মালিক আশতার

মালিক আশতার হচ্ছেন ইসলামের ঐসব মহান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত যাঁরা সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের সংগ্রামে বেছে নিয়েছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পথ। তাঁর জীবনের এতগুলো যুদ্ধে তিনি এত বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে, হযরত আলী (আ.) তাঁকে ইসলামী বাহিনীর সেনাপতি নিয়োগ করেছিলেন।

সাহসী মুজাহিদ হওয়া ছাড়াও মালিক আশতার ছিলেন একজন ধর্মভীরু আলেম। কর্মজীবনের মধ্যগগনে যখন তিনি হযরত আলী (আ.)-এর সেনাপতি তখন তিনি সমাজের সবচেয়ে বিনয়ী ব্যক্তি হিসাবে পরিগণিত হন। এই খোদাভীরু লোকটি ছিলেন হযরত আলী (আ.)-এর একজন বিশিষ্ট শিষ্য। এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) কী বলেছিলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মালিক আশতারকে তিনি যতগুলো কঠিন কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার সবই তিনি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছিলেন।

বেশ কয়েকবার গভর্নর বদলের পর হযরত আলী (আ.) মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকরের হাতে মিশরের শাসনভার দিয়ে পাঠান। সিরিয়ার বিদ্রোহী গভর্নর মুআবিয়া এ সময় হযরত আলীর অধীনে থাকা এই বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশটিতে ব্যাপক অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা শুরু করে। যদিও সেনাবাহিনীতে মালিক আশতারের বিশেষ প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ইসলামের বৃহত্তম স্বার্থে তিনি তাঁকে মিশর প্রেরণ করেন এবং মালিক আশতারের পরিচয় দিয়ে মিশরবাসীর কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ পত্র প্রেরণ করেন :

‘আল্লাহর সৃষ্টি আলী ইবনে আবি তালিবের পক্ষ হতে মিশরবাসীর প্রতি, যাদের ক্রোধ আল্লাহর স্বার্থে। তারা ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল যখন তারা দেখল যে, তাদের জমিন আল্লাহর অবাধ্য লোকদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে; যখন দলিত হচ্ছিল অধিকার আর অরাজকতাই হয়ে পড়েছিল আইন এবং ভালোমন্দ, মিশরীয়-অমিশরীয় সবাই তার শিকারে পরিণত হয়েছিল, যখন ধর্মভীরুতা ও সৎকর্মের মুখে নির্মিত হয়েছিল প্রাচীর; আর কেউই যখন নাফরমানি আর পাপ করতে এতটুকু দ্বিধা করত না।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা এবং রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালামের পর তোমরা জেনে রাখ যে, আমি তোমাদের কাছে এমন একজন আল্লাহর বান্দাকে পাঠাচ্ছি যিনি যুদ্ধের চরম সন্ধিক্ষণেও শত্রুকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেন না এবং যিনি কাফের ও অবাধ্যদের প্রতি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের চেয়েও ভীষণ।

তিনি হচ্ছেন মাহাজ গোত্রের মালিক ইবনে হারিস। তাঁর কথা শোন এবং মেনে চল তাঁর আদেশগুলো, যেগুলো তোমরা সঠিক ও ইসলামের খাঁটি বিধানগুলোর সাথে পূর্ণ সংগতিপূর্ণ দেখতে পাবে। তিনি আল্লাহর তরবারিগুলোর মধ্যে এমন সুতীক্ষ্ণ তরবারি যার ধার কখনই ভোঁতা হবে না এবং যার আঘাত একটিবারও লক্ষ্যচ্যুত হবে না। যদি তিনি তোমাদের আদেশ করেন শত্রুর বিরুদ্ধে এগুতে, তাহলে এগোও, তিনি যদি তোমাদের থামতে বলেন, থাম, কারণ, তিনি আমার আদেশ ছাড়া কখনই কাউকে সম্মুখে নেন না বা পেছনে ফেলেন না। তোমাদের কাছে তাঁকে পাঠানোর ক্ষেত্রে আমি আমার চেয়ে তোমাদের প্রয়োজনকেই বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছি, যাতে তোমরা বিশ্বস্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পার এবং সাহস ও দৃঢ়তার সাথে শত্রুদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হও।’- নাহজুল বালাগা, পত্র নং ৩

এ ছিল ইসলামের একজন একনিষ্ঠ সেবক সম্পর্কে হযরত আলী (আ.)-এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

সেনাবাহিনীর দুই অধিনায়কের কাছে প্রেরিত আর এক পত্রে মালিক সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেন : ‘যারা তোমাদের ওপরে এবং তোমাদের অধীনস্থ আছে তাদের সবার ওপর আমি মালিক আশতারকে নিয়োগ করছি। সুতরাং তাঁর আদেশ মেনে চল এবং তাঁকে গ্রহণ কর তোমাদের ঢাল ও বর্ম হিসেবে। কেননা, তিনি এমন এক  ব্যক্তি যাঁর পক্ষ হতে আমি কোনো দুর্বলতা বা ত্রুটির আশঙ্কা করি না; যেখানে দ্রুততা প্রয়োজন সেখানে আলস্য কিংবা যেখানে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন সেখানে তাড়াহুড়া করার সম্ভাবনা যার মধ্যে নেই।’

অপর পক্ষে জালিম উমাইয়্যা শাসকগোষ্ঠী তাঁর সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করত। ঐতিহাসিক ইবনে আসির লিখেন যে, মুআবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান সবসময়েই নামাযের পর আলী (আ.), হাসান (আ.) ও হোসাইন (আ.)-এর ওপর অভিশাপ দিতেন। কপটতার প্রতীক, ইতিহাসের নিষ্পেষক ও বিদ্রোহীদের সর্দার মুআবিয়া তাঁর গুপ্তচরদের মাধ্যমে মালিক আশতারকে হত্যা করার পর এই অশেষ রহমতের (!) জন্য খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পর বলেন : ‘আলী ইবনে আবি তালিবের দুটি হাত ছিল : একটি আম্মার ইয়াসির, যা কাটা পড়েছে সিফফিনে; আর একটি ছিল মালিক আশতার যা এইমাত্র কাটা পড়েছে।’

স্বপক্ষীয় ও বিরোধী উভয় পক্ষের কাছেই মালিক আশতার একজন মহান ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন।

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-এর হাতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর সাসানীয় রাষ্ট্র ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের সময় তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত উঁচুমানের সেনাপতি। বিদ্রোহী নাকেসিন, নাহরাওয়ানের খাওয়ারিজ এবং কাসেতিন ও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি ন্যায়ের সৈনিকদের পক্ষে বিজয়ের মুকুট বয়ে এনেছিলেন।

হযরত উসমানের খেলাফতের সময় মালিক আশতার খলিফার বিরাগভাজন হয়ে নির্বাসনে প্রেরিত হন, রাসূল (সা.)-এর সাহাবা হওয়ার গৌরবে তিনি গৌরবান্বিত ছিলেন এবং হযরত আলীর ঘনিষ্ঠ সহচরদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। উমাইয়্যা গুপ্তচরদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার কারণে মিশরে যখন বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তখন হযরত আলী (আ.) মুহাম্মাদ বিন আবি বকরের পরিবর্তে মালিক আশতারকে মিশরের গভর্নর নিয়োগ করেন। কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছার আগেই মিশরের নিকটবর্তী বুলজম গ্রামে উমাইয়্যা ঘাতকদের হাতে তিনি শাহাদাতবরণ করেন।

হযরত আলী (আ.) যখন মালিক আশতারের শাহাদাতের সংবাদ পেলেন তখন তিনি বলে ওঠেন : ‘হায় মালিক! কত বড় মানুষ ছিল সে! আল্লাহর শপথ, যদি সে পর্বত হতো, তাহলে হতো এক মহাপর্বত, সে যদি পাথর হতো, তাহলে সে এতটা কঠিন আর এতটা বিশাল হতো যে, কোনো অশ্বচালক উঠতে পারত না তার ওপর, কোনো পাখি উড়তে পারত না তার ওপর দিয়ে।’-নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ৪৪১

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.