ইতিহাস থেকে এক ঝলক —
৩য় খলীফা হযরত ওসমানের শাসনকাল —
নাহজুল বালাগা থেকে —
৩য় খলিফা হযরত উসমানের রাজত্বকাল সম্পর্কে মহান আল্লাহ কতৃক নির্বাচিত ১ম ইমাম আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আঃ) বলেন —
ওসমান ক্ষমতায় আসার পর পরই উমাইয়া গোত্র সুবিধা পেয়ে গেল এবং অবাধ ও নির্বিচারে লুটপাট শুরু করে দিল ।
খরায় শুকিয়ে যাওয়া অঞ্চলের গরুর পাল সবুজ ঘাস দেখলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে উমাইয়া গোত্র ঠিক সেভাবে আল্লাহর সম্পদের অর্থাৎ বায়তুল মাল এর উপর হামলে পড়ল এবং গোগ্রাসে তা নিঃশেষ করতে লাগল ।
অবশেষে ওসমানের প্রশ্রয় ও মারাত্মক স্বজনপ্রীতি এমন এক পর্যায় গেল যখন সাধারন জনগন তার ঘর অবরোধ করে তরবারি দ্বারা আঘাত করল এবং সে যা গলাধঃকরন করেছিল তা বমি করায়ে ছাড়ল ।
ওসমানের শাসনের সময়কালে দুঃশাসন ও কুশাসন এমনভাবে বিরাজ করেছিল যে , উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন সাহাবাগনের অকদর ও দারিদ্র দেখে কোন মুসলিম স্থির থাকতে পারর না ।
অথচ সমুদয় বায়তুল মাল উমাইয়া গোত্রের নিয়ন্ত্রনে ছিল । সরকারী পদ সমুহ তাদের অনভিজ্ঞ যুবক শ্রেনির দখলে ছিল । মুসলমদের বিশেষ সম্পদ তথা রাষ্টীয় সম্পদ তাদের মালিকানায় ছিল । চারনভুমি তাদের পশুপালের জন্য নিধারিত ছিল । গৃহ নিমিত হয়েছিল কিন্তু শুধুমাত্র তাদের দ্বারা এবং ফলের বাগান ছিল কিন্তু তা শুধু তাদের জন্য ।
যদি কোন সচেতন ব্যাক্তি এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করত তবে তার পাঁজর ভেঙ্গে দেয়া হত ।
এহেন আত্মসাতের জন্য কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করলে তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হত ।
যেমন রাসুল (সাঃ) এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী আবুজরকে (রঃ) ওসমান রাবযাহ মরুভুমিতে নির্বাসন দেন এবং সেখানেই আবুজর (রঃ) অনাহারে থেকে অত্যন্ত নির্মম ভাবে ইন্তেকাল করেন । দারিদ্র ও দুস্থদের যাকাত এবং সর্বসাধারনের বায়তুল মালের কি অবস্থা ওসমান করেছিল নীচে তার কিছু উদাহরন থেকে অনুমান করা যাবে –
১) হাকাম ইবনে আবুল আ’সকে রাসুল (সাঃ) মদিনা থেকে তাকে বহিস্কার করেছিলেন ।
রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাহ ও আগের ২ খলিফার নীতি ভঙ্গ করে ওসমান তাকেই মদিনায় এনে বায়তুল মাল থেকে ৩ লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন ।
সূত্র – বালাজুরী ১০০ ,পৃ – ২৭ ,২৮,১২৫ ।
২) পবিত্র কোরআনে মুনাফিক বলে ঘোষিত অলিদ ইবনে উকবাহকে বায়তুলমাল থেকে ১ লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন ।
সূত্র – রাব্বিহ ১১৮,৩য় খন্ড ,পৃ – ৯৪ ।
৩) ওসমান তার কন্যা উম্মে আবানকে মারওয়ান ইবনে হাকামের নিকট বিয়ে দিয়ে বায়তুল মাল থেকে ১ লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন ।
সূত্র – হাদীদ ১৫২, ১ম খন্ড ,পৃ – ১৯৮-১৯৯ ।
৪) ওসমান তার কন্যা আয়শাকে হারিছ ইবনে হাকামের নিকট বিয়ে দিয়ে তাকে বায়তুল মাল থেকে ১ লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন ।
সূত্র – রাব্বিহ ১১৮ ,৩য় খন্ড ,পৃ – ৯৪ ।
৫) তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে খালিদকে ৪ লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন ।
সূত্র – কুতায়বাহ ৪৮ ,পৃ -৮৪ ।
৬) আফ্রিকা থেকে খুমস হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ থেকে ৫ লক্ষ দিরহাম মারওয়ান ইবনে হাকামকে দিয়েছিলেন ।
প্রাগুক্ত ।
৭) সাধারন বদান্যতার কারন দেখিয়ে রাসুলে (সাঃ) এর প্রানপ্রিয় কন্যা থেকে অবৈধ ভাবে বাজেয়াপ্ত রাষ্ট্যায়াত্ব ‘ বাগে ফাদাক ’ মারয়ান ইবনে হাকামকে দান করেছিলেন ।
প্রাগুক্ত ।
৮) মদিনার মাহজুব নামক বানিজ্য এলাকা জনগনের ট্রাস্ট হিসেবে রাসুল (সাঃ) ঘোষনা করেছিলেন । কিন্ত ওসমান তা তার জামাতা হারিছ ইবনে হাকামকে দান করেছিলেন ।
প্রাগুক্ত ।
৯) মদিনার চারপাশে তৃনভুমিতে উমাইয়া গোত্র ছাড়া অন্য কারোর উটকে চরতে দেয়া হত না ।
সূত্র – হাদীদ ১৫২ ,১ম খন্ড , পৃ – ১৯৯ ।
১০) ওসমানের মৃত্যর পর তার ঘরে ৫০,০০০ দিনার স্বর্ন মুদ্রা ও ১০,০০,০০০ দিরহাম রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল ।
তার লাখারাজ জমর কোন সীমা ছিল না । ওয়াদি-আল কুরা ও হুনায়নে তার মালিকানাধীন ভুসম্পত্তির মুল্য ছিল ১ লক্ষ দিনার । তার উট ও ঘোড়ার সংখ্যার কোন হিসাব ছিল না ।
সূত্র – মাসুদী ১০৯ ,১ম খন্ড , পৃ – ৪৩৫ ।
১১) প্রধান নগরীগুলো ওসমানের আত্নীয়-স্বজনদের শাসনাধীনে ছিল ।
কুফার শাসন ক্ষমতায় ছিল অলিদ ইবনে উকবা । সে একদিন প্রচন্ড মাদকাসক্ত অবস্থায় ইমামতি করতে গিয়ে ফজরের সালাত ২ রাকাতের পরিবর্তে ৪ রাকাত আদায় করায় জনগন উত্তেজিত হয়ে পড়ে । এতে খলিফা ওসমান তাকে সরিয়ে অন্যতম চিঞ্ছিত মুনাফিক সাঈদ ইবনে আসকে কুফার শাসনকর্তা হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন ।
এভাবে মিসরে আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ , সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান ও বসরায় আব্দুল্লাহ ইবনে আমিরকে শাসনকর্তা হিসাবে নিয়োগ দিয়ে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রশাসনে মারাত্মক অরাজকতা সৃষ্টি করেছিলেন ।
সুত্র – নাহজুল বালাগাহ ।
সুপ্রিয় পাঠক ,
৩য় খলীফা হযরত ওসমানের উপর সাধারন জনরোষ এতটাই তীব্র ছিল যে , ওসমানের লাশ তিনদিন তার রাজপ্রাসাদে পড়ে ছিল । লাশে পচন শুরু হওয়াতে তার ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় স্বজন গভীর রাতে গোসল জানাজা বাদে গোপনে হিহুদীদের কবরস্থানে মাটি চাপা দিয়ে আসে ।
পরবর্তীতে মূয়াবীয়ার শাসন আমলে হিহুদী কবরস্থানের ঐ জায়গাটুকু জান্নাতুল বাকীর সাথে একত্রীকরন করা হয় ।
আরও বিস্ময়ের বিষয় যে , ওসমান হত্যাকান্ডের বিচার নিয়ে মূয়াবীয়া হযরত আলী (আঃ) এর বিরুদ্বে প্রচন্ড আন্দোলন করেছিল । এক পর্যায় হযরত আলী (আঃ) কে হত্যার পরে মূয়াবীয়া যখন পূর্ন ক্ষমতায় এল তখন ভুলেও মূয়াবীয়া ওসমান হত্যাকান্ড নিয়ে টু শব্দটি করে নি । মূয়াবীয়ার ক্ষমতায় আসার জন্য ওসমানের মৃত লাশটাই যেন জরুরী ছিল !