৩ শাবান সাইয়্যেদুশ শুহাদা হোসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর জন্মদিন। ৪ হিজরির এই দিনে তিনি মদীনায় জন্মলাভ করেন। তাঁর মূল নাম আল-হোসাইন এবং ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা’ তাঁর উপাধি। হযরত হোসাইন (আ.)-এর একটি ডাক নামও ছিল আবু আবদুল্লাহ।
হযরত হোসাইন (আ.)-এর পিতার নাম আমীরুল মুমিনীন ইমাম হযরত আলী (আ.) এবং মাতার নাম হযরত ফাতেমা (আ.)। হযরত ফাতেমা (আ.) ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কন্যা। সেই হিসাবে হযরত হোসাইন (আ.) ছিলেন মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র।
হযরত হোসাইন (আ.) ছিলেন নবুওয়াতী ধারার তৃতীয় ইমাম। মহানবী (সা.)-এর কাছে শিশু হোসাইনের জন্মের সুসংবাদ পৌঁছলে তিনি হযরত ফাতেমার বাসভবনে যান এবং নবজাতককে কোলে তুলে নিয়ে তাঁর ডান ও বাম কানে যথাক্রমে আজান ও একামত পাঠ করে শোনান। শিশু হোসাইনের জন্মের সপ্তম দিনে মহানবী (সা.) আকীকা সম্পাদন করে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তাঁর নাম রাখেন আল-হোসাইন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন : ইমাম হোসইন (আ.)-এর জন্মদিনে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-কে অবতরণ করে তাঁর নিজের ও ফেরেশতা জিবরাইলের পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-কে অভিনন্দন জানাতে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) একটি দ্বীপের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে ছিলেন ফুতরাস নামের এক ফেরেশতা যাঁকে আল্লাহ প্রদত্ত একটি কর্ম সম্পাদনে বিলম্বের দরুন নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। তাঁর পাখা খর্ব করা হয় এবং ঐ দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়। তিনি কয়েক বছর ধরে ঐ দ্বীপে অবস্থান করছিলেন এবং আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য ইবাদত করে কাটাচ্ছিলেন।
জিবরাইল (আ.)-কে দেখে ফুতরাস জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জিবরাইল তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ জিবরাইল (আ.) গন্তব্যস্থল এবং গমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করলে তিনি তাঁকে মহানবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন যাতে তিনি মহানবীকে আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর অনুকূলে সুপারিশ করার অনুরোধ করতে পারেন। জিবরাইল (আ.) ফুতরাসকে সাথে নিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছে আল্লাহ তাআলা এবং নিজের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানালেন। পরে ফেরেশতা ফুতরাসের কথাও মহানবী (সা.)-কে জানালেন। মহানবী (সা.) জিবরাইল (আ.)-কে বললেন, ‘আপনি ঐ ফেরেশতাকে এই নবজাতক শিশুর শরীর স্পর্শ করতে এবং আসমানে তাঁর জায়গায় ফিরে যেতে বলুন।’ ফুতরাস শিশু হোসাইনের শরীর স্পর্শ করা মাত্র আল্লাহর কৃপায় তাঁর পাখা ফিরে পেলেন এবং মহানবী (সা.) ও তাঁর নবজাতক দৌহিত্রের প্রতি মোবারকবাদ জানিয়ে আসমানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
ইমাম আলী ইবনে আবু তালিব (আ.) ও হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর দুই পুত্র হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.)-কে মহানবী (সা.) জান্নাতে যুবকদের সর্দার বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মহানবী (সা.) সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে, আমীর মুআবিয়ার পুত্র ইয়াযীদ যখন ইসলামের আকীদা-বিশ্বাসকে ধ্বংস করার চেষ্টা করবে তখন তাঁর দ্বিতীয় দৌহিত্র হোসাইন (আ.) তা জিন্দা করবেন।
ইয়াযীদ তার শয়তানি চরিত্র ও বর্বরোচিত আচরণের জন্য কুখ্যাত ছিল। সে অত্যন্ত লম্পট প্রকৃতির লোক হিসাবেও পরিচিত ছিল। জনসাধারণ ইয়াযীদের এই চরিত্রের কথা জানতে পেরে একটি চুক্তিনামা সম্পাদন করে যাতে আমীরে মুআবিয়া ইয়াযীদকে তার উত্তরাধিকার নিযুক্ত করতে না পারেন। ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার সময় মুআবিয়া এই অঙ্গীকার করেছিলেন বটে, কিন্তু মুআবিয়া তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন এবং ইয়াযীদকে তার উত্তরাধিকার নিয়োগ করেন।
ক্ষমতায় আসার পরপরই ইয়াযীদ পূর্ণ মাত্রায় তার চরিত্র অনুযায়ী কার্যকলাপ শুরু করে। সে ইসলামের মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের উপর হস্তক্ষেপ শুরু করে এবং অবাধে সকল অন্যায় ও অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। এমনকি নিজেকে মহনবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারের আসনে বসিয়ে তাকে রাহবার (নেতা) হিসাবে মেনে নিয়ে তার কাছে বাইয়াত গ্রহণের দাবি করতে থাকে। অথচ ইয়াযীদের মতো ব্যক্তির হাতে বাইআত গ্রহণের অর্থ ছিল একজন শয়তানকে স্বীকার করে নেয়া। তাই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মতো একজন খোদায়ী ব্যক্তিত্ব যদি ইয়াযীদের কর্তৃত্ব মেনে নেন তাহলে সেটাও হবে প্রকৃতপক্ষে শয়তানের প্রতি মানুষের স্বীকৃতি। ইয়াযীদ ইমাম হোসাইনের কাছে আনুগত্যের বাইয়াত দাবি করলেও ইমাম কোন অবস্থাতেই তা মেনে নিতে পারেন না। জনসাধারণ এই স্বৈরাচারের হাতে মৃত্যু ও ধ্বংসের আশঙ্কা করে তাঁর কাছ থেকে সরে পড়তে লাগলো। ইমাম হোসাইন বললেন, যা কিছুই ঘটুক না কেন তিনি কখনই খোদার কাছ থেকে শয়তানের কাছে যাবেন না এবং মহানবী (সা.) যা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা ব্যর্থ হতে দেবেন না।
এই পাষ-ের কাছে বাইআত গ্রহণে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তাঁর উপর শুরু হয় অত্যাচার ও নির্যাতন। যার ফলে তাঁকে মদীনায় নির্জন জীবন যাপন করতে হয়। সেখানেও তাঁকে শান্তিতে বসবাস করতে দেয়া হলো না, তিনি মক্কায় হিজরত করতে বাধ্য হন। মক্কায় তাঁকে চরমভাবে হয়রানি করা হয়। ইয়াযীদ মহামর্যাদাসম্পন্ন কাবার পবিত্র সীমানার মধ্যেই ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
ইমাম হোসাইন (আ.) তখন পবিত্র কাবার মর্যাদা রক্ষার তাগিদে হজের মাত্র একদিন আগে মক্কা ছেড়ে কুফায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিন হজ, অথচ এই সময় তিনি কেন মক্কা ছেড়ে চলে যাবেন তার রহস্য জিজ্ঞাসা করা হলে ইমাম হোসাইন বলেন, তিনি এ বছরের হজ কারবালায় সম্পাদন করবেন এবং কোন পশু কোরবানি না করে তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও কিছু ঈমাদার বন্ধু-বান্ধবকে কোরবানি দিবেন। কারবালার মহান আত্মত্যাগের সময় তাঁর সাথে তাঁর যেসব আত্মীয়-স্বজন জীবন দান করবেন তিনি পরপর তাঁদের নামও প্রকাশ করলেন।
ইয়াযীদের স্বৈরাচারী ও শয়তানি শাসনে অতিষ্ট কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে অসংখ্য চিঠি লিখে ও দূত পাঠিয়ে তাঁকে কুফায় আগমন ও তাঁদেরকে ঈমানের দিকনির্দেশনা দানের অনুরোধ করে। ইমাম হোসাইন যদিও এই আমন্ত্রণের চূড়ান্ত পরিণতি কী তা জানতেন তা সত্ত্বেও খোদা মনোনীত ইমাম হিসাবে তিনি হেদায়েত দানের এই আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেননি। ইমাম হোসাইন (আ.) যখন তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে কারবালায় পৌঁছলেন তখন তাঁর ঘোড়া রহস্যজনকভাবে এক জায়গায় থেমে যায় এবং আর সামনে অগ্রসর হচ্ছিল না। ইমাম ঘোষণা করলেন, ‘এই সেই জায়গা- দুঃখ-কষ্ট ও যাতনার জায়গা।’ তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে অবতরণ করলেন এবং সঙ্গী-সাথীদেরকে সেখানে শিবির স্থাপনের আদেশ দিয়ে বললেন, ‘এখানে আমরা শহীদ হতে পারি এবং আমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করা হতে পারে। এখানে আমাদের তাঁবুতে অগ্নিসংযোগ করা হতে পারে এবং আমাদের পরিবারবর্গকে বন্দি করা হতে পারে। এই সেই জায়গা যে জায়গা সম্পর্কে আমার নানাজান আগেই বলেছিলেন এবং তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী নিশ্চিতভাবেই পূর্ণ হবে।’
৭ মুহররম ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শিবিরে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণার যন্ত্রণা শুরু হয়। ইমামের শিবিরে তখন ছিল নিরপরাধ শিশু-কিশোর ও নারীসহ নবী পরিবারের কতিপয় পুরুষ সদস্য। আরো ছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কতিপয় বিশ্বস্ত অনুসারী যাঁরা আল্লাহর ওয়াস্তে ইমামের সাথে একাত্ম হয়ে শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
১০ মুহররম ভোরে ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের সৈন্যবাহিনীর দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখালেন যে, উমর ইবনে সা’দ তার বাহিনীকে ইমামের অনুসারীদের দিকে অগ্রসর হওয়ার হুকুম দিচ্ছে। তখন ইমাম তাঁর অনুসারীদেরকে একত্র করে তাঁদের উদ্দেশে এই ভাষণ দিলেন, ‘আজকের এই দিনে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এক পবিত্র জেহাদে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছেন এবং তিনি আমাদেরকে শাহাদাতের জন্য অবশ্যই পুরস্কৃত করবেন। অতএব, তোমরা ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করো। হে মহান ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের সন্তানগণ! ধৈর্য ও সহনশীল হও। মৃত্যু একটি সেতু ছাড়া আর কিছুই নয়, জান্নাতে প্রবেশ এবং আনন্দ উপভোগ করার জন্য যা অতিক্রম করার কষ্ট ও ক্লেশ, তা ভোগ করতেই হবে। তোমাদের মধ্যে কে না চায় এই কারাগার (পৃথিবী) ছেড়ে সুরম্য প্রাসাদে (জান্নাত) যেতে?’
ইমাম হোসাইন (আ.)- এর ভাষণ শুনে তাঁর সকল সঙ্গী-সাথি সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হে আমাদের নেতা! আমরা সকলেই আপনাকে ও আপনার আহলে বাইতের রক্ষা করতে এবং ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।’
এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) জেহাদ করার এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার জন্য একের পর একজনকে তাঁর শিবির থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেন। একে একে যখন সকল পুরুষ ও শিশু তাঁদের জীবন দান করলেন তখন সবশেষে ইমাম তাঁর ছয় মাস বয়সের শিশুপুত্র আলী আসগরকে বের করে এনে তাকে নিজের হাতের উপর তুলে নিয়ে তৃষ্ণায় মৃত্যুমুখী শিশুটির জন্য কিছু পানি চাইলেন। শিশু আসগরের তৃষ্ণা সেদিন মিটেছিল বর্বর বাহিনীর নিক্ষিপ্ত বিষ মাখানো তীরের আঘাতে, যা তার ঘাড়ে বিঁধেছিল অসহায় পিতার বাহু বেষ্টনীতে থাকা অবস্থায়। অবশেষে ছয় মাসের শিশুপুত্রটিও যখন নিহত হলো তখন ইমাম হোসাইন (আ.) আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন, ‘হে প্রভু! তোমার হোসাইন তোমার কাছে নিবেদন করছে যেমন করে তুমি তাকে তা করতে তৌফিক দিয়েছ। হে আল্লাহ! তুমি তোমার হোসাইনকে এই ত্যাগ স্বীকারের তৌফিক দান করো। হোসাইন এ পর্যন্ত যা কিছু করতে পেরেছে তার সবই তোমার সাহায্য ও রহমতের মাধ্যমে।’ এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) ময়দানে এগিয়ে গেলেন এবং শহীদ হলেন। ক্ষমার অযোগ্য সেই হতাযজ্ঞের বিস্তারিত বর্ণনা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। ইয়াযীদের সৈন্যরা ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করে তাঁর দেহ থেকে মস্তক কেটে বিচ্ছিন্ন করে একটি বল্লমে বিদ্ধ করে রাখে। বল্লমের ঐ শাখা থেকে ইমামের মস্তক মোবারক থেকে যেন আল্লাহর মহিমা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল আর যেন ঘোষণা করছিল, ‘আল্লাহু আকবার। সকল মহিমা আল্লাহর, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।’
(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯২)