হয় তৃতীয় শতাব্দী থেকে। প্রথম মুসলিম দার্শনকি ছিলেন ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি। বহু গ্রন্থ প্রণেতা আল-কিন্দি সম্পর্কে ইবনে আল-নাদিম তাঁর ‘আল-ফিহরিস্ত’ গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

এখন যা প্রয়োজন তা হচ্ছে মুসলমানদের এ বারো শতাব্দীর অবদানের ওপর পর্যাপ্ত অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান। তাঁরা কি তাঁদের পূর্ববর্তীদের মতামতের কেবল পুনরাবৃত্তি করেছেন? তাঁদের সমগ্র ভূমিকা কি কেবল প্রাচীন গ্রীস থেকে আধুনিক ইউরোপ পর্যন্ত দার্শনিক ঐতিহ্য স্থানান্তরের উপায় বা সংযোগ মাধ্যম হবার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল? ইসলামী দর্শনের যুগ কি শেষ হয়ে গেছে, সাধারণভাবে যেমন দাবি করা হয় যে, ইবনে সিনা, (ইমাম) গাজ্জালী ও আবু রুশদের পর আমরা উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি? ইসলামী দর্শনতত্ত্বে এমন কোন বিষয় আছে কি আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তাধারার সাথে যার তুলনা করা চলে?

এসব প্রশ্নের অবশ্যই জবাব দেয়া দরকার। তবে একথাও সত্য যে, এসব প্রশ্নের সঠিক ও সুস্পষ্ট জবাব দান কোন সহজ কাজ নয়। এর জন্য যথেষ্ট সময়, প্রচেষ্টা ও সুযোগ আবশ্যক। সৌভাগ্যের কথা যে, ইসলামের ধর্মতত্ত্ব ও দীনিয়াত অনুষদ ইসলামী দর্শনের ইতিহাসে একটি অধ্যায় সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছে এবং আশা করা যায় যে, তা উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সম্পাদনে সহায়ক হবে।

ইসলামী দর্শনের ইতিহাস ইসলামী দুনিয়ার বিজ্ঞান-ইতিহাসেরই অংশ। এর মধ্যে রয়েছে মুসলমানদের নিজেদের থেকে উৎসারিত আইন ও ফিকাহ, তাফসীর, হাদীস, মৌলিক জ্ঞান-গবেষণা, রিজাল (বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জীবনেতিহাস), ব্যাকরণ- ভাষা ও সাহিত্য সংক্রান্ত বিজ্ঞান, যেমন অলংকারশাস্ত্র প্রভৃতি। সেসাথে অনুবাদের মাধ্যমে ইসলামী বিশ্বে প্রবেশ করে মুসলমানদের বিজ্ঞানের অংশে পরিণত হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, অংকশাস্ত্র, জ্যামিতি, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্র।

বিজ্ঞান-ইতিহাসের গবেষক ও লেখকদের মতে এটা নিশ্চিত যে, ইসলামী জগতেই এসব বিজ্ঞানের জন্ম ও বিকাশ হয়েছে এবং মুসলমানরা মানব সভ্যতার ও বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। গ্রীক-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানরা যে পর্যায়ে উপনীত হয় সে সম্পর্কে ডালিস ওহারী লিখেছেন : ‘গ্রীকদের কাছ থেকে আরব মুসলমানরা যা গ্রহণ করেছে তা অন্যের কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার আগে মূল আকারে থেকে যায়নি; বরং একথা অবশ্যই বলা চলে যে, গ্রীক বিজ্ঞান আরব পরিবেশে এক বিশেষ পন্থায় উন্নয়ন ও বিকাশ লাভ করে। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অংকশাস্ত্রের ক্ষেত্রে তারা একই সাথে গ্রীক ও ভারতীয় অবদানকে আমদানি করে এবং সেগুলোকে একটি শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। এ কারণেই আরবদের হাতে এ দুই বিষয়ে শিক্ষার প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। একথা বলা যেতে পারে যে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বীজগণিত (অ্যালজেবরা) এবং সরল ও গোলক সংক্রান্ত ত্রিকোণমিতি উদ্ভাবিত ও বিকশিত হয়েছিল আরব তথা মুসলিম পণ্ডিতদের মাধ্যমে। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক মতামত দান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ছক রচনায় তাঁদের যথার্থ উন্নত জ্ঞান ছিল। তাঁরা নিজেদেরকে কেবল গ্রীক থেকে প্রাপ্ত বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। সেগুলো থেকে তাঁরা বাছাই করেছেন এবং প্রাচীন ছকের সংস্কার করেছেন। (ইন্তিকালে উলুমে ইউনানী বেহ আলমে ইসলামী, পৃ. ৬)

ইসলামী বিজ্ঞান উন্নয়নের ওপর অধ্যয়ন এমন একটি কাজ যা করা দরকার যথাযথ পন্থায় এবং খোদ মুসলমানদের দ্বারা যারা ইসলামী সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে জীবনযাপন করেছে, ঐ পরিবেশে নিজেদের প্রতিভা গড়ে তুলেছে এবং বিজ্ঞানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে নিজেদেরকে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছে। একাজ তাদের দ্বারা কখনই সম্পন্ন হওয়া উচিত নয় যারা প্রাচ্যপন্থী এবং যারা অন্য কোন বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল বা পরিবেশে গড়ে উঠেছে। অবশ্য একথাও সত্য যে, এ কাজ কেবল মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক পণ্ডিতের কাজ নয় এবং দুই এক দশকেও এ কাজ শেষ হবার নয়।

সে কারণেই আমরা এ নিবন্ধে ইসলামে দর্শনের উন্নয়ন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। অবশ্য আমরা দর্শন বলতে এখানে যা বুঝাতে চাই তা হলো সৃষ্টি ও জ্ঞানসংক্রান্ত দর্শন বা অধিবিদ্যা। যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বিধায় আমাদের আলোচনা যুক্তিবিদ্যার দিকেও প্রসারিত হবে এবং একই কারণে মনোবিজ্ঞানের দিকেও। কেননা, কোন কোন দিক দিয়ে মনোবিজ্ঞান অধিবিদ্যারই একটি অংশ। তাই স্বভাবতই ইসলামে দর্শন বিকাশের চারটি অংশ রয়েছে : অধিবিদ্যা বা সৃষ্টি ও জ্ঞান-দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা।

ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত এসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে দর্শনই হচ্ছে ঐতিহাসিক বিকাশ ধারায় সবচেয়ে বোধগম্য বিষয়।

যে যে বিষয় এক্ষেত্রে গবেষণাকে কঠিন করে তুলেছে তা হলো, ইসলামী দার্শনিকরা কেবল ঐসব সমস্যার ঐতিহাসিক গতিধারা আলোকপাত করেননি; বরং কতিপয় কারণে ও ঘটনার আকস্মিকতায় এ ব্যাপারে কিছু কিছু ভ্রান্ত মতামতও ব্যক্ত করেছেন।

আমার মতে, শায়খ আল-ইশরাক নামে পরিচিত শায়খ শিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দী দর্শন সংক্রান্ত সমস্যার ঐতিহাসিক কারণ সম্পর্কে অন্যান্য দার্শনিকের চেয়ে এ ধরনের অধিক বিভ্রান্তিকর মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর দরবেশতুল্য দার্শনিক ও সুফিসাধক মরহুম হাজী মোল্লা হাদী সাবজাওয়ারীও সমস্যার ঐতিহাসিক উৎস সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দিয়েছেন। অবশ্য মরহুম হাজী সাবজাওয়ারীর এহেন বিবৃতির কারণ হলো গ্রন্থাগারে প্রবেশের সুযোগ লাভ না করা এবং মধ্যম পর্যায়ে উৎসের ওপর নির্ভরশীলতা। কোন কোন দিক থেকে তিনি অবশ্য শায়খ আল-ইশরাক থেকে ভিন্ন। এর পশ্চাতে যে প্রকৃত কারণ নিহিত ছিল, তা হলো অতীত চিন্তাবিদদের বাণী-বিবৃতির একটি গ্রহণযোগ্য অর্থবোধক ব্যাখ্যা দানের প্রতি ঐ মনীষীর প্রবলতর অনুরাগ। মরহুম হাজীর উক্তিতে আমরা প্রায়শই তাঁকে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে বলতে দেখি, একটি বিশেষ বিষয়ে পেরিপ্যাটেটিকরা (Peripatetic) ইতস্তত ভ্রমণকারী) এ কথা বলেছেন এবং ইল্যুমিনেশনিস্টরা (Illuminationist- আলোকবাদী) এ কথা বলেছেন। পেরিপ্যাটেটিকরা অ্যারিস্টটলের অনুসারী এবং ইল্যুমিনেশনিস্টরা প্লেটোর অনুসারী। তিনি মনে করতেন, এ সমস্যাটি দেখা দিয়েছে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের সময় থেকে এবং তা আমাদের যুগ পর্যন্ত চলে আসছে। কিন্তু যখন তিনি পূর্ববর্তী চিন্তাবিদদের পুস্তকাদির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন তখন দেখতে পেলেন যে, সেখানে এরূপ কোন সমস্যাই নেই। সময়ে সময়ে ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদেরকে প্রশ্ন করে থাকে যে, ইবনে সিনার ‘আল-শিফা’, ‘আল-নাজাত’ অথবা ‘আল-ইশারাত’ এর কোথাও কি কেউ অস্তিত্ব বা সারবস্তুর মৌলিক বাস্তবতার সমস্যার ওপর আলোচনা দেখতে পাবে? যখন তারা দেখতে পায় যে, অ্যারিস্টটলের মুসলিম অনুসারীদের প্রধান ইবনে সিনার কোন গ্রন্থের মধ্যেই মৌলিক বাস্তবতা এবং সারবস্তুর মৌলিক বাস্তবতার উল্লেখ নেই, তখন তারা এ মর্মে বিস্মিত হয় যে, অ্যারিস্টটলের অনুসারীদের অস্তিত্বের মৌলিক বাস্তবতায় বিশ্বাসী এবং প্লেটোর অনুসারীদেরকে সারবস্তুর মৌলিক বাস্তবতায় বিশ্বাসী বলে কেন সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে। তারা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় যে, ইসলামী দর্শনের চিন্তাবিদদের মধ্যকার প্লেটো ও অ্যারিস্টটল অনুসারীরা যা বলে থাকেন, সে তুলনায় অনেক কিছুই প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তার বাইরে ছিল। আর এরই ফলস্বরূপ হাজী সাবজাওয়ারী প্লেটো ও অ্যারিস্টটলপন্থীদেরকে একে অপরের বিরোধী হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন। এটা হলো ইসলামী আমলে দর্শন বিকাশের ঘটনাসমূহের একটি।

মরহুম সাবজাওয়ারী পূর্বসূরিদের মতকে যুক্তিযুক্ত বলে তুলে ধরতে এবং ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায়শই এত অধিক দূরে পৌঁছে গেছেন যে, তিনি তাঁর উৎস থেকে নিজে যেসব উদ্ধৃতি দিয়েছেন তার সাথেই তা অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে গেছে। যেমন, তিনি বলেছেন, ‘পাহলভী দার্শনিকদের মত অনুসারে অস্তিত্ব হচ্ছে বিভিন্ন বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে সাদৃশ্যপূর্ণ বাস্তবতা।’ এ উদ্ধৃতি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, সোহরাওয়ার্দীকে (শায়খ আল-ইশরাক) অনুসরণ করে সাবজাওয়ারী যাদেরকে পাহলভী দার্শনিক আখ্যায়িত করেছেন, তাঁরা যে অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তা যেন একই মানের বাস্তবতা। দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র-ছাত্রীরা জানে যে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিই দুটি উদ্ধৃতিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে : প্রথমত, যা একটি চূড়ান্ত বাস্তবতা গড়ে তোলে সেটাই অস্তিত্ব, কোন সারাংশ বা সারবস্তু নয়। দ্বিতীয়ত, অস্তিত্ব হলো বিভিন্ন মাত্রাবিশিষ্ট একটি একক বাস্তবতা।

কিন্তু আমরা সকলেই জানি যে, এ বক্তব্যের ব্যাপারে মরহুম হাজী সাবজাওয়ারীর সূত্র বা উৎস হলো সোহরাওয়ার্দী। আর সোহরাওয়ার্দী দাবি করেছেন যে, প্রাচীন ইরানে এমন সব দার্শনিক ছিলেন যাঁরা তাঁর মতোই বিশ্বাস করতেন এবং অস্তিত্বের প্রকৃত মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে জোরালোভাবে অস্বীকার করতেন। তাঁর ‘হিকমাত আল-ইশরাক’ গ্রন্থে তিনি ‘ফি আদামে যিয়াদাতিল ওয়াজুদ আলাল মাহিয়্যাহ’ শিরোনামে অস্তিত্বের ই’তিবারি বা মানসিকভাবে উদ্ভাবন বিষয়ে বহু যুক্তির অবতারণা করেছেন। যে ব্যক্তি অস্তিত্বের ই’তিবারি বা মানসিক উদ্ভাবনে বিশ্বাস করে সে কি করে দাবি করে যে, ‘অস্তিত্ব হচ্ছে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং বিভিন্ন মাত্রা, সমৃদ্ধি ও ত্রুটির সমন্বয়ে গঠিত একটি বাস্তবতা?’

সত্যিকার অর্থে, সাবজাওয়ারীর মতামতের একটি উৎস সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু তিনি নিজে কখনও বলেননি যে, প্রাচীন ইরানের দার্শনিকরা (ফাহলাভীইয়্যুন) অস্তিত্বকে একটি একক মানের বাস্তবতা বলে মনে করতেন বা এটা তাঁর নিজেরও বিশ্বাস ছিল। বরং তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বরাবরই অস্তিত্বকে ই’তিবারি হিসাবে বিবেচনা করেছেন। সোহরাওয়ার্দী তাঁর দর্শনকে ‘আলো’ ও ‘অন্ধকার’-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং আলোকে একটি মানের বাস্তবতা বলে বিবেচনা করেছেন। দর্শন বিষয়ক রচনা ‘হিকমাত আল-ইশরাক’ অংশের প্রথম নিবন্ধের তৃতীয় পরিচ্ছেদে তিনি বর্ণনা করেছেন যে, একটি বস্তু ‘আলো’ ও ‘আলোহীন’ অবস্থায় বিভাজনযোগ্য এবং ‘আলো’ও পালাক্রমে ‘অবস্তুগতভাবে’ (মুজাররাদ) এবং আকস্মিক বিভাজনযোগ্য।

তিনি বিশ্বাস করেন মাত্রাভেদবিশিষ্ট আলো একটি মারতাবাহ বা একটি স্তরে আবশ্যক এবং অপর ক্ষেত্রে সম্ভব (মুমকিন) একটি ক্ষেত্রে বস্তু (জাওহার) আবার অপর ক্ষেত্রে আকস্মিক। ‘এসালাত আল-ওয়াজুদ’ মতবাদকে দার্শনিক ভিত্তি প্রদানকারী সাদরুল মুতাআল্লিহীন সহ যেসব দার্শনিক অস্তিত্বকে মৌলিক বাস্তবতা (এসালাত আল-ওয়াজুদ) বলে মনে করেন তাঁরা সোহরাওয়ার্দীর মতের প্রতি আপত্তি উত্থাপন করে বলেছেন যে, ‘আলো’ এবং প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশাই ছিল অস্তিত্বের বাস্তবতা এবং একেই তারা এক ধরনের ই’তিবারি হিসাবে বিবেচনা করতে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মরহুম হাজী সাবজাওয়ারীর মতো কিছু সংখ্যক দার্শনিক, যাঁরা অন্যদের মতামতকে যথাসম্ভব সর্বোত্তমভাবে ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে প্রবলভাবে আগ্রহান্বিত ছিলেন তাঁরা একইসাথে বলে গেছেন যে, সোহরাওয়ার্দী ‘আলো’ বলতে যা বুঝিয়েছেন তা ছিল অস্তিত্ব। কিন্তু তাঁর সকল বক্তব্য-বিবৃতির কোন অংশ থেকেই এহেন ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। এতে দর্শনগত সমস্যার ঐতিহাসিক ধারাপ্রবাহ অনুধাবনের ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কেবল বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে।

সাবজাওয়ারীর চিন্তাধারায় এ ধরনের আরো উদাহরণ রয়েছে। আমরা এ একটির কথা উল্লেখ করলাম এজন্য যে, আমাদের সম্মানিত পাঠকরা যেন জানতে পারেন যে, আমাদের পূর্বসূরিদের গ্রন্থরাজি কেবল দর্শন সংক্রান্ত বিষয়াবলির ইতিহাস তুলে ধরেছে তাই নয়, কিছু অসুবিধাও সৃষ্টি করেছে।

কয়েক বছর আগে আমার মনে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানসিক অস্তিত্বের সমস্যাটি তদন্ত করে দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আমার সামনে বহু দিক উন্মোচিত হয় এবং এক সময় আমার আহরিত বিষয়গুলো আমি প্রকাশ করার সুযোগ পাই। যেসব বিষয় আমি আবিষ্কার করি তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘শারহুল মানজুমাহ’ দর্শন সংক্রান্ত ইতিহাসের ব্যাপারে যে হিসাব দিয়েছে তা সঠিক নয়। ‘আল-আসফার’ প্রদত্ত হিসাবের সাথে যখন আমি তা তুলনা করি তখন আমি দেখতে পাই যে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ধৃত মতামতে বর্ণিত ঐতিহাসিক অগ্রগতি নির্ণয়ে অধিকতর সুন্দর। এর পশ্চাতে যে মূল কারণ নিহিত তাহলো মরহুম সাবজাওয়ারী বই-পুস্তকের মধ্যে বেশি প্রবেশ করেননি এবং অপরদিকে মোল্লা সাদরার সংগ্রহে ছিল বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ।

এ পর্যন্ত আমার গবেষণায় ইসলামী দর্শনের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা ধরা পড়েছে তা চার শ্রেণির :

১. কিছু কিছু বিষয় অবিকল রূপ ও বৈশিষ্ট্যে রয়ে গেছে এবং সেগুলোতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংশোধন হয়নি।

২. কিছু কিছু বিষয় ইসলামী দার্শনিকদের হাতে আরো উন্নত হয়েছে। এ উন্নয়নের মাধ্যমে অবশ্য বিষয়গুলো আরো দৃঢ় ও যুক্তিগ্রাহী হবার ভিত্তি লাভ করেছে। যুক্তির ধরন পরিবর্তন করা হয়েছে অথবা পূর্ববর্তী যুক্তির স্থলে নতুন যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। দর্শনের ক্ষেত্রে এমনকি অংকশাস্ত্রে ব্যবহৃত সংখ্যাগুলোরও একটি বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। যেমন অংকশাস্ত্রের জ্যামিতিতে বাড়তি প্রমাণাদিকে কৌতুহলের মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের একটি ব্যাখ্যামূলক কাজ সম্পর্কে খাজা নাসির উদ্দিন আত-তূসী ও অন্যরা একটি নির্দিষ্ট উপপাদ্যের বিভিন্ন প্রমাণাদি উপস্থাপন করে এনক্লিড (Enclid)-এর জ্যামিতির ওপর কাজ করেন। অংকশাস্ত্রীয় ধারণার সহজবোধ্যতা এমন যে, তা মনে গাঁথার জন্য একটি মাত্র প্রমাণই যথেষ্ট। দর্শন কিন্তু এমন নয়, এর পথসমূহ বহু বাঁকবিশিষ্ট পর্বতসঙ্কুল পথের মতো কঠিন। অবশ্য কারো কারো কাছে অন্যদের তুলনায় এ পথ সহজতরও মনে হতে পারে। সে কারণেই দর্শনে প্রমাণাদির গুরুত্ব অত্যধিক।

৩. কিছু কিছু সমস্যা নামে ও বর্ণনায় আগের মতোই রয়ে গেছে, কিন্তু বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অর্থাৎ বর্ণনায় যা উল্লেখ করা বা প্রমাণ করা হয়েছে তা ঐ নামে যে অর্থ প্রকাশ করে তা থেকে কিছুটা আলাদা।

৪. কিছু কিছু সমস্যা প্রাক-ইসলামী যুগে ছিল নজিরবিহীন এবং তা কেবল মুসলিম দার্শনকিরাই তুলে ধরেছেন। এমনকি প্রাক-ইসলামী যুগে ঐসব সমস্যার সমান্তরাল কোন নাম বা বর্ণনাও বিদ্যমান ছিল না।

দর্শনের সমস্যা নিয়ে এ পর্যন্ত যা উল্লেখ করা হলো সেসব উপাদান নিয়েই দার্শনিক আলোচনা গঠিত হয়েছে। উপাদানের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ছাড়াও সেখানে আরো পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে তার ধরন এবং মূলবাণী ও বিষয়বস্তুতে। আমরা যদি অ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যাকে পরবর্তীকালের ইসলামী দার্শনিকদের চিন্তাধারার সাথে তুলনা করে দেখি তাহলে দেখতে পাব মতামত সংগঠন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুর বিন্যাসের দৃষ্টিতে তাদের মধ্যে কিছুটা সাজুয্য রয়েছে।

উপরন্তু প্রাথমিক যুগগুলোতে কিছু কিছু সমস্যা যুক্তিবিদ্যা বা পদার্থবিদ্যার অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হতো এবং সেগুলো যুক্তিবিদ্যা ও পদার্থবিজ্ঞানের পেক্ষাপটে আলোচনা করা হতো। কিন্তু ইসলামী যুগে সেগুলোকে অধিবিদ্যা সমস্যার অংশীভূত করার উদ্দেশ্যে ধীরে ধীরে অবস্থান পরিবর্তিত হয়। কেননা, সেগুলো ছিল অধিবিদ্যার প্রভাব বলয়েরই আওতাভুক্ত। অর্থাৎ তা ছিল আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং যুক্তির ভিত্তি ছিল মধ্যম পর্যায়ের। বিষয়বস্তু বিবেচনায় শক্তি হওয়ার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অর্থাৎ দৈহিক বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য তুল্য।

যেমন অ্যারিস্টটল তাঁর ‘লজিক’ (যুক্তিবিদ্যা) গ্রন্থে শ্রেণিবিন্যাসের আলোচনা করেছেন। ইবনে সিনাও অ্যারিস্টটলের মতো তাঁর ‘আশ-শিফা’ ও ‘আন-নাজাত’ গ্রন্থের অংশবিশেষে ঐ সব বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এসব গ্রন্থে যুক্তির বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে দার্শনিকরা শ্রেণিবিণ্যাসকে অধিবিদ্যার অংশ হিসাবে এবং দর্শনগত সমস্যার শ্রেণি হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

অনুরূপভাবে অ্যারিস্টটল ও ইবনে সিনা পদার্থবিদ্যার একটি অংশে গতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কেননা, গতি হচ্ছে দেহ বা শরীরের একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মোল্লা সাদরা পরিবর্তনকে পদার্থবিদ্যায় গণ্ডিবদ্ধতার মতো শরীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেননি। তিনি পরিবর্তনকে দৈহিক অস্তিত্বের একমাত্র উপাদান বলে মনে করেন না বরং তাকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ গতি’ বলে বিশ্বাস করতেন। মোল্লা সাদরা প্রমাণ করেছেন যে, পরিবর্তন একটি শক্তি হিসাবে প্রথমিক একটি বিভক্তি আনে, মধ্যম বা দ্বিতীয় পর্যায়ের কিছু হয়ে নয়। পরিবর্তিত বা পরিবর্তিত না হয়ে যে বিভক্তি আসে তা হচ্ছে আবশ্যক বা ওয়াজিব, সম্ভব বা মুমকিন এবং চিরন্তন বা আদিম। সাদা ও কালো, ছোট ও বড় বা এ জাতীয় বিবেচনায় নয়। এ ভিত্তিতে পরিবর্তন বিষয়ে অধ্যয়ন যথাযথভাবে অধিবিদ্যার সাথে সংশ্লিষ্ট, পদার্থবিদ্যার সাথে নয়। তাই তিনি পরিবর্তনের আলোচনাকে অধিবিদ্যা সংক্রান্ত ‘আল-আসফার’ গ্রন্থের অংশে স্থান দিয়েছেন।

আত্মা সংক্রান্ত আলোচনা এবং অ্যারিস্টটল ও ইবনে সিনার দর্শনে পদার্থবিদ্যার একটি অংশ হয়ে আছে। কিন্তু সেই অবধি ইবনে সিনা তাঁর অধিবিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থের সূচনা অংশে এবং মোল্লা সাদরা তাঁর এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা বা তাওয়াল্লুকাত গ্রন্থে যেভাবে বলেছেন তাতে দেখা যায় কিছু কিছু সমস্যার দ্বৈত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান- এর একটি পদার্থবিদ্যাভুক্ত এবং অপরটি অধিবিদ্যাভুক্ত। মোল্লা সাদরা দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় তা অধিবিদ্যার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

মোল্লা সাদরা দর্শনের যুক্তিবাদী পদ্ধতিকে ইরফান বা সুফিবাদী পদ্ধতিতে প্রয়োগ করেছেন এবং তাঁর অধিবিদ্যাগত আলোচনাকে সুফিবাদের চার স্তরের আধ্যাত্মিক সাধনার আলোকে চারটি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বিভক্ত করেছেন।

১. সৃষ্টি থেকে খোদার দিকে যাত্রা বা মিনাল খাল্ক ইলাল হাক। এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অধিবিদ্যার সাধারণ সমস্যা। আর এটাই খোদায়ী জ্ঞানের (মারিফাত) দিকে প্রাথমিক পদক্ষেপ রচনা করে।

২. খোদার সাথে খোদায়ী সত্তায় গমন (ফিল হাক মাআল হাক)। এতে রয়েছে তত্ত্ববিদ্যার চর্চাকারী অধিবিদ্যার সমস্যাবলি এবং খোদায়ী নাম, গুণ ও বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত আলোচনা।

৩. খোদা থেকে খোদায়ী সৃষ্টির দিকে যাত্রা (মিনাল হাক ইলাল খাল্ক মাআল হাক)। এতে রয়েছে খোদায়ী কানুন ও অস্তিত্বের সাধারণ পরিধি।

৪. খোদার সাথে সৃষ্টিতে অভিযাত্রা। (ফিল খালেক মাআল হাক)। এতে রয়েছে মনস্তত্ত্ব ও পরকাল (মা’দ) সংক্রান্ত আলোচনা।

অবশ্য দর্শন সংক্রান্ত সমস্যা নিরূপণের বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতি রয়েছে। যার একটি এসেছে অ্যারিস্টটল ও ইবনে সিনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

১. যেসব সমস্যা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে : যুক্তিশাস্ত্রের অধিকাংশ সমস্যা, দশ ভাগে বিভক্ত শ্রেণিসমূহের আলোচনা, চার ভাগে বিভক্ত কারণসমূহ, বিজ্ঞানের শ্রেণির বিন্যাস এবং আত্মার অনুষদসমূহের বিভাগ ও সংখ্যা এই শ্রেণিভুক্ত। অবশ্য এই সমস্যাগুলো তাদের আগের অবস্থায় হুবহু রয়ে গেছে এবং আমরা মনে করি না যে, কোন ভাবেই তাতে কোন হস্তক্ষেপ করা হয়নি। আমরা যা বুঝাতে চাইছি তা হলো সামগ্রিকভাবে সেগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রয়ে গেছে; যেমন আমরা জানি যে, ইবনে সিনা শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্য নিরূপণে মূল্যবান ও নজিরবিহীন পর্যালোচনা করেছেন। ইবনে সাহলান আল-সাউজী বলেছেন, এই শ্রেণিবিভাগ হবে চার রকমের- দশ রকমের নয়। সোহরাওয়ার্দী বিশ্বাস করতেন এই শ্রেণিবিভাগ হবে পাঁচ প্রকার। এক্ষেত্রে তিনি ইবনে সাহলানের চারটি ভাগকে স্বীকার করে নিয়ে গতি বা পরিবর্তনকেও একটি বিভাগ হিসাবে গণ্য করেছেন। ইবনে সিনা ও মোল্লা সাদরা জ্যামিতিক সত্তার বিশ্লেষণ করেছেন তাতে তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, জ্যামিতিক ও দৈহিক সত্তার মধ্যকার পার্থক্য যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণের সাথে সম্পর্কিত। যেমন- জ্যামিতিক আকার-আকৃতি কোন দৈহিক সত্তার বহির্দেশীয় দুর্ঘটনা নয়; বরং তা হচ্ছে এর যুক্তিভিত্তিক ও বিশ্লেষণমূলক অংশ। এই ভিত্তিতে সংখ্যাবাচক বিষয়গুলো সাধারণভাবে বাইরের দুর্ঘটনা হিসাবে তাদের তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। এতদসত্ত্বেও অ্যারিস্টটলের দশ রকমের শ্রেণিবিভাগ তাদের মূল বৈশিষ্ট্যে সংরক্ষিত থাকে।

বিজ্ঞানের শ্রেণিবিন্যাসের ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী নতুন ধারণা উপস্থাপন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালের চিন্তাবিদদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।

২. বিকাশমান সমস্যা : এই শ্রেণির মধ্যে রয়েছে একটি অসীমের দিকে প্রত্যাবর্তনের বিষয়, আত্মার অবিনশ্বরতা, আবশ্যকীয় সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ, আবশ্যকীয় সত্তার ঐক্য, এক থেকে বহুর মধ্যে নির্গমনের অসম্ভাব্যতা, জ্ঞান ও জ্ঞানীর মধ্যে সমন্বয় (ইত্তেহাদ আল-আকিল ওয়া আল-মাকুল) এবং সুনির্দিষ্ট আকৃতির মূল প্রকৃতি।

অবশ্য এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য হলো উপস্থাপিত অতিরিক্ত প্রমাণাদির মূল্য। কখনও কখনও এসব নতুন প্রমাণ অ্যারিস্টটল ও আলেকজান্দ্রীয় ব্যাখ্যাকারদের আরোপিত যুক্তিপ্রমাণের চাইতে বলিষ্ঠ ছিল না, ঘটনাক্রমে সেগুলো বৃহত্তর বলিষ্ঠতা লাভ করেছে।

পরবর্তীকালের চিন্তাবিদরা অসীমের দিকে প্রত্যাবর্তনের অসম্ভাব্যতা সম্পর্কে দশটি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, যার মাত্র একটি এসেছে অ্যারিস্টটলল থেকে। ঐ প্রমাণটি ‘মধ্যবর্তী ও পার্শ্ববর্তী প্রমাণ’ বলে খ্যাত। ফারাবী ও ইবনে সিনা এই প্রমাণকে কার্যকর বলে বিবেচনা করেছেন এবং পরবর্তী চিন্তাবিদগণ একে পুনর্গঠন করে আরো পূর্ণাঙ্গ ও বিশেষ রূপ দিয়েছেন। মোল্লা সাদরা এ সম্পর্কে আলোচনাকালে ইবনে সিনার যুক্তির বরাত দিয়ে একে ‘বলিষ্ঠতম প্রমাণ’ (আশাদ্দুল বারাহিন) বলে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য, প্রত্যাবর্তনের অসম্ভাব্যতা বিষয়ে বেশ কিছু প্রমাণ রয়েছে, যা আমার মতে ‘মধ্যবর্তী ও পার্শ্ববর্তী প্রমাণ’-এর চেয়ে কম নির্ভরযোগ্য নয়। যেমন : ফারাবীর প্রমাণ। যাকে বলা হয় ‘বলিষ্ঠতর ও সংক্ষিপ্ততম প্রমাণ’ এবং খাজা নাসিরুদ্দিন আত-তূসী উপস্থাপিত একটি প্রমাণ। খাজা তূসীর ঐ প্রমাণের ভিত্তি ছিল ‘অপরিহার্যতা সৃষ্টি হওয়া ব্যতিরেকে কোন জিনিস অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না।’

আমার মনে হয় মোল্লা সাদরা তাঁর দর্শন চিন্তায় প্রত্যাবর্তনের অসম্ভাব্যতা সংক্রান্ত বিভাগে আত-তূসীর প্রমাণাদির উল্লেখ উপেক্ষা করেছেন। তবে তিনি তাঁর তাত্ত্বিক আলোচনা অংশে তা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া অন্য প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন মীর দমাদ ও অন্যান্য দার্শনিক।

আবশ্যকীয় সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ সংক্রান্ত প্রাক-ইসলামী যুগের যুক্তি হচ্ছে প্রথম চালিকশক্তি, যা খুব একটা গুরুত্ব রাখে না। এই গুরুত্ব বিষয়ে মুসলিম দার্শনিকগণ বহু বলিষ্ঠ যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

ইবনে সিনা ‘একটি সত্যতার প্রমাণ’ আখ্যায়িত করে আবশ্যকতা ও সম্ভাব্যতা (উজুব ওয়া ইমকান) ভিত্তিক একটি যুক্তির অবতারণা করেছেন। কিন্তু মোল্লা সাদরা তাঁর নিজের দর্শনের নীতির ভিত্তিতে অপর একটি যুক্তি তুলে ধরেছেন, ইবনে সিনার মতের ওপর এর প্রাধান্য রয়েছে। তিনি একে ‘বুরহান আল-সিদ্দিকীন’ আখ্যায়িত করে অধিকতর যুক্তিপূর্ণ বলে দাবি করেছেন।

আবশ্যকীয় অস্তিত্বের ঐক্য সম্পর্কে মুসলিম দার্শনিকগণ বহু যুক্তির অবতারণ করেছেন, বিশেষত ইবনে সিনা তাঁর ‘আল-শিফা’ ও ‘আল-ইশারাত’ গ্রন্থে বেশ কিছু যুক্তির অবতারণা করেছেন। আর অন্যরা তো অন্যান্য যুক্তির অবতারণা করেছেনই। মোল্লা সাদরাও তাঁর নিজস্ব সূত্রের ভিত্তিতে ‘বুরহান আল-সিদ্দিকীন’-এর পাশাপাশি একটি যুক্তি তুলে ধরেছেন।

আত্মার অবস্তুগত প্রকৃতি (তাজাররুদ) সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে কিছু পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, দর্শনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অনিশ্চিত হয়ে যায় যে, অ্যারিস্টটল আদৌ আত্মা ও আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাসী ছিলেন কিনা। মুসলমান দার্শনিকরা আত্মার অবিনশ্বরতার ধারণা প্রতিষ্ঠার দিকে অধিক দৃষ্টিদান করেছেন। মোল্লা সাদরা এ সম্পর্কে শারহে আল-হিদায়ায় বলেন, ‘যদি কেউ আত্মার অবিনশ্বরতার যুক্তির ওপর অধ্যয়ন করতে চায় তাহলে তার উচিত হবে ইবনে সিনা ও শায়খ আল-ইশরাক এর বই-পুস্তক অধ্যয়ন করা।’ ইবনে সিনার গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘আল-হুজ্জাজ আল-আশার’-এ এই ব্যাপারে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। সাদরা নিজে তাঁর ‘আল-আসফার’-এর চতুর্থ খণ্ডে ১১টি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

এই লেখক সাদর আল-মুতাআল্লিহিনের বিভিন্ন গ্রন্থ, যেমন ‘আল-আসফার’, ‘শাওয়াহিদ আল-রুবুবিয়্যাহ’, ‘আল-মাবদা ওয়া আল-মাআদ’ ইত্যাদিতে উপস্থাপিত সকল যুক্তি পর্যালোচনা করে দেখেছেন এবং পুনরুক্তি বাদ দিয়ে তাতে চৌদ্দটি যুক্তি পেয়েছেন। অবশ্য, এসব যুক্তির মূল্য একই রকম নয় এবং এর কিছু কিছু হচ্ছে সমর্থনসূচক- স্বতন্ত্র যুক্তি নয়।

৩. যেসব সমস্যার বিষয়বস্তু পরিবর্তন হয়েছে, প্রাক ইসলামী যুগে এ ধরনের বহু সমস্যা ছিল। এগুলো ছিল এক ধরনের অস্পষ্টতায় মোড়া, যা থেকে সেগুলোকে বের করে আনা হয় এবং একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দান করা হয়। যদিও সেগুলোর নাম ও বর্ণনা আগের মতোই রয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও সেগুলোর বিষয়বস্তুর পরিবর্তন হয়েছে। ইসলামী দর্শনে সেগুলোর পরিবর্তনের ধরন হলো এরকম যে, যে চিন্তাবিদ মূল থেকে ঐ বিষয়গুলো ধারণ করেছেন তিনি তা স্বীকার করেননি।

আমার মতে, প্ল্যাটোনীয় ধারণা এই শ্রেণিতে পড়ে। প্ল্যাটোর একটি নিজস্ব তত্ত্ব ছিল যা প্ল্যাটোনীয় মতবাদ বলে পরিচিতি লাভ করে। অ্যারিস্টটল ঐ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইসলামী যুগে ইবনে সিনা তার তীব্র সমালোচনা করেন। পক্ষান্তরে সোহরাওয়ার্দী একে সমর্থন এবং এর পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। মীর দমাদ একজন অ্যারিস্টটল অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও ঐ মতবাদকে সমর্থন করেছেন। সদর আল-মুতাআল্লিহিনও এই মতের পক্ষে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছেন এবং ইবনে সিনার সমালোচনা করেছেন।

৪. নতুন সমস্যা : এসব প্রধান প্রধান সমস্যা নিয়েই ইসলামী দর্শনের মেরুদ- গঠিত এবং এসব সমস্যার কিছু কিছু নিয়েই অধিকাংশ সমস্যার ভিত্তিমূল গঠিত হয়েছে।

অস্তিত্ব সংশ্লিষ্ট প্রধান সমস্যাগুলো হচ্ছে : অস্তিত্বের মৌলিক বাস্তবতা (এসালাত আল-উজুদ), অস্তিত্বের ঐক্য (ওয়াহদাত আল-উজুদ), মানসিক অস্তিত্ব (আল-উজুদ আল-জিহনী), অনস্তিত্বের সূত্র, অস্তিত্বে বাধাপ্রাপ্ত বস্তুর প্রত্যাবর্তনের অসম্ভাব্যতা, ‘সৃষ্টি’ সমস্যা কারণের জন্য প্রয়োজনীয় একটি জিনিসের মানদ-, সারাংশের বিভিন্ন ধারণা, দর্শনের মাধ্যমিক বোধগম্যতা, কয়েক ধরনের অগ্রাধিকার, বিভিন্ন ধরনের আবশ্যকতা, অসম্ভাব্যতা ও সম্ভাব্যতা প্রভৃতি।

যুক্তিশাস্ত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত ঘটনা প্রবাহের মধ্যেই এই জ্ঞান ধারণা (তাসাউর) ও রায় (তাসদিক) এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। দৃশ্যত তা প্রথম করেছেন ফারাবী। এ ধরনের অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহ হচ্ছে, রায়ের বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাস, রায়কে বহির্দেশীয়, মানসিক (জিহনিয়্যাহ) ইত্যাদিতে বিভক্তকরণ, যা ছিল যুক্তিবিদ্যার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তা প্রথম করেছিলেন ইবনে সিনা।

আমি জানি যে, আমি ‘ওয়াহদাত আল-ওয়াজুদ’ এর সমস্যা অথবা ‘বাসিত আল-হাকিকাহ’ এর নীতিকে যেভাবে বিবেচনা করেছি তাতে কিছু কিছু পাঠক বিস্মিত হবেন এবং এই বলে আপত্তি জানাবেন যে, ওয়াহদাত আল-ওয়াজুদ হচ্ছে এমন একটি ধারণা যার ভারত ও গ্রীসে কয়েক হাজার বছরের একটি ইতিহাস রয়েছে এবং তা মূলত নব্য প্ল্যাটোবাদী বিশেষত প্লটিনাস এর কাছ থেকে মুসলমানদের সংগ্রহ করা ওয়াহদাত আল-ওয়াজুদ এর ধারণা।

এই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের জন্য একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় প্রয়োজন। মোটামুটিভাবে এখানে এ কথা বলা চলে যে, আমরা যদি সমস্যাগুলোকে ভাসাভাসা পন্থায় বিচার করি, তাহলে তা আমাদের কাছে আপত্তিকর বলে প্রতিভাত হবে। কিন্তু আমরা যদি এই বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাব মুসলিম সাধকদের একতা এবং তাদের অনুসরণ করে মুসলিম দার্শনিকরা বিশ্ব চরাচরের দিকে দৃষ্টিদান করেছেন এবং একেই তাঁরা ‘ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই ‘ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ’ অন্যান্য চিন্তাধারার অনুসারীদের বিশ্বাসের একতা। ইউরোপীয়রা যাকে ঢালাওভাবে সর্বেশ্বরবাদ আখ্যায়িত করেছে সেই বিশ্বাসের একতা থেকে তা সম্পূর্ণরূপে আলাদা।

আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এই প্রবন্ধে ইসলামে দর্শনের বিকাশ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা প্রদান করা। এতে যেসব সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে তার প্রত্যেকটির জন্য পর্যাপ্ত অধ্যয়ন প্রয়োজন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.