হযরত মাসুমা (সা)’র শুভ জন্মবার্ষিকী

হযরত মাসুমা (সা)’র শুভ জন্মবার্ষিকী

নবীজীর আহলে বাইতের মহিয়সী নারী হযরত মাসুমা (সা)’র শুভ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আপনাদের সবার প্রতি রইলো আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। তার আসল নাম ছিল ফাতেমা। মাসুমা ছিল তাঁর উপাধি। তিনি ছিলেন ইমাম মূসা কাজেম (আ) এর কন্যা এবং ইমাম রেযা (আ) এর বোন। ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় এই মহিয়সী নারী ধর্মীয় চিন্তাবিদ ও জ্ঞানী-গুণী-মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।তাঁর পবিত্র জন্মবার্ষিকীতে আমরা তাঁরই জীবনাদর্শ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

১৭৩ হিজরীর জিলক্বাদ মাসের এ্যাক তারিখে হযরত মাসুমা (সা) মদীনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের অনেক আগেই তাঁর প্রিয় দাদা ইমাম সাদেক (আ) তাঁর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বলেছিলেনঃ ইরানের কোম শহরে আমার বংশের এক নারী গমন করবে। তার নাম হবে ফাতেমা-সে মূসা ইবনে জাফরের মেয়ে। এরপর ইমাম সাদেক (আ) বলেন তাকে ঘিরে এই কোম শহরে রাসূলে খোদার খান্দানের জন্যে একটি পবিত্র স্থাপনা বা হেরেম হবে।

নবীজীর আহলে বাইত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন এই মহিয়সী নারীর জন্মের অপেক্ষায় দিন গুনছিল। অবশেষে সেই শুভ লগ্নটি ঘনিয়ে এলো। পহেলা জিলক্বাদে ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ) এবং তাঁর স্ত্রী নাজমার চোখগুলো নবজাতক কন্যা শিশুটির মুখখানি দেখে আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। শিশুকন্যার শুভজন্মে তাঁর ভাই ইমাম রেজা (আ)ও ভীষণ খুশি হলেন।

হযরত মাসুমা (সা) এর শৈশব কাটে পিতা ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ) এবং ভাই ইমাম রেযা (আ) এর বহু স্মৃতি বিজড়িত প্রিয় সান্নিধ্যে। যার ফলে তাদেঁর মহামূল্যবান জ্ঞান ভাণ্ডারের অসামান্য রত্নে সমৃদ্ধ হয় তাঁর জ্ঞান। অবশ্য শৈশবের এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। কেননা হারুনের কারাগারে তাঁর পিতা শাহাদাত বরণ করেন। দশ বছরের কন্যা শিশু মাসুমা (সা) এর জীবন জুড়ে তাই নেমে আসে দুঃখের করুণ অন্ধকার। পিতার মৃত্যুর পর ভাই ইমাম রেযা (আ) এর অভিভাবকত্বে বেড়ে ওঠেন তিনি। ইতিহাসে এসেছে ইমাম রেযা (আ) তাঁর বোন হযরত মাসুমা (সা) কে ভীষণ ভালোবাসতেন। একইভাবে মাসুমা (সা)ও ভাইয়ের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ।

মাসুমা (সা) ছিলেন উন্নত নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী। তাঁর আচার-ব্যবহারও ছিল শালীন। ধৈর্য ও স্থিরতায় তিনি ছিলেন অসম্ভব দৃঢ় মনোবল। ইতিহাসে এসেছে মাসুমা (সা) ছিলেন একজন হাদিস বিশেষজ্ঞ। তাছাড়া জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ খ্যাতি। একদিন আহলে বাইতের প্রতি অনুরক্ত একদল লোক ফিকাহ এবং অন্যান্য কিছু বিষয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যে মদীনায় ইমাম কাজেম (আ) এর কাছে আসেন। কিন্তু তারা যখন ইমামের বাড়িতে এলেন তখন জানলেন যে ইমাম সফরে গেছেন। নিরুপায় হয়ে তাঁরা তাঁদের প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে ইমামের পরিবারের কারো কাছে দিলেন যাতে পরবর্তী সফরে এসে তাদেঁর প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে পারেন।

ক’দিন পর বিদায় নেবার জন্যে তাঁরা ইমামের বাড়ির দরোজায় যান। সেখানে গিয়ে জানতে পান যে হযরত মাসুমা (সা) তাদের প্রশ্নগুলোর জবাব তৈরি করে রেখেছেন। প্রশ্নের জবাব পেয়ে তাঁরা ভীষণ খুশি হলেন। ফেরার সময় ইমাম কাজেম (আ) এর সাথে তাদেঁর দেখা হয় এবং তারা ইমামকে ঘটনাটা বর্ণনা করেন। ইমাম মাসুমা (সা) এর লেখা জবাবগুলো দেখেন এবং সেগুলো একদম সঠিক বলে অনুমোদন করেন। নিজের মেয়ের ব্যাপারে তিনি তখন তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করে বললেন-তার বাবা তার জন্যে উৎসর্গিত হোক।

পিতার সমৃদ্ধ জ্ঞানের ভাণ্ডারকে তিনি জনগণের মাঝে বিস্তার করেন। তিনি বাবার কাছে যা শিখেছেন এবং যেভাবে শিখেছেন ঠিক সেভাবেই তা জনগণের কাছে পৌছিয়েঁছেন। তিনি বাবার কাছে শিখেছেন অবস্থা যতো প্রতিকূলই হোক না কেন সর্বাবস্থায় সত্য ও সঠিক পথে অনড় থাকতে হবে,কোনোভাবেই সত্য থেকে দূরে সরা যাবে না।এইসব শিক্ষা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তাঁর ভাই তাঁর সহযোগী ছিলেন।২০০ হিজরীতে আব্বাসীয় খলিফা মামুনের পীড়াপীড়ি ও হুমকি ধমকির কারণে ইমাম রেযা (আ) বাধ্য হয়েছিলেন খোরাসানে যেতে। তিনি তাঁর পরিবারের কাউকে সঙ্গে না নিয়েই মারভের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।

তাঁর সফরের এক বছর পর ভাই ইমাম রেযা (আ) এর সাথে সাক্ষাৎ করা এবং মুসলমানদের নেতা ও ইমামের ব্যাপারে তাঁর দায়-দায়িত্ব পালনের জন্যে মাসুমা (সা) ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। সে অনুযায়ী তিনিও মারভের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এ সময় তাঁর সাথে তাঁর ভাই এবং আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই ছিলেন। পথিমধ্যে যাঁরাই মাসুমা (সা) এর কথা শুনেছে তারাই গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে এসেছে তাঁর সাথে দেখা করতে এবং তাঁর বিচিত্র জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে সমৃদ্ধি অর্জন করতে। জনগণের এরকম আগ্রহ আর ভালোবাসা দেখে তিনিও তাঁর দায়িত্ব পালন করার সুযোগ নেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বনী আব্বাসীয় শাসকদের প্রকৃত চেহারা জনগণের সামনে তুলে ধরেন এবং তাদের জুলুম-নির্যাতন আর প্রতারক নীতির কথা ফাঁস করে দেন। এগুলো তিনি আব্বাসীয়দের ভয়-ভীতি প্রদর্শন আর জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদেই তিনি করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হযরত মাসুমা (সা) ভাই ইমাম রেযা (আ) এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে মারভ শহরে যাবার জন্যে যে সফর শুরু করেছিলেন,সেই সফর শেষ হয় নি। তাদেঁর কাফেলা যখন সভে শহরে গিয়ে পৌছেঁ তখন বলদর্পী শাসক গোষ্ঠির অনেকেরই রোষানলে পড়ে যান তাঁরা। শাসক বাহিনী মাসুমা (সা) এর পথ রোধ করে দাঁড়ায় এমনকি তাঁর নিকটজনদের অনেককেই শহীদ করে। মাসুমা (সা)ও এই সফরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর পক্ষে আর মারভের পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয় তখন তাঁর সঙ্গীদের বললেন তাকেঁ যেন কোমে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেনঃ আমাকে কোম শহরে নিয়ে যাও! কেননা আমার বাবার কাছে শুনেছি যে তিনি বলেছিলেন এই শহরটি নবীজীর আহলে বাইতের প্রতি অনুরাগীদের কেন্দ্র। সে কারণেই তাকেঁ কোম শহরে নিয়ে যাওয়া হয়।

কোম শহরের লোকজন যখন হযরত মাসুমা (সা) এর আগমনের খবর জানতে পায় তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে দলে দলে এগিয়ে যায়। মূসা ইবনে খাযরাজ নামের এক লোক মাসুমা (সা) এর আতিথেয়তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাসুমা (সা) কোমের জনগণের মাঝে ১৭টি দিন অতিবাহিত করেন। জীবনের শেষ এ কটি দিন তিনি আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে কাটান। অবশেষে অসুস্থতার কারণে তিনি চিরন্তন সত্যের সান্নিধ্যে চলে যান। এভাবেই মহিয়সী এই নারী কোম শহরে স্থায়ীভাবে থেকে যান। ভাই ইমাম রেযা (আ) এর সাথে সাক্ষাৎ আর হয়ে উঠলো না। ইমাম রেযা (আ) বলেছেনঃ ‘যে-ই কোমে ফাতেমার যিয়ারতে যাবে,সে যেন আমাকেই যিয়ারত করলো।’

কোম শহরে মাসুমা (সা) এর মাযার মোবারক থাকায় আহলে বাইতের অনুসারীগণ ইরান থেকে তো বটেই এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোমে আসেন। এভাবে মানুষের আনাগোনার ফলে কালক্রমে কোম শহরটি গড়ে ওঠে। হযরত মাসুমা (সা) এর মহান অস্তিত্বের বরকতে কোমে গড়ে ওঠে ধর্মীয় বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। সেইসব প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী চিন্তাদর্শের বিকাশ ঘটে সমগ্র বিশ্বময়। ইসলাম নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এবং ইসলামী মহান মনীষীদের সৃষ্টি ও লালনপালন করার ক্ষেত্রে কোমের অবদান অবিস্মরণীয়। মাসুমা (সা) এর মাযারটি যেন এক মৌচাক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মৌমাছিরা এসে আধ্যাত্মিক এক সুরের গুঞ্জন তোলে এখানে। সেই গুঞ্জনে ভরে যায় ভক্ত-অনুরক্তদের মন,প্রশান্ত হয়ে ওঠে অশান্ত আত্মা। #

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *