হযরত ইদ্রিস (আ.)’র জান্নাত গমন ও ঘটনাবহুল পয়লা মহররম

হযরত ইদ্রিস (আ.)’র জান্নাত গমন ও ঘটনাবহুল পয়লা মহররম

 

মক্কা থেকে কারবালার দিকে ইমাম হুসাইন (আ.)'র যাত্রাপথের ম্যাপ
মক্কা থেকে কারবালার দিকে ইমাম হুসাইন (আ.)’র যাত্রাপথের ম্যাপ

১৫ অক্টোবর (রেডিও তেহরান): পয়লা মহররম ইতিহাসে ঘটেছিল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যেমন, হযরত ইদ্রিস নবীর (আ.) জান্নাত গমন, হযরত জাকারিয়া (আ)’র দোয়া কবুল হওয়া, মক্কায় কাফের নেতাদের পক্ষ থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এবং তাঁর অনুসারীদের ওপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবরোধ আরোপের মত  কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ছাড়াও এই দিনে সব ঘটনাকে ম্লান করে দেয়া ঘটনার মহানায়ক তথা কারবালা বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর কাফেলা ও সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন এ বিপ্লবের অকুস্থল তথা কারবালা প্রান্তরের দিকে যদিও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কুফা শহরে পৌঁছা।

 

হযরত ইদ্রিস নবীর (আ.) জান্নাত গমনের ঘটনা:

 

আজ হতে কয়েক হাজার বছর আগে এমন দিনে (পয়লা মহররম) হযরত ইদ্রিস (আ.)-কে বেহেশতে উঠিয়ে নেন মহান আল্লাহ। মানুষকে একত্ববাদের দিকে ফিরিয়ে আনার মিশন সফল হওয়ার পর এই ঘটনা ঘটে। এর আগে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল বহু খোদার উপাসনা ও অগ্নি-পূজা।

 

হযরত ইদ্রিস (আ.)’র নাম ছিল আনুখ। বলা হয়, তিনি ছিলেন হযরত আদম (আ.)’র সপ্তম অধস্তন পুরুষ ও হযরত নুহ (আ.)’র পরদাদা। তিনি নিজে গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন এবং অন্যদেরও তা শিক্ষা দিতেন বলে তাঁকে বলা হত ‘ইদ্রিস’।

 

মানবজাতিকে তিনিই প্রথম কাপড় বুনন ও পোশাক সেলাইয়ের কৌশল শিখিয়েছিলেন। তাঁর আগে মানুষ জন্তু বা পশুর চামড়া ব্যবহার করত পোশাক হিসেবে। হযরত ইদ্রিস (আ.) প্রথম লিখনের প্রবর্তন করেন এবং কলম ব্যবহার করেছেন। তাঁর বাড়ী ছিল ইরাকের কুফা শহরের বাইরে সাহলা মসজিদে। হযরত ইদ্রিস (আ.)-কে বলা হত ‘দার্শনিকদের নবী’ এবং কোনো কোনো  প্রাচীন বইয়ের লেখক হিসেবে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়। পশ্চিম মিশরের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি শহর নির্মাণ করেছিলেন এই মহান নবী।

 

মজার ব্যাপার হল মানব-জাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদী (আ.)’র বাসস্থানও হবে সাহলা মসজিদ। এ মহান ইমাম হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র বংশধর বা আহলে বাইতের সর্বশেষ সদস্য। তিনি গোটা বিশ্বে ন্যায়বিচার, শান্তি ও সমৃদ্ধি ছড়িয়ে দিবেন।

 

– হাজার হাজার বছর আগে এই দিনে মহান আল্লাহ হযরত জাকারিয়া (আ)’র দোয়া কবুল করেছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে যেন এক নেক পুত্র সন্তান দান করেন এই ছিল বৃদ্ধ বয়সে জাকারিয়া নবীর দোয়া। মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন বিখ্যাত নবী ইয়াহিয়া (আ) যদিও জাকারিয়া নিজে ছিলেন বৃদ্ধ ও তার বৃদ্ধা স্ত্রীও ছিলেন বন্ধ্যা! এই দিনে কেউ রোজা রেখে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা কবুল করবেন বলে হযরত ইমাম রেজা (আ) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

 

– মক্কায় বিশ্বনবী(সা.)সহ মুসলমানদের ওপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবরোধ আরোপ:

 

এখন হতে ১৪৪৩ বছর আগে (পয়লা মহররম, হিজরতের ৬ বছর আগে) মক্কার কাফের নেতারা এইসব অবরোধ আরোপের জন্য একটি চুক্তি-পত্র স্বাক্ষর করেন। ফলে নিষিদ্ধ হয়ে যায় মুসলমানদের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক এবং সামাজিকভাবে বয়কট করা হয় শৈশবে উপনীত মুসলিম সম্প্রদায়কে। বিশ্বনবী (সা.)’র চাচা ও অভিভাবক হযরত আবু তালিব (আ.) অবরুদ্ধ মুসলমানদের দেখা-শুনার দায়িত্ব নেন। তিনি মুসলমানদেরকে মক্কার বাইরে একটি উপত্যকায় নিয়ে যান। এ উপত্যকা আজও ‘শেব আবি তালিব’ নামে খ্যাত।

 

তিন বছর ধরে ওই অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত ছিল। এ সময় মুসলমানরা তীব্র অর্থনৈতিক দুর্গতি ও কষ্টের শিকার হয়। মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য রাসূল (সা.)’র স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহা) তাঁর বিপুল সম্পদ ব্যয় করেন। তিনি ছিলেন এক সময় আরবের শীর্ষস্থানীয় ধনী। বিপুল সম্পদ দানের ফলে দরিদ্র অবস্থায় মারা যান এই মহীয়সী নারী ও প্রথম মুসলমান। (একই সময়ে পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন  দশ বছরের শিশু আলী-আ.)।

 

এ সময় বিশ্বনবী (সা.)’র চাচাত ভাই মহাবীর আলী (আ.) ছিলেন খুবই কম বয়সী। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুসলমানদের জন্য খাদ্য-শস্য  নিয়ে আসতেন। কিন্তু মুসলমানদের ওপর কাফেরদের নিষেধাজ্ঞা তাঁদেরকে কাবু করতে সক্ষম হয়নি। ফলে মূর্তি পূজারি আরব নেতারা হতাশ হয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা নিষেধাজ্ঞার চুক্তি-পত্রটি তালাবন্ধ বাক্স থেকে বের করে সবিস্ময়ে দেখে যে ওই চুক্তির সব ধারা বা শর্ত উল্লেখিত লাইনগুলো উই-পোকার খাদ্য হয়ে উধাও হয়ে গেছে! নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার সামান্য কিছু সময় আগে বিশ্বনবী (সা.)-কে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে ইন্তিকাল করেন সে সময় পর্যন্ত তাঁর একমাত্র স্ত্রী ও ২৫ বছরের দাম্পত্য-জীবনের শরিক হযরত খাদিজা (সা.)। ফলে নবী-নন্দিনী শিশু ফাতিমা (সা.) ইয়াতীম হয়ে যান।

 

·  ১৪১৭ বছর আগে হিজরি ২০ সালের এমন দিনে (পয়লা মহররম) মুসলিম বাহিনীর হাতে পূর্বাঞ্চলীয় রোমান বা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের আওতাভুক্ত মিশর মুক্ত হয়। মিশরীয়রা মুসলিম বাহিনীকে স্বাগত জানায় এবং তাদের বেশিরভাগই খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়।

 

·  ১৩৫৬ চন্দ্রবছর আগে ৮১ হিজরির এই দিনে (পয়লা মহররম) ইন্তিকাল করেন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র পুত্র মুহাম্মাদ আল হানাফিয়া। তার মায়ের নাম ছিল খাওলা। প্রথম স্ত্রী নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা (সা.)’র মৃত্যুর কয়েক বছর পর এই মহীয়সী নারীকে বিয়ে করেছিলেন হযরত আলী (আ.)। মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে পিতার অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন। অসুস্থ হওয়ার কারণে তিনি কারবালার অসম যুদ্ধে যুদ্ধে ভাই ইমাম হুসাইন (অ.)’র সঙ্গে অংশ নিতে পারেননি। মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া ছিলেন সত, সাহসী ও ধার্মিক। কারবালার  মহা-ট্র্যাজেডির পর তিনিই ছিলেন হযরত আলী (আ.)’র পরিবারের সবচেয়ে সিনিয়র বা বয়স্ক সদস্য। এ সময় ভাতিজা ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) নির্জনে থাকতে পছন্দ করতেন। মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার নাম (ও অনুমতি) নিয়েই কারবালা হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে কুফায় সফল গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহামতি মুখতার সাকাফি। #

 

 

রেডিও তেহরান/এএইচ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.