ইমাম খোমেনী (রঃ)এর দৃষ্টিতে মুক্তি ও স্বাধীনতা

ইমাম খোমেনী (রঃ)এর দৃষ্টিতে মুক্তি ও স্বাধীনতা

ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সময় “স্বাধীনতা, মুক্তি ও ইসলামী গণ-শাসন ব্যবস্থা” ছিল ইরানি জনগণের এবং তাদের অবিসংবাদিত নেতা মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)’র অন্যতম প্রধান শ্লোগান। ১৯৭৯ সালে বিপ্লব বিজয়ের পরই ইরানের রাজনৈতিক ও আইনী কাঠামোয় স্বাধীনতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার চেষ্টা শুরু হয়। পর পর বেশ কয়েকটি গণভোট ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দেশটিতে গড়ে ওঠে স্বাধীন রাজনৈতিক দল, সংবাদপত্র ও বিভিন্ন নাগরিক প্রতিষ্ঠান।
এভাবে ইসলামী বিপ্লবের আদর্শে উজ্জ্বীবিত ইরান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নানা বাধা ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও স্বাধীনতা ও মুক্তির আদর্শ বাস্তবায়নে সক্রিয় থেকেছে এবং স্বৈরাচারি সরকারের পতন ঘটানোর পর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। আর এ কারণেই ইসলামী ইরান আজ একটি স্বাধীনচেতা ও মুক্ত দেশ হিসেবে বিশ্বে অনন্য গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত।ইরানের মুসলিম জাতির বিপ্লবী আদর্শ বর্তমানে নিপীড়িত ও স্বৈরশাসনের শিকার মুক্তিকামী জাতিগুলোর জন্য অনুকরণীয় মডেল। ইরানের ইসলামী গণ-শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় শাসনেরও এক অনন্য আদর্শ। “ধর্ম মেনেই স্বাধীনতা অর্জন” ছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আন্তর্জাতিক বার্তা। অথচ সমাজবাদী ও লিবারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার কর্তৃত্বাধীন আধুনিক বিশ্ব-ব্যবস্থায় ধর্মীয় আইন-ভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থার কথা কেউ কল্পনাও করেনি।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বার্তা মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে জাগরণের জোয়ার বইয়ে দেয়। মুক্তিকামী আন্দোলনগুলো ইসলামী জাগরণে রূপান্তরিত হয়। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে বেলজিয়ামের বিশিষ্ট গবেষক ক্রিস জনসন বলেছেন, “ইরানের ইসলামী বিপ্লব তার বিজয়ের লগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত মুক্তিকামী ও স্বাধীনচেতা জাতিগুলোর আদর্শ। এমনকি এ বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও নন্দিত হচ্ছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিকামীতার ক্ষেত্রে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এই মহান বিপ্লবের ফলে জাতিগুলো তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ও মুক্তিকামী আন্দোলনে আরো অবিচল বা দৃঢ়-সংকল্প হয়ে উঠছে।”
ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের পাশাপাশি স্বাধীনতা বা মুক্তি বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমা মতাদর্শের মত একপেশে নয়। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, “মহান আল্লাহ তোমাদের স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন, তাই কারো গোলাম বা দাস হয়ো না।” স্বাধীনতা ধীরে ধীরে অর্জিত কোনো বিষয় নয়। বরং মানুষের স্বাধীনতা মহান আল্লাহর এমন এক উপহার যা মানুষের প্রকৃতির সাথে মিশে রয়েছে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা মানুষের ধর্মীয় ও প্রকৃতিগত অধিকার। ইসলামে স্বাধীনতা বেঁচে থাকার অধিকার ও জীবন যাপনের অধিকারের মতই গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ চিন্তা, বিশ্বাস ও আদর্শ বেছে নেয়ার ব্যাপারে স্বাধীন এবং স্বাধীন মতের অধিকারী ব্যক্তির সকল অধিকারকেও স্বীকার করে। এই ধর্মের দৃষ্টিতে মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি ও যোগ্যতার আলোকে জীবনের পথ অতিক্রম করার ব্যাপারেও সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে ইসলাম স্বাধীনতার কিছু সীমারেখা টেনে দিয়েছে যাতে তা মানুষের বিভ্রান্তি ও অধপতন কিংবা অন্যদের ক্ষতির মাধ্যম না হয় বা অন্যদের স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ না করে।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রঃ) স্বাধীনতা ও মুক্তিকামীতাকে ইসলামী বিপ্লবের ভিত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ” মানুষের জীবন তখনই মূল্যবান যখন তা হবে স্বাধীন এবং আমরা পরাধীন জীবনের কোনো মূল্য আছে বলে মনে করি না।” তাই তিনি স্বাধীনতা অর্জন ও তা রক্ষা করাকে প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব বলে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) বলেছেন, ” স্বাধীনতা এক খোদায়ী আমানত যা মহান আল্লাহই আমাদের দান করেছেন।”

অন্য কথায়, অমূল্য এ আমানত রক্ষার ব্যাপারে কোনো ধরনের অবহেলা বা বিশ্বাসঘাতকতা মোটেই কাম্য নয়। মহান এই ইমাম অন্যত্র বলেছেন, ” আমাদের জাতি বিপ্লব করেছে এবং এ বিপ্লবকে এগিয়ে নেয়া গোটা মানব জাতির যৌক্তিক দায়িত্ব।… … জনগণ তাদের প্রাথমিক অধিকার দাবি করছে। স্বাধীন থাকা ও নিজের কথা স্বাধীনভাবে বলা মানুষের প্রাথমিক অধিকার।”

ইমাম খোমেনী (রঃ) স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণার বক্তব্য তুলে ধরে বলেছেন, “মানবাধিকারের ঘোষণায়ও বলা হয়েছে, যে কোনো জাতির প্রত্যেক ব্যক্তি তার মতামত তুলে ধরার ব্যাপারে স্বাধীন এবং প্রত্যেক জাতি নিজের ভাগ্য নিজে নির্ধারণ করার অধিকার রাখে- আর এটা হচ্ছে মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকার।” তাই মার্কিন সরকারসহ মানবাধিকারের ধ্বজাধারী যেসব পশ্চিমা সরকার ইরানি জনগণের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে যেসব ষড়যন্ত্র করছে সেগুলো অব্যাহত রাখার বা নতুন কোনো ষড়যন্ত্র পাকানোর কোনো অজুহাত বা যুক্তি নেই।

ইমাম খোমেনী (রঃ)’র মতে মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হলে তারা বিভ্রান্ত হয় এবং অধঃপতনের শিকার হয়। বিপ্লব ও পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষের যে বিকাশ, উন্নয়ন বা পরিপক্কতা ঘটে তা স্বাধীনতার ছায়াতলেই সম্ভব। মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরার পর মুক্ত বা স্বাধীন চিন্তার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, “চিন্তার স্বাধীনতার অর্থ মানুষ স্বাধীনভাবে বা নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করবে। জ্ঞানগত বিষয় বা বৈজ্ঞানিক বিষয়ে স্বাধীন চিন্তার ফল হয় এক ধরনের এবং আর পূর্বানুমান বা বিশেষ অবস্থানের ভিত্তিতে ওই বিষয়ে চিন্তার ফল হয় অন্য ধরনের।”

মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)’র মতে, নৈতিকতার বিরোধী ও লাগামহীন খেয়াল-খুশী উদ্ভুত স্বাধীনতা তথা পাশ্চাত্যের কথিত স্বাধীনতাকে মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক। তাঁর মতে, এ ধরনের নিয়ম-বহির্ভূত স্বাধীনতা অন্তসারশুন্য। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ” পাশ্চাত্য কল্যাণকর বা ভাল কিছু আমাদেরকে দেয় না। পশ্চিমারা ইরান ও প্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য যে স্বাধীনতা দিতে চায় বা যেসব বিষয়ে স্বাধীনতা দিতে চায় সেগুলো আমাদের জাতি ও যুব সমাজের জন্য ধ্বংসের মাধ্যম।” ইমাম খোমেনী (রঃ)’র দৃষ্টিতে রাষ্ট্র জনগণের নাগরিক স্বাধীনতার পথে বাধা নয়, বরং মানুষের স্বাধীনতাগুলো মানবাধিকার ও ইসলামী আইনের আওতায় অর্থবোধক হয়। তাই নবী-রাসূলগণের শিক্ষার আলোকে ইরানে স্বাধীনতার নানা দিকের বিকাশ ঘটানোর ব্যবস্থা করেছেন তিনি। যেমন, সামাজিক স্বাধীনতা, বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা, নারীর ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা।

মানুষের পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ইমাম খোমেনী (রঃ) স্বৈরাচারী ও পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক মুসলিম সরকারগুলোর কঠোর সমালোচনা করতেন। আর তাই তিনি ওইসব দেশের জনগণকে মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য জেগে উঠতে বলতেন। মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)’র ইন্তেকালের ২২ বছর পরও তাঁর ওইসব বার্তার প্রতি জাতিগুলো ও বিশেষ করে আরব বিশ্বের জনগণের সাড়া প্রদান অব্যাহত রয়েছে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি জালেম শাসক, শোষক ও দখলদার শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে মিশর, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইনের মত দেশগুলোর জনগণ জেগে উঠেছে। #

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.