(মদীনা থেকে কারবালা পর্যন্ত)
মীনায় মদীনার আলেমদের সাথে বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণ
আমীর মু‘আবিয়ার জীবনের শেষ বছরে তথা কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর আগে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) পবিত্র মক্কা নগরীর পার্শ্ববর্তী মীনায় মদীনার আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে তিনি নিমেণাক্ত ভাষণ প্রদান করেন :
‘হে লোকসকল! আল্লাহ্ তা‘আলা (বনি ইসরাইলের) আলেমদের যে তিরস্কার করেছেন ও উপদেশ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ কর। তিনি এরশাদ করেছেন :
لَوْلَا يَنْهَاهُمُ الرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ عَن قَوْلِهِمُ الْإِثْمَ وَأَكْلِهِمُ السُّحْتَ ۚ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَصْنَعُونَ ﴿٦٣﴾
‘‘কেন (তাদের মধ্যকার) রাববানিগণ (আরেফ ও দরবেশগণ) ও আলেমগণ তাদের পাপ-কথা বলতে ও হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করল না?’’১
আল্লাহ্ আরও এরশাদ করেছেন :
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ۚ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا يَعْتَدُونَ ﴿٧٨﴾ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ ۚ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ ﴿٧٩﴾
‘‘বনি ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফ্্রীতে লিপ্ত হয়েছিল তাদেরকে দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের কণ্ঠে অভিসম্পাত করা হয়। কারণ, তারা নাফরমানী করত ও (আল্লাহ্র নির্ধারিত) সীমা লঙ্ঘন করত। তারা যে সব মন্দ কাজ করত তা থেকে তারা পরস্পরকে নিষেধ করত না; তারা যা করত তা কতই না নিকৃষ্ট কর্ম!’’২
কেন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের এভাবে তিরস্কার করলেন? কারণ, তারা যালেমদের- পাপাচারীদের যুলুম ও পাপ কাজ করতে এবং ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করতে দেখত, কিন্তু তাদের কাছ থেকে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা লাভ ও যুলুমের হাত থেকে নিরাপদ থাকার উদ্দেশ্যে তাদের এ সব থেকে নিষেধ করত না। অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন :
ۚ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ
‘‘…তোমরা লোকদের ভয় কর না, কেবল আমাকেই ভয় কর…।’’৩
তিনি আরও এরশাদ করেছেন :
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ
‘‘আর মু’মিন পুরুষগণ ও নারিগণ পরস্পরের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক; তারা (পরস্পরকে) ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে…।’’৪
আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াতে ভাল কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখাকে সর্বপ্রথম কর্তব্যকাজ (ফরয) হিসাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কারণ, এ ফরয কাজটি আঞ্জাম দেওয়া হলে সহজ ও কঠিন নির্বিশেষে অন্য সমস্ত ফরয কাজই আঞ্জাম দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। এছাড়া ‘ভাল কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখা’ মানে হচ্ছে ইসলামের প্রতি দাওয়াত প্রদান। কারণ, এর মানে হচ্ছে যুলুম-অত্যাচারের উচ্ছেদ সাধন, যালেম-অত্যাচারীদের প্রতি বিরোধিতা প্রদর্শন, বাইতুল মালের সম্পদ ও গনিমতের মাল (সকলের মাঝে সমভাবে) বণ্টনের এবং যাদের ওপর কর প্রযোজ্য তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা ও প্রকৃত হকদারদের মধ্যে তা বণ্টন করা।
হে শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ! কল্যাণ ও নেক আমলের জন্য খ্যাতিমান ব্যক্তিগণ! আর অন্যদের নসিহত করা ও উপদেশ দানের জন্য বিখ্যাত লোকেরা! জেনে রেখ, মানুষের অন্তরে তোমাদের জন্য যে ভক্তিশ্রদ্ধা ও মর্যাদা রয়েছে তা কেবল আল্লাহ্রই কারণে। তারা তোমাদের মধ্যকার শক্তিশালী লোকদের প্রতি আশার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে এবং তোমাদের মধ্যকার দুর্বল ও অক্ষমদের তারা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। তারা তাদের স্বজনদের তোমাদের জন্য উতসর্গ করে, যদিও তাদের ওপরে তোমাদের কোনই শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তাদের প্রয়োজন পূরণ না হলে তারা তোমাদের কাছে সুপারিশ চায়, আর তোমরা রাজা-বাদশাহ্দের ন্যায় শান-শওকতের সাথে এবং সমাজের শীর্ষস্থানীয় লোকদের ন্যায় মর্যাদা সহকারে পথ চলে থাক। এ সব কি কেবল এ কারণে সম্ভব হচ্ছে না যে, মানুষ তোমাদের ওপর এ মর্মে আশাবাদী যে, তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত অধিকারসমূহ পুনরুদ্ধারের জন্য রুখে দাঁড়াবে? কিন্তু বেশির ভাগ বিষয়েই তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছ এবং ইমামগণের অধিকারসমূহকে খুব হাল্কাভাবে নিয়েছ, আর দুর্বলদের অধিকারকে পয়মাল করেছ।
তোমরা যাকে নিজেদের অধিকার বলে মনে করেছ তা তোমরা অবৈধভাবে হস্তগত করেছ। অথচ তোমরা না আল্লাহ্র রাস্তায় তোমাদের ধনসম্পদ দান করেছ, না নিজেদের প্রাণ বিপদাপন্ন করেছ, আর না আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য নিজ নিজ গোত্র ও স্বজনদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছ।
বাহ্! এহেন ঘৃণ্য আমল সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা‘আলার বেহেশত লাভের ও নবী-রাসূলগণের প্রতিবেশী হবার এবং খোদায়ী আযাব হতে নিরাপদ থাকার আকাঙক্ষা পোষণের মত কেমন ধৃষ্টতাই না তোমরা দেখাচ্ছ!
ওহে, আল্লাহ্র কাছে এ ধরনের প্রত্যাশা পোষণকারীরা! আমার ভয় হচ্ছে যে, তোমাদের ওপর হয়ত আল্লাহ্র পক্ষ থকে আযাব নাযিল হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে এমন এক অবস্থানে উপনীত হয়েছ যে, অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছ। এমন কত লোকই না আছে যারা জনগণের মধ্যে সম্মানের পাত্র নয়, অথচ কেবল আল্লাহ্র জন্য তোমরা তাঁর বান্দাহ্দের মধ্যে সম্মানজনক অবস্থানের অধিকারী। অথচ তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কৃত অঙ্গীকারসমূহ ভঙ্গ হতে দেখছ, কিন্তু এ ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছ না এবং এ ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার ভয়ও সৃষ্টি হচ্ছে না। তোমাদের পূর্বপুরুষদের কতক অঙ্গীকার বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তোমরা বিলাপ করছ, অথচ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তিসমূহকে উপেক্ষা করছ। শহরগুলোতে অনেক অন্ধ লোক আছে, অনেক বোবা লোক আছে, অনেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোক আছে, কিন্তু তোমরা না তাদের প্রতি কোন দয়া দেখাচ্ছ, না তোমাদের পক্ষে সম্ভব এমন কোন কাজ তাদের জন্য করছ, না এ ধরনের কাজ করার জন্য নিয়্যত পোষণ করছ; বরং তোমরা কেবল নিজেদের স্বার্থ ও আরাম-আয়েশের জন্য যালেম-অত্যাচারীদের তোষামোদ করছ।
আল্লাহ্ তা‘আলা এ ধরনের নোংরা কাজ প্রতিহত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তোমরা এ ব্যাপারে একেবারেই গাফেল- উদাসীন; তোমরা হচ্ছ সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক লোক। কারণ, তোমরা জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও জেনে-শুনে তোমাদের দায়িত্ব পালন থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছ। অথচ জনসাধারণের কাজকর্ম ও আইন-কানুন বাস্তবায়নের দায়িত্ব আলেমদের হাতে থাকা উচিত- যারা হবে আল্লাহ্ তা‘আলার নির্ধারিত হালাল-হারাম কার্যকরকরণের ব্যাপারে আমানতদার।
কিন্তু এ দায়িত্ব ও এ মর্যাদা তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কারণ, তোমরা সত্যের অক্ষ থেকে দূরে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছ। অকাট্য দলীল-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাতের ব্যাপারে মতানৈক্যে লিপ্ত হয়েছ। দুঃখকষ্টের মোকাবিলায় তোমরা যদি ধৈর্যের পরিচয় দিতে এবং আল্লাহ্র দীনের পথে কষ্ট ও কাঠিন্য সহ্য করে নিতে তাহলে আল্লাহ্র দীনের বিষয়াদি কার্যকর করার দায়িত্ব তোমাদের হাতে এসে যেত। কিন্তু তোমরা যালেমদের নিজেদের জায়গায়- নিজেদের পদে ও মর্যাদায় বসিয়েছ এবং আল্লাহ্র দীনের বিষয়াদি তাদের হাতে সোপর্দ করেছ। আর তারা ভুলভাবে কাজ করে চলেছে এবং স্বীয় প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তোমরা কি জান যে, কেন যালেমরা সকল বিষয়ের কর্তৃত্ব দখল করতে পেরেছে? কারণ, তোমরা মৃত্যুর হাত থেকে পলায়ন করেছ, তোমরা অপসৃয়মান পার্থিব যিন্দেগীর সাথে প্রেমিকসুলভ হৃদয় সহকারে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছ।
এরপর তোমরা দুর্বল ও অসহায় লোকদেরকে যালেমদের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছ; এর ফলে তারা অনেককে তাদের দাস ও অধীনে পরিণত করেছে এবং অনেককে এক লোকমা খাদ্যের জন্য অসহায় ও অক্ষমে পরিণত করেছে। যালেমরা আল্লাহ্র রাজত্বে স্বেচ্ছাচারিতার সাথে যেমন খুশি পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং তাদের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় পথকে সহজ করে দিচ্ছে। তারা বদমাশ ও নীচ প্রকৃতির লোকদের অনুসরণ করছে এবং ধৃষ্টতার সাথে আল্লাহ্ তা‘আলার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। তারা প্রতিটি শহরেই খুতবার মিম্বারে উঠে বক্তব্য পেশের জন্য বক্তা নিয়োগ করেছে এবং এ বক্তারা চিৎকার করে চলেছে ও উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে। ধরণি পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং সকল ক্ষেত্রেই তাদের হস্ত উন্মুক্ত ও প্রসারিত। জনগণ এমনভাবে তাদের দাসে পরিণত হয়েছে যে, তাদের মাথায় যে কেউ করাঘাত করুক না কেন, তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম নয়।
এই হিংসুক ও ঈর্ষাকারী উদ্ধত যালেমদের একটি গোষ্ঠী অসহায়দের ওপর অত্যন্ত কঠিনভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তাদের একটি গোষ্ঠী হচ্ছে এমন ধরনের শাসক যে, না তারা আল্লাহ্কে মানে, না তারা শেষ বিচারের দিনের ওপর ঈমান রাখে। আশ্চর্য!
কেনই বা বিস্মিত হব না? একজন ধোঁকাবাজ ও প্রতারক ব্যক্তি-পরকাল যার অন্ধকার-হুকুমত দখল করেছে; মু’মিনদের দায়িত্বের বোঝা এমন এক ব্যক্তি কাঁধে তুলে নিয়েছে যে কখনই তাদের প্রতি দয়া দেখায় না।
আমাদের ও তার মাঝে যে বিরোধ দেখা দিয়েছে সে ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘আলাই সর্বোত্তম ফয়সালাকারী; তিনিই তার সাথে আমাদের লড়াইয়ের ফয়সালা করে দেবেন।
হে আল্লাহ্! তুমি আমাদের কাজকর্ম সম্বন্ধে অবগত; তুমি জান যে, আমরা যা বলছি তা না কর্তৃত্ব ও শাসনক্ষমতা হস্তগত করার জন্য, না কারও প্রতি শত্রুতা ও ঈর্ষা চরিতার্থ করার জন্য; বরং (আমাদের সংগ্রাম এজন্য যে,) যাতে তোমার পতাকাকে উড্ডীন করতে পারি, তোমার বান্দাহ্দের ভূখন্ডকে আবাদ করতে পারি, যালেম ও নিপীড়কদের হাত থেকে তোমার বান্দাহ্দের নিরাপদ করতে পারি, আর (সমাজের বুকে) তোমার আহকাম, সুন্নাত ও ফরযগুলোকে বাস্তবায়ন করতে পারি। তুমি যদি আমাদের সাহায্য না কর তাহলে যালেম ও নিপীড়ক গোষ্ঠী বিজয়ী হবে এবং তোমার নবী-রাসূলগণের নূরকে নির্বাপিত করে ফেলবে।
আল্লাহ্ই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং আমরা তাঁরই ওপর ভরসা করি, আর তাঁর পথেই আমরা চলব এবং তাঁর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন।৫
আমীর মু‘আবিয়ার মৃত্যু ও ইয়াযীদের বাই‘আত্ দাবি
৬০ হিজরির রজব মাসে মু‘আবিয়া বিন্ আবু সুফিয়ানের মৃত্যুর পর ইয়াযীদ (তার ওপর আল্লাহ্র লা‘নত) দামেশ্্কের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়। সে ক্ষমতায় বসেই মদীনার প্রশাসক ওয়ালীদকে এক পত্র মারফত মদীনাবাসীর, বিশেষ করে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বাই‘আত্ আদায়ের জন্য নির্দেশ দেয়। ইয়াযীদ তার পত্রে মদীনার প্রশাসককে এ মর্মে আদেশ দেয় যে, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ হতে অস্বীকৃতি জানালে যেন তাঁকে হত্যা করা হয় এবং তাঁর মাথা দামেশ্্কে ইয়াযীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ইয়াযীদের নিকট থেকে পত্র পাওয়ার পর ওয়ালীদ বনি উমাইয়্যার বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি মারওয়ান বিন্ হাকামকে ডেকে পাঠায় এবং হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে করণীয় সম্বন্ধে তার সাথে পরামর্শ করে। মারওয়ান বলে : ‘সে বাই‘আত্ হতে রাযী হবে না; তোমার জায়গায় আমি হলে তার শিরশ্ছেদ করতাম।’
ওয়ালীদ বলল : ‘হায়! আমার যদি আদৌ জন্ম না হত!’ এরপর সে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠায়।
ইমাম হুসাইন (আ.) বনি হাশিমের ত্রিশ জন লোক ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের সাথে নিয়ে ওয়ালীদের কাছে এলেন। ওয়ালীদ তাঁকে আমীর মু‘আবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ জানাল এবং তাঁকে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ হওয়ার জন্য বলল।
ইমাম হুসাইন (আ.) জবাব দিলেন : ‘হে আমীর (প্রশাসক)! বাই‘আত্ তো আর গোপনে হয় না। তুমি যখন জনসাধারণকে বাই‘আতের জন্য ডাকবে তখন তাদের সাথে আমাকেও ডেক।’
তখন মারওয়ান ওয়ালীদকে বলল : ‘হে আমীর! তার এ ওযর গ্রহণ কর না; বাই‘আত্ না হলে তার শিরশ্ছেদ কর।’
এ কথায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি বললেন : ‘ওহে বদকার নারীর পুত্র! তুই ধ্বংস হ। তুই বলছিস্ যে, আমার শিরশ্ছেদ করবে? মিথ্যা বলেছিস এবং লাঞ্ছিত হয়েছিস।’
এরপর তিনি ওয়ালীদের দিকে ফিরে বললেন : ‘হে আমীর! আমরা নবুওয়াতের আহ্লে বাইত এবং রিসালাতের খনি যাদের কাছে ফেরেশতারা আসা-যাওয়া করে। আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টিলোকের অস্তিত্বদান আমাদের মাধ্যমে শুরু করেছেন এবং আমাদের মাধ্যমেই একে সমাপ্তিতে পৌঁছাবেন। অন্যদিকে ইয়াযীদ হচ্ছে এক ফাসেক লোক; সে মদ্যপায়ী এবং সম্মানিত লোকদের হত্যাকারী। সে প্রকাশ্যেই পাপ কাজ করে থাকে। সে এ পদের (খেলাফতের) জন্য উপযুক্ত নয়। আমার মত ব্যক্তি এ ধরনের কোন লোকের অনুকূলে বাই‘আত্ হতে পারে না। তবে আমি আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব যাতে এ ব্যাপারে তুমিও চিন্তা করে দেখতে পার এবং আমরা সকলেও চিন্তা করে দেখতে পারি যে, আমাদের মধ্য থেকে কোন্ ব্যক্তি খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার ও বাই‘আত্ লাভের জন্য অধিকতর উপযুক্ত।’
এ সময় মারওয়ান ওয়ালীদকে বলল : ‘তুমি আমার কথার বিরোধিতা করলে।’
ওয়ালীদ বললো : ‘আফসোস্ তোমার জন্য, হে মারওয়ান! তুমি আমাকে আমার দীন ও দুনিয়া উভয়টিই ধ্বংস করতে বলছ। আল্লাহ্র শপথ, আমি সারা দুনিয়ার ধনসম্পদের মালিক হওয়ার বিনিময়েও হুসাইনের হত্যাকারী হতে চাই না। আল্লাহ্র শপথ, আমার মনে হয় না যে, এমন একজন লোকও পাওয়া যাবে যে ব্যক্তি হুসাইনের রক্তে তার হাত রঞ্জিত অবস্থায় আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাত করতে প্রস্ত্তত হবে, যদি না তার আমলের পরিমাণ এতই হাল্কা হয় যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করবেন না ও তাকে পবিত্র করবেন না; বরং তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অপেক্ষা করতে থাকবে।’
বর্ণনাকারী বলেন : ‘ঐ রাত পার হয়ে গেলে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) খবর জানার জন্য প্রত্যুষে তাঁর ঘর থেকে বের হলেন। পথে মারওয়ানের সাথে তাঁর দেখা হল। মারওয়ান ইমাম হুসাইনকে বলল : ‘হে আবা আবদিল্লাহ্! আমি তোমার খবর জানতে চাই; তুমি আমার কথা শোন যাতে সঠিক পথ পেতে পার।’
ইমাম হুসাইন বললেন : ‘আগে শুনি তুমি কী বলতে চাও।’
মারওয়ান বলল : ‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে এই যে, তুমি যদি আমীরুল মু’মিনীন ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ হও তাহলে তা তোমার দীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক।’
জবাবে ইমাম হুসাইন বললেন : ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘উন্। উম্মাহ্ যখন ইয়াযীদের ন্যায় শাসকের কবলে পড়ে তখন ইসলামকে বিদায়! আর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছি, তিনি এরশাদ করেছেন : আবু সুফিয়ানের পরিবারের জন্য খেলাফত হারাম।’
হযরত ইমাম হুসাইন ও মারওয়ানের মধ্যকার কথোপকথন অনেকক্ষণ যাবত চলল। শেষ পর্যন্ত মারওয়ান ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
মক্কাত্যাগকালীন ভাষণ
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে পরিবার-পরিজন ও ভক্ত-অনুরক্তদের নিয়ে মদীনা ছেড়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে চলে যান এবং মসজিদে হারামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে থাকাকালে তাঁকে কুফায় গিয়ে বিপস্নবে নেতৃত্বদানের জন্য কুফাবাসীর পক্ষ থেকে দাওয়াত আসতে থাকে। ইতিমধ্যে যখন তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পারলেন যে, ইয়াযীদ হজ্বের সময় লোকজনের ভীড়ের মধ্যে তাঁকে হত্যা করার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠিয়েছে, তখন পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে তিনি হজ্বের আগের দিন আটই যিলহজ্ব প্রত্যুষে কুফার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন। এর আগের রাতে তিনি তাঁর কাছে সমবেত তাঁর কতক বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য, সঙ্গীসাথি, অনুসারী ও উপস্থিত জনতার উদ্দেশে নিমেণাক্ত ভাষণ প্রদান করেন :
‘সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহ্র জন্য। তিনি যা চাইবেন তা-ই হবে। তাঁর সম্মতি ছাড়া কারও পক্ষেই কোন কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয়। প্রশংসা আল্লাহ্র এবং তাঁর রাসূলের ওপর দরূদ বর্ষিত হোক।
আদম-সন্তানদের গলায় মৃত্যুর দাগ কেটে দেওয়া হয়েছে (অবধারিত করে দেওয়া হয়েছে) যেভাবে যুবতীদের গলায় হারের দাগ কেটে থাকে। ইয়াকুব (আ.) যেভাবে ইউসুফ (আ.)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ঠিক সেভাবেই আমি আমার পূর্ববর্তী পুণ্যবানদের সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করি। আর যে জায়গা আমার শাহাদাত্গাহ্ হবে এবং আমার লাশ গ্রহণ করবে সে জায়গা আমার জন্য পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাকে এখন সেখানে পৌঁছতে হবে। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, কারবালার নাওয়াভীসে৬ মরুভূমির নেকড়েরা আমার শরীর ছিন্নভিন্ন করছে এবং তাদের শূন্য উদর ভর্তি করছে। আর কোন মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা যাতে সন্তুষ্ট, আমরা রিসালাতের পরিবারও তাতেই সন্তুষ্ট। এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে পরীক্ষা; আমি এ পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করব। আর ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পরম দাতা আল্লাহ্ তা‘আলার হাতে। যারা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক রাখে তারা তাঁর থেকে পৃথক হবে না এবং বেহেশ্তে তাঁর সমীপে থাকবে, আর তাদের দর্শনে আল্লাহ্ তা‘আলার মহান রাসূলের নয়নদ্বয় উজ্জবল হবে।
আমি প্রত্যুষে রওনা হব, ইনশা আল্লাহ্।৭
আশুরার রাতের ভাষণ
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) আশুরার রাতে অর্থাৎ ৬১ হিজরির নয়ই মুহররম দিবাগত রাতে কারবালা প্রান্তরে তাঁর সঙ্গীসাথীদের এক জায়গায় সমবেত করেন এবং তাঁদের উদ্দেশে নিমেণাক্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রদান করেন :
‘সর্বোত্তম প্রশংসা সহকারে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট উভয় অবস্থায়ই তাঁর প্রশংসা করছি। হে আমার রব! যেহেতু তুমি আমাদের নবুওয়াতের দ্বারা সম্মানিত করেছ, কুরআন ও দীনের জ্ঞান দ্বারা মর্যাদামন্ডিত করেছ এবং আমাকে শোনার মত কান, দেখার মত চোখ ও সচেতন অন্তঃকরণ প্রদান করেছ সে জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। হে আল্লাহ্! আমাকে তোমার প্রশংসাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও।
আমার সঙ্গীসাথিদের তুলনায় আন্তরিক ও একনিষ্ঠ সঙ্গীসাথি (আর কারও) ছিল বা আছে বলে আমার জানা নেই। আর আমার আহ্লে বাইতের (পরিবারের) তুলনায় অধিকতর অনুগত আহ্লে বাইতের কথাও আমার জানা নেই। তেমনি আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজখবর নেওয়ার ক্ষেত্রেও আমার আহ্লে বাইতের তুলনায় নিষ্ঠাবান আহ্লে বাইত আছে বলে জানি না। আমাকে সাহায্য-সহায়তা করার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।
আমি জানি যে, আগামীকাল তাদের (ইয়াযীদী পক্ষের) সাথে আমাদের ব্যাপারটা যুদ্ধে পর্যবসিত হবে। তাই আমি আমার অনুকূলে তোমাদের কৃত বাই‘আত্ তুলে নিচ্ছি। আমি তোমাদের অনুমতি দিচ্ছি, তোমরা পথ চলার জন্য ও এখান থেকে দূরে চলে যাওয়ার জন্য রাতের অন্ধকারকে ব্যবহার কর এবং বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাও যাতে আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পথ বের করে দেন এবং তোমরা মুক্তি লাভ করতে পার। ঐ লোকগুলো আমাকে চায়। অতএব, তারা আমাকে পেলে তোমাদের সাথে তাদের কোন কাজ নেই।’৮
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর সঙ্গীসাথীদের ওপর থেকে বাই‘আতের দায়ব তুলে নেওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মধ্য থেকে কেউই তাঁকে ত্যাগ করে চলে যাননি।
আশুরার দিনে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রথম ভাষণ
আশুরার দিন সকালে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর ঘোড়া আনতে বললেন এবং তা আনা হলে তিনি তার ওপর আরোহণ করলেন। এরপর তিনি ইয়াযীদের অনুগত সেনাপতি ওমর বিন্ সা‘দের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর দিকে মুখ করে উচ্চৈঃস্বরে এমনভাবে আহবান করে তাঁর ভাষণ শুরু করলেন যে, তাদের মধ্যকার অধিকাংশ লোকই তা শুনতে পেল। ইমাম বলতে লাগলেন : ‘হে লোকসকল! আমার কথা শোন এবং (আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য) তাড়াহুড়া কর না যতক্ষণ না আমি তোমাদের সেই বিষয়ে উপদেশ প্রদান করি যে ব্যাপারে আমার ওপর তোমাদের অধিকার আছে এবং যতক্ষণ না আমার পক্ষ থেকে প্রকৃত বিষয় তোমাদের কাছে পেশ করি। অতঃপর তোমরা যদি আমার ওযর কবুল কর, আর আমার কথার সত্যতা স্বীকার কর এবং আমার প্রতি তোমাদের পক্ষ থেকে ইনসাফ কর তাহলে এ কারণে তোমরা অধিকতর সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। সে ক্ষেত্রে আমার ব্যাপারে তোমাদের আর কোন দায়িত্ব থাকবে না। আর তোমরা যদি আমার ওযর কবুল না কর এবং তোমাদের পক্ষ থেকে ইনসাফের পরিচয় না দাও তাহলে (আমি হযরত নূহের ভাষায় বলব) :
فَأَجْمِعُوا أَمْرَكُمْ وَشُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُنْ أَمْرُكُمْ عَلَيْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُوا إِلَيَّ وَلَا تُنظِرُونِ ﴿٧١﴾
অতঃপর তোমরা তোমাদের ও তোমাদের শরীকদের কাজকর্ম গোছগাছ করে নাও যাতে তোমাদের কাজ তোমাদের কাছে অস্পষ্ট না থাকে, অতঃপর আমার ব্যাপারে তোমাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর কর এবং আর অপেক্ষা কর না।’’৯
إِنَّ وَلِيِّيَ اللَّـهُ الَّذِي نَزَّلَ الْكِتَابَ ۖ وَهُوَ يَتَوَلَّى الصَّالِحِينَ
‘‘নিঃসন্দেহে আমার অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ্, যিনি কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছেন এবং তিনি পুণ্যবানদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করবেন।’’১০
এরপর হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) প্রতিপক্ষের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ধরে উচ্চৈঃস্বরে সম্বোধন করে বললেন : ‘হে শাবাছ্ বিন্ রাব্‘ঈ! হে হাজ্জার্ বিন্ আব্জার্! হে কায়স্ বিন্ আশ্‘আছ! হে ইয়াযীদ বিন্ হারেছ্! তোমরা কি আমাকে এ বলে পত্র লিখনি যে, ‘ফল পেকে গেছে এবং যমিন সবুজে ঢেকে গেছে; আপনি যদি আসেন, তাহলে আপনার খেদমতে একটি সুসজ্জিত বাহিনী দেখতে পাবেন?’
তখন কায়স্ বিন্ আশ্‘আছ জবাব দিল : ‘আমরা বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন। তবে আপনি যদি আপনার চাচার গোত্রের১১ ফরমানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তাহলে কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু দেখবেন না।’
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর খিমার (তাঁবুর) নারী ও কন্যারা যখন তাঁর ভাষণ শুনতে পেলেন তখন তাঁরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। হযরত ইমাম (আ.) তাঁদেরকে থামতে বলার জন্য তাঁর ভাই আববাস ও স্বীয় পুত্র আলী আকবারকে নারীদের তাঁবুতে পাঠালেন। তিনি বলে পাঠালেন : ‘আমার প্রাণের শপথ, এরপরে তোমরা আমার জন্য অনেক বেশি ক্রন্দন করবে।’
মহিলারা ও বালিকারা নীরব হলে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় আল্লাহ্ তা‘আলাকে স্মরণ করলেন এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.), পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ ও ফেরেশতাগণের প্রতি দরূদ পাঠালেন। এরপর তিনি তাঁর ভাষণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলেন :
‘তোমরা আমার নসবের (বংশ পরম্পরার) বিষয়টি স্মরণ কর, ভেবে দেখ, আমি কে। তোমাদের হুঁশ হোক; তোমরা নিজেদের ধিক্কার দাও এবং ভেবে দেখ যে, আমাকে হত্যা করা এবং আমার মর্যাদা বিনষ্ট করা কি তোমাদের জন্য জায়েয?’
‘আমি কি তোমাদের রাসূলের কন্যার পুত্র নই? আমি কি তাঁর (রাসূলের) স্থলাভিষিক্ত ও চাচাত ভাইয়ের পুত্র নই- যিনি সকলের আগে ঈমান এনেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যা এনেছিলেন তার সত্যতা স্বীকার করেছিলেন?’ ‘সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা হামযাহ্ কি আমার চাচা১২ নন?’ ‘জা‘ফর তাইয়ার- আল্লাহ্ তা‘আলা যাঁকে কারামতস্বরূপ দু’টি পাখা দিয়েছেন যাতে তিনি তা দিয়ে বেহেশ্তের ভিতরে উড়তে পারেন, তিনি কি আমার চাচা নন?’ ‘তোমরা কি জান না যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এরশাদ করেছেন : ‘এ দু’জন হচ্ছে বেহেশ্তে যুবকদের নেতা।’?’
‘তোমরা যদি আমার কথায় বিশ্বাস করতে না পার এবং আমার কথার সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করে থাক, তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলার শপথ করে বলছি, যখন থেকে জেনেছি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মিথ্যাবাদীকে তাঁর দুশমন হিসাবে গণ্য করেন তখন থেকে কখনই মিথ্যা কথা বলিনি। তোমাদের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা তাদের সত্যবাদিতার জন্য সুপরিচিত, তারা আমার কথার সত্যতা স্বীকার করবে। তোমরা জাবের বিন্ আবদুল্লাহ্ আনসারী, আবু সা‘ঈদ খুদরী, সাহল্ বিন্ সা‘দ্, যায়দ্ বিন্ আর্ক্বাম্ ও আনাস্ বিন্ মালেকের কাছে জিজ্ঞাসা কর যাতে তারা আমার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছ থেকে যা শুনেছেন তা তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন। তাহলে তোমাদের কাছে আমার কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। এসব সাক্ষ্য কি আমার রক্তপাত ঘটানো থেকে তোমাদের বিরত থাকার জন্য যথেষ্ট নয়?’১৩
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সাথে শিম্রের কথোপকথন
এ সময় ইয়াযীদের সেনাদলের অন্যতম সেনাপতি শিম্র্ বিন্ যিল্ জাওশান্ বলল : ‘তুমি যা বললে তা-ই যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমি কখনই মজবুত ‘আক্বীদাহ্ সহকারে আল্লাহ্র ইবাদাত করিনি।’
তখন ইমামের অন্যতম সঙ্গী হাবীব বিন্ মাযাহের বললেন : ‘আল্লাহ্র শপথ, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুম নড়বড়ে ‘আক্বীদা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সহকারে আল্লাহ্র ইবাদাত করছ। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি এখন সত্য বলছ; আসলে তুমি বুঝতে পারছ না যে, ইমাম কী বলছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার অন্তঃকরণের ওপর গাফলাতের মোহর মেরে দিয়েছেন।’
ইমাম হুসাইন শিম্র্কে বললেন : ‘তোমার কি এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহ আছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যার সন্তান? আল্লাহ্র শপথ, এ বিশ্বে পূর্ব ও পশ্চিমের দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী ভূখন্ডে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যার পুত্র আমি ছাড়া আর কেউ নয়। তোমার জন্য পরিতাপ! আমি কি তোমার কাউকে হত্যা করেছি যে, আমার কাছ থেকে তার রক্তের বদলা আদায় করতে চাচ্ছ? আমি কি তোমার কোন সম্পদ বিনষ্ট করেছি, নাকি আমার কাঁধে কারও কেসাসের দায় রয়েছে যা তুমি কার্যকর করতে চাচ্ছ?’
এ সময় ইয়াযীদী পক্ষের লোকেরা চুপ করে থাকল। কারণ, তখন তাদের বলার মত কোন কথাই ছিল না। এরপর ইমাম হুসাইন পুনরায় ইয়াযীদের দলের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ধরে উচ্চৈঃস্বরে সম্বোধন করে বললেন : ‘হে শাবাছ্ বিন্ রাব্‘ঈ! হে হাজ্জার্ বিন্ আব্জার্! হে কায়স্ বিন্ আশ্‘আছ! হে ইয়াযীদ বিন্ হারেছ্! তোমরা কি আমাকে এ বলে পত্র লিখনি যে, ‘ফল পেকে গেছে এবং যমিন সবুজে ঢেকে গেছে; আপনি যদি আসেন তাহলে আপনার খেদমতে একটি সুসজ্জিত বাহিনী দেখতে পাবেন।’?’
ইমাম হুসাইন (আ.) এরপর ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সম্বন্ধে বলতে লাগলেন :
‘হে কুফাবাসী! তোমাদের মায়েরা তোমাদের শোকে ক্রন্দন করুক। তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার এ নেক বান্দাহ্কে দাওয়াত করেছিলে এবং বলেছিলে : আমরা আপনার পথে জীবন বিলিয়ে দেব। কিন্তু এখন তোমরা তার বিরুদ্ধে তোমাদের তলোয়ারগুলোকে উন্মুক্ত করেছ এবং তাকে সকল দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছ। তোমরা তাকে এ বিশাল পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা চলে যাবার জন্য সুযোগ দিচ্ছ না। এখন সে বন্দীর মত তোমাদের হাতে আটকা পড়ে আছে। তোমরা তাকে এবং তার পরিবারের নারী ও কন্যাদের ফোরাতের পানি পান করতে বাধা দিয়েছ, অথচ ইহুদী ও খ্রিস্টান গোত্রসমূহের লোকেরাও সেখান থেকে পানি পান করছে। এমনকি পিপাসায় আমাদের পশুগুলোর প্রাণও ওষ্ঠাগত হয়েছে এবং সেগুলো ছটফট করছে ও গড়াগড়ি দিচ্ছে। তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বংশধরদের ব্যাপারে তাঁর বর্ণিত মর্যাদার সীমারেখাকেও রক্ষা করনি। মহাপিপাসার দিনে আল্লাহ্ তোমাদের পরিতৃপ্ত না করুন।’
তখন কায়স্ বিন্ আশ্‘আছ পুনরায় জবাব দিল : ‘আমরা বুঝতে পারছি না, আপনি কী বলছেন। তবে আপনি যদি আপনার চাচার গোত্রের ফরমানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তাহলে কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু দেখবেন না।’
জবাবে হযরত ইমাম হুসাইন বললেন : ‘আল্লাহ্র শপথ, আমি তোমাদের দিকে হীন-লাঞ্ছিতের হাত বাড়িয়ে দেব না এবং (তোমাদের সামনে থেকে) ক্রীতদাসের ন্যায় পালিয়েও যাব না।’’১৪
এরপর ইমাম বললেন : ‘হে আল্লাহ্র বান্দাহ্গণ! আমি তাঁর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি যিনি আমার রব এবং তোমাদেরও রব । কিন্তু যে সব উদ্ধত লোক কিয়ামত দিবসের ওপর ঈমান রাখে না তাদের ওপর আমি অসন্তুষ্ট। আর তাদের হিংস্রতা থেকে আমি তাঁরই কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।’
এরপর ইমাম তাঁর বাহন ঘোড়াটিকে শোয়ালেন এবং সেটির পা বাঁধার জন্য উক্ববাহ্ বিন্ সিম্‘আন্কে নির্দেশ দিলেন।১৫
আশুরার দিনে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর দ্বিতীয় ভাষণ
দুশমন বাহিনী নীরব হলে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাদেরকে সম্বোধন করে পুনরায় বলতে লাগলেন :
‘হে লোকসকল! ধ্বংস ও দুঃখ তোমাদের ঘিরে ফেলুক; কারণ, (মনে করে দেখ,) কেমন বর্ণনাতীত আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস সহকারে তোমরা আমাকে দাওয়াত করেছিলে! আর এ কারণেই আমি এখানে এসেছি। আমি খুব দ্রুত তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছি। কিন্তু আমরা তোমাদের হাতে যে তলোয়ার অর্পণ করেছিলাম১৬
তা-ই আমাদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত করেছ। আর আমরা আমাদের দুশমন ও তোমাদের দুশমনদের বিরুদ্ধে যে অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিলাম তোমরা তাকেই আমাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ডতর করে তুলেছ। তোমরা তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে ও দুশমনদের সপক্ষে যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছ, যদিও তারা না তোমাদের সাথে ইনসাফ ও সুবিচারের সাথে আচরণ করেছে, না তাদের দ্বারা তোমাদের কোন কল্যাণ হবে বলে আশা করা যায়, আর না আমরা এমন কোন কাজ করেছি যে কারণে আমাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের শত্রুতা ও আগ্রাসনের সঙ্গত কারণ থাকতে পারে।
পরিতাপ তোমাদের জন্য; তোমাদের তলোয়ারগুলো যখন খাপে বদ্ধ ছিল, আর তোমাদের হৃদয়গুলো শান্ত ছিল এবং তোমাদের চিন্তাশক্তি সুশৃঙ্খল ছিল তখন কেন তোমরা আমাদের পরিত্যাগ করনি? তোমরা মাছির মত ফিত্নার দিকে উড়ে গিয়েছ, প্রজাপতিদের (আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার) মত একজন আরেক জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছ। হে ক্রীতদাসীর দাসগণ! হে আহ্যাবের১৭ অবশিষ্ট লোকেরা! হে কিতাব (কুরআন) পরিত্যাগকারীরা! হে আল্লাহ্র কালাম বিকৃতকারীরা১৮! হে রাসূলের সুন্নাতকে বিস্মৃতির অতলে নিক্ষেপকারীরা! হে নবী-রাসূলগণের বংশধরদের ও তাঁদের অছিদের (মনোনীত প্রতিনিধিদের) বংশধরদের হত্যাকারীরা১৯! হে জন্মপরিচয়হীনদের জন্মপরিচয়ের অধিকারীদের সাথে সংযুক্তকারীরা২০! হে মু’মিনদের কষ্ট প্রদানকারীরা! হে ‘কুরআনকে ছিন্ন করে ফেলল’ বলে চিৎকারকারীদের নেতারা২১! তোমরা ধ্বংস হও।
আমি বলছি, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে হত্যা কর না। কারণ, আমাকে হত্যা করা বা অবমাননা করা তোমাদের জন্য জায়েয নয়। আমি তোমাদের রাসূলের কন্যার সন্তান, আর আমার নানী খাদীজাহ্ তোমাদের রাসূলের স্ত্রী। হয়ত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সেই কথা তোমাদের কাছে পৌঁছে থাকবে যে, তিনি এরশাদ করেছেন : ‘হাসান ও হুসাইন হচ্ছে বেহেশতবাসী যুবকদের দুই নেতা।’
হ্যঁা, আল্লাহ্র শপথ, ওয়াদা ভঙ্গ করা, বিশ্বাসঘাতকতা ও চুক্তি ভঙ্গ করা তোমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তোমাদের (তোমরা হচ্ছ এমন বৃক্ষতুল্য যার) মূল ধোঁকা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার সাথে মিশে গেছে। তোমাদের শাখা-প্রশাখাসমূহ এর ওপর ভিত্তি করেই প্রসারিত হয়েছে। তোমরা হচ্ছ সর্বাধিক নোংরা- নিকৃষ্টতম ফল; তাই তোমরা স্বীয় বাগান-মালিকের গলায় আটকে যাও এবং আত্মসাৎকারী ও লুণ্ঠনকারীদের জন্য সুস্বাদু ও সুখাদ্য হয়ে যাও।
আল্লাহ্র পক্ষ থেকে লা‘নত বর্ষিত হোক সেই অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদের ওপর যারা মজবুত করে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবার পরও তা ভঙ্গ করেছে। তোমরা (তোমাদের অঙ্গীকারের ব্যাপারে) আল্লাহ্কে সাক্ষী করেছিলে এবং তাঁর নামে শপথ করেছিলে; তোমরা হচ্ছ সেই অঙ্গীকার ভঙ্গকারী গোষ্ঠী। এখন পিতৃপরিচয়হীনের পুত্র পিতৃপরিচয়হীন২২ আমাকে দু’টি বিষয়ের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলেছে : হয় যুদ্ধ নয়ত লাঞ্ছিত জীবন। দূর হোক লাঞ্ছনা আমা থেকে; আমি কখনই লাঞ্ছনা মেনে নেব না। আল্লাহ্, রাসূল (সা.) ও মু’মিনগণ কখনই আমাদের জন্য কাপুরুষতা পছন্দ করেননি। যে সব পবিত্র কোল আমাদের লালন-পালন করেছেন তাঁরা এবং আত্মমর্যাদাবান লোকেরা কখনই হীন ও নীচদের আনুগত্যকে নিহত হওয়ার ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করবেন না। আমি এ স্বল্পসংখ্যক লোক নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, এমনকি আমার সঙ্গীসাথীরা যদি আমাকে একা ফেলে যায় তবুও।২৩
এরপর হযরত হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) একটি কবিতা আবৃত্তি করেন যার অর্থ নিমণরূপ :
‘‘যদি আমি বিজয়ী হই তো আমি অনেক আগে থেকেই বিজয়ী হয়ে আছি, আর আমি যদি পরাজিত হই, তবুও আমি পরাজিত নই। আমরা ভয়ে অভ্যস্ত নই; বরং আমাদের নিহত হওয়া অন্যদের ধনসম্পদের অধিকারী হওয়ার প্রায় সমার্থক।’’
এরপর তিনি তাঁর ভাষণের ধারাবাহিকতায় বলেন : ‘আল্লাহ্র শপথ, হে কুফ্্রী অবলম্বনকারী গোষ্ঠী! আমার পরে খুব বেশিদিন না যেতেই-খুব অল্প দিনের মধ্যেই-একজন আরোহী তার বাহনের ওপর আরোহণ করবে২৪ এবং তোমাদের জীবনে এমন এক অবস্থা নিয়ে আসবে যেন তোমরা যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছ। সে তোমাদের গভীর দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক ও দিশেহারা অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করবে। আর এ হচ্ছে আমার নানার পক্ষ থেকে আমার পিতার মাধ্যমে আমার সাথে কৃত অঙ্গীকার। অতএব, তোমরা তোমাদের নিজেদের ও তোমাদের সঙ্গীসাথীদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আরেক বার পর্যালোচনা ও চিন্তাভাবনা করে দেখ যাতে কালের প্রবাহ তোমাদের ওপর দুঃখ ও দুশ্চিন্তা বর্ষণ না করে। আমি আমার বিষয়টি আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর সোপর্দ করেছি। আর আমি জানি যে, এ ধরণির বুকে এমন কোন কিছুই ঘটে না যা তাঁর কুদরাতী হাতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারে।
হে আল্লাহ্! তুমি এদের ওপর আসমান থেকে বারি বর্ষণ বন্ধ করে দাও। এদের ওপর লাঞ্ছনা ও দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দাও। আর সেই ছাক্বাফী গোলামকে২৫ এদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দাও যাতে সে এদের বিষের পেয়ালার আস্বাদন করাতে পারে এবং তাদের বিরুদ্ধে আমার, আমার সঙ্গীসাথিগণ, আহ্লে বাইত ও আমার অনুসারীদের (হত্যার- যা হতে যাচ্ছে) প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারে। কারণ, তারা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অসহায় করে ফেলেছে। তুমি আমাদের রব; আমরা তোমার দিকেই মুখ করেছি এবং তোমার ওপর তাওয়াক্কুল করেছি, আর আমাদের প্রত্যাবর্তন তোমারই দিকে।২৬
ওমর বিন্ সা‘দের পরিণতি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী
এরপর হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াযীদী বাহিনীর সেনাপতি ওমর বিন্ সা‘দের খোঁজ করলেন, বললেন : ‘ওমর বিন্ সা‘দ্ কোথায়? ওকে আমার সামনে আসতে বল।’
ওমর বিন্ সা‘দ্ যদিও ইমামের সামনে আসতে ইচ্ছুক ছিল না, তথাপি ইমাম তাকে আহবান করায় সে ইমামের সামনে এল। ইমাম হুসাইন তাকে বললেন : ‘তুমি আমাকে হত্যা করবে? আমি মনে করি না যে, পিতৃপরিচয়হীনের পুত্র পিতৃপরিচয়হীন২৭ রেই ও গোরগানের শাসনক্ষমতা তোমাকে অর্পণ করবে।২৮ আল্লাহ্র শপথ, কখনই তা ঘটবে না। আমার এ অঙ্গীকার এমন এক অঙ্গীকার যেন তা বাস্তবায়িত হয়েই আছে। তুমি যা চাও তা করতে পার, কিন্তু জেনে রেখ, আমার (শাহাদাতের) পরে তুমি না দুনিয়ায়, না আখেরাতে- কোথাও আনন্দের মুখ দেখতে পাবে না। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, কুফার বুকে তোমার মাথা বর্শার ডগায় গেঁথে রাখা হয়েছে এবং শিশুরা তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করছে ও সেটিকে লক্ষ্যস্থল বানিয়ে লক্ষ্যভেদ করছে।’’২৯
এতে ওমর বিন্ সা‘দ ক্রুদ্ধ হল এবং ইমাম হুসাইনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে তার সৈন্যদের উদ্দেশে বলল : ‘কিসের অপেক্ষা করছ? সবাই একযোগে ওর বিরুদ্ধে হামলা চালাও; ওরা মুষ্টিমেয় সংখ্যক বৈ তো নয়।’৩০
আশুরার দিনে ইমাম হুসাইনের তৃতীয় ভাষণ৩১
ইমাম হুসাইন (আ.) শত্রুবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সারিগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তারা তখন তরঙ্গের মতো গর্জন করছিল। এ সময় শত্রুবাহিনীর মধ্যে ওমর বিন্ সা‘দ্সহ কুফার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এক জায়গায় অবস্থান করছিল। ইমাম হুসাইন তার দিকে তাকিয়ে বললেন :
‘আমি আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসা করছি, যিনি এ দুনিয়াকে সৃষ্টি করেছেন এবং একে অস্থায়ী ও ধ্বংসশীল গৃহ বানিয়েছেন, আর দুনিয়াবাসীকে বিভিন্ন অবস্থার অধিকারী করেছেন। যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতারণার শিকার হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সে অজ্ঞ, আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট ও তার দ্বারা সম্মোহিত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সে হতভাগ্য।
দুনিয়া যেন তোমাদের ধোঁকা না দেয়। কারণ, যে ব্যক্তিই দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে দুনিয়া তারই আশাকে নিরাশায় পরিণত করে এবং যে ব্যক্তি তার লোভে পড়ে, দুনিয়া তাকে হতাশ করে দেয়। আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমরা একটি কাজ সম্পাদনের জন্য এখানে একত্র হয়েছ যার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহ্কে অসন্তুষ্ট করেছ ও তাঁর ক্রোধ সঞ্চারের কারণ হয়েছ। তাই তিনি তোমাদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন এবং তোমাদের জন্য তাঁর শাস্তি নাযিল (-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ) করেছেন, আর স্বীয় রহমত থেকে তোমাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের রব অত্যন্ত মহান। কিন্তু তোমরা অত্যন্ত খারাপ বান্দাহ্। তাই তাঁর আনুগত্যের অঙ্গীকার করেও এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনলেও রাসূলের পরিবার-পরিজন ও বংশধরদের ওপর চড়াও হয়েছ এবং তাদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। শয়তান তোমাদের ওপর বিজয়ী হয়েছে, তাই তোমরা মহান আল্লাহ্র কথা ভুলে গিয়েছ। তোমরা ধ্বংস হও। তোমরা যা চাচ্ছ সে ব্যাপারে আমি বলছি : ইনণা লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘উন্।৩২
এরা হচ্ছে এমন একটি জনগোষ্ঠী যারা ঈমান আনার পরে কাফের হয়েছে। দূর হোক আল্লাহ্র রহমত যালেমদের কাছ থেকে।’
এ সময় ওমর বিন্ সা‘দ্ কুফার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলল : ‘আফসোস তোমাদের জন্য যে, তোমরা তার সাথে কথোপকথন করছ! আল্লাহ্র শপথ, এ হচ্ছে সেই পিতার পুত্র যে, পুরো একদিনও যদি কথা বলতে চায়, কথা বলতে অক্ষম হবে না।’
তখন শিম্র্ ইমামের দিকে এগিয়ে এল এবং বলল : ‘হে হুসাইন! তুমি এ কী সব কথা বলছ? তুমি আমাদের বুঝিয়ে দাও যাতে আমরা বুঝতে পারি।’
তখন ইমাম হুসাইন (আ.) বললেন : ‘আমি বলছি যে, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে হত্যা কর না। কারণ, আমাকে হত্যা করা ও আমার অবমাননা করা তোমাদের জন্য জায়েয নয়। আমি তোমাদের রাসূলের কন্যার সন্তান এবং আমার নানী তোমাদের রাসূলের স্ত্রী খাদীজাহ্। হয়ত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর এ উক্তি তোমাদের কাছে পৌঁছে থাকবে যে, তিনি এরশাদ করেছেন : হাসান ও হুসাইন বেহেশতে যুবকদের নেতা।’৩৩
মদীনা থেকে কারবালা : ইমাম হুসাইন (আ.)-এর স্লোগান
সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) মদীনা মুনাওয়ারাহ্ থেকে মক্কা মু‘আযযামায় ও সেখান থেকে কুফার পথে কারবালায় পৌঁছা পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এবং আশুরার দিনে কারবালার রণাঙ্গনে যে সব ভাষণ দেন ও বক্তব্য রাখেন সে সবের মধ্যে এমন কতকগুলো কথা আছে যা খুবই প্রভাববিস্তারকারী এবং সে সবে জিহাদ ও আত্মমর্যাদার জন্য প্রেরণা সৃষ্টিকারী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর এ কথাগুলো ভাষণের অংশই হোক, বা কথোপকথনের অংশ বা স্লোগান হোক, নির্বিশেষে এগুলো এক ধরনের স্লোগানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ সব স্লোগান থেকে হুসাইনী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং আশুরা-কেন্দ্রিক চিন্তাধারা ও চেতনার সন্ধান পাওয়া যায়। এ কারণে তাঁর ভাষণ ও কথার এ অংশগুলোকে আশুরা আন্দোলনের স্লোগান বলে গণ্য করা চলে। এ স্লোগানগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি নিমেণ উদ্ধৃত করা হল :৩৪
۱. على الاسلام سلام اذ بليت الامة براع مثل يزيد.
১. ‘উম্মাহ্ যখন ইয়াযীদের ন্যায় শাসকের কবলে পড়েছে তখন ইসলামকে বিদায়!’৩৫
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) মদীনায় মারওয়ান ইবনে হাকামের কথার জবাবে এ কথা বলেন।
۲. و الله لو لم يكن ملجا و لا ماوى لما بايعة يزيد بن معاوية.
২. ‘আল্লাহ্র শপথ, এমনকি আমার যদি কোন আশ্রয়স্থলও না থাকত, তথাপি আমি ইয়াযীদের পক্ষে বাই‘আত্ হতাম না।’৩৬
ইমাম হুসাইন তাঁর ভাই মুহাম্মাদ আল্-হানাফীয়ার কথার জবাবে এ কথা বলেন।
۳. اني لا ارى الموت الا سعادة و الحياة مع الظالمين الا برما.
৩. ‘অবশ্যই আমি মৃত্যুকে সৌভাগ্য এবং যালেমদের সাথে বেঁচে থাকাকে দুর্ভাগ্য ব্যতীত অন্য কিছু মনে করি না।’৩৭
ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় তাঁর সঙ্গীসাথীদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
۴. الناس عبيد الدنيا و الدين لعق على السنتهم يحوطونه ما درت معايشهم فاذا محصوا بالبلاء قل الديانون.
৪. ‘মানুষ হচ্ছে দুনিয়ার দাস, আর দীন তাদের কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যাতে তারা পার্থিব জীবনের সুবিধাদি দেখতে পায় যা তাদের ঘিরে রেখেছে। অতঃপর তারা যখন বিপদে নিপতিত হয় তখন খুব কম লোকই তা (সে বিপদকে) জয় করতে পারে।’৩৮
ইমাম হুসাইন কারবালায় যাওয়ার পথে যি হিসাম্ নামক স্থানে এ কথা বলেন।
۵. الا ترون ان الحق لا يعمل به و ان الباطل لا يتناهى عنه؟ فليرغب المؤمن في لقاي ربه محقا.
৫. ‘তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে, সত্যের ভিত্তিতে কাজ করা হয় না এবং বাতিল থেকে বিরত থাকা হচ্ছে না? অতএব, (এহেন পরিস্থিতিতে) যথার্থভাবেই মু’মিনের উচিত তার রবের সাথে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হওয়া।’৩৯
ইমাম কারবালায় স্বীয় সঙ্গী-সাথিদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
۶. خط الموت على ولد آدم مخط القلادة على جيد الفةاة.
৬. ‘আদম-সন্তানদের গলায় মৃত্যুর দাগ কেটে দেওয়া হয়েছে (অবধারিত করে দেওয়া হয়েছে) যেভাবে যুবতীদের গলায় হারের দাগ কেটে থাকে।’৪০
ইমাম হুসাইন মক্কা ত্যাগের প্রাক্কালে তাঁর কাছে সমবেত তাঁর কতক বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য, সঙ্গীসাথি, অনুসারী ও উপস্থিত জনতার উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
۷. من راى سلطاناً جائراً مستحلاً لحرام الله، ناكثاً عهده، مخالفاً لسنة رسول الله، يعمل في عباد الله بالاثم و العدوان فلم يغير عليه بفعل و لا قول كان حقاً على الله ان يدخله مدخله.
৭. ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্র কৃত হারামকে হালালকারী, তাঁর (আল্লাহ্র গৃহীত) অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাতের বিরোধিতাকারী কোন নিপীড়ক শাসককে আল্লাহ্র বান্দাদের মধ্যে পাপাচার ও দুর্বৃত্তপনা করতে দেখে, সে যদি তার কাজ বা কথার মাধ্যমে তাকে প্রতিহত না করে, তাহলে আল্লাহ্র জন্য দায়িত্ব হয়ে যায় যে, তাকে (প্রতিহতকরণে বিরত ব্যক্তিকে) তার (নিপীড়ক শাসকের) প্রবেশদ্বার দিয়ে (জাহান্নামে) প্রবেশ করাবেন।’৪১
কুফার পথে অবস্থিত বাইযাহ্ নামক মনযিলে হূর্ বিন্ ইয়াযীদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ইমাম এ কথা বলেন।
۸. ما الامام الا العامل بالكتاب و الآخذ بالقسط و الدائن بالحق و الحابس نفسه على ذات الله.
৮. ‘ঐ ব্যক্তি ছাড়া কেউ সত্যিকারের ইমাম হতে পারে না যে (আল্লাহ্র) কিতাব অনুযায়ী আমল করে, ন্যায়সঙ্গতভাবে (কর) গ্রহণ করে, সত্যের ভিত্তিতে (সুদমুক্ত) ঋণ প্রদান করে এবং আল্লাহ্র সত্তার কাছে স্বীয় প্রবৃত্তিকে বন্দী করে রাখে।’৪২
ইমাম হুসাইন কুফাবাসীর দাওয়াতের জবাবে সত্যিকারের ইসলামী নেতা ও শাসকের গুণাবলি বর্ণনা করে মুসলিম ইবনে ‘আক্বীলের মাধ্যমে তাদের কাছে প্রেরিত পত্রে এ কথা বলেন।
۹. سامضى و ما بالموت عار على الفتى
اذا ما نوى حقا و جاهد مسلما.
৯. ‘অচিরেই গত হব; কিবা লাজ মৃত্যুতে যুবকের
লক্ষ্য যবে সত্য, আর লড়ে যবে মুসলিম রূপে।’৪৩
এটি একজন কবির কবিতার উদ্ধৃতি। ইমাম কুফার পথে হূর্ বিন্ ইয়াযীদের হুমকির জবাবে এটি আবৃত্তি করেন।
۱۰. رضي الله رضانا اهل البيت، نصبر على بلائه و يوفينا اجر الصالحين.
১০. ‘আল্লাহ্র সন্তুষ্টিতেই আমাদের আহ্লে বাইতের সন্তুষ্টি; আমরা তাঁর পক্ষ থেকে আগত পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করব এবং তিনি অবশ্যই আমাদের তাঁর নেক বান্দাদের জন্য প্রতিশ্রুত পুরস্কার প্রদান করবেন।’৪৪
ইমাম হুসাইন মক্কা থেকে বহির্গত হওয়ার প্রাক্কালে স্বীয় সঙ্গী-সাথী ও স্বজনদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
۱۱. انما خرجت لطلب الاصلاح في امة جدي.
১১. ‘অবশ্যই আমি কেবল আমার নানার উম্মাতের সংশোধনের উদ্দেশ্যে বহির্গত হয়েছি।’৪৫
ইমাম মদীনা ত্যাগের প্রাক্কালে তাঁর ভাই মুহাম্মাদ বিন আল্-হানাফিয়ার উদ্দেশে লিখিত অসিয়তনামায় এ কথা বলেন।
۱۲.لا اعطيكم بيدي اعطاء الذليل
و لا اقر اقرار العبيد و لا افر فرار العبيد
১২. ‘তোমাদের হাতে দেব না’ক কভু লাঞ্ছিতের হাত
করব না কভু জেন দাসের অঙ্গীকার/
পালিয়ে যাব না কভু ক্রীতদাস সম।’’৪৬
আশুরার দিনে দুশমন-বাহিনীর সামনে প্রদত্ত ভাষণে তাদের পক্ষ থেকে বাই‘আত্-দাবির জবাবে ইমাম হুসাইন এ কথা বলেন।
۱۳. هيهات منا الذلة، يابي الله ذلك لنا و رسوله و المؤمنون.
১৩. ‘দূর হোক লাঞ্ছনা আমাদের থেকে; আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মু’মিনগণ এটা আমাদের জন্য অপছন্দ করেন।’৪৭
দুশমন পক্ষ ইমাম হুসাইনকে আত্মসমর্পণ বা নিহত হওয়া- এ দু’টির যে কোন একটি বেছে নিতে বললে এবং তৃতীয় কোন পথ খোলা না থাকায় তিনি আশুরার দিনে দুশমনদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
۱۴. فهل هو الا الموت؟ فمرحباً به.
১৪. ‘মৃত্যু ছাড়া আর কী হবে? অতএব, তাকে স্বাগতম!’৪৮
ইমামকে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে লেখা ওমর্ বিন্ সা‘দের পত্রের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
۱۵. صبرا بني الكرام، فما الموت الا قنطرة تعبر بكم عن البوس و الضراء الى الجنان الواسعة و النعيم الدائمة.
১৫. ‘মহানুভবতার ভিত্তি হচ্ছে ধৈর্য; আর মৃত্যু দুঃখ-কষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতির ওপর দিয়ে পার হয়ে সুবিস্তৃত ও চিরস্থায়ী নে‘আমতে পরিপূর্ণ বেহেশতে উপনীত হওয়ার পুল ছাড়া অন্য কিছু নয়।’৪৯
ইমাম হুসাইনের কয়েক জন সঙ্গীর শাহাদাতের পর আশুরার দিন সকালে আত্মোৎসর্গী অন্যান্য সঙ্গীসাথির উদ্দেশ প্রদত্ত ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
۱۶. موت في عز خير من حياة في ذل.
১৬. ‘লাঞ্ছনার জীবনের চেয়ে সম্মান সহকারে মৃত্যুই শ্রেয়।’৫০
۱۷. لم يكن لكم دين و كنتم لا تخافون المعاد فكونوا احرار في دينكم.
১৭. ‘তোমাদের কোন দীন নেই এবং তোমরা পরকালকে ভয় করছ না, সুতরাং তোমরা তোমাদের দীনের ব্যাপারে স্বাধীন হয়ে যাও।’৫১
ইমামের শাহাদাতের পূর্বে ইয়াযীদী বাহিনী তাঁর পক্ষের নারীদের তাঁবুতে হামলা চালালে তিনি তাদের সম্বোধন করে এ কথা বলেন।
۱۸.هل من ناصر ينصر ذرِية الاطهار؟
১৮. ‘(রাসূলুল্লাহ্র) পবিত্র বংশধরকে সাহায্য করবে এমন কোন সাহায্যকারী আছে কি?’৫২
অসুস্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ছাড়া ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সকল পুরুষ সঙ্গী ও আত্মীয় শহীদ হলে ইমাম এ আহবান জানান।
۱۹. هل من ذاب يذب عن حرم رسول الله؟
১৯. ‘এমন কোন বিগলিতপ্রাণ আছে কি যে রাসূলের হারামের জন্য বিগলিত হবে?’৫৩
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ছাড়া হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সকল পুরুষ সঙ্গী ও আত্মীয় শহীদ হলে ইমাম এ আহবান জানান।
۲۰. اني لم اخرج اشرا و لا بطرا ولا مفسدا و لا ظالما و انما خرجت لطلب الاصلاح في امة جدي (ص) اريد ان آمر بالمعروف و انهى عن المنكر و اسير بسيرة جدي و ابي علي بن ابي طالب.
২০. ‘আমি একগুঁয়েমির বশবর্তী হয়ে বা পার্থিব আরাম-আয়েশের জন্য বা বিশৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে অথবা যুলুম-অত্যাচারের উদ্দেশ্যে বহির্গত হইনি; বরং আমি আমার নানার উম্মাতের সংশোধনের চেষ্টা চালানোর উদ্দেশ্যে বহির্গত হয়েছি; আমি ভাল কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিহত করতে এবং আমার নানার ও আমার পিতা আলী বিন্ আবি তালিবের জীবনাচরণের অনুসরণ করতে চাই।’৫৪
আশুরার স্লোগানের শিক্ষা
উপর্যুক্ত নূরানী ও বীরত্বব্যঞ্জক বাক্যগুলো সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের স্লোগান হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ বাক্যগুলো পর্যালোচনা করলে নিমেণাক্ত তথ্য ও শিক্ষাসমূহ পাওয়া যায় :
১. ইয়াযীদী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কোন শাসক শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা ইসলামের ধ্বংসের নামান্তর।
২. ইয়াযীদের ন্যায় যে কোন লোকের অনুকূলে বাই‘আত্ হওয়া হারাম।
৩. লাঞ্ছনার জীবনের তুলনায় শহীদী মৃত্যু অধিকতর মর্যাদার।
৪. ঈমানের কঠিন পরীক্ষার মোকাবিলায় টিকে থাকে এমন প্রকৃত মুসলমানের সংখ্যা খুবই কম।
৫. বাতিল শক্তি ক্ষমতাসীন থাকার যুগে শাহাদাতকামী লোকদের উপস্থিতি অপরিহার্য।
৬. মানুষের জন্য শাহাদাত হচ্ছে অলঙ্করণস্বরূপ।
৭. শক্তিমদমত্ত ও খোদাদ্রোহী দুর্বৃত্ত শক্তির আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অপরিহার্য।
৮. কুরআন অনুযায়ী চলা ও ন্যায়বিচার ইসলামী নেতৃত্বের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।
৯. আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ ও সন্তুষ্ট থাকা অপরিহার্য।
১০. সত্যকামী আন্দোলনে শাহাদাতকামীদের সাথে থাকা অপরিহার্য।
১১. স্বাধীনচেতা ও মু’মিন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য লাঞ্ছনার সামনে মাথা পেতে দেওয়া হারাম।
১২. মৃত্যু হচ্ছে নে‘আমতে পরিপূর্ণ বেহেশ্তে পৌঁছার পুল স্বরূপ।
১৩. স্বাধীনচেতা হওয়া ও মহানুভবতা ঈমানদারদের বিশেষ গুণ।
১৪. সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব সময়ই ও সকলের কাছেই সাহায্য চাওয়া প্রয়োজন।
বস্ত্তত আশুরা তথা সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনার স্মৃতি যে হাজার বছরেরও বেশিকাল যাবৎ অমর হয়ে আছে তা তাঁর বাণীতে প্রতিফলিত এসব মহান ও সমুন্নত শিক্ষার কারণেই। এ কারণেই যুগে যুগে যুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়নবিরোধী এবং স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনসমূহ কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা গ্রহণ করেছে। কবির ভাষায় :
درس آزادى به دنيا داد رفتار حسين
بذر همت در جهان افشاند، افكار حسين
ﮔر ندارى دين به عالم، لا اقل آزاده باش
اين كلام نغز مى باشد ز ﮔفتار حسين
مرگ با عزت ز عيش در مذلت بهتر است
نغمه اى مى باشد از لعل درّ بار حسين.
বিশ্বে দিল শিক্ষা আযাদীর হুসাইনের আচরণ
হুসাইনী চিন্তায় হিম্মত-বীজে ভরে গেল এ ভূবন
না যদি থাকে ধর্ম তোমার, স্বাধীন হয়ে বাঁচ তবু
এ অমূল্য বাণী মনে রেখ, হুসাইনের এ কথন
লাঞ্ছিত জীবন নয়, মর্যাদা নিয়ে মৃত্যুবরণও ভাল
হুসাইনী ভান্ডারে বহু পাবে তুমি মণিমুক্তা এমন।৫৫
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী
তথ্যসূত্র
- সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৬৩
২. সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৭৮-৭৯
৩. সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৪৪
৪. সূরা আত্-তাওবাহ্ : ৭১
৫. তুহাফুল ‘উকূল
৬. نواويس – কারবালার নিকটবর্তী একটি গ্রাম; হুর্ বিন্ ইয়াযীদের কবর সেখানে অবস্থিত।
৭. ক্বেচ্ছেয়ে কার্বালা, পৃ. ১৪৮; আল্-লুহূফ্, পৃ. ২৫
৮. কিতাবুল ইরশাদ : শেখ মুফীদ, পৃ. ৯৩
৯. সূরা ইউনুস : ৭১
১০. সূরা আল্-আ‘রাফ : ১৯৬
১১. অর্থাৎ বনি উমাইয়্যাহ্র।- অনুবাদক
১২. স্মর্তব্য, হযরত হামযাহ্ ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পিতার চাচা, আর আরব রীতি অনুযায়ী পিতার চাচাকেও ‘চাচা’ বলা হয়।- অনুবাদক
১৩. হায়াতুল ইমামিল্ হুসাইন, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৮৪
১৪. و الله لا اعطيكم بيدي اعطأ الذليل و لا افر فرار العبيد. বাক্যের শেষাংশের পাঠান্তর : ولا اقر قرار العبيد. – ‘আর আমি গোলামের অঙ্গীকারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হব না।’
১৫. কিতাবুল ইরশাদ : শেখ মুফীদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৯৭
১৬. এখানে ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর পিতা হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যখন কুফা ছিল তাঁর রাজধানী এবং কুফার লোকেরা তাঁর অনুগত ছিল।- অনুবাদক
১৭. ইমাম হুসাইন এখানে আহ্যাবের যুদ্ধের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে যুদ্ধে আরবের বিভিন্ন মুশরিক গোষ্ঠী (احزاب – দলসমূহ) ঐক্যবদ্ধভাবে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল যাতে অবশ্য তারা সফল হয়নি।- অনুবাদক
১৮. এখানে ইমাম (আ.) ইয়াযীদী পক্ষভুক্ত সাবেক ইয়াহুদী ও সাবেক খ্রিস্টানদের বুঝাতে চেয়েছেন বলে মনে হয়।- অনুবাদক
১৯. এখানেও তিনি সাবেক ইয়াহুদী ও সাবেক খ্রিস্টানদের বুঝাতে চেয়েছেন বলে মনে হয়।- অনুবাদক
২০. স্মর্তব্য, জারজ সন্তানের পিতৃপরিচয়ে পরিচিত করা নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও আবু সুফিয়ানের জারজ সন্তান (কারবালার ঘটনার সময় কুফার প্রশাসক ওবায়দুল্লাহ্র পিতা) যিয়াদকে আমীর মু‘আবিয়াহ্ তাঁর ভাই বলে পরিচয় দিতেন; সম্ভবত ইমাম এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।- অনুবাদক
২১. এখানে ইমাম হুসাইন (আ.) সিফ্ফীনের যুদ্ধের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন বলে মনে হয় যখন হযরত আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার মুখে আমীর মু‘আবিয়াহ্র নির্দেশে তাঁর সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে যুদ্ধবিরতির জন্য আবেদন জানায় এবং হযরত আলীর সৈন্যদের মধ্যকার একটি বিরাট অংশ অজ্ঞতাবশত এতে প্রতারিত হয়ে তাঁকে, তাদের ভাষায়, ‘কুরআনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ না করার জন্য চাপ দেয় এবং এর ফলে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হন- যে যুদ্ধবিরতির বিষময় পরিণতি মুসলিম উম্মাহ্ আজও বহন করে চলেছে। এভাবে যুদ্ধ বন্ধের জন্য হযরত আলী (আ.)-এর ওপর চাপ সৃষ্টিকারীরা পরবর্তীকালে তাঁকে পরিত্যাগ করে যায় এবং ‘খারেজী’ নামে পরিচিত হয়।- অনুবাদক
২২. কারবালার ঘটনার সময় কুফার প্রশাসক ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদ।-অনুবাদক
২৩. তুহাফুল ‘উকূল্, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ১৭৪; আল্-ইহ্তিজাজ্, ২য় খন্ড, পৃ. ৯৯; মাক্বতালুল্ হুসাইন : খারাযমী, ২য় খন্ড, পৃ. ৬।
২৪. ইমাম হুসাইন এখানে তাঁর শাহাদাতের পরে অচিরেই মুখতার ছাক্বাফী যে অভ্যুত্থান করেন এবং কারবালার যালেমদের বিরুদ্ধে নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণ করেন সে সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।- অনুবাদক
২৫. অর্থাৎ মুখতারকে।- অনুবাদক
২৬. বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃ. ৯
২৭. কুফার প্রশাসক ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদ।
২৮. ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদ ওমর বিন্ সা‘দকে এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং এ লোভেই সে হযরত ইমামের হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।- অনুবাদক
২৯. ইমাম হুসাইনের এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল।- অনুবাদক
৩০. বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃ. ১০
৩১. আশুরার দিনে ইমাম হুসাইন (আ.) কয় বার রণাঙ্গনে আসেন এবং শত্রুবাহিনীর উদ্দেশে ভাষণ দেন ইতিহাসে তা পুরোপুরি সুস্পষ্ট নয়। আমরা এখানে তাঁর তিনটি ভাষণ উদ্ধৃত করেছি। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন যে, তিনি কি যথেষ্ট পরিমাণে বিরতি সহকারে বিভিন্ন সময় এসে এ ভাষণগুলো দিয়েছেন, নাকি এগুলো একই ভাষণেরই বিভিন্ন অংশ এবং ঐতিহাসিকগণ এগুলোকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি আশুরার দিনে শত্রুবাহিনীকে সম্বোধন করে তিন বারের বেশি ভাষণ প্রদান করেন। (ওয়াসিলাতুদ্-দারাইন : ২৯৮)
৩২. ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ্র জন্য (সৃষ্ট হয়েছি) এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনরত।’ (সূরা আল্-বাক্বারাহ্ : ১৫৬)
৩৩. বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃ. ৫
৩৪. ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নিমেণাক্ত স্লোগানমূলক কথাগুলো সরাসরি আরবি থেকে অনূদিত হয়েছে।- অনুবাদক
৩৫. মাওসূ‘আতু কালামাতিল্ ইমাম আল্-হুসাইন, পৃ. ২৮৪
৩৬. বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ৩২৯; আ‘ইয়ানুশ্ শি‘আহ্, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৮৮
৩৭. বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ৩৮১
৩৮. তুহাফুল ‘উকূল, জামে‘আহ্ মুদার্রেসীন কর্তৃক প্রকাশিত সংস্করণ, পৃ. ২৪৫; বিহারুল আনওয়ার, ৭৫তম খন্ড, পৃ. ১১৭
৩৯. মানাক্বিব : ইবনে শাহ্র আশূব, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৬৮
৪০. আল্-লহূফ্, পৃ. ৫৩; বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ৩৬৬
৪১. ওয়াক্ব‘আতু আল্তাফ্, পৃ. ১৭২; মাওসূ‘আতু কালামাতিল ইমাম আল্-হুসাইন, পৃ. ৩৬১
৪২. বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ৩৩৪
৪৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৮
৪৪. বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ৩৬৬; আ‘ইয়ানুশ্ শি‘আহ্, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৩৯
৪৫. মানাক্বিব্ : ইবনে শাহ্র্ আশূব্, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৮৯
৪৬. মাক্বতালুল্ হুসাইন : মুক্বরিম্, পৃ. ২৮০। [দ্বিতীয় পঙ্ক্তিটির দু’টি পাঠ রয়েছে; এখানে দু’টিই উদ্ধৃত হয়েছে।]
৪৭. নাফাসুল্ মাহ্মুম্, পৃ. ১৩১; মাক্বতাল : খারাযমী, ২য় খন্ড, পৃ. ৭
৪৮. মাওসূ‘আতু কালামাতিল্ ইমাম আল্-হুসাইন, পৃ. ৩৮২
৪৯. নাফাসুল্ মাহ্মুম্, পৃ. ১৩১; মা‘আনিল্ আখবার্, পৃ. ২৮৮
৫০. বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ১৯২
৫১. প্রাগুক্ত, ৪৫তম খন্ড, পৃ. ৫১
৫২. যুর্রিয়্যাতুন্ নাজাহ্, পৃ. ১২৯
৫৩. বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃ. ৪৬
৫৪. মাক্বতাল্ : খারাযমী, ১ম খন্ড, পৃ. ১৮৮
৫৫. হুসাইন পিশ্ভয়ে এন্সান্হা, পৃ. ৭০। [কবিতাটি ফাযলুল্লাহ্ সালাওয়াতী কর্তৃক রচিত।]
সৌজন্যে : প্রত্যাশা, একটি মানব উন্নয়ন বিষয়ক ত্রৈমাসিক, বর্ষ ১, সংখ্যা ৩