রোযার আরেকটি নাম হচ্ছে সাওম। রমজানের রোযা আল্লাহ প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য ফরজ করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ কোরআনে বলেছেন-“হে মুমিনগন! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের উপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করতে পারো।” (সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৩)।
রহমত, মাগফেরাত আর নাজাতের বার্তা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান বর্ষপরিক্রমায় প্রতিবছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে। নিঃসন্দেহে অন্যান্য মাস অপেক্ষা রমজান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা অসীম। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ মাসকে “শাহরুল্লাহ” তথা আল্লাহর মাস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং এ মাসে রোযা পালনকারীকে স্বীয় মেহমানের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। তাই এ মহিমান্বিত মাসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও গুরুত্বকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা প্রতিটি মুমিনের উপর একান্ত অপরিহার্য। কেননা, এরই মাঝে আল্লাহর নৈকট্য ও মানুষের পরিশুদ্ধতা অর্জনের রহস্য নিহিত। প্রকৃতপক্ষে, মাহে রমজান হচ্ছে, মুমিনদের জন্য আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম এবং তাকওয়াপূর্ণ জীবনগড়ার সর্বোত্তম প্রশিক্ষণকাল।
এখন আমরা মাহে রমজানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ যে বিস্ময়কর আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের সূবর্ণ সুযোগ লাভ করে সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তকারে আলোকপাত করছিঃ
সিয়াম শব্দের অভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পরিহার করা এবং সংযত হওয়া। সিয়ামের পরিভাষিক অর্থ হচ্ছে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত সকল ধরণের পানাহার, পাপাচার এবং ষড়রিপুর তাড়না থেকে নিজেকে বিরত সংযত রাখা। পাপাচার ও অনৈতিক কার্যাবলী মানবীয় স্বত্বাকে পাপাসক্ত করে তোলা। আর রোযা মানুষকে এ সকল গর্হিত ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখে এবং মানব হৃদয়ে এক অলৌকিক প্রশান্তির আভা দান করে। রাসূল (সাঃ) বলেন, “রোযা অন্যায় থেকে নিস্কৃত পাওয়ার ঢালস্বরূপ। রমজান মাসে বরকতময় মুহূর্তগুলোতে আল্লাহ পাকের অফুরন্ত রহমতের ধারা অনবরত বর্ষিত হয়। বৃষ্টি বর্ষণের ফলে মৃত-শুষ্ক জমিন যেমন সবুজ শস্য, শ্যামলিমায় প্রানবন্ত হয়ে ওঠে, তেমনি মাহে রমজানের একটানা সিয়াম সাধনা দেহ ও আত্মাকে করে কলষমুক্ত আর মানবহৃদয়কে করে ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত। মাহে রমজান হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার শাশ্বত জীবন বিধান আল কোরআন নাজীলের মাস। আল কোরআনের ভাষায় “রমজান মাস, এ মাসেই কোরআন নাজীল হয়েছে, যা সমগ্র মানবজাতীর৩ জন্য দিশারী, সত্যপথের স্পষ্ট পথনির্দেশকারী এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরুপণকারী।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)।
রোযা অথবা সাওমের আরেকটি আভিধানিক অর্থ হলো চুপ থাকা এবং সম্ভবতঃ হযরত মরিয়মের (আঃ) মাধ্যমে এই অর্থের কোরআন মজিদে উল্লেখ রয়েছে যে, “ইন্নি নাজরাতু লিররাহমানি সাওমা” অর্থাৎ, আমি চুপ থাকার মানত করেছি। সাওমের আরেক অর্থ হলো বিরত থাকা। সম্ভবত প্রথম অর্থের উপরেও সাওমের এই অর্থ বর্তাবে অর্থাৎ, কথা বলা থেকে বিরত থাকার মানত অথবা কথা বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। শরীয়ত এই আভিধানিক অর্থকে নিয়ে কিছু সিমাবদ্ধতা ও কিছু উপযোগ সংযুক্ত করে প্রচলিত অর্থ গঠন করেছে যেমন, উক্ত শব্দ ছাড়া (সওম) ঐ শব্দগুলি যেমন সালাত, হজ্জ্ব অথবা জাকাত শব্দ প্রভৃতিও একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্ববর্তী আম্বিয়া (আঃ) গনের যুগেও মানুষদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে। কিন্ত ‘ আল্লাহর অশেষ রহমত ও মেহেরবাণী যে, তিনি তার প্রিয় নবী (সাঃ) এর উপর পবিত্র কোরআনের ন্যায় এক মহান গ্রন্থা নাযিল করেছেন এছাড়া স্বয়ং রোযা সম্পর্কেআল্লাহর এরশাদ হচ্ছে অর্থাৎ, “রোযা আমার জন্য এবং আমিই তার পুরস্কার দান করবো।” (সূত্র: পক্ষিক ফজর, ১৫ সেপ্টেম্বার ২০০৭, রেজি নং এল-৩৭৫)।
তাহলে “ইয়া আইয়্যুহাল্লাযী না আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আলাল্লাযীনা মিন্ ক্বাবলিকুম লাআলল্লাকুম তাত্তাকুন ” এ আয়াত দ্বারা প্রমানিত হয় যে, আল্লাহর তরফ থেকে যত শরীয়াত দুনিয়ায় নাযিল হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই রোযা রাখার বিধি-ব্যবস্থা ছিল। চিন্তা করার বিষয় এই যে, রোযার মধ্যে এমন কি বস্তু নিহিত আছে, যার জন্যে আল্লাহ তাআলা সকল যুগের শরীয়াতেই এর ব্যবস্থা করেছেন। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।
পবিত্র রমজান মাস হলো আল্লাহর মাস। এটা সেই মাস যে মাসে রহমত তথা জান্নাতের দরজা খুলে যায় আর দোযখের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। হযরত ইমাম রাযা (আঃ) হতে বর্ণিত যে, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) শাবান মাসের শেষের দিকে একটি খুৎবা বর্ণনা করেছিলেন। খুৎবায় তিনি বলেছিলেন যে, ওহে লোক সকল, তোমরা সকলে যেনে নাও যে আল্লাহর মাস রহমত, বরকত ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার সব চাইতে ভাল দিন নিয়ে তোমাদের নিকট উপস্থিত হয়েছে। এই মাস আল্লাহর নিকট সব চাইতে উত্তম মাস। রমজান মাসের দিন সমস্ত বছরের দিনের চাইতে এবং রমজান মাসের রাত সমস্ত বছরের চাইতে উত্তম। এই মাসে তোমাদের শ্বাস নেওয়াও তসবিহ এর সোয়াবের সমতুল্য। এই মাসে তোমাদের নিদ্রা ও ইবাদতে গণ্য হবে। আর তোমাদের ইবাদতও দোয়া গৃহীত হবে। সুতরাং তোমরা পরিস্কার ও পবিত্র মনে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর এই যে, যেন আল্লাহ তোমাদের কে রমজান মাসে রোযা রাখার ও কোরআন শরীফ পড়ার সামর্থ্য দান করেন। লোকসকল! এ মাসে তোমাদের মধ্যে হতে যে একজন কোন মুমিন ভাই কে ইফতার করাবে আল্লাহ তাকে একজন ক্রীতদাস মুক্তি করে দেওয়ার সোয়াব দান করবেন আর তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেবেন। এই কথা শুনে কয়েকজন বলল যে, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ! রোযাদারের ইফতার করানোর সামর্থ আমাদের নেই। হযরত (সাঃ) বললেন যে, তোমরা দোযখের আগুন হতে নিজেকে রক্ষা কর আর রোযাদার কে ইফতার করাও, হয় অর্ধেক খোরমার মাধ্যমে, না হয় এক ডুক পানির মাধ্যমে। তারপর নবী (সাঃ) বললেন যে, এই মাসে যে প্রচুর পরিমাণে আমার ও আমার আহলে বাইতের উপর দরূদ শরীফ পড়বে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার নেকির পাল্লা ভারি করে দিবেন। আবার এই মাসে যে কোরআন শরীফের একটি আয়ত ও পাঠ করবে তাকে অন্য মাসের কোরআন শরীফ শেষ করার সমান দান করা হবে। ওহে লোক সকল! এই মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়, তাই দোয়া কর যে, এই দরজা যেন তোমাদের জন্য বন্ধ করে না দেওয়া হয়। আর এই মাসে দোযখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই দোয়া কর যে, এই দরজা যেন তোমার জন্য খোলা না হয়। আবার এই মাসে শয়তান বন্দী হয়ে যায়। তাই তোমরা দোয়া কর যে, শয়তান যেন তোমাদের শাসনকর্তা রূপে পরিণত না হয়। (সূত্র: তোহফাতুল আওয়াম মাকবুল যাদিদ, লেখকঃ হযরত আয়াতুল্লাহ আল-ওযমা সৈয়দ মোহসিন হাকিম তাবা তাবাই)
রোযা প্রসঙ্গে
পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ রোযাকে ফরজ করেছেন এবং রোযার সময়সীমা উল্লেখ করে দিয়েছেন। কালাম পাকে সুরা বাকারায় পরিস্কার লেখা আছে রাতের বেলায় রোযাকে পূর্ণ করা। অর্থাৎ সুবহা সাদেকের পর থেকে রাতের কালো অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে রোযাকে পরিপূর্ণ করা।আর এই আয়াতের দলিলসমূহ বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের সকল কোরআনের তরজমায় একই কথা ‘রাত পর্যন্ত’ উল্লেখ আছে। যার কিছু দলীলসমূহ নিম্নে দেওয়া হয়েছেঃ
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তায়ালা হুকমু দিচ্ছেন যেঃ “আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষন না রাত্রির কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। ” (সূত্র: আল কোরআন, সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৭, নূর কোরআন শরীফ -সোলেমানিয়া বুক হাউস, ৭ নং বায়তুল মোকাররম)।
“আর পানাহার কর যতক্ষন না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়”। (সুত্র: পবিত্র কোরআনুল করীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), মূলঃ তফসীর মাআরেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ৯৪, হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী (রহঃ), অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, (সউদী আরবের মহামান্য শাসক খাদেমুল-হারামাইনিশ শরীফাইন বাদশা ফাহ্দ ইবনে আবদুল আজীজের নির্দ্দেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পবিত্র কোরআনের এ তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তফসীর মুদ্রিত হলো)।
“আর রাতের বেলায় খানাপিনা কর, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের নিকট রাতের কালো রেখা থেকে সকালের সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে না ওঠে। তখন এসব কাজ ছেড়ে দিয়ে রাত পর্যন্ত নিজেদের রোযা পুরা কর। (সুত্র: সহজ বাংলায় আল কোরআনের অনুবাদ, প্রথম খণ্ড, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র)-এর উর্দু তরজমার বাংলা অনুবাদ, অধ্যাপক গোলাম আযম, কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড, জানুয়ারি ২০০৮)।
“তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ ভোর বেলার রেখার পরে সাদা রেখা পরিস্কার দেখা যাইবে। অতঃপর তোমরা রাত্র পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর”। (সূত্র: বাংলা কোরআন শরীফ, ফুরফুরা শরীফের শাহ সূফী মাওলানা আবদুদ দাইয়্যান চিশতী কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত, কথাকলি-ঢাকা গাইবান্ধা, সন: আগষ্ট ১৯৮৯)।
“আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণ রেখা হতে উষার শুভ্ররেখা স্পষ্টরূপে প্রতিভাত না হয়। অতপর রাত্রি পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর”। (সূত্র: নূর বাংলা উচ্চারণ অর্থ ও শানে নুযুলসহ কোরআন শরীফ, উচ্চারণ ও অনুবাদে: মাওলানা খান মোহাম্মদ ইউসুফ আবদুল্লাহ (এম.এম), ছারছীনা দারুস সুন্নাত আলিয়া মাদ্রাসা খতীব, বায়তুস সালাত মসজিদ, সদরঘাট, ঢাকা-১১০০; সোলেমানিয়া বুক হাউস, ৪৫, ৩৬ বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, সন-২০০১)।
“যে পর্যন্ত না আকাশের রাত্রের কালো রেখা হইতে ঊষার সাদা রেখা প্রকাশ পায় প্রত্যুষকালে, অতঃপর রোযা রাত্রি পর্যন্ত পূর্ণ কর”। (সূত্র: পবিত্র কোরআন শরীফ, হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)-এর ঊর্দুতরজমা বয়ানুল কোরআনের বঙ্গানুবাদ, বাংলা উচ্চারণ ও অনুবাদক আলহাজ্ব মাওলানা এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুনশী এম, এম (ফাষ্ট ক্লাস); ডি, এফ; বি, এ,(অনার্স); এম, এ, এম, ফিল, রিচার্স ফেলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী লিমিটেড, প্যারীদাস রোড ঢাকা, সন-২০০৪)।
“অতঃপর রাত আসা পর্যন্ত রোযাগুলো সম্পূর্ণ করো”। (সুত্র: তরজমা-ই-কোরআন, কানযুল ঈমান কতৃ আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত মাওলানা শাহ্ মুহাম্মদ আহমদ রেযা খান বেরলভী (রহঃ), তাফসীর (হাশিয়া) খাযাইনুল ইরফান কৃত সদরুল আফাযিল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী (রহঃ), বঙ্গানুবাদ: আলহাজ্জ্ব মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান” প্রকাশনায়: গুলশান-ই-হাবীব ইসলামী কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম, সন-১৯৯৬)।
“অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত”। (সুত্র: তফসীরে মা’আরেফুল-কোরআন, ১ম খণ্ড, মূল হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী (র), অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
তোমরা পানাহার অব্যাহত রাখতে পারো যতোক্ষণ পর্যন্ত রাতের অন্ধকার রেখার ভেতর থেকে ভোরের শুভ্র আলোক রেখা তোমাদের জন্যে পরিস্কার প্রতিভাত না হয়, অতপর তোমরা রাতের আগমন পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করে নাও। (সুত্র: কোরআনের সহজ বাংলা অনুবাদ, হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমেদ, আল কোরআন একাডেমী লন্ডন)।
এখানে মাত্র দশটি কোরআনের দলীলসমূহ দেখানো হয়েছে এবং প্রত্যেকটিতেই কিন্তু লাইল (অর্থ রাত) বলা হয়েছে। কিন্তু এই পৃথিবীতে কিছুসংখ্যাক লোক ব্যতীত অধিকাংশই আল্লাহর এই আয়াতকে না মেনে নিজের ইচ্ছে মতে কেয়াস করে থাকেন এবং সন্ধাকে লাইল (অর্থাৎ, রাত) বানিয়ে দেন। তাই আপনাদের কাছে কোরআনের এই আয়াতটিকে আরো স্পষ্ট ভাবে অর্থাৎ শব্দার্থ আকারে তুলে ধরছি যেন লাইল সম্পর্কে মানুষদের স্পষ্ট ধারণা হয়ে যায়। কোরআনে এই আয়াতের অর্থ হচ্ছেঃ
ওয়া কলু – এবং ভক্ষণ কর, আর খাও।
ওয়াশরাবু – এবং পান কর।
হাত্তা – – যে পর্যন্ত, যতক্ষন।
ইয়াতাবাঈয়্যানা – স্পষ্ট হয়, প্রকাশ পায়।
আল খাইতু – রেখা, চিহ্ন, দাগ।
আল-আব্ইয়াদ্বু – শুভ্র, সাদা।
মিনাল্ খাইতি – চিহ্ন হইতে, দাগ থেকে, রেখা হইতে।
আল্ আসওয়াদি – কৃষ্ণ , কাল।
মিনাল্ ফাজরি – প্রভাত হইতে, ভোর হইতে।
সুম্মা – অতঃপর, তারপর।
আতিম্মু – পুরা করিবে।
আস্ সিয়ামু – রোযা।
ইলা – দিকে, পর্য্যন্ত।
আল লাইলি – রাত্র, রজনী, রাত।
রোযা পূর্ণকরার সময় প্রসঙ্গে হাদীস শরীফেও বর্ণিত আছে যে, “বারাআ (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেছেন, মুহাম্মদ (সাঃ) -এর সাহাবাদের কেউ রোযা রাখতেন, ইফতারের সময় উপস্থিত হলে কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে তিনি আর কিছু খেতেন না, পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবেই রোযা রাখতেন। এক সময়ের ঘটনা, কায়েস বিন সিরমা আনসারী (রা) রোযা রেখেছিলেন। ইফতারের সময় হলে তিনি স্ত্রীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে খাওয়ার মত কিছু আছে কি? স্ত্রী জওয়াব দিলেন, না। তবে আমি তালাশ করে দেখে আসি তোমার জন্য কিছু যোগাড় করতে পারি কিনা। কায়েস বিন সিরমা আনসারী ঐ সময় মজুরী খেটে খেতেন। (স্ত্রী খাবার তালাশে যাওয়ার পর) ঘুমে তার চোখ মুদে আসলো। তাঁর স্ত্রী ফিরে এসে এ অবস্থা দেখে বলে উঠলেন, তোমার জন্য আফসোস! পরদিন দুপুর হলে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন। ঘটনা নবী (সাঃ) -এর নিকট পৌছলে কোরআনের আয়াত নাযিল হল। রমযানের রাত্রির বেলা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা (যৌনমিলন) হালাল করা হয়েছে….এ হুকুম অবহিত হয়ে সবাই অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। এরপর নাযিল হলো, তোমরা খাও ও পান করো যতক্ষণ না ফজরের কালো রেখা দুর হয়ে সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে ইঠে। আর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করো। (সূরা বাকারা: ১৮৭; সহীহ আল বুখারী, ২য় খণ্ড, হা: ১৭৮০, পৃ: ২২৮)।
“আর তোমরা খাও ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের কালো রেখা দূর হয়ে সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠে। আর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করো।” বারাআ (রা) এ সম্পকির্ত হাদীস নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। (সূত্র: সহীহ আল বুখারী, ২য় খণ্ড, ১৭-অনুচ্ছেদ, পৃষ্ঠা: ২৩৯, আধুনিক প্রকাশনী, সন-১৯৯৩)।
আমাদের দেশে অধিকাংশ লোকই মাগরিবের সাথে রোযা খোলে কিন্তু এ সকল কোরআনের আয়াত থেকে কি কোন ভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব যে ‘সত্ত্বর’ বলতে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই (মাগরিবের আযানের) সময়কেই বুঝায়? বরঞ্চ পবিত্র কোরআনের আয়াত সমূহ এবং হাদিসসমূহের আলোকে ইহাই প্রকৃষ্টরূপে প্রমানিত হয় যে, মুসলমানদেরকে রোযা রাত্রি পর্যন্ত পূর্ণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনের আদেশ বা হুকমু কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া বা জেনেও না জানার ভান করা, বা অনুসরণ না করার কোন পথই মুসলমানদের জন্য খোলা নেই।
আসীল (সন্ধা) ও লাইল (রাত) প্রসঙ্গে
কোরআনের অভিধানিক অর্থে ‘আসালুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সন্ধ্যার সময়। (সুত্র: কোরআনের অভিধান, পৃষ্ঠা: ১৩ (কোরআনে ব্যবহৃত সকল শব্দার্থ সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ অভিধান) মুনির উদ্দিন আহমদ, পরিবেশকঃ প্রীতি প্রকাশন, ১৯১, বড় মগবাজার ঢাকা ১২১৭, সেপ্টেম্বার ১৯৯৩)।
কোরআনের অভিধানিক অর্থে ‘লাইলুন’ ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত। (সুত্র: কোরআনের অভিধান, পৃষ্ঠা: ৩০১ (কোরআনে ব্যবহৃত সকল শব্দার্থ সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ অভিধান) মুনির উদ্দিন আহমদ, পরিবেশকঃ প্রীতি প্রকাশন, ১৯১, বড় মগবাজার ঢাকা ১২১৭, সেপ্টেম্বার ১৯৯৩)।
রোযা ও ইফতারির সময় সম্পর্কে যাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ বা দ্বিধা-বিভক্তির সৃষ্টি না হয় তার সকল প্রমাণ, দলিল এবং ব্যাখ্যা আল কোরআনেই বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ দিবা-রাত্র এবং মধ্যবর্তী বিভিন্ন সময়ের উল্লেখ করতে ভিন্ন ভিন্ন শব্দমালার ব্যবহারের মাধ্যমে সেই সকল সময়কে সুষ্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। যেমন লাইল অর্থ রাত, তা কোরআনে ১৬২ টি স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। তাছাড়া বাংলাতেও লাইল অর্থ যে রাত বুঝায় তা বহুল প্রচলিত যেমন: প্রত্যেকটি মুসলমান লাইলাতুল বারাত (ভাগ্য রজনী), লাইলাতুল ক্বা দর (মহিমান্বিত রজনী) শব্দের সাথে পরিচিত এবং তার লাইল অর্থ কোন ভাবেই সন্ধাকে বা সূর্যাস্তের সময়কে মনে করে না। তদ্রূপ আল্লাহ সকালকে বুকরা অপরাহ্নকে ‘নাহার’ বলেছেন। পবিত্র কোরআনে বিকালের সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা, ‘সুরা আল আসর’ রয়েছে, সন্ধা সম্পর্কে আসীল শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, প্রভাতকাল সম্পর্কে সূরা মুদাচ্ছিরের ৩৪ নং আয়াতে ‘সুবহ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, সূর্যাস্তের সময়কে পবিত্র কোরআনে ‘গুরবে শামস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সূর্যাস্তের পরে পশ্চিম আকাশে যে রক্তিম আভার সৃষ্টি হয় এবং যা প্রায় ১৮ থেকে ২৬ মিনিট বিদ্যমান থাকে সেই সময়কে সূরা ইনশিকাক এর ১৬ নং আয়াতে ‘শাফাক্ব’ উল্লেখ করা হয়েছে। এবং শাফাকের পূর্ণ পরিসমাপ্তির ১০ পরেই যে লাইল বা রাতের শুরু হয় তাও সূরা ইনশিকাক এর ১৬ এবং ১৭ নং আয়াত দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
রাত সম্পর্কে বা রাতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনরকম সন্দেহের অবকাশ না থাকে সে জন্যে পরমকরূনাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাতের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা তার কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করবঃ
“আর আমি রাত্রি ও দিবসকে (স্বীয় অসীম কদুরতে) করিয়া দিয়াছি দুইটি নিদর্শন, এবং রাত্রির নিদর্শনকে করিয়াছি অন্ধকার এবং দিনের নিদর্শনকে করিয়াছি আলোময়, যেন ইহাতে (দিনে) তোমরা তোমাদের রবের দেওয়া জীবিকা অন্বেষণ করতে পার।” (সূরা বণি ইসরাঈল, আয়াত: ১২)।
“আর তাদের জন্য আরেকটি নিদর্শন হল রাত, আমিই তার থেকে দিনকে বাহির করিয়া আনি, তখনই তো তারা অন্ধকারে আসিয়া যায়।” (সুত্র: আল কোরআন, সূরা ইয়াসিন, আয়াত: ৩৭, শুরা নং: ৩৬)।
“ওয়া আয কুরিসমা রাব্বিকা বুকরাতারাও ওয়া আসীলান, ওয়া মিনাল লালাইলি ফাসজুদ লাহু ওয়া সাব্বিহহু লাইলান ত্বাবী-লান”। আর সকালে ও সন্ধায় আপন প্রভুর নাম স্বরণ কর। এবং রাত্রের কতক সময় মাগরীব ও এশায় তাহাকে সিজদাহ্ কর এবং দীল্লা রাত্রি ব্যাপিয়া তাঁহার প্রশংসা বর্ণনা কর। (সূত্র: আল কোরআন, সুরা দহর, আয়াত: ২৫-২৬)।
“অতঃপর আমি সন্ধ্যার রক্তবর্ণের কসম করিতেছি, এবং রাত্রের ও রাত্রি যাহা সংগ্রহ করে তাহার কসম”। (সুরা ইনশিকাক, আয়াত: ১৬-১৭)।
“এবং দিনের কসম যখন ইহা তাহার মহিমা প্রকাশ করে, এবং রাত্রের কসম যখন ইহা তাহাকে ঢাকিয়া লয়। (সূরা শামস, আয়াত: ৩-৪, শুরা নং: ৯১)।
“রাতের কসম যখন উহা জগৎকে অন্ধকারে ঢাকিয়া লয়।” (সূত্র: আল কোরআন, সূরা লাইল, আয়াত: ১, শুরা নং: ৯২)।
“এবং রাত্রের কসম যখন উহা (অন্ধকারে ঢাকিয়া লয়) নিস্তব্ধ হয়। (সুত্র: আল কোরআন, সূরা দোহা, আয়াত: ২, শুরা নং: ৯৩)।
“উহাই সকালে ও সন্ধ্যায় তাহাকে পড়িয়া শুনান হয়। (সুত্র: আল কোরআন, সুরা ফুরকান, আয়াত: ৫, শুরা নং: ২৫)।
“তিনিই রাত্রিকে করিয়াছেন তোমাদের জন্য আবরণ স্বরূপ এবং নিদ্রাকে আরামের শান্তি করিয়াছেন এবং দিনকে করিয়াছেন পুনরায় উঠিবার সময়। (সুত্র: আল কোরআন, সুরা ফুরকান, আয়াত: ৮৭, শুরা নং: ২৫)।
“এবং তিনিই রাত্রি ও দিনকে একে অন্যের অনুসরণকারী করিয়াছেন তাহাদের জন্য যাহারা উপদেশ গ্রহণ করিতে চায় অথবা শোকর আদায় করিতে চায়। (সুত্র: আল কোরআন, সুরা ফুরকান, আয়াত: ৬২, শুরা নং: ২৫)।
“আল্লাহর নাম স্বরণ করা হইয়া থাকে সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁহার মহিমা ঘোষণা করিতে থাকে। (সুত্র: আল কোরআন, সুরা নুর, আয়াত: ৩৬, শুরা নং: ২৪)।
“আল্লাহ্ই রাত ও দিনকে পরিবর্তন করিতেছেন। নিশ্চই উহাতে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকদের জন্য বুঝিবার বিষয় রহিয়াছে। (সুত্র: আল কোরআন, সুরা নুর, আয়াত: ৩৬, শুরা নং: ২৪)।
“এবং উহার রাতকে ঢাকিয়া আঁধার করিয়া দিয়াছেন এবং ইহার প্রভাতকে আলোকে প্রকাশ করিয়াছেন। (সুত্র: আল কোরআন, সুরা নাযিয়াত, আয়াত: ২৯, শুরা নং: ৭৯)।
“এবং তোমার প্রভুকে মনে মনে, সবিনয়ে, সকাতরে, গোপনে ও নিম্ন স্বরে প্রভাতও সন্ধ্যায় ইয়াদ কর এবং সাবধান, ইহাতে অবহেলা করিও না। (সুত্র: আল কোরআন, সুরা আরাফ, আয়াত: ২০৫, শুরা নং: ৭)।
অতঃপর আল্লাহ্ বলেছেন, “অন্ধকার আর আলো কি এক? তবে কি তাহারা আল্লাহর এমন শরীক করিয়াছে যাহারা আল্লাহর সৃষ্টির মত সৃষ্টি করিয়াছে যে ১২ কারনে সৃষ্টি উহাদিগের মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটাইয়াছে” (সুত্র: আল কোরআন, সুরা রাদ, আয়াত: ১৬, শুরা নং: ১৩)।
উল্লেখিত সমগ্র আয়াত থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, লাইল বা রাত্র হলো এমন একটি সময় যা পরিপূর্ণরূপে বা সম্পূণরূপে অন্ধকারাচ্ছন্ন। যেখানে দিনের আলোর উপস্থিতির কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। লাইল বা রাত্র অর্থ: শাফাক্ব, গুরুবে শামস, আসর বা আসীল নয়। আল্লাহর কোরআন সত্য ও সঠিক হলে যাহারা সন্ধ্যা বা গুরুবে শামস এর সময় ইফতার করে তা সম্পূর্ণ ভুল। অথবা কোরআনে কি ভুল সময় উল্লেখ করা আছে? (নাউযুবিল্লাহ)। যাহারা আল্লাহর দেয়া সময়ে রোযা পূর্ণ না করে ভুল হাদীস ও নিজেদের মনগড়া সময়ে রোযা পূর্ণ করছে তাহারা সঠিক? অবশ্যই এই রকম ধারনায় নাউযুবিল্লাহ বলারই কথা। কারন আমাদের মহান আল্লাহ রাব্বুলআলামিন সকলের চিন্তাধারণার উর্দ্ধে এবং তাহার সমতুল্য কেহই নয়। তাই আল্লাহ তায়ালা কোরআনে যা হুকুম দিয়েছেন সেটাই আমাদেরকে মানতে হবে।
কোরআনে লাইল বলা হয়েছে, আসীল বলা হয় নাই। আর আসীল দ্বারা কোরআনে সন্ধা বুঝানো হয়েছে। (সূত্র: তাফহীমুল কোরআন- গোলাম আযম, সুরা দাহর ২৫-২৬, পারা: ২৯, সুরা নং: ৭৬, পৃষ্ঠা: ৩৩২, ১২তম ব্যাখ্যা)।
‘গুদুউয়্যি ওয়াল আসাল’ এর শাব্দিক অর্থ সকাল-সন্ধ্যায়। আর মর্মার্থ, সব সময় (সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে সকাল-এভাবে সকল সময়)। ‘আসাল’ শব্দাটি ‘আসীল’ এর বহুবচন। আসর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়কে বলে আসাল। (সুত্র: তাফসিরে মাযহারী, কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী (রহঃ), মাওলানা তালেব আলী অনূদিত, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩১০)।
“যাহারা আল্লাহর আয়াতকে ব্যর্থ করিবার চেষ্টা করে তাহাদের জন্য রইয়াছে ভয়ংকর মর্মন্তদ শাস্তি এবং তাহারা শাস্তি ভোগ করিতে থাকিবে।” (সুত্র: আল কোরআন, সূরা সাবা, আয়াত: ৫, ৩৮)।
তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আমাদেরকে রোযা রাত্রি পর্যন্ত পূর্ণ করার আদেশ বা হুকুম দিয়েছেন, শাফাক বা গুরুবে শামস, অথবা আসীল পর্যন্ত নয়, যাহা উল্লেখিত আয়াতসমূহ দ্বারাই প্রমানিত।