প্রশ্ন : মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী তার প্রবেশপথ’। এই কথাটি কি সহীহ হাদীস? যদি সহীহ হয়ে থাকে তাহলে বুখারী শরীফে তা উল্লেখ নেই কেন? ব্যাপারটি একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
উত্তর : আপনার উল্লিখিত হাদীসটি একটি সহীহ হাদীস। এর সপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপনের আগে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, বুখারী শরীফে কোনো হাদীস না থাকলেই যে হাদীসটি সহীহ হবে না তা ঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার আগে আপনার প্রশ্নের প্রথম অংশে আমরা ফিরে যেতে পারি। আপনি যে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন তা ‘সহীহ মুসতাদরাক’ গ্রন্থে এসেছে। তবে হাদীসটির আরো একটি অংশ রয়েছে। সম্পূর্ণ হাদীসটি হলো : ‘আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী তার প্রবেশপথ। তাই যে জ্ঞানের আশা করে তাকে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হবে।’ সিহাহ সিত্তার অন্তর্গত সহীহ তিরমিযী শরীফে এই হাদীসটি একটু ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিরমিযী শরীফের হাদীসটি হলো মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘আমি জ্ঞানভাণ্ডার এবং আলী তার দরজা (বা প্রবেশপথ)।’
প্রাচীনকালের বিখ্যাত অনেক আলেমই এই হাদীসের সত্যতা স্বীকার করেছেন এবং তাঁদেরকে দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইজালাতুল খিফা আন খিলাফাতিল খোলাফা’ গ্রন্থে এই হাদীস উল্লেখ করেছেন।
কাজেই উপরিউক্ত হাদীস যে একটি সহীহ হাদীস সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মূলত হযরত আলী (আ.)-এর সাথে মহানবী (সা)-এর ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। একেবারে ছোটবেলা থেকেই আল্লাহর নবীর সাহচর্যে বড় হয়েছেন হযরত আলী (আ.)। কোনো প্রকার ভ্রান্তি ও কলুষতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। মহানবী (সা.) নিজের মতো করে হযরত আলীকে গড়ে তুলেছিলেন। এর চেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে যে, বিশ্বনবী (সা.) আপন সাহচর্যে রেখে একজনকে গড়ে তুলেছেন তাঁর সফল উত্তরসূরি হবার জন্য! আল্লাহর নবীর শিক্ষার কারণে হযরত আলী জ্ঞানে গরিমায় উম্মতে মুহাম্মাদীর মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের আসন অলঙ্কৃত করেন। তাঁর এই শ্রেষ্ঠত্ব কোনো পক্ষপাতমূলক ছিল না। কারণ, তিনি ছিলেন মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অন্যতম প্রধান। আর এই আহলে বাইতকে নিষ্পাপ বলে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন। ‘হে নবীর আহলে বাইত! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সূরা আহযাব : ৩৩)
হাদিসে উল্লিখিত আছে যে, একবার মহানবী (সা.) মসজিদে নববী সংলগ্ন সকল সাহাবীর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন শুধু তাঁর নিজের এবং হযরত আলীর দরজা ছাড়া। এতে কতিপয় সাহাবী অভিযোগ উত্থাপন করলে মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমি আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছি একমাত্র আলীর দরজা ছাড়া আর সকলের দরজা বন্ধ করে দিতে।’ (দ্রষ্টব্য মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল)
মহানবী (সা.)-এর পরে মুসলমানদের মাঝে যে হযরত আলীই শ্রেষ্ঠ ছিলেন তার সপক্ষে ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, পাক কুরআনে আলীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে যতগুলো আয়াত নাযিল হয়েছে অন্য কারো বেলায় হয়নি। তাঁর গুণাগুণ সম্বলিত তিনশটি আয়াতের সন্ধান পাওয়া যায়। (দ্রষ্টব্য ইবনে হাজার মাক্কী প্রণীত ‘সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ’)
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেন, হযরত আলীর গুণাবলি সম্বলিত এত অধিক সংখ্যক হাদিস অন্য কোনো সাহাবীর বেলায় পাওয়া যায় না। (ইমাম হাকিম প্রণীত ‘আল-মুসতাদরাক’)
উম্মতের মধ্যে জ্ঞানে-গুণে যে হযরত আলী (আ.) শ্রেষ্ঠ তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন নবী মোস্তফা (সা.) বলেন : ‘এই আলী কুরআনের সাথে এবং কুরআন আলীর সাথে। হাউযে কাউসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’ (সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ)
হযরত উমর প্রায় সময়েই কোনো সমস্যার সমাধানে হযরত আলীর সাহায্য গ্রহণ করতেন। (তারিখুল খোলাফা- আল্লামা সুয়ূতি)।
হযরত আলীর মতো এরূপ মদীনায় আর কেউ বলার সাহস রাখত না- ‘যা খুশি তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা কর। আমি তার জবাব দেব।’ (তারিখুল খোলাফা)
সত্যিই হযরত আলী (আ.) অসামান্য মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। নবীশ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জ্ঞান-গরিমার প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন বলেই গাদীরে খুমের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন : ‘আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ! আলীকে যে ভালোবাসে তুমিও তাকে ভালোবাস। আলীকে যে ঘৃণা করে তুমিও তাকে ঘৃণা কর।’ (সহীহ মুসলিম শরীফ, মুসনাদে ইমাম আহমাদ)
উপরিউক্ত উদ্ধৃতিসমূহ হযরত আলী (আ.) সম্পর্কিত সামান্য কিছু উদ্ধৃতি মাত্র। এই সকল উদ্ধৃতি যে সকল গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে তা সবই প্রামাণ্য গ্রন্থ।