শামীমা আফরোজ
বাংলা সাহিত্য জগতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এঁরা দু’জনেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে শুধু উন্নত ও সমৃদ্ধই করেননি, বিশ্ব দরবারে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিতও করেছেন। দু’জনেই যে যার ক্ষেত্রে প্রজ্জ্বলমান নক্ষত্রসম। এদের একজনকে ছাড়া অন্যজনকে ভাবা যায় না, এরা উভয়ে বাংলা সাহিত্যের একই বৃন্তে দু’টি ফুল। বয়সের বেশ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের মাঝে আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, স্নেহ-ভালোবাসার কমতি ছিল না। একজন অপরজনের কবিতা, গান, সাহিত্যের ভক্ত হলেও কেউ কারও দ্বারা প্রভাবিত হননি। বরং, আপন স্বকীয়তায় রেল লাইনের দু’লাইনের মতই সমান্তরালভাবে সদাবহমান। আমরা বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপালকে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। আদর্শ কবিগণ স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে স্থায়ী আসন পেতে নেন ভক্তের অন্তরের অন্তঃস্থলে। প্রিয় কবির দু’লাইন কবিতার ছত্রে ভক্ত যেন খুঁজে পান হৃদয়ের কথা, শাণিত চেতনা। এখানেই কবির স্বার্থকতা।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান যুদ্ধের ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে, দেশকে স্বাধীন করতে যে অবদান রেখেছে, উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে তার নজির বিরল। নিঃসন্দেহে প্রিয় কবির স্বভাব-চরিত্র, চিন্তা-চেতনার প্রচণ্ড প্রভাব পরে ভক্তদের হৃদয়ে। মুসলিম জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুলের মাঝে আমরা খুঁজে পাই বাঙালি মুসলিম জাতির জাতিসত্ত্বা ও ধর্মীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ। যদিও তিনি হিন্দু জাতির জন্যও অনেকগুলো শ্যামা সঙ্গীত, কির্তন ইত্যাদি লিখে গেছেন। তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতায়ও হিন্দু ধর্মের অনেক দেব-দেবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িকের মাঝে ইসলামী জাগরণের কবি। নজরুল যেমন অসংখ্য ইসলামী গান, হামদ, নাত রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথও পূজার গান রচনা করেছেন ৬১৭টি। অনেক হিন্দু তাদের পূজায় রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে থাকেন, অনেকে তাকে দেবতা বানিয়ে পূজাও করছেন। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, আপত্তি থাকার কথাও নয়। আপত্তি হলো যখন বাংলাদেশের কিছু মুসলমান অতিভক্তির আতিশয্যে রবীন্ত্রনাথকে হিন্দুদের মতো দেবতা বানিয়ে পূজার অনুরূপ করে থাকেন তখন, তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, আর স্বধর্মের জাতীয় কবিকে সঠিক মর্যাদা দেয় না, অবহেলা করে, তখন বড় কষ্ট হয়! সহজ সরল সাধরণ মুসলমানের ঈমানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করা হয়। জাতীয় চেতনাকে বিনষ্ট করা হয় তখন সইতে পারি না!
১লা বৈশাখে রবীন্দ্র বন্দনা ও চর্চা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা হয় দেখে মনে হয় বাংলার মাটিতে রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বৈশাখ মাস আসেনি, সমাজের কেউ ১লা বৈশাখ উদযাপন ও হালখাতাও করেননি। বাংলাদেশে রবীন্দনাথকে নিয়ে যে ধরনের বাড়াবাড়ি করা হয় ইন্ডিয়া, কলকাতা খোদ কবির বাড়ি জোড়াসাঁকোতেও তার সিকিখানিও করা হয় না। এসব দেখে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো স্বয়ং লজ্জা পেতেন ও আপত্তি জানাতেন। রবীন্দ্রানুষ্ঠানের আয়োজকরাই নজরুলের ব্যাপারে এত কার্পণ্য কেন করে থাকেন, বুঝে আসে না। ইদানীং একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় তাহলো মিডিয়াগুলোতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিস্তৃতির জন্য যতটুকু চেষ্টা করা হয় নজরুল গীতির জন্য ততটুকু করা হয় না। রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য নামকরা ও ভালোমানের শিল্পীদের সিলেক্ট করা হয়। অথচ নজরুল গীতির জন্য সমমানের শিল্পীদের সিলেক্ট করা হয় না বলেই মনে হয়। নজরুলের গানের শব্দ, সুর, উচ্চারণে প্রচুর ভুলভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। অনেক গানে আন্তরিকতা, যোগ্যতা, প্রশিক্ষণেরও প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হয় যা শ্রুতিকটু ঠেকে। কিন্তু ঐ গানগুলোই বিখ্যাত নজরুল শিল্পীদের দিয়ে পরিবেশন করলে গানের তাল, লয়, সুর, উচ্চারণে আন্তরিকতা ফুটে ওঠে, ফলে অনেক শ্রুতিমধুর হয়, গানের আবেদন ও স্বাভাবিকতার ফলে সর্বজন গ্রাহ্যতাও বেড়ে যায়। নজরুল মাত্র ২২/২৩ বছর লিখতে পেরেছেন তাও আবার শান্তিতে বসে নয়। বাল্যঅবধি দারিদ্র্যের কষাঘাতে, যুদ্ধের ডামাডোলে, জেলখানার জিঞ্জিরায়, রাজনৈতিক অস্থিরতায়, পারিবারিক সমস্যায়, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের শিকারে থাকা অবস্থায়! ধীরস্থিরভাবে তিনি লিখতেও পারেননি গবেষণাও করতে পারেননি। তদুপরি যা লিখেছেন, সঠিক সংরক্ষণের অভাবে সে সময় থেকে শুরু করে অদ্যবধি সেসবের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, চুরি হয়েছে, নষ্ট হয়েছে। এখনও অজানাই রয়ে গেছে তার অনেক গান, কবিতা রচনাবলি! গত ক’দিনপূর্বে নজরুলের ইসলামী গানের সম্রাট ও সহচর মরহুম আব্বাসউদ্দিন এর সুযোগ্য সন্তান নজরুল গীতির শিল্পী মোস্তফা জামান আব্বাসী জানিয়েছেন, নজরুল অসুস্থ হয়ে নয় বরং কাঁধে প্রচণ্ড আঘাত করায় নির্বাক হয়ে গেছেন! এ সম্পর্কিত বা চিকিৎসা সংক্রান্ত ১৫টি প্রেসক্রিপশন ও ওনার কাছে মওজুদ আছে বলে তিনি জানান। নজরুলের সরলতার সুযোগে তাঁকে দিয়ে চলচ্চিত্রে শ্রী-কৃষ্ণের অভিনয় থেকে শুরু করে পূজা অর্চনাও করানো হয়েছে। এতেও নিস্তার মেলেনি কবির, অবশেষে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে নির্বাক-নিস্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবহেলা, দ্রুত ও উন্নত চিকিৎসার অভাবে বাংলার গানের বুলবুলি চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। গুটিকয়েক ভক্ত ও কল্যাণকামী ছাড়া কবির প্রতি কেউ সত্যিকারার্থে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দেননি। হিন্দু-মুসলিম-বৃটিশ রাজ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকই কবিকে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দিয়েছেন। একথাও প্রচলিত আছে যে, কবিকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছিল। অত্যাধিক শারীরিক ও মানসিক কষ্ঠে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কবি নির্বাক অসুস্থ হয়ে যান। কবি আরও ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন, যদি ষড়যন্ত্রমূলক অসুস্থ না হয়ে ঐ ৩৪ বছর অর্থাৎ পরিণত বয়স পর্যন্ত অনুকূল পরিবেশে ধীরে সুস্থে লিখতে পারতেন, তাহলে নজরুলের গান, কবিতা ও রচনাবলির নিকট পৃথিবীর কোনো কবি-সাহিত্যিক দাঁড়াতে পারতেন বলে মনে হয় না। এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ভাগ্যবান ছিলেন। তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে সহিত্যিক জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন। ৮০ বছরের জীবনে ৬৪ বছর লিখে গেছেন নিশ্চিন্ত মনে, কোনো পারিবারিক, সামাজিক জেল-জুলুম ব্যতিরেকে।
অসুস্থ কবির জীবন সায়াহ্নে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব কবিকে সম্মানের সাথে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনানোর ব্যবস্থা করেন। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়, ধানমন্ডিতে কবিকে বাসা ও গাড়ি দেয়া হয়। পিজি হাসপাতালের সম্মুখস্থ ফুলবাগানে কবি পায়চারি করতেন, বিকেলে গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াতেন, কথা বলার চেষ্টা করতেন, কবিকে বেশ উৎফুল্ল মনে হতো, ওনার সেন্সও অনেকটা সচল হচ্ছিল। কিন্তু এতবড় একজন রোগী জাতীয় কবির সাথে পূর্বেকার ষড়যন্ত্রের দোসররা ষড়যন্ত্র করতে এবারও দ্বিধা করেনি। বিকেলে কবি পাজামা-পাঞ্জবি পরিধান করে তৈরি থাকতেন বেড়াতে যাওয়ার জন্য। গাড়ি নষ্ট, তেল নাই, ড্রাইভার আসেনি এ সকল কথা বলে কবিকে বেড়াতে নেয়া হতো না। কবি মন খারাপ করে বসে থাকতেন। কবি ক্ষীর খেতে পছন্দ করতেন বলে কবির ভক্ত এক অধ্যাপিকা প্রতিদিন ক্ষীর বা পায়েস রান্না করে নিয়ে আসতেন, কবি আগ্রহ ভরে খেতেন। অধ্যাপিকাকেও ক্ষীর আনতে নিষেধ করে দেয়া হয়। আরও জেনেছি কবির সম্মুখে কবির রচিত প্রিয় গানগুলো উল্টাপাল্টা করে বা বেসুরা করে শুনানো হতো। এতে কবি খুবই কষ্ট পেতেন। তিনি ক্ষীপ্ত হয়ে এটা ওঠা ছুঁড়ে ফেলতেন, রাগান্বিত অবস্থায় পায়চারি করতেন। জীবনের শেষপ্রান্তেও কবিকে এ ধরনের মানসিক বা মেন্টাল টর্চার করা হয়েছে। একটি কুচক্রি মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই কবির পেছনে লেগে থাকতো। এরা কবির সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন সহ্য করতে পারতো না। এদের উত্তরাধিকারীরা আজও কবির জীবনী, গান কবিতা রচনাবলী সকলে জানুক তা চায় না, এসব দিয়ে বাংলার মুসলিম জনগণ উজ্জীবিত হোক তাও চায় না।
যারা নজরুলের ভক্ত, জাতির প্রতি যাদের দায়বদ্ধতা আছে তাদের উচিত কবির রচনাবলী মন থেকে মনে, ঘর হতে ঘরে, দেশ হতে দেশান্তরে ছড়িয়ে দেয়া, তাঁর গানের মান বজায় রাখার ব্যবস্থা করা। ইসলামী জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, চেতনার কবি, জাতীয় কবিকে আর অবমূল্যায়ন বা স্বল্পমূল্যায়ন নয়।
নজরুলের লিখনী দিয়ে এ দেশের মুসলমানদের ঈমান-একতা, সম্মান-মর্যাদা, সাহস-হিম্মত, দায়িত্ব-কর্তব্য, দেশপ্রেম-ধর্মপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি ফিরে পেতে হলে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে হলে, নজরুলকে জানতে হবে, তাঁর সাহিত্য ছড়িয়ে দিতে হবে বেশি বেশি করে। নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে হলে সচেতন কবি ভক্তদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তবেই কবির সঠিক মূল্যায়ন হবে, কবির প্রতি দায়িত্ব পালন করা হবে, হয়তো এভাবে কবির বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। জাতি জাতীয় কবির সঠিক মূল্যায়ন করবে এ আশা ব্যক্ত করছি। ওমা তৌফিকী ইল্লাবিল্লাহ।
সূত্র: সাপ্তাহিক সোনার বাংলা