আত্মসংশোধন ও আত্ম-উন্নয়ন ছাড়া নববর্ষ উদযাপন সার্থক নয়

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর দৃষ্টিতে নব-বসন্তের মাধ্যমে শুরু-হওয়া নব-বর্ষ প্রফুল্লতা ও সজীবতার প্রকাশ। নওরুজ বা নববর্ষ আত্মাকে পরিশীলিত বা সংস্কার করার এক ভালো সুযোগ বয়ে আনে। এই সুযোগ হল মহান আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে হৃদয়কে সজীব করার সুযোগ। (তাই এই সুযোগকে সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজে লাগানো উচিত।) তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন:

‘নওরুজ বা নববর্ষ মহান প্রতিপালকের সামনে মানুষের দাসত্ব ও বিনম্রতা প্রকাশের মাধ্যম। নওরুজ বা নববর্ষ উৎসব হল নব-উদ্ভাবন বা সৃষ্টিশীলতা, সজীবতা, তারুণ্য ও প্রফুল্লতার প্রতীক। একইসঙ্গে এই উৎসব পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও ভাইয়ে-ভাইয়ে হৃদ্যতা, আত্মীয়-স্বজনের পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি, পরিচিত জন ও বন্ধুদের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি ও হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার প্রতীক।’

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে কোনো কোনো দেশে নওরুজ উৎসব কেবল একটি প্রাচীন উৎসব মাত্র। ইরানে ইসলাম-পূর্ব যুগেও এই উৎসবের ছিল বেশ কিছু সুন্দর প্রথা ও আনুষ্ঠানিকতা। অবশ্য এর পাশাপাশি কিছু কুসংস্কারও প্রচলিত ছিল। ইরানে ইসলাম আগমনের পর নওরুজের মধ্যে বেশ কিছু মূল্যবান আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এবং এ উৎসব পরিণত হয় আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও সন্তুষ্টি অর্জনের এক মোক্ষম সুযোগে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন,

‘বর্তমানে নওরুজ ইরানি জাতির জন্য আল্লাহকে স্মরণের মাধ্যম। নতুন বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরানিরা আল্লাহকে স্মরণ করে বলেন:

হে অবস্থাসমূহের পরিবর্তনকারী আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।–এভাবে ইরানিরা নওরুজের সময় আল্লাহর স্মরণ বা আল্লাহর দিকে মনোযোগ জোরদার করেন। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও ইরানিরা নওরুজ উপলক্ষে প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে যান এবং এ সময় তারা গ্লানি, বিদ্বেষ ও মান-অভিমান দূর করেন ভালবাসার মাধ্যমে। আর এভাবে নওরুজ হল ইসলামের ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও বিশেষ করে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ যোগাযোগ অব্যাহত রাখার নির্দেশ পালন করার অন্যতম মাধ্যম। এ ছাড়াও নববর্ষের উৎসবের সময় ইরানিরা পবিত্র স্থানগুলো বা ধর্মীয় সাধক ও আওলিয়ার মাজার জিয়ারত করেন। আর এসবই খুব ভালো প্রথা। এভাবে ইরানিরা নওরুজে প্রচলিত বহু কুপ্রথা দূর করে তাতে যুক্ত করেছে অনেক সঠিক ও ভালো প্রথা।’

ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা এবং বিশেষ করে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ যোগাযোগ রক্ষা করে চলা মানুষের আয়ু বাড়িয়ে দেয়। এভাবে নওরুজ হয়ে পড়েছে আল্লাহর ও তার সৃষ্টির সঙ্গে নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, দয়ার্দ্র আচরণ করা, তাদের খোঁজ-খবর নেয়া-এসবই করা উচিত কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। অন্য কথায় নওরুজ নিজেকে উন্নত করার মাধ্যম বা স্টেশন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, মানুষের জীবনের চলার পথে বা গতিশীল এ জীবনে এমন কিছু বিরতির স্থান বা স্টেশন থাকা জরুরি যাতে কেটে যায় একঘেয়েমি। কারণ, একঘেয়ে জীবনে মানুষ নতুন বা সৃষ্টিশীল কিছু উপহার দিতে পারে না।
নওরুজও হল নবজীবনের প্রতীক। নতুন চিন্তা, নতুন কাজ ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচক হতে পারে সময়ের একটি বিশেষ লগ্ন বা উৎসবের ক্রান্তি-লগ্ন। এভাবে নববর্ষ হয়ে উঠতে পারে সৃষ্টিশীলতা ও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যম।

নববর্ষের প্রাক্কালে একজন সচেতন মানুষ এই চিন্তা করতে পারেন যে গত এক বছরে সমাজ ও ব্যক্তি-জীবনে যে পরিবর্তন বা উন্নতি হওয়ার কথা ছিল তা সাধিত হয়েছে কিনা। যদি উন্নতি কিছু ঘটে থাকে তাহলে আরো উন্নতি কিভাবে করা যায় তা নিয়ে ভাবা উচিত। আর যদি উন্নতি না হয়ে থাকে বা আল্লাহ না করুক অবনতি হয়ে থাকে তাহলে কেন অবনতি ঘটলো এবং কি কি সংস্কার আনা উচিত তা নিয়ে ভাবতে হবে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, আমরা যদি অতীতের ভুলগুলো বা বদভ্যাসগুলোর সংশোধন করতে পারি তাহলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব এবং পারব নিজেকে উন্নত করতে। তিনি এ প্রসঙ্গে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক সংশোধনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন: ‘আমার মতে নওরুজের সময় যে বিষয়ে চিন্তা করাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা হল আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক। বছরের শুরুতে মানুষের ভাবা উচিত যে বছরটি চলে গেছে ভালো ও খারাপ যা-ই ছিল তা চলে গেছে। এখন শুরু হয়েছে এক নতুন বছর। এ বছর আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের এক উন্নততর অধ্যায় গড়ে তুলতে হবে।’

আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক সংশোধন আমাদের অনেক সমস্যা সমাধান করবে। আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) এ প্রসঙ্গে যেমনটি বলেছেন: ‘যে আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ককে সংশোধন করবে আল্লাহও মানুষের সঙ্গে ওই ব্যক্তির সম্পর্ক সংশোধন করে দেবেন।’

আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক সংস্কার বা সংশোধন করা আর গাছ-পালার সংস্কারের মধ্যে মিল রয়েছে। বাগানের গাছ-পালার শুকনো বা অপ্রয়োজনীয় ডালপালা কেটে দিলে গাছগুলোর প্রবৃদ্ধি ভালো হয়, গাছপালা ভালোভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারে এবং অপেক্ষাকৃত ভালো পাতা গজায় ও ভালো ফল ধরে। এভাবে মানুষেরও উচিত যা কিছু তার আত্মাকে কলুষিত করছে ও ক্ষতিগ্রস্ত করছে সেসবকে নির্মূল করা ও তাকে খোদায়ী আলোর জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। ফলে আত্মা আবারও হবে বসন্তের মতই পরিশুদ্ধ, নির্মল ও সুরভিত।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির মতে, সব ধরনের কদর্যতা ও অপরিচ্ছন্নতার উৎস হল আমাদেরই গোনাহ। কেউ তার আচরণগুলো নিয়ে চিন্তা করলেই নিজের গোনাহগুলো খুঁজে পাবেন। তার উচিত এইসব পাপগুলোকে আত্মা ও আমল বা কাজ থেকে মুছে ফেলা।

এ সম্পর্কে উপদেশ দিতে গিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন: ‘মানুষ কোনো কোনো গোনাহয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই তারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করছে না। মানুষ যদি একটু ভাবে তাহলে এসবের অস্তিত্ব সে টের পাবে। অবশ্য মানুষ নিজের সম্পর্কে সাধারণত সুধারণা রাখে। তারা খুব কমই নিজের সম্পর্কে মন্দ ধারণা করে। এটা মানুষের জন্য এক বড় সংকট যে তারা নিজের মন্দ কাজগুলোর ব্যাপারে সাফাই দিতে অভ্যস্ত।’

ইসলাম মানুষকে সব সময়ই নিজের হিসেব-নিকেশ করতে তথা কাজকর্মের পর্যালোচনা করতে বলে। এ বিষয়ের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘নিজের হিসেবে নিজেই নেয়া খুব ভাল কাজ। মানুষের উচিত নিজের পাপ ও ভুলগুলো সনাক্ত করা এবং একে একে এইসব পাপের অভ্যাস বা ভুল অভ্যাসের সংখ্যা কমিয়ে আনা। মানুষ কখনও কখনও ৫/৬টি পাপে অভ্যস্ত হয়। নতুন বছরে এইসব পাপকে একে একে বিদায় করা ও এইসব দুর্বল দিকগুলো একে একে কমিয়ে আনা উচিত।’

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মানুষের আত্মার প্রকৃতি তুলে ধরে বলেছেন: ‘

মানুষের আত্মা ও বিবেকের একটি বাতেনি বা সুপ্ত দিক রয়েছে। এই অপ্রকাশ্য দিকটি আমাদের সঙ্গে সত্য-নিষ্ঠ। আত্মার বাহ্যিক দিকগুলো আমাদের ধোঁকা দিলেও এর ভেতরের দিক আমাদের সঙ্গে ন্যায়পরায়ণ। আত্মার এই অপ্রকাশ্য দিকের সঙ্গে খুব কমই আমরা যোগাযোগ করি। যদি মানুষ এ দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে সে দেখবে যে তার কলঙ্কগুলো দেখা যাচ্ছে। সে দেখতে পাবে যে কোনো কোনো পাপাচার তার অভ্যাস হয়ে গেছে ও কোনো কোনো পাপকে সে নগণ্য বলে ভাবে এবং এইসব পাপের অধীন হয়ে গেছে সে। নতুন বছরে এইসব পাপ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে ভাবাই হবে অন্যতম প্রধান কাজ যাতে নতুন বছরে এইসব পাপের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়।’

মানুষ যদি প্রকৃতিতে থাকা বসন্তের নবায়নের মত নিজেকেও সংশোধন করতে পারে তাহলেই নববর্ষ উদযাপন তার জন্য সার্থক হবে বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মনে করেন। আর সাধনা করলে তা অসম্ভব নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.