পবিত্র কোরআনে মসীহ্ (যীশু খ্রিস্ট)
পবিত্র কোরআন হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর যে ব্যক্তিত্ব উপস্থাপন করেছে তা বর্তমানে প্রাপ্য বাইবেলসমূহে উপস্থাপিত ব্যক্তিত্ব অপেক্ষা অনেক মহিমান্বিত ও আকর্ষণীয়।
পবিত্র কোরআন হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে খ্রিস্টানদের কিছু কিছু বিশ্বাসকে নিশ্চিত করে, আর ত্রিত্ববাদ ও ক্রুশবিদ্ধকরণসহ অন্যান্য কিছু বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে।
যীশুর জন্ম
যীশু হচ্ছেন ইমরানের কন্যা মারইয়ামের পুত্র। পবিত্র কোরআনে মারইয়ামের বিস্ময়কর জীবনের কাহিনী সবিস্তারে বিধৃত হয়েছে। কথিত আছে যে, মারইয়াম তাঁর মায়ের প্রতিজ্ঞার কারণে জেরুযালেম গমন করেন। অতঃপর ঘটনান্তে হযরত যাকারিয়া (আ.) তাঁকে এক লটারির মাধ্যমে দত্তক গ্রহণ করেন।
যীশুর খোদায়ীর দাবিদারদের উদ্দেশে বলতে হয়, সূরা আলে ইমরানের ৪৫তম আয়াতসহ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে যীশুকে মারইয়ামের পুত্র হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে যাঁকে জন্ম দেন এক মাতা এবং যাঁকে অন্য সবার মতো গর্ভের মধ্যে এক সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্তর পার হয়ে জন্ম নিতে হয়। তিনি আর যাই হোন, আল্লাহ হতে পারেন না। কারণ, আমরা জানি, সর্বশক্তিমান আল্লাহ কোন পরিবর্তন বা বিবর্তনের বিষয় হতে পারেন না।
পবিত্র কোরআন বলছে : তিনি বললেন, ‘তা-ই হবে।’ তোমার আল্লাহ বলেন, ‘আমার জন্য এটা অত্যন্ত সহজ, সাদামাটা এক কাজ মাত্র।’ আর আমরা এজন্যই তা করব যেন আমরা তাকে মানবজাতির জন্য এক নিদর্শন বানাতে পারি আর সে হবে আমাদের পক্ষ থেকে এক করুণাস্বরূপ। আর এ ছিল ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্তকৃত এক ব্যাপার। এভাবেই সে গর্ভধারণ করল এবং গর্ভ (যীশু) সহ দূরবর্তী এক স্থানে চলে গেল। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নিকটে নিয়ে গেল। সেখানে সে বলল, ‘আমার যদি এ ঘটনার পূবেই মৃত্যু হত এবং আমি এক স্মরণ-অযোগ্য বিস্মৃত কিছুতে পরিণত হতে পারতাম।’ ঠিক সেই মুহূর্তে সে তার নিচ থেকে বলে উঠলো, ‘দুঃখিত হয়ো না। তোমার খোদা তোমার পদপ্রান্ত দিয়ে এক ঝরনা প্রবাহিত করেছেন। ঐ খেজুর গাছের কান্ডটি ধরে নাড়া দাও, সদ্য তোলা খেজুর তোমার ওপর ঝরে পড়বে। খাও, পান কর আর আরাম বোধ কর। অতঃপর কোন মানুষ যদি তোমার নজরে পড়ে তখন বল, ‘সত্যি সত্যিই আমি সর্বদয়াময়ের নিকট ওয়াদা করেছি রোযা রাখার জন্য, কাজেই আমি আজ কোন মানুষের সাথে বাক্য বিনিময় করব না।’ (মারইয়াম : ২১-২৬)
মানুষ যখন দেখল মারইয়াম গর্ভবতী তখন তারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা শুরু করল। বলল : তোমার পিতাও একজন ভাল মানুষ ছিলেন, আর তুমি কিনা হলে এ রকম কুসন্তান! আর বিবাহ ছাড়াই হয়ে গেলে গর্ভবতী।…
প্রসব বেদনা উঠলে মারইয়াম আল্লাহকে উদ্দেশ করে বললেন : ‘হে আল্লাহ! আমি এখন কী করব?’ তখন ফেরেশতাকণ্ঠ তাঁকে বললেন : ‘এ শহর ছেড়ে চলে যাও।’ মারইয়াম তখন শহরের বাইরে এক বাগানে চলে গেলেন যেখানে ছিল একটি শুষ্ক খেজুর গাছ। আল্লাহ তখন মারইয়ামকে ঐ গাছটিতে ঝাঁকুনি দিতে বললেন। অতঃপর মোজেজা এবং খোদায়ী শক্তির বলে ঐ শুকনা গাছ থেকে ঝরে পড়লো তাজা খেজুর। মারইয়াম সেগুলো থেকে আহার করলেন এবং অবশেষে এক শিশুসন্তানের জন্ম দিলেন।
মারইয়াম যে সমাজের লোকদের দৃষ্টির অন্তরালে তাঁর পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, তিনি এখন তাদের মধ্যেই চলে গেলেন এবং তাদের দ্বারা তিরস্কৃত হলেন। আল্লাহর নির্দেশে মারইয়াম লোকদেরকে বললেন : ‘শিশুটিকেই জিজ্ঞেস করে দেখ।’ তখন শিশুটি বলল, ‘সত্যিই আমি আল্লাহর এক বান্দা! তিনি আমাকে এক কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। তিনি আমাকে তাঁর করুণাসিক্ত করেছেন। তিনি আমাকে নামায কায়েম করতে আর যাকাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন, আর আমার মায়ের প্রতি সদাচরণ করতে বলেছেন; তিনি আমাকে স্বেচ্ছাচারী ও হতভাগ্যদের অন্তর্ভুক্ত করেননি।’ (সূরা মারইয়াম : ৩০-৩৩)
এভাবে এক বিস্ময়কর, অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ মারইয়ামকে সমাজের অভিযোগ থেকে রক্ষা করলেন।
মারইয়াম আল্লাহর নির্বাচিত
আল কোরআনে যেমন বলা হচ্ছে : আর ফেরেশতাগণ যখন বলল : ‘হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে বাছাই করেছেন এবং পবিত্র করে নিয়েছেন, আর তিনি দুনিয়ার সকল নারীর মধ্য থেকে তোমাকেই নির্বাচিত করেছেন। হে মারইয়াম! তোমার প্রতিপালকের আনুগত্য কর এবং সিজদা কর ও রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।’ (আলে ইমরান : ৪২-৪৩)
মারইয়াম ফেরেশতাদের সাথে সংলাপকারী
ইসলাম সত্যিই নারীদেরকে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে মূল্যায়ন করে। বস্ত্তত নারীরা যেখানে সমাজে অবহেলিত ছিল, সেখানে পবিত্র কোরআন তাদেরকে উচ্চ মর্যাদার আসন দান করেছে, নারীদের অবস্থান এমন উচ্চ হতে পারে যে, তারা আল্লাহর ফেরেশতাদের সাথে কথা বলতে পারে। পবিত্র কোরআন বলছে : ‘ফেরেশতারা যখন বলল, হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে এমন এক সুখবর দিচ্ছেন তাঁর পক্ষ থেকে যার নাম মেসিয়াহ অর্থাৎ মসীহ্, মারইয়াম পুত্র ঈসা, যে দুনিয়া ও আখেরাতে বিশিষ্ট ও সম্মানিত এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভকারিগণের অন্যতম।’ (আলে ইমরান : ৪৫-৪৬)
আমরা মূসার মাকে প্রত্যাদেশ করেছিলাম : ‘তার সেবা-যত্ন কর, অতঃপর তার জন্য যখন তোমার ভয় হবে, তখন তাকে নদীতে ভাসিয়ে দাও। আর ভয় পেও না বা দুঃখিত হয়ো না; কেননা, আমরাই তাকে তোমার নিকট ফিরিয়ে আনব এবং তাকে রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত করব।’ (আল কাসাস : ৭)
অবিলম্বে সে (অর্থাৎ জিবরাইল কিংবা গর্ভে ধারণকৃত শিশু যীশু) তাকে তার নিচ থেকে ডেকে বলল : ‘দুঃখিত হয়ো না! তোমার প্রভু তোমার পদপ্রান্তে ঝরনা প্রবাহিত করেছেন।’ (মারইয়াম : ২৪)
স্বামীহীন অবস্থার কুমারী মারইয়াম ঐ শিশুপুত্রের জন্মদান করায় তাঁকে প্রশ্নবানের হাত থেকে রক্ষায় এবং তাঁকে সান্ত্বনাদানকল্পে পবিত্র কোরআন বলছে : ‘সে বড় হয়ে ত বটে, এমনকি দোলনা থেকেই মানুষের সাথে কথা বলবে। আর সে হবে অন্যতম সৎকর্মশীল।’ (আলে ইমরান : ৪৬)
মারইয়াম আল্লাহর মেহমান
আল্লাহই মারইয়ামের গর্ভকালীন তাঁর মেহমানদারী করেন। পবিত্র কোরআনে আমরা দেখি : ‘খেজুর গাছের কান্ডটি ধরে ঝাঁকুনি দাও, সদ্য তোলা খেজুর তোমার ওপর ঝরে পড়বে।’ (মারইয়াম : ২৫)
ঈসা (আ.) আমাদের মতোই আল্লাহর একজন বান্দা
পিতা ছাড়া খ্রিস্টের জন্ম তাঁর খোদায়িত্বে বিশ্বাসের কোন কারণ হতে পারে না, কেননা, আদমের সৃষ্টি কঠিনতর ছিল, যেহেতু আদমের এমনকি মাতাও ছিল না।
জন্মের পর হযরত ঈসা (আ.) সর্বপ্রথম যে কথা বলেছিলেন তা ছিল : ‘বাস্তবিকই, আমি আল্লাহর এক বান্দা! তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে একজন নবী বানিয়েছেন। আমি যেখানেই থাকি না কেন, তিনি আমাকে তাঁর করুণায় সিক্ত করেছেন; তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন বাঁচব আমাকে নামায কায়েম করতে ও যাকাত আদায় করতে হবে আর আমার মায়ের প্রতি সদাচরণ করতে হবে। আর তিনি আমাকে না স্বেচ্ছাচারী বানিয়েছেন আর না হতভাগ্যদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।’ (মারইয়াম : ৩০-৩৩)
ত্রিত্ববাদ
পবিত্র কোরআন মতে, ত্রিত্ববাদ পৌত্তলিকতা ও ধর্মদ্রোহের শামিল এবং যীশু নিজে তা অস্বীকার করেছেন।
পবিত্র কোরআনে যেমন বলা হয়েছে : ‘তারা অবশ্যই অবিশ্বাসী যারা বলে, আল্লাহ হচ্ছেন মসীহ, তিনি মারইয়ামপুত্র।’ অথচ মসীহ বলেছিল : ‘হে বনি ইসরাইলগণ! তোমরা সেই আল্লাহর ইবাদাত কর যিনি আমার ও তোমাদের প্রভু। বস্ত্তত যে-ই আল্লাহর সাথে শরীক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ করেছেন; তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম, আর পাপীষ্ঠদের কোন সাহায্যকারী নেই।’ অবশ্যই তারা অবিশ্বাসী যারা বলবে, ‘আল্লাহ তিনের মধ্যে তৃতীয় জন অথচ এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন প্রভু নেই। তারা যা বলছে তা যদি তারা পরিত্যাগ না করে তবে তাদের মধ্যে অবিশ্বাসীদের ওপর নেমে আসবে এক মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (আল-মায়েদা : ৭২-৭৩)
তারা কখনই যীশু খ্রিস্টকে হত্যা করেনি কিংবা ফাঁসিতেও ঝুলায়নি। কিন্তু ভুলক্রমে তারা যীশুর মতো দেখতে অন্য এক ব্যক্তিকে ফাঁসি দিয়েছে। যারা যীশুর বিষয়ে যুক্তি দিচ্ছিল, তারা নিজেরাও তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে দোটানায় পড়ে গিয়েছিল, আসলে তারা বিভ্রান্তি ও মিথ্যা ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েছিল।
তাদের বিশ্বাসহীনতা (কুফ্রী), মারইয়ামের ওপর ভয়াবহ মিথ্যা অপবাদ, যীশুকে হত্যা কিংবা ক্রুশবিদ্ধ না করেও বলা, ‘আমরা মারইয়ামপুত্র ও আল্লাহর নবী ঈসা মসীহকে মেরে ফেলেছি’- এসব অপকর্মের কারণে ব্যাপারটা তাদের নিকট যাতে ঐ রকমই মনে হয় তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
বস্ত্তত তাঁর সম্পর্কে যারা মতবিরোধ করে তারা অবশ্যই তাঁর সম্পর্কে সন্দিহান। ধারণা-অনুমানের পিছনে ছোটা ছাড়া তাদের নিকট কোন জ্ঞানই নেই। আর নিশ্চিতরূপেই তারা তাঁকে হত্যা করেনি। বরং আল্লাহ তাঁকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন। আর আল্লাহ সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী। (আন-নিসা : ১৫৬-১৫৮)
আল-কোরআনের আরেক আয়াতে আমরা দেখি : ‘যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমার আত্মাকে নিয়ে নেব এবং তোমাকে আমার নিকট তুলে আনব এবং অবিশ্বাসীদের দেয়া অপবাদ থেকে তোমাকে মুক্ত করব, আর তোমাকে যারা অনুসরণ করবে তাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত অবিশ্বাসীদের ওপর নেতৃত্বে বহাল রাখব।’ (আলে-ইমরান : ৫৫)
মুফাস্সিরগণের মতে, উপরোক্ত আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো : আল-কোরআনে تـوفـى মৃত্যু বোঝায় না, এর অর্থ হলো সম্পূর্ণরূপে বুঝে পাওয়া এবং সংরক্ষণ করা। ‘রাফিয়াকাহ’ বলতে এও বুঝায় যে, ‘আমরা তোমাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।’ ‘রাফাআ’ শব্দের অর্থ উচ্চ মর্যাদায় অভিসিক্ত করা। (তাফসির আল-মিযান, আল্লামা তাবাতাবাঈ, ৩য় খন্ড, পৃ. ৬০৩)
পবিত্র কোরআনে ৩৩ বার হযরত ঈসা (আ.)-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং আমরা মুসলমানরা নবী ঈসা (আ.)-কে অনেক উচ্চ মর্যাদা দিয়ে থাকি। যাঁরা তাঁকে অন্তর দিয়ে ভালবাসেন তাঁদের সকলকে জানাই শুভ নববর্ষ।
অবলম্বনে : মাহ্যুবাহ, প্রবন্ধ নং ১, খন্ড ২৪, সংখ্যা ৩০০, ডিসেম্বর ২০১১।
অনুবাদ : আব্দুল আউয়াল মিয়া